অশনী সংকেত

সামীউর, স্টার্ট ফ্রন্টরোল। আরো একবার দিনটা শুরু হলো ফ্রন্ট্ররোল দিয়ে। সকালের পিটিতে যাওয়ার ফল ইন। যথারীতি ঘুম থেকে উঠতে দেরী এবং হাউজ ফল ইনে লেট। ক্লাস নাইন পর্যন্ত প্রায় প্রতিটা দিনই আমার শুরু হয়েছে রুমের দরজার কাছ থেকে ফ্রন্টরোল দিয়ে। এভাবে গড়াতে গড়াতেই নোটিশ বোর্ডের সামনে পৌঁছে যেতাম, পা থাকলেও হেঁটে আসার সুযোগ খুব একটা হয়নি। তাই সবাই যখন শ্বেতশুভ্র পোষাকে রাজহংসের মত গলা উঁচিয়ে পিটিতে যাচ্ছে, তখন আমি এবং আমারই মত কয়েকজন মকরা ক্যাডেটের সাদা পোষাকগুলো ধুলো ধুষরিত। হাউজের মেঝে যত্ন করে নাম লিখে দিয়েছে সাদা শার্টের পিঠে, তাই পিটি গ্রাউন্ডে স্টাফের কাছেও একদফা শাস্তি পাওনা।
এভাবেই নিউটনের সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়ার সূত্র মেনে আরামের ঘুম এবং যন্ত্রণার শাস্তির ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ায় শুরু হত আমার দিন। দশ, এগারো কিংবা বারো ক্লাসে এসে হাউজ ফল ইনে আর শাস্তি পেতে না হলেও হাউজ থেকে বের হওয়ার সময় অ্যাডজুটেন্ট বা সিএসএমের সঙ্গে দেখা হওয়াটা রোজকার ব্যপার। এর সব কিছুর পেছনে হচ্ছে ঘুম। সকাল বেলাটা বাড়তি খানিকটা সময় ঘুমিয়ে কাটানোর মজাটা যে কী, নয়টা-পাঁচটা অফিস করনেওয়ালারা সেটা ভালো করেই জানেন! এই ঘুমের জন্য সমরখন্দ –বুখারাও হাতছাড়া করে ফেলা যায়, আর শাস্তি! সে তো পেটে খেলে পিঠে সয়। তো যাই হোক, সকালে ঘুম থেকে উঠতে দেরী হয়ে যাচ্ছে, আমি রোজ রোজ অনেক সিনিয়রের পরে ফল ইনে যোগ দিচ্ছি, লক্ষ্মণ তো সুবিধের নয়। সমাধান, অ্যালার্ম ঘড়ি। বাসায় চিঠি লিখলাম, পরের প্যারেন্টস ডে তে গোলাপি রঙের চৌকোণা অ্যালার্ম ঘড়ি চলে এল। ব্যস, এরপর থেকে টেবিলের ওপর বেশ একটা ঘড়ি, সকাল বেলা এই ব্যাটাই আমায় জাগিয়ে দেবে।
তারপর, সময় বয়ে যায় আর ঘড়ি ডেকে যায়। ট্রিং, ক্রিং, কুঁউউ কুঁউউউ, ট্যাঁট ট্যাঁট…নিদ্রাদেবী তবু বিদায় নেন না। সময় মত ঘুম আর ভাঙ্গেই না! আমার ঘড়ির শব্দে নাকি নিচের হাউজে ঠিক বরাবর রুমের লোকেদের ঘুম ভেঙ্গে যায়, অথচ এক ফুট দূরে আমার কানে সেই শব্দ কোন প্রতিক্রিয়াই করে না। যাই হোক, খারাপ সময়ের পর তো ভালো সময় আসে। আমারও এলো। মানে সিনিয়র হলাম। এবার হাউজ বেয়ারা তার চাবির গোছা দিয়ে জানালার কাঁচে পৃথিবীর কর্কশতম শব্দ করে রোজ ডাকে। আমাদের জামাল ভাই মাঝে মধ্যে ঘাসপাতার ধোঁয়া টেনে ভোর চারটের সময়ও ডেকেছেন। সেই শব্দের স্বয়ং কূম্ভকর্ণেরও ঘুম ভেঙ্গে যাবে আর আমি তো কোন ছার! কলেজ শেষ হল, বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে বুঝতে পারলাম ক্লাসে সময় মত হাজির হওয়াটা খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয়। অনেক ক্লাসে না গেলেও হয়। কোথাও পেছনের দরজা দিয়ে টুক করে ঢুকে যাওয়া যায়। নেহায়েত ত্যাঁদড় শিক্ষক না হলে ক্লাসে ঢোকার সময়টা মেনে চলার খুব একটা বাধ্যবাধকতা নেই। কিছুদিন পর মনে হল, ক্লাস করারই আসলে কোন বাধ্যবাধকতা নেই!!!
সেই থেকে সকাল সকাল বিছানা ছাড়ার বদ-অভ্যাস ছাড়লাম। আটটা-নয়টা পর্যন্ত তো ঘুমানোই যায়। শুধু পরীক্ষার দিনগুলোতে সকালে ওঠার তাড়া, তাও মোবাইলে আমি না অ্যালার্ম দিয়ে রাখত আম্মু। কে না জানে, পরীক্ষার টেনশন যে মায়েদেরই বেশী।এরপর চাকরিতে এসে তো পোয়া আক্ষরিক অর্থেই বারো! তিনটা থেকে অফিস, রাতে টিভিতে খেলা দেখে, খোমাখাতায় গেঁজিয়ে, তা নিয়ে “মর্যাদা উর্ধভার” করে এরপর আবার গোটা দশেক লাইকের জন্য অপেক্ষা করে হাতে একটা বই নিয়ে ঘুমাতে যাই। সব কিছু মিলিয়ে তিনটার আগে তো হয়েই ওঠে না। অ্যালার্মের বদলে বাসার সামনের রাস্তায় ছয় নম্বর বাসের হর্ন আর এক ঘন্টার লোডশেডিং এর কল্যাণে কাছেপিঠেই চালু হওয়া কোন এক বা একাধিক জেনারেটর আমায় জাগিয়ে দেয় সাড়ে এগারোটার দিকে। তার পর গোটা তিনেক পত্রিকায় চোখ বুলিয়ে, আয়েশ করে নাস্তা সেরে বারান্দায় ধোঁয়া ছেড়ে যাই স্নানঘরে। বেরিয়ে জিনসটা পায়ে গলিয়ে, টি-শার্টটা গায়ে চাপিয়ে হেলেদুলে অফিসের দিকে। এর মধ্যেও যে দু-একদিন সকালে উঠতে হয়নি,তা নয়! তবে সে অবরে-সবরে, হাতেগুণে বলে দেওয়া যাবে।
এভাবেই যাচ্ছিলো কেটে জীবনের নিয়মে। গোল বাঁধলো আজকের দিনটাতে এসে। আব্বা-আম্মা দিনদুয়েকের জন্য, সিলেটে। বাসায় রান্নার লোক নেই, তাই ছোটবোনকে নিয়ে শ্যামলীতে কাজিনের বাসায় চলে এসেছি হিজরতে। এখানে দেখি সব উল্টো, সবাই ঘড়ি ধরে চলে! ভোর পাঁচটা থেকেই বিভিন্ন দিকে বিভিন্ন সুরে অ্যালার্ম বাজছে। আমি একটা মোবাইল অন্ধকারে হাতড়ে অ্যালার্ম বন্ধ করে যেই বালিশে মাথা ছুঁইয়েছি, অমনি আরেকটা বেজে উঠলো। এভাবে কারো ফজরের নামাজ, কারো অফিস সকাল সাতটায়, কারো নয়টাও হলেও বের হয় সাতটায়, কারো ক্লাস আটটায় একেবারে ত্রাহি মধুসূদন অবস্থা। সেই অশনী সংকেতের চোটেই ভোর আটটায় উঠে বসে আছি তো আছি, ঘুম আর আসছে না। কী আর করা, তাই বসে বসে এই ব্লগটাই লিখে ফেললাম।

১,৮১৬ বার দেখা হয়েছে

১৪ টি মন্তব্য : “অশনী সংকেত”

  1. দিবস (২০০২-২০০৮)
    আমাদের জামাল ভাই মাঝে মধ্যে ঘাসপাতার ধোঁয়া টেনে ভোর চারটের সময়ও ডেকেছেন

    :khekz: :khekz: :khekz:

    আমি এখানে আসার প্রথম এক বছর এমন নিয়ম ছিল যে ক্লাসে না গেলে একদিনের স্টাইপেন কাটা যা্বে।১ দিনের স্টাইপেন কাটা গেলে সেটার প্রভাব মাসের শেষের দিকে এসে বেশ ভালই বোঝা যায়,কিন্তু এই ঘুমের জন্য প্রতি মাসে ২/৩ টা ক্লাস মিস যেতই।আর মাস শেষে :((

    এখন অবশ্য সে ঝামেলাটা আর নেই,তাই এখন মাঝে মাঝে সারাদিন ঘুমিয়ে রাতের বেলায় ঘুম থেকে উঠি।আজকেও রাত সাড়ে আটটার দিকে উঠলাম। 😀 (সম্পাদিত)


    হেরে যাব বলে তো স্বপ্ন দেখি নি

    জবাব দিন
  2. তাইফুর (৯২-৯৮)
    কী আর করা, তাই বসে বসে এই ব্লগটাই লিখে ফেললাম।

    প্রতিদিন সকালে উঠবি আর একটা কইরা ব্লগ নামাবি ...

    আমি সারাটা জীবন "কাল কে শালা মইরা গেলেও ভোরে উঠুম না" ভেবে ঘুমাতে যাই আর ভোর বেলা উঠতেই হয় ...


    পথ ভাবে 'আমি দেব', রথ ভাবে 'আমি',
    মূর্তি ভাবে 'আমি দেব', হাসে অন্তর্যামী॥

    জবাব দিন
  3. জুনায়েদ কবীর (৯৫-০১)

    আমি একটা সিস্টেম করছি... :-B
    আমার সকালে উঠতে হয় সাড়ে ৮টায়...একটা এলার্ম দিছি ৭ টায় আরেকটা সাড়ে ৮ টায়...৭ টার এলার্ম বন্ধ করে যখন দেখি আরো দেড় ঘন্টা আছে...কি যে শান্তি লাগে...তারপর জটিল একটা ঘুম দিয়ে সাড়ে ৮ টায় উঠি... 😀


    ঐ দেখা যায় তালগাছ, তালগাছটি কিন্তু আমার...হুঁ

    জবাব দিন
  4. রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)

    আমার কাছ থিকা অলরেডি আমার বড় মেয়ে ৫ মিনিট পিক করছে।
    সাড়ে তিন বছর বয়সেই তাকে স্কুলের জন্য ঘুম থেকে তোলা হলে সে বলে,
    আম্মু (হাসি দিয়ে) আর পাঁচ মিনিট ঘুমাই!


    এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : লুবজানা (২০০৫-২০১১)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।