বাইচ্যা আছি

মানুষ বড় হয়ে কত কিছু হইতে চায়। কেউ ডাক্তার, কেউ ইঞ্জিনিয়ার, নবীন গবেষক, আবার কেউ ছাত্রলীগের নেতা। আমি যত বড় হইতে লাগলাম খালি মনে হতে লাগলো আমার কিছুই হওয়ার দরকার নাই। ২৪/৭ মনের মত আলসেমি করে দিন পার করে দিতে পারলেই আমি খুশী। সে লক্ষ্যে বেশ ভালোমতই এগিয়ে যাচ্ছিলাম। বিএসসি সার্টিফিকেট বালিশের তলায় রেখে রাতের বেলায় ঘুমাতাম আর সকাল সাড়ে বারোটায় ঘুম থেকে উঠে হাই তুলতে তুলতে ভাবতাম – আহা, জীবন কত সুন্দর! মানুষ হয়ে জন্মানোর অন্যতম বড় অভিশাপ হইতেসে এই প্রজাতির কপালে বেশিদিন সুখ সয়না। কপাল খারাপ, চেহারা দেখে মাঝে মাঝে অন্যপ্রজাতির মনে হইলেও আমিও আসলে মানুষ হয়েই জন্মাইসিলাম। ওয়ান ফাইন মর্ণিং আমার সকল অলসতা জলাঞ্জলি দিয়ে লাবলু ভাইয়ের পিছু পিছু অফিস যাওয়া শুরু করলাম। তারপর একদিন না, দুই দিন না, তিন তিনটা মাস এবিসির ডেস্কে বইসা কম্প্যুটার চালাইলাম। ভাবলাম কী, আর হইলোডা কী। হায় সুখ, সোনালী ডানার সুখ!

এই দিকে বাসায় বাপ মা টেনশন করে। ছেলে কিছু করেনা ক্যান, পড়াশুনা করতে চায়না ক্যান, চাকরি করতে চায় না ক্যান, খালি ক্যান আর ক্যান। এত ক্যান ক্যান সহ্য করতে না পাইরা রাজি হইলাম যে এমবিএ করমু। ঢাকা ভার্সিটির ফর্ম তুইলা পরীক্ষা দিলাম। ভাবসিলাম পামুনা, অবশ্য পামুই বা ক্যান। না পইড়া কে কবে পাশ করসে। কিন্তু হয়ে গেল। আমি পড়লাম চিপায়। তারপর আবার বুঝাইলাম সামনে আইবিএ পরীক্ষা, এইটা এমবিএর বড় বাপ। এইটা বাদ্দিয়া ঐটায় দেই। বাপ মা প্রথম প্রথম গাইগুই করে পরে রাজি হয়ে গেল। আমি আরো কয়েকমাস আলসেমি করার লাইসেন্স পাইলাম। এদিকে নবীন গবেষক রায়হান আবীরের ডিপার্টমেন্টে এমফিল এর জন্য এপ্লাই করলাম। এমবিএর চে নিজের পছন্দের কিছু নিয়ে থাকা ভালো সেইটা ভেবে দেয়া। আর বিদেশ টিদেশ থাকা আমারে দিয়া হবেনা সেটা বহু আগেই বোঝা হয়ে গেসে। তবে এপ্লাইয়ের পরেই বুঝলাম এইখানেও আশা নাই। দশ জন নেয়ার কথা, আমি এগারো নাম্বারে এপ্লাই করসি। তাই এইটার আশা বাদ্দিয়া ভাবতে লাগলাম এখন কী করা যায়। ভাবতে ভাবতে দেখি আইবিএ এক্সামের ফর্ম তোলার ডেট কবে চলে গেসে টেরও পাইনাই। 😕 বাসায় এইটা বললে মাইরা ফেলবে। তাই কিছু বললাম না। বাসায় বললাম ঠিকাছে, সামনে পরীক্ষা, দোয়া কইরো। যথাসময়ে পরীক্ষা দিলাম এবং বাসায় জানাইলাম দুর্ভাগ্যক্রমে তাদের পুত্র চান্স পায়নাই। বাপ মা মন খারাপ করলো, আমিও করলাম। এমন সময় জানলাম এমফিলে আশা এখনো আছে, হয়ে যাইতে পারে। চাকরি এড়ানোর সুযোগ আবার চোখের সামনে দেখতে পেয়ে মনে বল ফিরে পাইলাম। আমার লাক বরাবরই খারাপ। তাই খুব বেশি আশা করে রইলাম তাও না। বাসাতেও আগে থেকে কিছু জানাইলাম না। বাপ মা রে বার বার ছ্যাঁকা দিতে কারই বা ভালো লাগে। শেষ মেষ স্যার নিশ্চিত করলো যে নেক্সট তিনবছর চাকরি বাকরি নিয়া টেনশন করতে হবেনা। আমি হাপ ছেড়ে বাচলাম।

তাই এখন আমি সকাল বেলা উঠে রুটি খাই। তারপর চৈতালি বাসে দুলতে দুলতে কার্জন হলের গেটের সামনে পৌঁছে নেমে পড়ি। চারপাশটা বড়ই মনোরম। ছেলে পিলেরা প্রেম করে, মাঝে মাঝে জীবনে বৈচিত্র্য আনতে পড়াশুনা করে। দেখে ভালো লাগে। ছোটবেলায় খুব শখ ছিলো ঢাকা ভার্সিটিতে পড়বো। কিন্তু কখনো ভাবিনি পূরণ হবে। হয়ে গেল ক্যামনে ক্যামনে জানি। তাই আপাতত খুশি।

——————————————————————————-

পহেলা বৈশাখে মানুষ কত কী করে। বাইরে বেরোয়, পাঞ্জাবী পড়ে মাঞ্জা মেরে ঘুর্তে বেড়োয়, পান্তা খায় , সাথে একটা মরিচ চিবায়। আর আমার কাছে পহেলা বৈশাখ মানে সারাদিন বাসায় একটু আরামে থাকা যাবে, আজকে আর কারেন্ট যাবেনা। কিন্তু এইবার সকাল সাড়ে দশটায় কারেন্ট গেলোগা। মেজাজ গেলো খারাপ হয়ে। তখনই উদয় এসে জানালো নিচে খাবার রেডি। লাবলু ভাই যেতে বলসে। উদয় লাবলু ভাইয়ের একমাত্র ছোট ছেলে 😀 । রেডি হয়ে জামানরে ডাকি। সে উঠেনা। দশ মিনিট ধাক্কাধাক্কি করে তার চোখ খুলাইলাম। সেই খোলা চোখ চার সেকেন্ড পড়েই আবার বন্ধ হয়ে গেল। বুঝলাম হবেনা। তাই সাফওয়ান আর আমি মিলেই রওনা দিলাম দুই তলার উদ্দেশ্যে। খাওয়ার টেবিলে বসে চোখ কপালে উঠলো। গুনে গুনে দেখলাম আট পদের ভর্তা। সাথে পান্তা ইলিশ ভাজি। আর খিচুড়ি গরু। দেখেই অর্ধেক পেট ভরে গেল। বাকি অর্ধেক ভরাতে খাওয়া শুরু করলাম। যারা আমাকে চিনে তারা খুব ভালো মতই জানে আমি কত বড় ভোজন রসিক। কিন্তু আমিও ক্যামনে ক্যামনে জানি বহু খেয়ে ফেললাম। আর খেয়ে টেয়ে মনে হল কী অছাম একখান বাঙালি খানা খাইলাম বহুদিন পর। খাওয়া শেষে ঢেকুর তুলতে তুলতে আবার চারতলা অভিমুখে রওনা দিলাম। রুমে ঢুকে দেখি জামান বিরস মুখে ফেসবুকিং করে। বেচারা। জানলোও না তার পেটে কী জিনিস ঢুকলোনা।
———————————————————————————————–

ইদানিং আবার নতুন কাহিনি যোগ হইসে। ইস্টার্ন হাউজিং এর অনেক প্লট এখনো খালিই রয়ে গেছে। এলাকার পোলাপান সেগুলারে মাঠা বানায়া সকাল বেলা ক্রিকেট খেলে তো বিকেল বেলায় ফুটবল। এতদিন খালি তাদের খেলা দেখতাম, আর মনে হইতো বড় হয়া গেলাম নাকি। খেলাধূলা যে একেবারেই বাদ গেল। তবে গত কয়েক সপ্তাহ ধরে আমরা ক্রিকেট খেলা শুরু করসি উইকেন্ড এ। কত বছর ক্রিকেট ব্যাট ধরিনা গুনতে গেলে আঙুল ব্যাথা হয়ে যাবে। তাই গোণাগুণি বাদ্দিয়া ক্রিকেট খেলি দুপুরের রোদরে বুড়া আঙুল দেখায়া। খারাপ লাগেনা। হঠাৎ করে মনে হয় এখনো বড় হয়ে যাইনাই। আমাদের পোলাপান খেলতে আসে দেখে বেশ আড্ডা আর খানাপিনাও হয়ে যায় খেলাধুলা শেষে। ভালোই লাগে।

সব মিলায়া দিনকাল ভালোই। মহাসুখে না হইলেও, আপাতত সুখেই আছি। তবে একটু টেনশনেও আছি। মানুষ প্রজাতি বড়ই দুর্ভাগা । তাদের কপালে নাকি বেশিদিন সুখ সয়না।

৪,৮৯৭ বার দেখা হয়েছে

৭৩ টি মন্তব্য : “বাইচ্যা আছি”

  1. তাইফুর (৯২-৯৮)

    দিনকাল যেহেতু ভালই যাইতেছে ...
    বিয়া কইরা ফ্যাল ...

    (তুই কি লাবলু ভাইয়ের নীচতলায় থাকস নিকি ?? লাবলু ভাইরে ইট্টু দেইখা রাখিস ... :khekz: )


    পথ ভাবে 'আমি দেব', রথ ভাবে 'আমি',
    মূর্তি ভাবে 'আমি দেব', হাসে অন্তর্যামী॥

    জবাব দিন
  2. সামিয়া (৯৯-০৫)

    :)) :))
    কত্তদিন কত্তদিন পর তোমার এই ধরণের লেখা পড়লাম...হাসতেই আছি, রুমমেট রাগী রাগী চোখে তাকায় আছে, অবশ্য ওর রাগী রাগী চোখে তাকানোর জন্য কোন কারণ লাগেনা...
    তবে মজার ব্যাপার হলো তোমার ভাষায় মনে হয় কিঞ্চিৎ পরিবর্তন আসছে...
    সবকিছু লিখলা...খালি সুইডেন প্রবাসী...উনার কথা লিখলা না?? :-B

    জবাব দিন
  3. রাব্বী (৯২-৯৮)

    ঠিকাসে। পর সমাচার এই যে খবরাখবর জাইনা খুশি হইলাম। কিন্তু দুবার চোখ কচলাইয়াও কেনজানি এইডা যে সিসিবি সেইটা নিয়া এক্টা সন্দো বাড়তেছে মনে। 😕

    চৈতালি বাসটারে নিয়া আমাদের সময়ের দুষ্টু পুলাপান ঠোট টিপা হাসাহাসি করতো। 😛


    আমার বন্ধুয়া বিহনে

    জবাব দিন
  4. আহসান আকাশ (৯৬-০২)

    আহা কতদিন পর একটা ব্লগর ব্লগর পড়লাম... সুখে বাইচ্যা আছ শুনে ভাল লাগল :thumbup:


    আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
    আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷

    জবাব দিন
  5. আন্দালিব (৯৬-০২)

    তোমার তো দেখি নির্বাচনে জেতা নেতার মতো সুসময়। সাম্নের কয়েক বছর ফুরফুর করে উড়ে বেড়াবা! 😀

    বাঁইচ্যা থাকা খুব মজাদার ব্যাপার। এইটা যে না টেস্ট করছে, সে বুঝবে না। তুমি টেস্ট করতেছো - বুঝতে পারবা কি বলতেছি। 😉

    জবাব দিন
  6. আমিন (১৯৯৬-২০০২)
    আমার কিছুই হওয়ার দরকার নাই। ২৪/৭ মনের মত আলসেমি করে দিন পার করে দিতে পারলেই আমি খুশী।

    এইটাই সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ। আমি বরাবরই "কিছুই না" ব্যাধিতে আক্রান্ত। সেটার মাত্রা এতৈ বেশি যে ইদানিং আমার কিছুই করতে ইচ্ছা করে না। আমারে কেউ জিগাইলে আমার প্ল্যান কী আমি কই কিছুই না... বউ বিদেশে কেমন লাগতেছে জিগাইলে কই কিছুই লাগে না.... পড়ালেখা কেমন চলে এর উত্তর ও কিছুই না.... কি করতে মন চায় তার উত্তরও কিছুই না.... এর লাইগাইয়া আসলে সিসিবিতে ঢুকেও কিছুই লিখি না ... কারণ লিখার কিছুই খুঁজে পাই না।

    জবাব দিন
  7. জুনায়েদ কবীর (৯৫-০১)
    জানি না বলে যা লোকে, সত্যি কি না-
    কপালে সবার নাকি সুখ সয় না...

    লোকের কথার মুখে ছাই-লাভা দিয়ে লাইফ সাপোর্ট ছাড়াই বেঁচে থাক...অনেক অনেক দিন... :thumbup:


    ঐ দেখা যায় তালগাছ, তালগাছটি কিন্তু আমার...হুঁ

    জবাব দিন
  8. কামরুলতপু (৯৬-০২)

    এই লেখাটা তোমার সাথে গেল না। মনে হয় সুখের আলাপ করেছ দেখে কিংবা বেঁচে আছি টাইপের হতাশা নাম দিয়ে সুখের গীত গাওয়ার জন্য। তুমি একটা ছড়া লেখ কিংবা একটা মেঘপিয়নের চিঠির মত বুকে মোচড় দেওয়া লেখা।

    জবাব দিন
  9. Saiaf bin rayhan

    অস্থির !!!!!! ভাই আপনের মত সুখী লোকদের জন্যই আজ আমার মত দুখী পোলাপাইন দুনিয়া এর অন্য প্রান্তে কষ্টে দিন যাপন করতেসে....this is called natural equilibrium...আপনের সুখ দেখে হিংসা হচ্ছে...........................


    Сайф

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : সামিয়া (৯৯-০৫)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।