ভালো আছি, ভালো থেকো

আমার রুম থেকে বেরিয়ে করিডোরে দাঁড়িয়ে চোখ দুটো সোজা করে তাকালে সারি বাঁধা ইউক্যালিপ্টাসগুলো চোখে পড়ে সবার আগে। ওরা এমনিতে খুব চুপচাপ। শুধু হঠাৎ হঠাৎ যখন বাতাস এসে চুরি করে গায়ে এসে আছড়ে পড়ে তখন আনন্দে ওরা মাথা নাড়ে ঝিরঝিরে পাতাগুলো নাড়িয়ে । আমার এমনিতেই সচরাচর কোন কাজ কাম থাকেনা। যখন কিছুই করার থাকেনা তখন চুপচাপ করিডোরে ইউক্যালিপটাসগুলোকে সামনে রেখে দাঁড়িয়ে থাকতাম। থাকতাম বলাই ভালো। কারণ দাঁড়িয়ে থাকার সময় হাতে আর খুব বেশি নেই। নোটিশ এসেছে দশ তারিখের পর ওখানে আর চাইলেই দাঁড়িয়ে থাকা যাবেনা।

আই ইউ টি লাইফের এই শেষ বেলায় এসে খেয়াল করে দেখলাম ইদানিং ইউক্যালিপটাস গুলোর মত গায়ে গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকি আমরা। মানে আমাদের বন্ধুরা। চার বছরের দিকে সময় পেলেই পিছন ফিরে তাকাই আর নির্দিষ্ট কোন স্মৃতি মনে করে একসাথে আনন্দে মাথা নাড়াই। কখনো পেট চেপে গড়াগড়ি খাই। আবার কখনো কখনো ইউক্যালিপটাসগুলো সচরাচর যেমন থাকে, সেরকম হুট করে চুপ হয়ে যাই।

এই সব মিলিয়েই কাটছে শেষ দিন গুলো।
…………………………………………………………

পরীক্ষা শেষ হয়েছে বেশ কয়েকদিন আগেই। শুধু শেষ হচ্ছিলনা টেনশনগুলো। সব পরীক্ষা ঠিক ঠাক উৎরে গেলেও একবারে শেষ পরীক্ষায় এসে প্যান্ট ভিজে যাওয়ার দশা। তারপর মাথার ভেতর খালি টেনশন পোকার গুনগুনানি। পাস না ফেল। ফেল নাকি পাস। ঐদিকে পন্ডিতি করে শেষ পরীক্ষার আগেই বাসায় জানিয়ে দিয়েছি তোমরা সমাবর্তনের দিন না আসলে কিন্তু খেলবোনা! সবাইকে খেলার আমন্ত্রণ জানিয়ে নিজেই এরপর খেলা থেকে লাল কার্ড পাওয়ার দশা! তারপর আমাকে অবাক করে দিয়ে শ্রদ্ধেয় মাস্টার মশায় কোন রকম গিয়াঞ্জাম না করে রেজাল্টের দিন জানিয়ে দিলেন তুমি এ যাত্রায় বেঁচে গেছো। যাও এইবার নিউমার্কেট গিয়ে সমাবর্তনের জন্য জুতো মোজা কিনে নিয়ে আসো।

আমি খুশি মনে তাই টাকা নিয়ে ঢাকা গেলাম। ১৮.৫” এল সি ডি মনিটর কিনলাম (এইটা কিন্তু সমাবর্তনের জন্য না)। আমার ভাগ্নির আর কয়দিন পরেই জন্মদিন। তাই ওর জন্য সাইকেল কিনলাম। নিজের জন্য জুতো কিনলাম, কিন্তু মোজা কিনতে ভুলে গেলাম। তারপর ভাবলাম এমনেই অনেক টাকা চলে গেছে। তাই পুরান শার্ট দিয়ে এ যাত্রা চালিয়ে দেবার ধান্দা করে শুধু প্যান্ট বানাতে দিলাম। টাইটাও কেনা হলো ক্যামনে ক্যামনে।

সব কেনাকাটা শেষ করে রুমে এসে দেখি পকেটে খালি পকেটটাই আছে। সকাল বেলায় যেখানে আঠারো হাজার টাকা ছিল হাওয়াই মিঠাইয়ের মত তা’ মিলিয়ে গিয়ে পাঁচশো সামথিং এ এসে চুপসে গেছে।

মন খ্রাপ করে ভাবতে লাগলাম এর চে বোধহয় পাশ না করাই ভালো ছিলো।

……………………………………..

চার বছরে তেমন কিছু না করতে করতেও ক্যামন করে যেন অনেক কিছুই জমে গেছে সামনের বাকি সময়গুলোতে মনে রাখার জন্য। সেসবই আজকাল ভবিষ্যতের জন্য একটু একটু করে গুছিয়ে নিচ্ছি। আই ইউ টি তে না আসলে হয়তো এমন করে ব্লগিং করা হতো না কোনদিনই। কিংবা সিসিবির জন্ম হলেও তার সাথে আমার কোন সম্পৃক্ততা থাকতো না। আমি হয়তো আগের মত সহজেই হেরে যাওয়া একটা মানুষ হিসেবেই নিজেকে ভাবতাম সবসময়। আই ইউ টি লাইফের চার বছরের ঝঞ্ঝাটহীন লাইফের ভিতরেও একেক সময় একেক দিক থেকে প্রতিকূলতা এসে কাঁপিয়ে দিতে চেয়েছে। আমি শেষ মেষ ভাঙতে ভাঙতেও ভেঙে যাইনি। রেজাল্টের বিচারে এই চারবছরে আমার প্রাপ্তি সামান্যই। কিন্তু পাশাপাশি এমন কিছু অর্জন করেছি সেগুলোর দিকে তাকিয়ে বাকি সব অপ্রাপ্তিকে হাসি মুখে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে দেয়া যায়।

চার বছরের শেষ মাথায় দাঁড়িয়ে থেকে আমি এখন একটা কথা নিশ্চিতভাবেই জানি – আমি চাইলে যে কোন কিছুই করতে পারি। যদি কোন কারণে নাও পারি তবু এটুকু ভেবেই খুশি হতে জানি যে আমি আমার সর্বোচ্চ চেষ্টাটাই করেছিলাম।

আমার মাঝে এখনো অনেক অনেক সীমাবদ্ধতা। অনেক চিন্তাভাবনার এখনো ব্যাপক রকমের পরিবর্তন দরকার। একটা সময় পর্যন্ত আমার ধারণা ছিল আমি খুব অ-দরকারী একটা মানুষ। যাকে দিয়ে কোন কিছুই কখনো ঠিকভাবে হয়না। সেই অ-দরকারী মানুষটাই কেমন কেমন করে যেন আর কয়েকজন বন্ধুর সাথে মিলেমিশে সিসিবি বানিয়ে ফেললো। তারপর সেটাকে ভালোবাসা দিয়ে গড়ে পিঠে মানুষ করলো সিসিবির এখনকার বাকি সবাই মিলে।

সিসিবির গড়ে ওঠা তাই সেই “অ-দরকারী” মানুষটার জীবনে অনেক বড় একটা অনুপ্রেরণা।

আই ইউ টি লাইফের শেষ বেলায় এসে বলি , আপনারা সবাই আমার কৃতজ্ঞতা গ্রহণ করুন। আপনাদের ভালোবাসা না পেলে নিজের ভেতর গুটিয়ে থাকা একটা মানুষের হয়তো কোনদিনই জানা হতোনা – এ পৃথিবীতে কেউই অ-দরকারী নয়।

২,৩৮৩ বার দেখা হয়েছে

৩৬ টি মন্তব্য : “ভালো আছি, ভালো থেকো”

  1. কাইয়ূম (১৯৯২-১৯৯৮)

    এ পৃথিবীতে কেউই অ-দরকারী নয়। খুবই সত্যি কথা।
    আবার অনেকেই দরকারী নয় 🙁 ওর্থলেস , এইটাও সত্যি কথা মনে হয়।
    আশা করি সব সময় প্রথম দলেই থাকবি। :thumbup: :thumbup:


    সংসারে প্রবল বৈরাগ্য!

    জবাব দিন
  2. রকিব (০১-০৭)

    আর হবে না ইউক্যালিপটাসের পানে চেয়ে স্বপ্ন দেখা; অবশ্য সামনের জীবনটা যেমন প্রখর তেমনি নাকি বিস্তৃত। ভবিষ্যত জীবনের জন্য শুভকামনা রইলো।


    আমি তবু বলি:
    এখনো যে কটা দিন বেঁচে আছি সূর্যে সূর্যে চলি ..

    জবাব দিন
  3. ফয়েজ (৮৭-৯৩)

    দূর স্টুডেন্ট লাইফ একটা লাইফ হইলো নাকি, ওটা তো দুধ-ভাত।

    খাও-পড়-াগু কর, াগু কর-খাও-পড়, এইছাড়া আর ইম্পর্টেন্ট কোন কাজ নাই। :thumbdown:


    পালটে দেবার স্বপ্ন আমার এখনও গেল না

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : আমিন (১৯৯৬-২০০২)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।