বিরিসিরিতে ঘোরাঘুরি, একটু স্মৃতির খোঁড়াখুঁড়ি…

ক্রিং ক্রিং ক্রিং। ফোন বেজেই চলেছে। এক বার দুই বার তিন বার। শালার আমি আর হ্যালো বলার চান্স পাইনা। সবাই যদি আমার মত এত সময় পর্যন্ত ঘুমায় তাইলে তো দেশের ভবিষ্যত অন্ধকার।
দেশের কথা পরে। আমাদের এই ঝটিকা মিশন কি তাইলে শুরুর আগেই শেষ হয়ে যাবে? আমি মহিব আর মুহাম্মদের দিকে মেজাজ খারাপ করে তাকাই।
কিন্তু না। কিছুক্ষণ পর ওপাশ থেকে কল ব্যাক।
– হ্যালো।
– হ্যা, বল।
– যাবি নাকি? মুহাম্মদ, মহিব রাজি। খালি তুই হইলেই হয়।
-ঠিকাছে?
_ ঠিকাছে।
– আচ্ছা। তাইলে দুইটায় মহাখালী দেখা হইতেসে।
আমি বাই বলে ফোন রেখে দেই। পজিটিভ সিগন্যাল দিতেই মহিব রেডি হওয়া শুরু করলো। কিন্তু ঐদিকে মুহাম্মদ তার টিপিক্যাল মুখটারে প্যাঁচার মত করে হঠাত বলে বসলো সে যাবেনা। ওর কথা শোনার তখন টাইম নাই। আমরা দুইজন পাঁচ মিনিটে রেডি হয়ে মুহাম্মদরে এক মিনিটের আল্টিমেটাম দিলাম। মুখটারে এইবার হাওলার মাংকির মত করে মুহাম্মদ রেডি হওয়া শুরু করলো।

ও আচ্ছা, ভাল কথা আমরা বিরিসিরি যাচ্ছি। যাবেন নাকি? তাইলে তাড়াতাড়ি রেডি হন। ঘড়িতে এখন এগারোটা বেজে আরো কয়েক মিনিট। পৌণে একটার দিকে বেরিয়ে পড়বো কিন্তু। কারণ এর পরের সময়ে বোর্ডবাজার টু মহাখালী লাইনে পচুর গিয়ান্জাম থাকে।

……………………………….

দেখতে দেখতে দুইটা বাজার কিছু আগেই মহাখালী টার্মিনালে পৌছে গেলাম। কি তাজ্জব ব্যাপার! অবশেষে টার্মিনালের এপাশ ওপাশ ঘেটে বিরিসিরির কাউন্টার খুঁজে পাওয়া গেল। কিন্তু দুইটার সময় যার এখানে এসে থাকার কথা তাকে আর খুঁজে পাওয়া যায়না। আবার ফোন দিলে বলছে ব্যাটা নাকি আমাদের আগেই এসে বসে আছে। তাইলে গেল কই। মুহাম্মদ কিছুক্ষণ পর পর চিপায় গিয়ে গুজুর গুজুর ফুসুর ফুসুর করে এসে বলে ও এই এসে পড়লো বলে। এইভাবে দশমিনিটের মত যাবার পর আমার ক্যান জানি মনে হইতে লাগলো মুহাম্মদ ওর সদ্য নতুন হওয়া গার্লফ্রেন্ডের সাথে কথা বলে এসে সেটাকে চতুর্থ জনকে খোঁজাখুঁজির নামে চালিয়ে দিচ্ছে। কাজেই এইবার নিজেরাই ফিল্ডে নামলাম। আমি একদিকে। মহিব, মুহাম্মদ তার উল্টাদিকে গিয়ে খোঁজা শুরু করলো। চারপাশে এত এত মানুষের ভীড়। এর মাঝেও হঠাৎ করে টার্মিনালের একেবারে দক্ষিণ মাথায় দাঁড়িয়ে একেবারে উত্তর প্রান্তে চেনা মুখের আভাস পেলাম। রায়হান আবীর তার সদ্য গজানো ভুড়ি খানা দুলিয়ে হেলেদুলে এদিকেই আসছে। আমি মেজাজ খারাপ করতে গিয়েও করলাম না। যাত্রা শুরুর আগে নাকি এসব করতে হয়না। শাস্ত্রে মানা আছে।

এইবার বিরিসিরি কাউন্টারে গিয়ে আরেক কাহিনী। কাউন্টার আছে কিন্তু ভিতরে কেউ নাই। কিছুক্ষণ হুদাই অপেক্ষা করার পর একজন দয়ালু লোক এসে জানালো বিরিসিরির বাস আজকে নাকি আর যাবেনা। তারচে আমরা ময়মনসিংহ গিয়ে ওখান থেকে লোকাল বাসে গেলে নাকি ভাল করবো। লোকটার এরকম অযাচিত উপকারী উপদেশ পেয়ে বড়ই খুশি হই। দেশ থেকে তাইলে এখনো ভাল মানুষ সব উঠে যায়নাই। কিছুক্ষণ পরেই অবশ্য জানা গেল লোকটা ময়মনসিংহগামী একটা কাউন্টার বাসের কন্ডাকটর। কি আর করার। তাই সই। তবে প্ল্যানে একটু চেন্জ আনা হলো। আজকের রাতটা ময়মনসিংহে মুহাম্মদের বাসায় থেকে কাল বিরিসিরি যাওয়া হবে।
এদিকে পকেটে টাকা পয়সার টানাটানি। একেবারেই হুট করে চলে আসা হয়েছে। মহিব পাশ থেকে আল্লাদী স্বরে বলে উঠলো- আমরা কিন্ডু সবচে ভাল বাসটাতে যাবো। শখের তোলা আশি টাকা। আমরা সেটাকে নব্বই টাকা বানিয়ে বাসে উঠে পড়ি। টাকা পয়সার চিন্তা বাসে উঠে না হয় একটু সময় করে ভাবা যাবে।

আমি দুনিয়াতে দুইটা জিনিস খুব ভাল পারি। তারমধ্যে দ্বিতীয়টা হল বাসে ওঠার দুই মিনিটের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়া (নাক ডাকা ছাড়া)। সেরকম একটা ঘুম শেষে যখন চোখ খুললাম দেখি ময়মনসিংহ এসে গেছি। সোয়া ছয়টার মত বাজে। রিকশা নিয়ে মুহাম্মদের বাসার দিকে রওনা হলাম। মাঝপথে দুই ব্যাটসম্যানের (ব্যাটসম্যানের বদলে পড়ুন- রিকশাওয়ালা) মধ্যে কিন্চিৎ ভুল বোঝাবুঝি। ফলাফল: আমি আর মুহাম্মদ এক পাড়ায়। রায়হান আর মহিব ভুলে অন্য পাড়ায়। মোবাইলে কিছুক্ষণ খোঁচাখুঁচি করে শেষমেষ আবার একসাথে হলাম। মুহাম্মদের বাসায় কিছুক্ষণ থেকে, ব্যাগগুলো রেখে এবার নদীর তীরে যাবার জন্য বের হলাম। ওর বাসা থেকে ব্রম্মপুত্র দুই মিনিটের পথ। বেরোবার আগে মুহাম্মদের ছোট ভাই ফাহিম চোখ মুখ বড় করে আমাদের ভয় দেখানোর চেষ্টা করলো। রাতে নাকি তিনজন একসাথে বাইরে বেরোলে থাকলে RAB এসে ধরে। ভাল কথা। তাইলে তো আমাদের ভয় পাওয়ার কিছু নাই। কারণ আমরা তিনজন না, চারজন।

ময়মনসিংহ শহরটা আমার বরাবরই প্রিয় একটা শহর। যদিও খুব কমই এখানে আসা হয়েছে। শহরের কোমর জড়িয়ে বয়ে চলা ব্রম্মপুত্র নদটাই এই শহরের প্রতি আমার ভাল লাগার সিংহভাগ চুরি করে নিয়েছে। হিমহিমে কুয়াশা জড়ানো সন্ধ্যাবেলায় আমার চারজন চুপচাপ নদীতীরে গিয়ে বসে পড়ি। মাঝে মাঝে টুকটাক কথা বার্তা চলে। আর বেরসিক ইন্জিনের নৌকার হঠাৎ হঠাৎ সশব্দ উপস্থিতি। তাছাড়া আর সব কিছু শুনশান। নদীর ছলাৎ ছলাৎ ঢেউয়ের দোলায় একটু একটু করে দুনিয়ার সব গিয়ান্জাম আস্তে আস্তে দুরে সরে যায়। পাড়ে কেবল আমরা চারজন রয়ে যাই। আর টুকটাক গল্প করি। আহা! পুরো জীবনটা এমন মধুর হয়না কেন।

পরদিন খুব ভোরে উঠে পড়ি। কতদিন পর এত সকালে উঠলাম মনে করতে পারিনা। অল্প কিছু খেয়েদেয়ে বাসস্ট্যান্ডের দিকে রিকশায় চড়ে দৌড়। মেডিকেল কলেজ থেকে মোরশেদও চলে আসে একসময়। মোরশেদ আমার কলেজ লাইফে ছয় বছর রুমমেট ছিল। কাল রাতেই ওদের হোস্টেলে গিয়েছিলাম। তখনই ঠিক হয়েছিল আজকের দিনের আইটেম, ক্লাশ এর গুল্লি মেরে ওও আমাদের সাথে যাচ্ছে। আমরা পাঁচজন বাসে উঠে পড়ি চটপট। মুড়ির টিন একসময় ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে রওনা হয়। আমরা মুড়ির মত সীটের এমাথা থেকে ওমাথা ঝাঁকতে থাকি। যাত্রা ঠিক মত শুরু হবার আগেই দশ মিনিটের মাথায় ড্রাইভার সাব যাত্রাবিরতি দিয়ে হুট করে বাস থামিয়ে কই যেন নেমে চলে গেল। আরো দশ মিনিট পর আবারও একই কাহিনী। এ তো দেখি বাঁশের চে কন্চি বড়। সামনে আরো কতবার এরকম বিরতি আছে ভাবতে ভাবতে আমি ঘুমিয়ে পড়ি। একসময় ঘুম থেকে উঠে দেখি সামনের একটা ব্রীজ ভেংগে গেছে। বাস আর যাবেনা। কিছুক্ষণ আফসোস করি। ইশ! আমি না ঘুমাইলে বোধহয় এইযাত্রায় ব্রীজটা ভাঙতো না!

বাস থেকে নেমে পাঁচজনে মিলে হাঁটা দিলাম। ধুলা খাইতে খাইতে হাটতেসি তো হাটতেই আসি। কিন্তু কোন টেম্পো বা রিকশার খোঁজ নাই। একসময় জারিয়া বাজারও পার হয়ে গেলাম। উপরওয়ালা এইবার দয়া করলেন। পিছন থেকে ভটভট করতে একটা বিশালদেহী একটা ট্রাক্টর হঠাৎ কোথ্থুকে যেন উদয় হল। ড্রাইভার সাবের চেহারা দেখে আমাদের মনে হলো স্বয়ং মাদার তেরেসার ছোট ভাই আমাদের ত্রাতা হিসেবে উদয় হয়েছে। সে কাঁধ ঝাকিয়ে একটু ইশারা করতেই আমরা হুড়মুড় করে ট্রাক্টরের পিছে উঠে পড়লাম। শুরু হলো আমাদের ট্রাক্টর ভ্রমণ । একেবারে হাওয়ার বেগে উইড়া উইড়া যাওয়া যাকে বলে। ড্রাইভার সাব অন্যান্য দিনের মত বালির বস্তা নিয়ে যাচ্ছেন ভেবেই চালাইতেসিলেন কীনা কে জানে। ঝাকির চোটে পেটের সব কিছু গলায় এসে লটকে থাকলো। মহিব দেখি সইতে না পেরে রেলিংএর উপর বসা বাদ দিয়ে নিচেই বসে পড়েছে। বাকি সবার অবস্থাও আশংকাজনক। আমরা নিজেদের ভবিষ্যত নিয়ে এতই বেশি শংকিত ছিলাম যে কখন বিরিসিরি ছেড়ে দুর্গাপুরে এসে পড়েছি টেরই পাইনি। পরে অবশ্য ব্যাপারটা শাপে বরই হোল।

সিদ্ধান্ত হল এদিকে যখন এসেই পড়েছি তো একবারে পাহাড় দেখে যাই। বিজয়পুর নাকি এদিক দিয়েই যেতে হয়।আর ওখান থেকে পাহাড় দেখা যায় খুব ভালভাবে। রিকশা নিয়ে যখন নদীর ঘাটে নামলাম একপলক চারদিকে চোখ বুলিয়েই মনটা ভাল হয়ে গেল। নদীটা এত্ত কিউট! কাছাকাছি গিয়ে একটু টাশকিও খাইলাম। নদীর পানি দেখি একেবারেই কম। এই কাঠ ফাঁটা দুপুর বেলায় আমার রবি ঠাকুরের কথা মনে পড়লো…আমাদের ছোট নদী চলে বাকে বাকে… , নদীটা যদিও প্রস্থে অতটা ছোট নয়। পাহাড়ি নদী বলেই বোধহয় নদীর পানি একদম স্বচ্ছ… চিক চিক করে বালি কোথা নাহি কাঁদা…. এই নদীর পানি বোতলে পুরে একটা মিনারেল ওয়াটারের স্টিকার লাগায়ে দিলে আসল নকল বোঝার কোন চান্সই নাই। নৌকা করে নদী পার হতে হতে চারপাশটা দেখতে লাগলাম। ক্লান্তিগুলো শান্তিতে কনভার্ট হওয়া শুরু করলো দেখতে না দেখতেই।

নদীর ওপারে পৌঁছে বিজয়পুর‍‍‍ যাবার উপায় খোঁজা শুরু হল। রিকশা না বাইক- কোনটায়‍‍ যাওয়া উচিত হবে। অবশ্য এইটা নিয়ে আমরা বেশি মাথা ঘামলাম না। রায়হান এর মত ম্যানেজার থাকতে শুধু শুধু এইসব ছোট ছোট ব্যাপারে পেইন নেবার কোন মানে হয়না। তো ম্যানেজার সাব বাছাই করে দেখলেন বাইকে যাওয়াই সবদিক থেকে ভাল। আমরাও জী আজ্ঞে বলে দুইটা বাইকে চড়ে রওনা হলাম। গন্তব্য বিজয়পুর। বিশ মিনিটের মত বাইক ভ্রমণের সারাটাক্ষণ সোমেশ্বরী নদীটা পাশে পাশে সংগ দিল। ইশ! আরেকটু পানি থাকলে হয়তো নৌকা করেই বিজয়পুর যাওয়া যেত।
বিজয়পুর যাবার পথে বেশ কিছু জিনিস দেখা হল। মিশনারীদের সেন্টার, একটা অদ্ভুত স্তম্ভ (জিনিসটা কি জন্যে বানানো হয়েছে সেটার সদুত্তর দিতে পারেনি কেউ), একটা আশ্রম আর পাহাড়ি বাংগালী জীবনের বিচিত্র সংমিশ্রণ। দেখতে দেখতে বিজয়পুর বিডিআর ক্যাম্পে পৌছে গেলাম। ক্যাম্পের পাশেই একটা ছোটখাট টিলার উপর আমাদের গাইড তুলে দিয়ে বললো- দেখেন। প্রথমে কিছুক্ষণ বুঝতেই পারলাম না কি দেখতে বলতেসে। কারণ টিলার উপর দাড়িয়ে শুধু অনেক দুরে ধোয়াশার মত বড় বড় পাহাড়ের অবয়ব দেখতে পাচ্ছিলাম। আর তার সামনে একটা নদী। ব্যাস। আর কিছুনা। নদীটা তো এতক্ষণ দেখতে দেখতেই আসলাম। সেটা দেখার জন্য দুইশ ট্যাকা খরচ করে নিশ্চয়ই এত দুরে আসিনাই। গাইড ভাইকে শেষমেষ জিগাইয়াই বসলাম – কি দেখতে বলেন?
– পাহাড় দেখেন। ঐ যে দুরে পাহাড় দেখতেসেন। ঐগুলা হইলো ইন্ডিয়া।
ধুর। আমার মনটাই খারাপ হয়ে গেল। মনে হয় অন্যদেরও। ইন্ডিয়ার পাহাড় দেখতে এতদুর আসছি নাকি।
-বাংলাদেশের পাহাড় কৈ?
জবাবে গাইড ডানদিকের কয়েকটা রোগা সোগা টিলার দিকে ইংগিত করলো। এইটা কোন ইনসাফ হলো – পাহাড়গুলো দেখতে দেখতে মনটা কেমন তিতে হয়ে গেল। এখন পর্য‍ন্ত যত বর্ডার এরিয়ায় ঘুরতে গেসি সবখানে একই কেস। সব বড় বড় পাহাড়গুলো ভারতের দিকে। আমাদের কিছু নাই। শুধু ওদেরগুলোর দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলতে হয়। আমি আনমনা হয়ে মেঘের দেশের কাছাকাছি বেড়ে ওঠা পাহাড়গুলোর দিকে তাকিয়ে থাকি। কিছুটা বিষণ্ন মনে। সারা শরীরে রহস্যময়তা জড়িয়ে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকা পাহাড়গুলো দেখতে দেখতে আমার ওদের চুড়ায় উঠতে ইচ্ছে করে খুব।

তো, ঐ টিলার মত জায়গাথেকে চারপাশের সবকিছু দেখা শেষ হতে বেশি সময় লাগেনা। আর কি করা যেতে পারে। পাশেই একটা নদীর ঘাট। কয়েকজন গোসলও করছিল। বৈচিত্রের ধান্দায় মহিব একটা প্রস্তাব দেয়
– দোস্ত চল। ন্যাংটা হয়ে গোসল করি। এতদুর আইসা যদি খালি ইন্ডিয়ার পাহাড় দেখে চলে যাইতে হয় তাইলে ক্যামনে কি।
আমি ভাবি আইডিয়াটা খারাপ না। করা যায়। কিন্তু মুহাম্মদের মত সুশীল মানুষ আমাদের সাথে ন্যাংটা হয়ে গোসল করতেসে ব্যাপারটা ঠিক কেমন কেমন জানি হয়ে যায়। কাজেই এই প্ল্যান বাদ। আমাদের না হয় মান ইজ্জত নিয়া সমস্যা নাই। কিন্তু তাই বলে মুহাম্মদ…. থাক
অগত্যা নদীর তীরে বসে বসে আমরা চার জন গ্যাজানি শুরু করলাম।

আসার সময় কে জানি বলসিল চীনা মাটির পাহাড়টাও দেখে আসবেন। আমাদের গাইড অবশ্য এটা নিয়ে কিছু বলে নাই। আমরাও ধরে নিয়েছিলাম সে জায়গাটা তেমন হাতি ঘোড়া টাইপের কিছুনা। কিন্তু এখানে সময় বেঁচে যাচ্ছে দেখে ভাবলাম ওখানেও যাওয়া উচিত। গাইডকে বলতেই মোটামুটি নির্বিকার মুখে আমাদের নিয়ে বাইকে আবার রওনা হল। চীনামাটির পাহাড় দেখে প্রথমেই ভাল লেগে গেল। এইটার কথা গাইড কেন বললোনা আগে ঠিক বুঝতে পারলাম না। আমরা ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলাম চারপাশ। সাথে সাথে কিছু ছবিও তোলা হতে লাগলো। রায়হাইন্যা দেখি আমাদের ছবি তুলতে বড়ই অনাগ্রহী। খালি ফুল পাখি আকাশ বাতাসের ছবি তুলতেসে একটার পর একটা।এইভাবে চলতে থাকলে দেখা যাবে আমাদের একটা ছবিও তোলা হয়নাই। কাজেই ওকে ঝাড়ি দিয়ে আমরা নিজেরা কিছু ছবি তুললাম পাহাড়ের ওপরে উঠে। নইলে কেউ যদি ছবি দেখে বলে তোরা তো এইগুলা নেট থেকে মেরে দিসিস বললেও কিছু করার নাই। একটা দেখা শেষে গাইড বললো ওদিকে আরো কিছু চীনামাটির পাহাড় আছে।

আমরা পরবর্তী চীনামাটির পাহাড়ের দিকে হাঁটা দিলাম। আমি আর মোরশেদ আগে আগে। মহিব আর মুহাম্মদ একটু পিছে। আর রায়হান দেখি তখনো মাটির ওপর গড়াগড়ি খাইতে খাইতে (সত্যিই গড়াগড়ি খাইতেসিল। বানায়ে বলিনাই) ফুল ফল লতা পাতার ছবি তুলেই যাচ্ছে। চীনামাটির পাহাড়ের সামনে উঁচুমত জায়গাটুকু পার হয়ে পাহাড়ের সামনে আসতেই সবার প্রথমে ব্যাপারটা দেখলাম আমি। দেখেই আর কোন কথা নাই। ছোটখাট সাইজের একটা চিল্লানি দিলাম। আর না দিয়ে উপায় আছে নাকি। চোখের সামনে হঠাৎ করে নীল রঙা পানির এমন অদ্ভুত সুন্দর একটা লেক পুরো দৃষ্টিসীমা জুড়ে দাঁড়িয়ে গেলে কে না অবাক হবে। বাকি সবাই আসলো। এবং আমার মতই অবাক হল। এরপর আমরা সেখানে অনেকক্ষণ থাকলাম। অনেক ছবিও তুললাম। লেকের পানি দেখে কেবলই মনে হচ্ছিল পুরো আকাশ বুঝি উপুড় হয়ে সেই জলে স্নান করতে নেমে ভুল করে আর উঠে যায়নি। আমি হঠাত করে একসময় খেয়াল করলাম মেঘালয়ের পাহাড়গুলো দেখতে দেখতে মনের মধ্যে যে বিষণ্ণতাগুলো না বলে কয়ে ঘণিয়ে উঠেছিল আস্তে আস্তে সেগুলো কোথায় যেন মিলিয়ে গেছে। কে বলে আমাদের কিছু নেইঁ?

অনেক তো হল। এবার ফেরার পালা। সবার মানিব্যাগই অলরেডী চিমসে গেছে। হুট করে আসা হয়েছে বলে টাকা পয়সাও বেশি নেই সাথে। সোমেশ্বরী নদী পার হয়ে যখন আবার এপারে আসলাম ঘড়িতে তখন সাড়ে তিনটার মত বাজে। ওদিকে ঢাকার বাস চারটার পরে আর এখান থেকে ছাড়েনা।বিরিসিরি বাসস্ট্যান্ডে যাবার জন্য রিকশা খুঁজতে গিয়ে কষ্টেসৃষ্টে একটা পাওয়া গেল। মুহাম্মদ আর মহিব ওটায় চড়ে চলে গেল। রইলাম আমরা তিনজন। রিকশার আশায় ওদের রিকশা যে পথে গেল সে পথে হাঁটা দিলাম। দুর্গাপুরে এসে নেমেছিলাম বলে বিরিসিরি বাসস্ট্যান্ড আমরা চিনিনা। আমরা হাঁটতে লাগলাম। কিন্তু রিকশার আর খোঁজ নেই। এদিকে সারাদিনের ক্লান্তিতে পা আর চলতে চায়না। রিকশা ততক্ষণে আমাদের চোখের আড়ালে চলে গিয়েছে। চোখের সামনে রাস্তা কেবল একটাই। ঐটা দিয়েই হাঁটতে লাগলাম। বাসস্ট্যান্ড নিশ্চয়ই সামনেই কোথাও পড়বে। হাঁটতে হাঁটতে একবার ডানে তাকাই, একবার বামে। তাকাতে তাকাতেই চোখের কোণায় কিছু একটা ধরা পড়লো। যা দেখলাম মনে হল সমরেশের “উত্তরাধিকার” থেকে পাহাড়ি মেয়ের সেই গোসল করার দৃশ্য আমার সামনে ঝুপ করে নেমে এসেছে। পার্থক্য একটাই। বইটা পড়ার সময় আমাকে দৃশ্যটা কষ্ট করে কল্পনা করে নিতে হয়েছিল। এইবার নিজের চোখেই দেখতে লাগলাম। লাইভ এন্ড এক্সক্লুসিভ। তবে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকিনি। আমি না হয় যেমন তেমন। কিন্তু আমার বাপজান তো ভদ্রলোক। তার সম্মান রাখতেই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নিজের দৃষ্টিকে সংযত করলাম। অবশ্য এর আগে যে কিছুই দেখিনাই এইটা কিন্তু বলিনাই।
পাহাড়ি মেয়ের ঘোর কাটতে না কাটতেই কিছুদুর এগিয়ে ডানে তাকাতেই দেখি নদীর ধারে বোল্ডার ফেলে আর বনায়ন করে বেশ সুন্দর পাড় তৈরি করা হয়েছে। এমনিতেই প্রচন্ড ক্লান্ত। রায়হান আরো উসকে দিয়ে বললো রাস্তা দিয়ে রোদের মধ্যে কষ্ট করে যাবার কি দরকার। তারচে চল নিচ দিয়ে নেমে যাই। বেশ আরামদায়ক প্রস্তাব। তিনজনে মিলে ধেই ধেই করে নিচে নেমে নদীর পাড় দিয়ে হাঁটতে লাগলাম। জায়গাটা সত্যিই অনেক সুন্দর ছিল। সবকিছু ভুলিয়ে দেবার মত। যে জন্য কিছুক্ষণ পরেই বোঝা গেল আমরা পথ ভুল করে প্রায় আধা মাইলের মত বেশি হেঁটে চলে এসেছি। ওদিকে ফোনে মুহাম্মদের তাড়া। সাথে একটা গুড নিউজও দিল। আজকে নাকি বিরিসিরি থেকে ঢাকার বাস ছাড়বেনা আর। কেয়া বাত হ্যায়!
এক চাচামিয়া কে সামনে বাসস্ট্যান্ড কোথায় জিজ্ঞেস করতেই কেমন কেমন দৃষ্টিতে যেন তাকালো। পাবনা থেকে ছাড়া পাওয়া কারো দিকে কি মানুষজন এভাবে তাকায়? আমি ঠিক শিওর না।

– মিয়ারা, কোথ্থিকা আসছেন?
– ঢাকা
– অ বুঝছি। চলেন আমার সাথে।
কি বুঝলো কে জানে। তবে আমরা না বুঝেই তার পিছন পিছন চললাম। সঠিক পথে যেতে যেতে বুঝা গেল কাহিনী। দোষটা আসলে আমাদের না। ঐ পাহাড়ি মেয়ে দুইটার। এত সময় আর এর এত মানুষ থাকতে ক্যান আমাদের সামনেই গোসল করতে হবে। তাদের দেখতে গিয়েই আমরা পাশের চিকন রোডটা বাদ দিয়ে অন্য রাস্তায় হাঁটা শুরু করেছিলাম।

এখান থেকে যেহেতু সরাসরি ঢাকা যাওয়া যাচ্ছেনা কাজেই ঠিক করা হল ময়মনসিংহ গিয়ে সেখান থেকে ঢাকার বাস ধরা হবে। এবারের জার্নিটাও মোটেও সুখকর ছিলনা। তবে অন্যদের জন্য। আমি ওঠার দুই মিনিটের মধ্যেই ঘুম। ময়মনসিংহ পৌছানোর পর এবার টাকার হিসাব। সবার টাকা মিলিয়ে দেখা গেল ঢাকা যাবার বাসভাড়া হচ্ছেনা। কিন্তু পরে জানি জানি ক্যামনে ক্যামনে ম্যানেজ হয়ে গেল। সেই আনন্দে হোটেলে ঢুকলাম ডিনার করতে। খাবার পর দেখা গেল বাজেটের চে বেশি খাওয়া হয়ে গেসে। সো আবার বাস ভাড়া সংকট। সেটাও পরে ক্যামনে ক্যামনে জানি ম্যানেজ হয়ে গেল। মুখ দিয়েছেন যিনি তিনিতো ডিনার এ বেশ ভালই আহার দিলেন। সেইরকম ভাবে চাইতে পারলে বাসভাড়াটাও দিবেন না- তা কি হয়?

বিরিসিরি ভ্রমণের এই ওয়ানডে ম্যাচের এখানেই আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি। সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ।

চলে যাবার আগে: এই ব্লগে কোন ছবি দিলাম না। আগ্রহীরা চাইলে রায়হান আবীরের এই ব্লগটাতে একবার ঢুঁ মেরে আসতে পারেন।

৩০ টি মন্তব্য : “বিরিসিরিতে ঘোরাঘুরি, একটু স্মৃতির খোঁড়াখুঁড়ি…”

  1. জিহাদ (৯৯-০৫)

    এখন বুঝতে পারছি। বিরিশিরি গেলে দুই-তিন দিন থাকার চিন্তা করেই যাওয়া উচিত। আমাদের কোনকিছুই প্ল্যান করা ছিল না। মাত্র ৪-৫ ঘণ্টায় কয়েক শ টাকা দিয়ে আর কি-ই বা দেখা যায়। সীমাবদ্ধতার কথা চিন্তা করলে সফল ভ্রমণই বলতে হবে।


    সাতেও নাই, পাঁচেও নাই

    জবাব দিন
  2. হাসনাইন (৯৯-০৫)
    বিজয়পুর যাবার পথে বেশ কিছু জিনিস দেখা হল। মিশনারীদের সেন্টার, একটা অদ্ভুত স্তম্ভ (জিনিসটা কি জন্যে বানানো হয়েছে সেটার সদুত্তর দিতে পারেনি কেউ), একটা আশ্রম আর পাহাড়ি বাংগালী জীবনের বিচিত্র সংমিশ্রণ।

    জিহাদ,
    এইটাই কি সেই স্তম্ভটা? রিক্সাওয়ালা বলছিল এইটা নাকি কোন এক বিশেষ ধর্মাবলীদের মঞ্চ, নাচগান হয় নাকি!! কি জানি কতটুকুন সত্য। :-/
    পাকা রাস্তার পাশে একটা বাগানবাড়িও নাকি আছে, সেখানে অবশ্য সময়ের অভাবে যেতে পারি নাই।

    মামা তোর লেখা পইড়া আরেকবার ঘুইরা আইলাম বিরিসিরি থেইক্কা। :dreamy: :dreamy:
    ভাল্লাগছে খুব। :clap:

    জবাব দিন
  3. ইফতেখার (৯৫-০১)

    গেসিলাম ১৩ জন। ছিলাম ymca সেন্টার এ। ৫০০ টাকায় (প্রতি) হয়ে গেসিলো সব।

    গেসিলাম ট্রেন এ, আরামে গেসি, টাকা ও কম ই লাগসিলো।

    এইখানে ছবি আছে কিছুঃ (আমাদের অবশ্য একদিন ময়মনসিংহ এবং ২ ১/২ দিন বিরিশিরি ভ্রমন)

    http://www.facebook.com/album.php?aid=86771&id=864050482
    http://www.facebook.com/album.php?aid=86829&id=864050482

    জবাব দিন
  4. মাসরুফ (১৯৯৭-২০০৩)
    মুহাম্মদ ওর সদ্য নতুন হওয়া গার্লফ্রেন্ডের সাথে কথা বলে এসে সেটাকে চতুর্থ জনকে খোঁজাখুঁজির নামে চালিয়ে দিচ্ছে।

    ব্লগে এত গরম খবর থাকতে পাবলিক আমারে নিয়া টানাটানি করে।ইনসাফ নাই রে পাগল! x-(

    জবাব দিন
  5. রকিব (০১-০৭)

    মুহাম্মদ ওর সদ্য নতুন হওয়া গার্লফ্রেন্ডের সাথে কথা বলে এসে সেটাকে চতুর্থ জনকে খোঁজাখুঁজির নামে চালিয়ে দিচ্ছে।

    রায়হান আবীর তার সদ্য গজানো ভুড়ি খানা দুলিয়ে হেলেদুলে এদিকেই আসছে।

    =)) =)) :goragori: :goragori:
    পুরানো লেখা পইড়া পিরা মিরা গেলাম আরেকবার। জুহাদ ভাই ড়ক করে।


    আমি তবু বলি:
    এখনো যে কটা দিন বেঁচে আছি সূর্যে সূর্যে চলি ..

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : হাসনাইন (৯৯-০৫)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।