রসনায় স্মৃতিযাপন

রিইউনিয়নের দিনতারিখ ঘনিয়ে আসছে, কিভাবে যাওয়া হবে কোথায় থাকা হবে এই ছুতোয় ক্যাডেট কলেজ ক্লাবে আড্ডা দিতে বসেছি এক শনিবার দুপুরে। কথার তুবড়ি ছুটছে, পেটে ছুঁচোর কেত্তনও শুরু হয়ে গেছে। দুপুরের খাবারের মেন্যুতে সেদিন ক্লাবে দেখি খিচুড়ি, দেখেই আমাদের আলাপের বিষয় হয়ে গেল কলেজে থাকার সময় বুধবার লাঞ্চের মেন্যু। খেতে খেতেও চলল একই আলাপ, কারণ ক্লাবের খিচুড়ির স্বাদ নাকি কলেজের খিচুড়ির মতই এবং এতক্ষণ ধরে চলে আলাপে আমাদের বহুমত থাকলেও এই একটা ব্যাপারেই আমরা দ্রুত একমত হয়ে গেলাম। ক্যাডেট কলেজের বাবুর্চিই অবসর নিয়ে বা বাড়তি বেতনে ক্লাবে চলে এলো কি না সেই আলোচনাও চলল।

একটু খুঁটিয়ে ভাবতেই টুকরো টুকরো ছবিগুলো জোড়া লাগিয়ে যেটা পেলাম, তা হলো কলেজের মেন্যুতে ছিল এমন কোন খাবার বাইরে কোথাও খেলে অবচেতনভাবেই হয়তো আমাদের স্বাদকোরক একটা তুলনায় চলে যায়। ছয় বছর ধরে একদম বাঁধাধরা ভাবে খেয়ে যাওয়া সেই খাবারের স্বাদগন্ধ আমাদের মগজের ধূষরকোষ গুলোতে এমনই ছাপ রেখে গেছে যে একটু উস্কানিতে না চাইতেই তা স্মৃতির ঝাঁপি খুলে বেরিয়ে আসে। রাতজাগার পর সকাল বেলা পরিচিত একটা গন্ধ নাকে এলেই আমি যেন ইট পাথরের এই রাজধানী ছেড়ে ফিরে যাই চা বাগান ঘেরা সেই পরিচিত ৫২ একরে। গন্ধটা পরটা ভাজার! সকালে ঢাকাবাসীর ঘুম ভাঙ্গার আগেই ঘুম ভাঙ্গে পাড়ার রেস্টুরেন্ট কর্মচারীদের। উনুনে বিশাল কালো তাওয়ায় ভাজা হচ্ছে পরটা, যন্ত্রদানবের চলাচল শুরুর আগ পর্যন্ত ঢাকার বাতাসে তাদেরই মৌতাত। আর সেই গন্ধ নাকে এলেই আমি চলে যাই শাহজালাল হাউজের ২০৪ নাম্বার রুমের বারান্দায়! সপ্তম শ্রেণীতে সেটাই যে ছিল আমার ঠিকানা। হাউজের একদম পূবদিকের এই কোণের ঘরগুলোর সঙ্গে ডাইনিং হলের দূরত্ব যৎসামান্য, ভাজা পরটার গন্ধমাখা গরম বাতাসের জন্য তো সেটা আরও কম। পিটির পর ঘামে ভেজা শরীরটা নিয়ে রুমের দিকে যেতে যেতে নাকে সেই গন্ধ এসে লাগলেই তো চোখের সামনে ভেসে উঠতো চৌকো পরটাগুলো। ঠিকঠিক ভাজা, স্টিলের প্লেটে করে একটা ছোট্ট পিরিচ চাপা দিয়ে যা টেবিলে রেখে যাচ্ছেন দেওয়ান ভাই। কলেজ থেকে বের হবার পর পরটাকে বৃত্ত হতেই দেখলাম, বর্গক্ষেত্রের মত অমন চৌকো পরটা বোধহয় হোটেল রেস্তোরা থেকে বিলুপ্ত!

কোন এক শুক্রবার শীতের সন্ধ্যায় ফল ইন করে দাঁড়িয়ে আছি ডাইনিং হলের সামনে। ইউক্যালিপটাসের হালকা লেবুগন্ধী সৌরভের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে পোলাও এর সৌরভ। তার আগে অবশ্য হাউজের কমনরুম থেকে শুঁকে এসেছি কাবাব ভাজার পোড়া পোড়া ঘ্রাণ! সৈয়দ মুজতবা আলীর লেখায় পড়েছি, তিনি নাকি অতিথিদের অ্যাপিটাইজার হিসেবে নিজ হাতে বানানো একটা পানীয় দিতেন। ক্যাডেট কলেজের শৃংখলাবদ্ধ জীবনে তো আর সেই সুযোগ নেই, তবে এই ঘ্রাণই যে অ্যাপিটাইজারের কাজ করতো সেটা বলা যায় নিঃসন্দেহেই।
কাঁধে দাগের সংখ্যা একটু বেড়ে যাবার পর বুঝেছি, মিল্ক ব্রেক এর মত “অত্যাচার” আছে কমই। যাবতীয় পরীক্ষামূলক খাবার বুঝি খাওয়ানো হত এই বেলাতেই, যার বেশিরভাগই ক্লাস সেভেন ছাড়াবার পর খেয়েছি বলে মনে পড়ে না। আমার বন্ধু বিস্কুটের নাম দিয়েছিল দাঁতের চিহ্ন রেখে আসা বিস্কুট, কারণ সেগুলো এত শক্ত ছিল যে মিল্কব্রেকের স্বল্প সময়ে তা কামড়ে শেষ করা সম্ভব ছিল না। কর্মমুখী শিক্ষার ক্লাস থেকে ইটের প্রকারভেদ জানার পর অল্পসময়েই পিঁয়াজুর নাম হয়ে গেল খোয়া/ঝামা। বেশি পুড়ে যাওয়া ইটের টুকরোকে তাই তো বলা হয়েছে পাঠ্যপুস্তকে! এছাড়াও খাজা গজা নিমকি জাতীয় বিচিত্র সব খাবার। এসব খেতে এতটা পথ উজিয়ে যাওয়া এবং যাত্রাপথে কোন স্টাফ বা প্রিফেক্ট এর নজরে পড়ে শাস্তি পাবার শংকা, এ যেন পেটে খেলে পিঠে সয় না। তাই তো একটু উঁচু ক্লাসে উঠে অনেকেই যেতাম না মিল্কব্রেকে, ঘনিষ্ঠ কোন বন্ধু আবার সেটা খেয়াল করে ফেরার সময় হাতের তালুতে লুকিয়ে ঠিকই নিয়ে আসতো একখানা আলুর চপ অথবা সিঙ্গাড়া।

স্পেশাল ডিনারের পুডিংটা ছিল যেন জুয়াড়ির সর্বস্ব দিয়ে ধরা বাজির মতই মূল্যবান! ইষৎ বাদামী ছাদের নিচে হলদে রঙের জমাট চারকোনা অমৃত খন্ডটিকে খেতাম, চামচ দিয়ে অল্প অল্প করে কেটে , তাড়িয়ে তাড়িয়ে স্বাদকোরকের সমস্তটুকু দিয়ে উপভোগ করে। শুক্রবার ছুটির দিনটাতেও ডিউটি ক্যাডেট হিসেবে খাকি পোষাকটা গায়ে চাপানো আর নানান কাজে ছোটাছুটিতে আরাম হারাম হলেও খাবার চাখার সুযোগে অনেকগুলো পুডিং সাবাড় করার আনন্দে নিশ্চয়ই সেই আক্ষেপটা উবে যেত। স্পেশাল ডিনারের কথা যখন চলেই এল,তখন ইংলিশ ডিনারই বা বাদ পড়বে কেন? ব্রেকফাস্টে বাটার আর জেলি দিয়ে ব্রেড খেতে ভাল লাগুক আর নাই লাগুক, ইংলিশ ডিনারে ডিশে একটা ব্রেডও পড়ে থাকত না। জীবনের প্রথম ইংলিশ ডিনারের কথাটা মনে আছে এখনো। সকালে ধরাবাঁধা ব্রেড বাটারের বদলে লুচি আর মাংস দেখেই ব্রেকফাস্ট টেবিলে গাইড ফারহান ভাই পাশ থেকে বললেন “ আজকে রাতে ইংলিশ ডিনার আছে।” ক্লাস সেভেনের অনভ্যস্ত হাত ছুরি আর কাঁটার সহবত তখনো রপ্ত করতে পারেনি, চেনাজানা খাবারের বদলে রাতে কি যে জুটবে কপালে সেটা জিজ্ঞেস করার আর সাহস হলো না। ডিনারে এসে দেখি চিকেন কারি আর ব্রেড,সঙ্গে কাপে স্যুপ একটা আর সুইট ডিশে কাস্টার্ড! এবং সঙ্গে ইংলিশ ডিনারের বিখ্যাত ভেজিটেবল। শুরুতে খারাপ লাগলেও বেড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে ইংলিশ ডিনারে আমরাও ব্রেড খাওয়ার প্রতিযোগিতায় নেমে পড়লাম। কলেজে প্রচলিত কিছু কিংবদন্তীর মতই অমুক ভাই এর ৩৬ পিস ব্রেড খাওয়ার রেকর্ড ভাংতে উদ্যোগী হয়ে গেল কেউ কেউ। এজন্যে ডিনারের আগে শরীরচর্চার মাধ্যমে ক্ষুধা বাড়ানোর টোটকা শুনে সেই চেষ্টাও করা হয়েছে বলে শুনেছি। কেউ একজন গর্ব করে বলতে গিয়ে মুখ ফস্কে বলেছিলেন,”আমি এক ব্রেড ডিশ খেয়েছি।” এজন্যে তাকে কম ভোগান্তিতে পড়তে হয়নি!
ডাইনিং হল নিয়ে গল্প হবে আর তাতে মেস ওআইসি স্যারের কোনভূমিকা থাকবে না, এ যেন ডেনমার্কের রাজপুত্রকে ছাড়াই হ্যামলেট মঞ্চায়ন করা। কারণ প্রতিবেলা খাবারের সময় তার উপস্থিতি যে সেখানে অনিবার্য। কে না জানে, জগতের সব উপকারী খাবারের স্বাদ খুব বিচ্ছিরি হয়।সবজির স্বাদ তাই যথানিয়মেই ভাল হত না। একজন মেস ওআইসি লাঞ্চ ও ডিনারে টেবিলগুলো ঘুরে ঘুরে দেখতেন আর যার প্লেটেই সবজি দেখতেন তাকে বলতেন “বাজি কাও”। তখন খারাপ লাগলেও এখন বুঝি, আমাদের ভাল চাইতেন বলেই জোরটা করতেন। আরেকটা মজার বিষয় ছিল মেস মিটিং। মেনু পরিবর্তনের অনেক আলোচনা হলেও কি করে যেন মেনুটা আগের মতই থেকে যেত,হয়তো দুপুরেরটা রাতে আর রাতেরটা দুপুরে এমন। সেরকমই একটি মেস মিটিং, যেখানে প্রিন্সিপাল স্যার উপস্থিত এবং কথাবার্তা যথারীতি ইংরেজিতেই বলছেন। একজনের অভিযোগ ছিল শুক্রবার লাঞ্চের মেনু নিয়ে, তাতে কি থাকে প্রিন্সিপাল জানতে চাইলে উত্তর ছিল “চিকেন স্পেয়ার পার্টস”। গাড়ি বা যন্ত্রের স্পেয়ার পার্টস থাকে, তাই বলে মুরগিরও যে থাকে সেটা জেনেছিলাম সেদিনই।
শনিবার বিকেল মানেই বেকারি থেকে ভেসে আসা প্যাটিসের ঘ্রাণ। বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সহপাঠির মা একবার শিক্ষিকা হিসেবে বদলী হয়ে এলেন সিলেট ক্যাডেট কলেজে। তার সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে দেখি, সেই ম্যাডাম ক্যান্টিন থেকে প্যাটিস আনিয়ে রেখেছেন। বিস্ময় প্রকাশ করতেই বললেন, “আমি জানি সিলেটের ক্যাডেটরা কলেজের এই প্যাটিস অসম্ভব পছন্দ করে।” এই প্যাটিস নিয়েই তো, “ফেট্টিস খাইতাম” ঘটনার জন্ম।
এতো গেল সব ডাইনিং হলের খাবারদাবারের গল্প, তার বাইরে কি কোন খাওয়া দাওয়াই চলতো না? একদমই না।আমের মৌসুমে অ্যাকাডেমিক ব্লকের পেছনের বা হাউজের পেছনের আমগাছের আম পেড়ে বালতিভর্তি আমমাখা, মধ্যরাতের মুড়ি চানাচুর, প্রহরীর চোখকে ফাঁকি দিয়ে কমান্ডো কায়দায় পেড়ে আনা নারকেল বা কাঁঠাল এসবের স্বাদ তো স্বর্গীয়।

বছর ছয়েক ধরে রোজ পাঁচবেলা করে কতবারই তো ঢুকেছিলাম কলেজ ডাইনিং হলে। কিন্তু ফেয়ারওয়েল ডিনারের ফল ইনে যখন দাঁড়ালাম,তখন গলার কাছটা কোথায় যেন ধরে এসেছিল। শুনতে পাচ্ছিলাম অদৃশ্য শেষ বাঁশি।জানতাম,এই ছবিটা আর তৈরি হবে না কখনো।এই সবগুলো চেহারা আমি আর একসঙ্গে কখনো দেখব না। ঝাপসা চোখের কোণ নিয়েই সেদিন বেরিয়ে এসেছিলাম, জানি আমার মত আরো অনেকেরও সেদিন চোখে জমেছিল জল। বেরিয়ে এলেও আমি অবশ্য হারিয়ে ফেলিনি সিলেট ক্যাডেট কলেজকে। প্রতিটা দিনেই আমি যাপন করি প্রিয় কলেজের স্মৃতি। কখনো অনুভূতিতে,কখনো বা রসনায়।
(সিলেট ক্যাডেট কলেজের রিইউনিয়ন স্যুভেনিরে প্রকাশিত)

৪,৪১৯ বার দেখা হয়েছে

৬ টি মন্তব্য : “রসনায় স্মৃতিযাপন”

  1. পারভেজ (৭৮-৮৪)

    শুধু খাওয়া দাওয়া নিয়েই গোটা একটা ব্লগ?
    দারুন ব্যাপার তো?
    আমি খুব একটা খাদ্য রসিক না বলেই এত কিছু কলেজে থাকা কালে লক্ষ করি নাই।
    বুঝলাম, লক্ষ করার মত আরও অনেক কিছুই ছিল।
    আর তা খাবার সহ...


    Do not argue with an idiot they drag you down to their level and beat you with experience.

    জবাব দিন
  2. লুৎফুল (৭৮-৮৪)

    দারুন স্মৃতিমুখর লেখাটা স্মৃতিপ্রকোষ্ঠে কলেজের স্মৃতির দোর্দন্ড প্রতাপের কথা জানালো দুর্বার।
    পাঠকের স্মৃতির সব নিউরন উসকে দিয়েও গেলো সেই সাথে বলা যায় নিশ্চিত।

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : লুৎফুল (৭৮-৮৪)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।