দ্যা গ্রেটেস্ট , মাই ওন স্টোরি- ৪+৫

সর্বকালের সেরা মুষ্টিযোদ্ধার আত্মজীবনী ‘দ্য গ্রেটেস্ট – মাই ওন স্টোরি’ । মোহাম্মদ আলীর জবানীতে লিখেছেন রিচার্ড ডারহাম।
‘কালের কন্ঠ’তে ধারাবাহিক ভাবে অনুবাদ করছি আমি। ভালো হচ্ছে নাকি খারাপ, সেই প্রতিক্রিয়া জানার জন্যে সিসিবিতে দেয়ার লোভটাও সামলানো গেল না! আজ দিচ্ছি ধারাবাহিকের পরের দুই পর্ব-

অনেক দিন ধরেই এর উল্টোটাই দেখিয়েছি । ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে জো ফ্রেজিয়ারের লেফট হুক যখন আমাকে মাটিতে শুইয়ে দিয়েছিল তখনো তাদের এমন বুনো আনন্দ দেখিনি। কিন্তু এবার আর ফ্রেজিয়ার কিংবা ফোরম্যানের মতো দানবীয় কেউ নয় বরং আমাকে হারিয়ে দিয়েছে সামান্য এক ‘লোকাল বয়’।
রিং-এ নামার আগে, আলাপের সময় হার্বাট বলেছিল, ‘ তোমার সঙ্গে লড়াইয়ের সময় কোনো স্থানীয় আর বহিরাগত থাকে না।’ ও বলছিলো, ‘তোমার বয়স বত্রিশ চলছে, আর তোমাকে লড়তে হচ্ছে তোমার চেয়েও কমবয়সী, রাফ আ্যন্ড টাফ তরুণদের সঙ্গে। তোমাকে হারিয়ে দিতে পারলে সারা দুনিয়ার নজর কাড়তে পারবে ওরা। তাই তোমাকে প্রতিপ হিসেবে পেলেই আরো বেশি তেতে ওঠে নতুনরা। তোমার কাছে হারলে কোন লজ্জ্বা নেই, জিতলেই দেদার খ্যাতি — এই ভাবনাটাই ওদের ভেতরের আগুনটাকে উস্কে দেয়।’
রিংয়ে নামার আগে আমি আর হার্বার্ট একটা নিভৃত কোণে বসে আল্লাহ’র সাহায্য চাইতাম, এটা একরকম নিয়মই হয়ে দাঁড়িয়েছিল। আজকের লড়াই নিয়ে হার্বার্ট বলেছিল, ‘তুমি নিয়মের বইয়ে লেখা সুস্থতার সব শর্তই ভাংতে যাচ্ছো’। আমি অনেকটা জোর দিয়েই বলেছিলাম, নরটনকে আমি যে কোনো অবস্থায় হারিয়ে দিতে পারি, আমি কোন ম্যাচ বাতিল করে দিতে পছন্দ করি না।
আয়নার সামনে বসে নিজের তবিত মুখের দিকে তাকিয়ে আছি। মানুষজন ককে আসছে যাচ্ছে। কেউ কোন কথা বলছে না। কেমন অদ্ভুত এক নীরবতা। আসলে আমি ভুলেই গিয়েছিলাম এটা কোনো বিজয়ীর ক নয়। সেখানে সবাই অভিনন্দন জানাতে আসে। এটা পরাজিতের জায়গা। এখানে ঠিক কী বলতে হবে কেউ সেটা জানে?
কেন হারলাম আমি? এটা চিন্তা করতে করতে ম্যাচের দ্বিতীয় রাউন্ডের ছবিগুলো ভেসে উঠলো মনের পর্দায়। নরটন আমার রণ ভেঙ্গে চোয়ালে একটা লেফট আপ বসিয়ে দিয়েছিল, আমি দেখতে পাচ্ছিলাম গ্লাভস পরা একটা হাতের সঙ্গে আমার চোয়ালের সংঘর্ষ। হঠাৎ করেই চোখের সামনে কালো পর্দা, মুখের ভেতর রক্তের নোনা স্বাদে সম্বিত ফিরে পেলাম। আমার নির্ধারিত জায়গায় ফিরে এসে ‘ডক’কে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আচ্ছা কারো চোয়াল ভেঙ্গে গেলে তোমরা কীভাবে টের পাও’?
‘তুমি যখন এভাবে হা করো’ বেশ বড় করে মুখ খুলে দেখিয়ে প্যাচিও বললো, ‘তখন কিক একটা শব্দ হবে’। ‘কিক’, হাঁ করেই আমি নিজের চোয়ালের ভাঙ্গা হাড়ের অদ্ভুত শব্দটি শুনলাম, সেই সঙ্গে প্রচন্ড ব্যথার অব্যক্ত এক অনুভূতি ছড়িয়ে পড়লো আমার চোখে- মুখে।
‘আসলেই ,তোমার চোয়াল ভেঙ্গে গেছে’ — ডাক্তারের সহজ অথচ নির্ভুল জবাব। ‘ভাঙ্গা চোয়াল নিয়ে বক্সিং চালিয়ে যাওয়া উচিৎ হবে না’, আমাকে সাবধান করে দিলো সে। যদিও সে জানে একবার রিংয়ে নামলে জেতা বা হারার আগে আমি বের হই না। মুখের ভেতরে জমা থাকা একদলা থুথু ও রক্তের মিশেল উগড়ে ফেলে পানি দিয়ে মুখের ভেতরটা ভালো করে ধুয়ে নিলাম।
এখনো ১৩ রাউন্ড বাকি এবং আমি জিততেও পারি। আমি রিংয়ের আশেপাশে একবার চোখ বুলিয়ে নিলাম, সামনেই জো ফ্রেজিয়ার আর আর্চি মুর বসে আছে, নরটনকে ওরাই শেখাচ্ছে। ওদের আজ হতাশ করে বাড়ি পাঠাতে চাই।
রিং এর ভেতরে ঢোকার আগে একদম শেষমূহুর্তে বান্ডিনি আমার কানের কাছে এসে ফিসফিসিয়ে বললো, ‘ ‘শর্টি’ তোমায় দেখছে। সে বসার ঘরে পা ভাঁজ করে বসা, সে তোমায় দেখছে, কথাটা মনে রেখো’।
কোন এক অজানা কারণে সৃষ্টিকর্তাকে ‘শর্টি’ ডাকে বান্ডিনি। এবং আমার ভাঙ্গা চোয়ালে নরটনের আরেকটা কড়া আঘাত না পড়া পর্যন্ত ও চেঁচিয়েই যাচ্ছিলো ‘শর্টি তোমায় দেখছে! সে বসার ঘরে! টেলিভিশনে তোমায় দেখছে!’।
একের পর এক রাউন্ড পেরিয়ে যেতে থাকে, আর বুঝতে থাকি ভেতর থেকে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছি আমি। কোন পালতা ঘুঁষি মারতে পারছিনা, নরটনকে কোণায় নিয়ে চেপে ধরতে পারছিনা, গেঁটেবাতের রোগির মতো অবশ হয়ে উঠেছে আমার হাত। আর চোখ দেখছে একের পর এক ধেয়ে আসা একজোড়া দস্তানা। পরে লোকে জানতে চেয়েছিলো, আমি থেমে যাই নি কেন? আমি কি জানতাম না ও আমার চেহারাটাকে একটা ছেঁড়া পুরোনো খবের কাগজের মতো বানিয়ে তুলবে? আমি জানি , এটা ব্যাখ্যার অতীত। খুব সম্ভবত আমি বিশ্বাসই করতে পারিনি যে নরটনের মতো কেউ একজন আমাকে হারিয়ে দেবে, এমনকি চোয়াল ভেঙ্গে যাবার পরেও! নির্বোধের মতো মৃত ঘোড়ায় চড়ে যুদ্ধ জয়ের স্বপ্ন দেখছিলাম আমি। আমার চোয়ালকে সে এতোটা বাজে ভাবে ভেঙ্গে দেবে এটা কল্পনাতেই আমার মাথায় আসেনি। এর একটাই ব্যখ্যা দাঁড় করানো যায়, কারণ আমি কখনো এর আগে লড়াই শেষ না করে রিং এর বাইরে আসি নি।
কে যেন দরজায় খুব জোরে ধাক্কা দিচ্ছে, ‘ডাক্তারকে ভেতরে আসতে দাও’। ক্যালিফোর্নিয়া বক্সিং আ্যসোসিয়েশনের ডাক্তার এসে পড়েছে, সে দরজা থেকে সোজা আমার দিকেই হেঁটে এলো। আমার মুখটা আলতো করে তুলে দেখতে লাগলো, যেমন নিলামের শেষে চেক কাটার আগে শেষবারের মতো জিনিষটা পরখ করে দেখে কোন ক্রেতা! রিং এর ভেতর হট্টগোল আর লড়াই এর উত্তেজনায় ব্যাথাটা বোঝা যায়নি, এখন পেশির সামান্য নড়াচড়াতেই কেন নরটনকে মনে পড়ছে!
চোয়ালটা কি ভেঙ্গেই গেছে?
কোন উত্তর নেই…
অবস্থা কতটা খারাপ?
একমাত্র এক্স-রে রিপোর্ট পেলেই সেটা বোঝা সম্ভব, ডাক্তারের উত্তর। এরপর সে ব্যস্ত হয়ে পড়লো প্যাচিও সাথে কথাবার্তায়। আমি শুধু দেখছি একজোড়া ঠোঁট নড়ছে, আর প্যাচিও’র চেহারায় ক্রমেই দুশ্চিন্তার ছাপ প্রকট হয়ে উঠছে। এসময় আবারো দরজায় কোন আগন্তুকের আওয়াজ। নিশ্চয়ই খারাপ কিছু একটা ঘটেছে, খুব খারাপ।
বেলিন্ডা কোথায়?
আবারো সবাই চুপ
অবশেষে মুখ খুললো জোসেফ, সে পাশের রুমেই আছে। তাহলে যাও কেউ একজন তাকে এখানে নিয়ে এসো, বললাম আমি। আসলে সে হলের দিকের একটা রুমে আছে, খুবই বিপর্যস্ত।
এমন সময় আবার মুখ খুললেন ক্যালিফোর্নিয়ান ডাক্তার, ‘মোহাম্মদ, আমাদের জন্য গাড়ি অপেক্ষা করছে। প্লাস্টিক সার্জনও প্রস্তুত, আমাদের এক্ষুণি যাওয়া উচিত’।
কিন্তু এসবের কোন কিছুই আমি গা করলাম না। আমার চিন্তায় শুধুই বেলিন্ডা, কোথায় সে? ওদের ঠেলে সরিয়ে আমি বেরিয়ে এলাম দরজা দিয়ে, পেছনে ছুটে এলো দুই ডাক্তার।
দরজা খুলতেই দেখলাম উল্লাসে ভাটা পড়েনি এখনো, জটলা পাকানো মানুষ গুলোর কণ্ঠে বিদ্রুপ আর চিতকার’চাপাবাজটার দিন শেষ’, ‘নরটন ঐ নিগ্রোটাকে হারিয়ে দিয়েছে’। হায় রে নিগ্রো! আজ সকালেই বিছানা ছাড়ার সময়ও নরটন ছিলো আমার মতোই একজন ‘কালা আদমি’, আর আজ সে সাদা মানুষদের আশা ভরসার পাত্র!
ব্যাথায় ভরা শরীরে সব বিদ্রুপের বাক্যবাণ উপো করে একসময় বেলিন্ডার রুম পর্যন্ত গেলাম, আমরা ঢুকে যেতেই দরজা বন্ধ করে দেয়া হলো। এ কি দেখছি আমি! দৃশ্যটা কেন নরটনের ঘুঁষির চেয়ে জোরে নাড়িয়ে দিলো আমাকে। বেলিন্ডা একটা ড্রেসিং টেবিলের সাথে বাঁধা, নিজেই নিজেকে আঁচড়াচ্ছে, মাটিতে গড়াচ্ছে। আর তাকে ধরে রাখার চেষ্টা করছে চারজন বলশালী লোক! হা ঈশ্বর।
আমাকে দেখেই মোচড় দিয়ে উঠলো বেলিন্ডা, বাঁধনগুলো আলগা হয়ে গেলো। তাকে ধরে রাখাদের একজন ছুটে গিয়ে গিঁট শক্ত করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। এই দৃশ্য দেখে মনে হলো আমার উপর যারা প্রতিশোধ নিতে চায়, আমার পরাজয়ে যাদের উল্লাস তাদের সকল প্রার্থনাই ঈশ্বরের কানে পৌঁছেছে।
আমি আস্তে করে তার মাথার কাছটায় বেঞ্চে গিয়ে বসলাম, ‘আমি ওকে কড়া ঘুমের ঔষধ দিয়েছি’, বললো প্যাচিও। বেলিন্ডার সাথেই থাকে মন একজনকে জিজ্ঞেস করলাম, কি হয়েছিলো?
‘আমি জানি না’ উত্তরে বললো মেক্সিকান মেয়েটা, ওরা যখন কেন নরটনকে বিজয়ী ঘোষণা করল তখনি ও পাগলাতে হয়ে গেলো। প্রথম দিকে ও ছিলো একদম চুপচাপ, খুবই চুপচাপ কিন্তু আমি টের পাচ্ছিলাম ওর ভেতর একটা খারাপ কিছু হচ্ছে। লড়াইতে নামার আগেই বেলিন্ডা বলছিলো অর মনে কি যেন একটা হচ্ছে, নেহাত আমার মনোযোগের খাতিরেই সবটা বলেনি। রিং থেকে দেখেছিলাম , ফল ঘোষণার পর সে চোখ ঢেকে ফেলছিলো, শুনলাম পরে সে নাকি পাশের কিছু লোককে মেরে বসেছে।

আলী-৫

‘ও (বেলিন্ডা) ভেবেছে আমি মরে গেছি’! আমি আস্তে করে গিয়ে ওকে ধরলাম,শক্ত করে, বোঝাতে চেষ্টা করছিলাম এখনো বেঁচে আছি। আমার মনে পড়ে যাচ্ছিলো আমাদের অনেক মধুর স্মৃতি। বিয়ের সময় ওর বয়স ছিলো ১৭, আর আমি তখন নিষিদ্ধ। প্রথম তিনটা বছর কি দারুণই না কেটেছিলো আমাদের । বক্সিং লড়তে দূরে কোথাও যাওয়া নেই, নিজেকে তৈরী রাখার জন্য কঠোর অনুশীলন নেই। এটা ছিলো আমার ক্যারিয়ারের সবচেয়ে খারাপ সময়, কিন্তু আমার পরিবারের জন্য সবচেয়ে মধুর।
বেলিন্ডার কপালটা আগুনের মতো গরম। এরপর ওর হাতে জড়ানো বাঁধন গুলো ঢিল করে দিলাম, একটু ঝুঁকে মুখটা ওর কানের কাছে নিয়ে ফিসফিস করে বললাম ‘ সবকিছুই ঠিক আছে, এই যে আমি এখানে’। কিন্তু বেলিন্ডার কানে এসবের কিছুই ঢুকছে না , সে শুধু বিড়বিড় করেই যাচ্ছে,‘ আলী মারা গেছে, ওরা আলীকে মেরে ফেলেছে’। ওর চোখের দিকে তাকালাম , ফ্যাকাসে হয়ে আসা চোখদুটোতে শুধুই শুন্যতা, আর আতংক।
আমার চিন্তার জাল ছিঁড়ে ডাক্তারের কথায়, ‘তোমাকে এখুনি হাসপাতালে যেতে হবে, যত দ্রুত এক্স -রে টা করানো যায় ততোই ভালো’। ‘ও আমার সঙ্গে যাবে’ বেলিন্ডাকে কিছুতেই আর কাছ ছাড়া করতে চাই না আমি। ‘ওর জন্য আরো ভালো একটা হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছি, তোমাকে হারতে দেখেই মনে হয় ও প্রচন্ড মানসিক আঘাত পেয়েছে’ ডাক্তারের সোজা উত্তর। আমি বেঞ্চ থেকে উঠে টেবিলে ওর পাশে একটু গা এলিয়ে দিয়ে কানে কানে বললাম,‘ আমি এখনো মারা যাইনি, ওরা আমাকে মেরে ফেলতে পারেনি’। ডাক্তার দুজন আমাকে বারবার তাড়া দিচ্ছিলো, কিন্তু আমাকে তখন নিজের যন্ত্রণার চেয়ে বেলিন্ডার এই অবস্থাটাই বেশি ভোগাচ্ছে। পরে সুজিকে বললাম যেন বেলিন্ডার সাথে হাসপাতালে যায় এবং ঠিকমতো দেখেশুনে রাখে।
ওরা আমাকে নিয়ে গেলো কেয়ারমন্ট হাসপাতালে,একতলা লম্বা একটা বিল্ডিং যেখানে একটাও ব্যক্তিগত কামরা নেই। কেবল আমার জন্য পাশের বিছানাটা ফাঁকা রাখা হলো। চললো এক্স রে সহ নানা পরীক্ষা নিরীক্ষা। এরপর আমাকে প্রায় উড়িয়ে নেয়া হলো অপারেশন থিয়েটারে। ‘ঘুম ভাংগলেই দেখবে, সব ব্যাথা গায়েব’ চেতনানাশক দেবার আগে শেষ বারের মতো এই কথাগুলোই আমার কানে ঢুকলো, তারপর সব অন্ধকার।

১,৪২০ বার দেখা হয়েছে

১০ টি মন্তব্য : “দ্যা গ্রেটেস্ট , মাই ওন স্টোরি- ৪+৫”

মওন্তব্য করুন : মশিউর (২০০২-২০০৮)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।