পুরোনো পাটিগণিত, একটি স্টেডিয়ামের অপমৃত্যু ও ‘দিনবদল’ এর বিজ্ঞাপণেই সীমাবদ্ধতা

পাটিগণিতের সেই বিখ্যাত অংকটির কথা সবার মনে আছে নিশ্চিত, সেই যে একটি তৈলাক্ত বাঁশ আর দুরন্ত বাঁদরের অংক। বাঁশ বেয়ে ওঠে আর নামে… । আমার কেন জানি সেই দুরন্ত বাঁদরের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে, বেয়ে যাচ্ছে অনন্ত বাঁশ।

বাংলাদেশ ২০১১ বিশ্বকাপ ক্রিকেটের সহ-আয়োজক এটা পুরোনো খবর, খবর হলো হবেটা কোথায়? মিরপুরের হোম অফ ক্রিকেটে নাকি ক্রিকেট-ফুটবল-আ্যথলেটিকসের টানাপোড়েনে সমস্যায় জর্জরিত বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে?

২০০৫ এর জানুয়ারির শেষ দিনে জিম্বাবুয়ে কে হারিয়ে টাইগাররা মেতে ওঠে দেশের মাটিতে প্রথম সিরিজ জয়ের আনন্দে। তারপর ত্থেকেই আর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের মুখ দেখেনি এই স্টেডিয়াম। ক্রিকেটের জনপ্রিয় সাইট ক্রিকিনফো বলছে বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম (বিএনএস) হচ্ছে পৃথিবীর একমাত্র স্টেডিয়াম যার দুটি ভিন্ন দেশের প্রথম টেস্ট আয়োজনের সৌভাগ্য হয়েছিলো। অবশ্য কোন কীর্তিই আমরা মনে রাখিনা তা সে পুরাকীর্তিই হোক আর ক্রীড়াকীর্তিই হোক!

ক্রিকেটের বৈশ্বিক সম্প্রচারের সাথে বঙ্গবন্ধুর নাম বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ছে এই ধারণায় মগ্ন হয়ে যারা বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম থেকে ক্রিকেটকে প্রথমে ফতুল্লায় ও পরে মিরপুরে নির্বাসিত করলেন তাদের প্রস্থানের পর আবার ক্রিকেটকে আবারো ‘মায়ের কোলে’ ফিরিয়ে আনার প্রস্তাবনা চলছে। একশ্রেণীর ক্রীড়া সংগঠক নামক ক্রীড়া ‘গোরখোদক’ আবারো ক্রিকেটকে বিএনএস এ স্থানান্তরিত করবার প্রয়াস শুরু করে দিয়েছে। না কোন চেতনার উন্মেষে নয়, আসন্ন বিশ্বকাপ উপলক্ষে স্টেডিয়ামের সংস্কার কাজ, বিলবোর্ড ও টিকেট বাণিজ্যের মাধ্যমে নিজেদের উদরপূর্তি করাই তাদের লক্ষ্য।
একসময় বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের গ্যালারিতে হতো উপচে পড়া ভীড় আর এখন ১০/২০ টাকা টিকেটেও কেউ খেলা দেখতে আসেনা! লাখ লাখ টাকার ভিআইপি হসপিটালিটি বক্সে হকি আর আ্যথলেটিক্স ক্যাম্পের খেলোয়াড়দের বাসস্থান! ফ্লাডলাইটের আলোর কথা বলতে গেলে সামিনা চৌধুরির গানের কথা মনে পড়ে…’জোনাকির আলো নেভে আর জ্বলে’।

দিল্লীতে বিশ্বকাপ আয়োজক কমিটির বৈঠকের পর মিরপুর শেরেবাংলা জাতীয় স্টেডিয়াম পরিদর্শনে চলে এসেছেন যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী আহাদ আলী সরকার। পরিদর্শন শেষে ফিরে যাওয়ার সময় ছেঁকে ধরা টেলিভিশন ক্যামেরার সামনে তিনি বলে গেলেন, “বিশ্বকাপের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানটা আমরা বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামেই করতে চাই। অবশ্য সবকিছু চূড়ান্ত হবে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনার পর”। এতবড় একটা আয়োজনের সামনে দাঁড়িয়ে, জাতির ও ‘নিজের’ পিতার নাম কি তার সাথে জুড়তে চাইবেন না ‘ভুমিধ্বস’ বিজয় নিয়ে সংসদে আসা প্রধানমন্ত্রী? যেখানে একটা পাড়ার রাস্তা তৈরিতে নিজের নাম ফলকটা লাগাতে কোন রাজনীতিবিদ এতোটুকু কার্পণ্য করেন না সেখানে এতোটা উদারতার পরিচয় আশা করা কি আমড়া গাছে কাঁঠাল আশা করবার মতোই!

ক্ষমতায় গেলেই ‘দিন বদলের সনদ’ হয়ে যায় ‘নাম বদলের সমন’। আগের সব কিছু খারাপ আমাদের সব ভালো…সেই বানরের তৈলাক্ত বাঁশ বেয়ে ওঠার মতো । তিন হাত ওঠে দুই হাত নামে…এক দিন তো আগায় পৌঁছাবে এই স্বপ্ন নিয়ে! এই সুত্র মেনে নিলে তো ইংরেজদের বানানো কলকাতার ইডেন গার্ডেন্স কবেই গান্ধীবাদের আশ্রমে পরিণত হত আর চেন্নাই এর চিপ্পুক স্টেডিয়ামের জায়গায় হয়তো কোন রাবার ফ্যাক্টরির চিমনী দিয়ে ধোঁয়া বেরুতো। ভাগ্যিস তা হয়নি।

ক্রিকেট খেলার সুবাদে যেখানে আজ বিশ্বের অনেক জায়গায় বাংলাদেশের পতাকা উড়ছে, বাংলাদেশের খেলোয়াড় টাকায় নয় ডলারে বিকোচ্ছে সেখানে কতিপয় সুবিধাবাদী লোকদের কল্যাণে ক্রিকেটে আবারো এক কালো ছায়া,ক্রীড়াঙ্গনে অস্থিরতা।
ক্রীড়াঙ্গনে এম্নিতেই আমাদের মটো- ‘সাফল্য নয় অংশগ্রহণই বড় কথা’। আমাদের খেলোয়াড়রা বিদেশে খেলতে গিয়ে ‘হারিয়ে যায়’, হোটেলের টাওয়েল কাটাচামচ চুরি করে আনে, হালি হালি গোল খায় এইসব গ্লানি থেকে কিছুটা হলেও মুক্তি দিচ্ছিলো ক্রিকেট। কিন্তু শেষ রক্ষা মনে হয় হচ্ছে না। আ্যন্টিগাতে মাঠের বাজে অবস্থার কারণে টেস্ট ম্যাচ বাতিল হয়েছে, এখন বাজে ভেন্যুর কারণে না আবার বিশকাপের আয়োজকের তালিকা থেকে নাম বাদ পড়ে।

আসন্ন এএফসি কাপের আগে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামকে ‘উন্নত’ না করতে পারলে নিষেধাজ্ঞার হুমকি দিয়ে গেছেন ফিফা ও এএফসির কর্মকর্তারা , আবার ২০১১ বিশ্বকাপের জন্য প্রস্তুতি এই দুই এর টানা পোড়েনে যে অশ্বডিম্ব প্রসব হবে তা বলাই বাহুল্য। কথাশিল্পী শওকত ওসমানের ‘সৌদামিনী মালো’ গল্পে লেখক ‘স্বদেশী বাবু’র চরিত্র বোঝাতে বলেছিলেন তার (স্বদেশী বাবু) শুভ্রতা টুপির মধ্যেই সীমাবদ্ধ রইল, তেমনি ‘দিনবদলের গল্প” ও বিদেশী বহুজাতিক মুঠোফোন কোম্পানি আর বহুল প্রচারিত দৈনিকের বিজ্ঞাপণেই সীমাবদ্ধ রইল। আর বানরটা… এখনো আগায় উঠতে পারেনি।

পাঠক কে সেলাম।

২,১৭৩ বার দেখা হয়েছে

১৮ টি মন্তব্য : “পুরোনো পাটিগণিত, একটি স্টেডিয়ামের অপমৃত্যু ও ‘দিনবদল’ এর বিজ্ঞাপণেই সীমাবদ্ধতা”

  1. অসাধারন।
    মোস্তফা মামুন ভাই ছাড়া অন্য কারো কাছ থেকে এতো সুন্দর খেলা নিয়ে লেখা অনেকদিন পড়ি না।

    ঘুমাতে যাবার আগে এই লেখাটি অনেক ভাবালো। সামীউর, সিসিবিতে তোর লেখালেখি নিয়ে প্রত্যাশা অনেক বাড়িয়ে দিচ্ছিস। আমি তোর লেখার ভক্ত হয়ে গেলাম।

    একটাই অনুরোধ, না অনুরোধ না আদেশ, নিয়মিত লিখ এখানে। :thumbup:

    জবাব দিন
  2. সামীউর (৯৭-০৩)

    'ক্রিকেটটুমরো ডট কম'- এ লেখালেখির কারণে, গত কয়েকদিন ক্রিকেট নিয়ে টানাহেঁচড়ার ঘটনা গুলো মনের মধ্যে তীব্র একটা ক্ষোভের জন্ম দিচ্ছিল। এই লেখাটা তারই ফসল। প্রথমে ভেবেছিলাম সাইটে দিবো কিন্তু পরে মনে হলো কিছু Direct impulse' পাওয়া দরকার। তাই সিসিবি তে দিলাম। মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ। আর কারো রাজনৈতিক আদর্শকে আঘাত করে থাকলে আমি ক্ষমাপ্রার্থী।

    জবাব দিন
  3. সাকেব (মকক) (৯৩-৯৯)

    সামীউর,
    মারাত্মক লিখেছো হে... :boss:
    কিন্তু শেষ রক্ষা মনে হয় হবে না... :no:
    জাতির জনকের নাম বিশ্বব্যাপী প্রমোট করার এই দুর্নিবার আকর্ষণ কি জনকের বেটি এড়াইতে পারবে? এড়াইতে চাইলেও তো মোসাহেবের দল দিবেনা x-(


    "আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
    আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস"

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : সামীউর (৯৭-০৩)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।