ভীষ্মকাপ

গৌরচন্দ্রিকা-
(ভারতীয় পূরাণ মহাভারতে পান্ডব ও কৌরবদের পিতামহের নাম ভীষ্ম।প্রায় গোটা মহাকাব্যেই তাকে ভীষ্ম বলে ডাকা হলেও তার প্রকৃত নাম দেবব্রত।বিশাল এই মহাকাব্যের শুরুর দিকে তার জন্ম ও নামকরণের কারণের বর্ণনা পাওয়া যায়। বিমাতা সত্যবতীর বাবার ইচ্ছা অনুযায়ী আজীবন কৌমার্যব্রত পালন ,হস্তিনাপুরের সিংহাসনের দাবীত্যাগ ও আজীবন হস্তিনাপুরের রাজ্যপ্রধানের সেবায় নিয়জিত থাকার কঠিন প্রতিজ্ঞা করেছিলেন বলে তার নাম হয় ভীষ্ম। যার অর্থ কঠিন প্রতিজ্ঞাকারী।)
কানকথা-
ও এম এস এর ন্যায্যমুল্যের চাল নয়,সিডর আইলা পীড়িত অঞ্চলে বিশুদ্ধ পানি কিংবা পানি বিশুদ্ধকরণের ট্যাবলেট নয়, যাকাতের কাপড় কিংবা এক টুকরা মাংসের জন্য বিত্তবানের বাড়ির সামনেও নয়, এই লাইন টিকেটের জন্য। বিশ্বকাপের টিকেট। বিশ্বকাপ ক্রিকেটের টিকেট। যে টিকেটের জন্য এক এক জন ক্রিকেট প্রেমী এক এক জন ছোটখাট ভীষ্ম হয়ে যাচ্ছেন। ত্রিশ ঘন্টার মত ঠায় দাঁড়িয়ে থেকেছেন সিটি কিংবা অগ্রণী ব্যাংকের লাইনে। কামড়েছে মশা, দাঁত বসিয়েছে শীত আর কুয়াশা। একজন রাত দশটার সময় ছিলেন লাইনের সামনের দিকে।তারপর মধ্যরাতে স্থানীয় রাজনৈতিক লেবাসের কর্মীরা এসে তাদের সরিয়ে নিজেদের লোক দাঁড় করিয়ে দিয়ে চলে গেছে। দিনে লাঠি নিয়ে এসেছে পুলিশ। তারাও গজারির ডাল চালিয়েছে সমানে। ঠিক বীরেন্দর শেবাগ, শহিদ আফ্রিদি কিংবা আমাদের তামিম ইকবালরা উইলো কাঠের ব্যাট যেভাবে চালান। ডানে, বামে। কখনো কভার ড্রাইভের নান্দনিকতায় পা লক্ষ্য করে। কখনো পুল হুকের উন্মত্ততায় পিঠের উপর। যারা পিঠে কুলো বেঁধে যাননি তাদের নির্ঘাত বাসায় এসে শরীরে আয়োডেক্স লাগাতে হয়েছে। কারো পিঠে খেয়েও পেটে সয়েছে। হাতে পেয়েছেন টিকেটের ভাউচার। কারো পেটে সয়নি। ক্লান্ত শরীর, আর তিক্তরা স্বাদের সঙ্গে ব্যথার বাড়তি উপহার নিয়েই বাড়ি ফিরেছেন। আর নিজেকে স্বান্তনা দিয়েছেন, টিভিতেই তো ভালো দেখা যায়। রিপ্লে, স্কোর, সুন্দরী উপস্থাপিকা কত্তকিছু। ক্রিকেট মাঠে তো শুধু বেকুবরাই যায়।

কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়। এই দায় কার? এই ব্যবস্থাটাকে কি আরেকটু স্বচ্ছ করা যেতো না। আমাদের অফিসগুলোতে কম্পিউটার শুধুই জায়গা বদল করেছে টাইপরাইটারের সঙ্গে। আর হাতের সর্বাধুনিক মুঠোফোনটা যেন প্রযুক্তিতে আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেল এর ও আগের জমানার। একুশ শতকের আধুনিক সমাজে হালফ্যাশনের শীতবস্ত্র গায়ে দেয়া কর্মকর্তারা যে প্রস্তরযুগের মানুষের প্রযুক্তিজ্ঞান নিয়ে দিব্যি ঘুরে বেরাচ্ছেন এই ডিজিটাল স্বপ্নেও আমরা সেটা এতটা টের পাইনি। গত দুই দিনে পেলাম। সামনে আরো পাবো।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি, ট্রেনের টিকেট, পরিসেবার বিল অনেক কিছুই দেয়া যায় মুঠোফোনে। এই ব্যাপারে কি কোন মুঠোফোন সেবাদাতার সাহায্য নেয়া যেতো না! কিংবা ব্যাংকের নির্দিষ্ট শাখায় আগে থেকেই বেঁধে দেয়া সংখ্যা পর্যন্ত টিকেটের দাম জমা নেয়া যেতো না। যেমনটা হয় পুঁজিবাজারে আইপিও’র ক্ষেত্রে। অন্তত পক্ষে ভারতীয় হাইকমিশনে ভিসার আবেদনপত্র জমা দেয়ার জন্য যেভাবে টোকেন নিতে হয়, সেই নিয়মটাও কি চালু করা যেতো না।
কিন্তু করা হয়নি। কারণ যন্ত্র যে নীতি বোঝে, দুর্নীতি বোঝে না। তার কাছে ০ আর ১ ছাড়া আর যে কিছুই নেই! কিন্তু মানুষের তো অনেক রকম রঙ, পদ, লেবাস আছে। সরকারী দল আছে, বিরোধী দল আছে।মন্ত্রী, এমপি, বিসিবি কাউন্সিলর আছে। তাদের আত্মীয় স্বজন পরিবার পরিজন আছেন। যন্ত্রের তো তাদের চেনার চোখ নেই!
আসলে প্রযুক্তি জ্ঞান নয়, প্রায়োগিক যোগ্যতা নয় ভয় হচ্ছে স্বছতার। দূর্নীতির রাহুগ্রাসে আটকে যাওয়া এই দেশে সবচেয়ে অভাব স্বচ্ছতার। স্বচ্ছতাকেই সবচেয়ে ভয় পান উপরের তলার মানুষেরা। রক্তকরবীর রাজা যেমন থেকে যান লোহার জাফরি কাটা পর্দার ওপারে। অস্পষ্ট, ঝাপসা।

তাই এক এক জন ক্রিকেটপ্রেমী হয়ে ওঠেন এক এক জন ভীষ্ম। ত্রিশ ঘন্টা দুপায়ের উপর দাঁড়িয়ে, শুধু চা বিস্কুট দুই দিন পার করে অপেক্ষা করেন। ভ্লাদিমির এবং এস্ট্রোগেন যেমন গডোর জন্য অপেক্ষা করতো।

অংকে আর কথায়-
২০০৭ সালের ক্রিকেট বিশ্বকাপ হয়েছিলো ওয়েস্ট ইন্ডিজে। এই উপলক্ষ্যে চীন সরকারের অনুদানে অ্যান্টিগায় তৈরি করা হয়েছে নতুন স্টেডিয়াম, “স্যার ভিভিয়ান রিচার্ডস স্টেডিয়াম”। সেন্ট কিটস অ্যান্ড নেভিসে তাইওয়ানের অনুদানে তৈরী করা হয়েছে ওয়ার্নার পার্ক স্পোর্টিং কমপ্লেক্স। যার আসন সংখ্যা বিশ্বকাপের জন্য দ্বিগুন করা হয়েছে। অন্যদিকে সংস্কারের পরে মিরপুরের দর্শকধারণ ক্ষমতা কমেছে। শ্রীলঙ্কায় দুটো নতুন স্টেডিয়াম হয়েছে। একটির (প্রেমাদাসা, কলম্বো) উন্নতি করা হয়েছে। ভারতেও ৩টি স্টেডিয়াম (কলকাতার ইডেন ও মুম্বাইর মোহালি, চেন্নাইর চিদাম্বারাম) এর সংস্কার করা হয়েছে। এই ফাঁকে একটা তথ্য জানিয়ে রাখি। দর্শকধারণ ক্ষমতায় সবচেয়ে ছোট স্টেডিয়াম দুটো কিন্তু আমাদের! মিরপুরে ৩৫ হাজার ও চট্টগ্রামের সাগরিকায় ২০ হাজার। অন্যদিকে ভারতের বিশ্বকাপ ভেন্যুগুলোর সবচেয়ে কম দর্শকধারণক্ষমতার স্টেডিয়ামে ৩৫ হাজার দর্শক খেলা দেখতে পারে।

ক্যারিবিয়ানের বিশ্বকাপে কিন্তু স্টেডিয়ামে দর্শক হয়নি। কারণ চিরায়ত ক্যারিবিয় বৈশিষ্ট্য (যেমন বাদ্যযন্ত্র নিয়ে মাঠে ঢোকা যাবে না, “নকল” জার্সি পড়া চলবে না ইত্যাদি) গুলো আইসিসির ( পড়ুন স্পনসরদের চাপে)ছেঁটে ফেলতে চাওয়ার কারনে তাদের টিকেট বিক্রি থেকে আয়ের লক্ষমাত্রা ৪২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার অর্জিত হয়নি। গ্রুপ পর্ব থেকে ভারত ও পাকিস্তানের বিদায় নেওয়াটাও ছিলো দর্শক কমে যাওয়ার একটি বড় কারণ। সুপার এইটের যে ম্যাচটি ভারত পালিস্তান হওয়ার সম্ভাবনা ছিলো, সেটি হয়ে যায় বাংলাদেশ- আয়ারল্যান্ড (বাংলাদেশ দলের প্রতি যোগ্য সম্মান রেখেই বলছি) । স্বভাবতই মার্কিন প্রবাসী ভারতীয় ও পাকিস্তানীরা ডলার খরচ করে এই ম্যাচ দেখতে আসার আগ্রহ দেখাননি। অথচ এখানে ৬টি ম্যাচের টিকেট যে গতিতে নিঃশেষ হচ্ছে এবং যে চাহিদা তাতে মনে হচ্ছে ৬০টি ম্যাচ হলেও মানুষ টিকেট কিনবে!
অন্তিমে-
কাউন্সিলররা প্রত্যেকে ২টি করে বিনেপয়সায় ও ১৪টি লাইনে না দাঁড়িয়ে কিনতে পারবেন। নিজেদের ভাগ আদায় করে নেয়াটা তারা ভালোই শিখেছেন। শেখেননি আয়োজন দক্ষতা। বিশ্বকাপ উপলক্ষে গড়ে ওঠেনি কোন স্টেডিয়াম। স্টেডিয়াম লাগোয়া এলাকাতেও লাগেনি কোন উন্নতির ছোঁয়া।এতগুলো ব্যর্থতার পর ত্রিশ ঘন্টা লাইনে দাঁড়ানো মানুষদের বঞ্চিত করে টিকেট নিতে তাদের কি একটুও গায়ে লাগছে না? নাকি শীতের কারণে গায়ে যে ব্লেজারটা, সেটা হয়তো গন্ডারের চামড়া দিয়ে বানানো।
বিশেষ দ্রষ্টব্য- তথ্যগুলো উইকিপিডিয়া থেকে নেয়া

১,৪৬৫ বার দেখা হয়েছে

১১ টি মন্তব্য : “ভীষ্মকাপ”

  1. আহসান আকাশ (৯৬-০২)

    এক কথায় অসাধারন লেখা হয়েছে সামীউর। মনের কথা গুলো বলে দিয়েছো। গত দুদিন ধরে টিকিট বিক্রীর রিপোর্টিং গুলো দেখে এসব কথাই মনে আসছিল। আজ আবার শুনলাম মন্ত্রী আমলারা নাকি ২০টি করে টিকিট চেয়েছে প্রধানমন্ত্রীর কাছে।


    আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
    আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷

    জবাব দিন
  2. মনজুর (৮৯-৯৫)

    শুধু ভালো লিখেছো বললে, কম বলা হয়। :clap:
    সিটি ব্যাংক বনানী শাথার সামনে দিয়ে অফিস যেতে হয়। লাইন দেখি, লাইনে দাড়ানো উচ্ছল তরুণদের দেখি, দিন শেষে তাদের আশাভঙ্গের চিত্র কল্পনা করি, আর আমার শুধু মেজাজ খারাপ হয়। নিজেকে কোনো মধ্য যুগের বাসিন্দা মনে হয়। এতো ছোট-খাটো বিষয়ে এতোটা অব্যবস্থাপনা আর কোনো দেশের মানুষ চেষ্টা করেও করতে পারবে কিনা সন্দেহ আছে ।
    প্রাক্তন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা আকবর আলি খান এর এক সাক্ষাতকার নেয়ার সময় তার বলা একটা কথা মনে পড়ছে- "এদেশের কোনও উন্নয়ন করতে চাইলে, পরিবর্তন করতে চাইলে.. সক্রিয় রাজনীতি করতে হবে।রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছাড়া কোনও ধরনের পরিবর্তন সম্ভব নয়।যাও, রাজনীতিতে যোগ দাও"

    জবাব দিন
  3. কিবরিয়া (২০০৩-২০০৯)

    তাওতো ভালো ...... খালি এইটা পড়ে দেখেন।।

    শরীর মন দুইটাই চুল্কানো শুরু করল কেন জানি আমার।।


    যেমন রক্তের মধ্যে জন্ম নেয় সোনালি অসুখ-তারপর ফুটে ওঠে ত্বকে মাংসে বীভৎস ক্ষরতা।
    জাতির শরীরে আজ তেম্নি দ্যাখো দুরারোগ্য ব্যাধি - ধর্মান্ধ পিশাচ আর পরকাল ব্যবসায়ি রূপে
    - রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ

    জবাব দিন
  4. রকিব (০১-০৭)

    দায় বোধহয় আমাদের ক্রীড়া-ব্যবস্থাপকদের ঘাঁড়েই বর্তায়। মন্ত্রী মিনিষ্টারদের ক'জন আর খেলা দেখতে যাবেন, কিংবা গেলেও সেভাবে সোল্লাসে গলা ফাটিয়ে সমর্থন যোগাবেন? অথচ তাদের হাতে ২০খানা টিকেট পড়বার চান্স আছে!!! কিচ্ছু বলার নাই!


    আমি তবু বলি:
    এখনো যে কটা দিন বেঁচে আছি সূর্যে সূর্যে চলি ..

    জবাব দিন
  5. তাসনিম (২০০২-২০০৮)

    🙁 আমি নিজেও ভুক্তভোগী...হতাশ আর ক্ষোভ নয় ভাই...আমি বিষ্মিত তাঁদের উপর। মানুষ জনরে কী কষ্টটাই না দিল! সব দষ আমার বাপের। উনি মন্ত্রী হইলেই চলত... 😛

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : কিবরিয়া (২০০৩-২০০৯)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।