সারমেয় পূরাণ

খাঁন বাহাদুর গণি সাহেব, বিশাল ভূ-সম্পত্তির মালিক, অগাধ প্রতিপত্তি। তার বাবার বাবা ইংরেজ দের জমানায় খাঁন বাহাদুর খেতাব পেয়েছিলেন, সেই থেকে বংশানূক্রমিক ভাবে তারা খাঁন বাহাদুর নামেই পরিচিত। দেশের গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার মাঝেও এলাকায় গণি সাহেবের কথাই আইন। সালিশ-বিচার আচারে গণি সাহেবের কথাই চুড়ান্ত। নায়েব গোমস্তা পাইক এখনো তার বিঘার পর বিঘা জমি দেখাশোনা করে, বর্গাদারদের কাছ থেকে ধান-চাল আদায় করে। সবমিলিয়ে খাঁন সাহেবের এলাকাটা যেন মধ্যযুগের কোন থমকে থাকা প্রতিচ্ছবি।
সৌখিন খাঁন সাহেবের অনেক শখের একটি শিকার। শীতকালে বিলাতী হাঁস কিংবা ঘুঘু মারতে তিনি বেশ পছন্দ করেন।
এসময় তাকে দেখা যায় অনুচর পরিবেষ্টিত হয়ে দোনলা বন্দুক হাতে বিলাতী হাঁস ,বটের কিংবা ঘুঘুর খোঁজে পাশের বিলে বা শালবনে শিকারে যেতে। আর খাঁন বাহাদুর সাহেবের শিকারের বিশ্বস্ত সঙ্গী ভূলু, তার আদরের ‘বাঘা’ কুকুর। সরাইলের হিংস্র জাতের এই কুকুর শিকারের সময় তার আগে আগে যায়, খরগোশের পেছনে ছোটে। ভুলুটা সাথে থাকে বলেই সাপ,বেজী, ছুঁচো এসব হয়তো তার কাছে আসেনা। রাতে বাড়ি পাহারাতেও ভুলোর জুড়ী নেই। পাইক বরকন্দাজ তো আছেই কিন্তু ভুলো হলো প্রভুভক্ত জাত! তার চোখে ঘুম নেই, সদা সতর্ক টানটান। মালিকের বাড়ির সীমানায় যাতে কেউ অনুপ্রবেশ করতে না পারে এ ব্যপারে ভুলো খুবই সাবধান।
খাঁন বাহাদুর সাহেবের বাড়িতে খাওয়া-দাওয়াটা ভালোই হয় ভুলোর। হলুদ দিয়ে সেদ্ধ করা মাংস, দুধ, আর উৎসব আয়োজনে গরু খাসী জবাই হলে তো কথাই নেই। তখন রোদে গরম হওয়া খড়ের গাদার উপর শুয়ে আরামে হাড় চিবোয় ভুলু। আর আল্লাহর দোয়ায় খাঁন বাহাদুর সাহেবের বাড়িতে উপলক্ষ্য লেগেই থাকে।
অবশ্য মাঝে মাঝেই তার বুনো হিংস্র স্বত্তা জেগে ওঠে, তখনই সে গ্রামের কৃষকের খোঁয়াড় থেকে হাঁস-মুরগী ধরে আনে, লোকজনকে ধাওয়া করে, অকারণেই খেঁকিয়ে ওঠে। তার ধাওয়া খেয়ে পুব পাড়ার মাস্টার মশাই একবার পুকুরে নেমেছিলেন, আর হারু গোয়ালা দুধের বাঁক ফেলে চড়ে উঠেছিলো গাছের মগডালে। এসব করে নিজের হারানো বুনো জীবনটাকে মনে করে ভুলো। এতে মাঝে মাঝে খাঁন বাহাদুর সাহেব বিরক্ত হোন, ভূলোকে শেকলে বেঁধে রাখতে বলেন, পাইক-বরকন্দাজদের বলেন সামলে নিতে। আবার দুই একজন হয়তো ক্ষতিপূরণ পায় তবে বেশীর ভাগই এসে ভূলোর বিরুদ্ধে নালিশ জানানোর সাহস পায় না। হাজার হোক খাঁন বাহাদুর বাড়ির কুকুর তো বটে! কদিন বাদেই হয়তো খাঁ সাহেবই আবার শেকল খুলে ভূলোকে শিকারে নিয়ে যান। এভাবে বেশ চলছিলো ভুলোর।

হঠাৎ হিসেবে গরমিল হয়ে গেলো, ভুলো পাগল হয়ে গেলো। পানি দেখলে ভয় পায়, ভুলো সবাইকে কামড়াতে চায়, এমনকি ঘরের লোককেও আঁচড়ে কামড়ে একাকার। চেনা অচেনা সবাইকে দেখলেই খেঁকিয়ে ওঠে। একদিন খাঁ সাহেব এক সালিশে বসে আছেন হঠাৎ হতচ্ছাড়া ভুলোটা কোত্থেকে এসে একে ওকে তাড়া করে বেড়াতে লাগলো। কিছু লোকজন লাঠি সোঁটা নিয়ে এলেও মারতে সাহস করলো না। হাজার হোক হুজুরের পেয়ারের কুকুর!
কিন্তু ওদিকে কুকুরের কারণে যে গ্রামে মানুষের সামনে খাঁন বাহাদুর সাহেবের অপদস্থ অবস্থা। সামান্য কুকুরের ব্যবস্থা নিতে পারেন না? কিন্তু কিছুতেই যেন কিছু হচ্ছেনা, বেঁধে রাখলেও ছুটে বেড়িয়ে যাচ্ছে, নইলে তারস্বরে চেঁচাচ্ছে, একে আঁচড়াচ্ছে , ওকে কামড়াচ্ছে ,কুকুরের কাছে যেন নাজেহাল সবাই।
এসময় খাঁন বাহাদুর সাহেব শক্ত স্বীদ্ধান্তে পৌঁছলেন। ভুলোকে তাড়িয়ে দিলেন। শহরে খবর দিলেন , সেখান থেকে লোকজন এসে ভূলোকে ধরে সুঁই ফুটিয়ে দিলো। ভুলো এখন খাঁন বাহাদুর বাড়ির সদর দরজার সামনে ঘুরোঘুরি করে , কাঁইকুঁই করে, লেজ চুলকোয়। খাঁন বাহাদুর সাহেব কি আবার ভুলোকে বাড়িতে ঢুকতে দেবেন?

১,২৪৭ বার দেখা হয়েছে

১৪ টি মন্তব্য : “সারমেয় পূরাণ”

  1. কামরুলতপু (৯৬-০২)
    খাঁন বাহাদুর সাহেব কি আবার ভুলোকে বাড়িতে ঢুকতে দেবেন?

    আমরা চাই খাঁন বাহাদুরের সুবুদ্ধি হোক। তিনি যেন ভুলোর কুঁইকুঁই এ না ভুলেন। আর যেন এইসব ভুলোরা জমিদারবাড়িতে স্থান না পায়।

    অসাধারণ সামীউর।

    জবাব দিন
  2. কামরুল হাসান (৯৪-০০)

    ভুলোকে সামলানো যায়নি। ছাত্রলীগকেও না।
    খান বাহাদুর সাহেব পারেন নি। পারেননি শেখ হাসিনাও।

    গল্প ভালো হয়েছে সামীউর।
    চমৎকার। :thumbup:


    ---------------------------------------------------------------------------
    বালক জানে না তো কতোটা হেঁটে এলে
    ফেরার পথ নেই, থাকে না কোনো কালে।।

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : মু. নূরুল হাসান (৯৪ - ০০)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।