সিঙ্গেল লাইন

১.
আচ্ছা মানুষ কি পিঁপড়ে? নাকি মানুষদের পিঁপড়ে হতে এখানে পাঠানো হয়? ব্যাপারটা ঠিক বুঝে ঊঠতে পারে না তাশফিন। এখানকার সবকিছুই কেমন পিঁপড়ে পিঁপড়ে! দল বেঁধে থাকা, খাওয়া, পড়া খেলা ঘুমানো এমনকি বাথরুম অবধি ! সবখানেই লাইন, সিঙ্গেল লাইন।
দুপুরের খাবারের জন্য ক্লাসরুম থেকে বেড়িয়ে খাবার ঘরের দিকে যাচ্ছিলো তাশফিনরা। মানে তাশফিন, নাঈম, মুকুল এমন অনেক, প্রায় শ’দুয়েক ক্ষুধার্ত মুখ। সারি সারি পিঁপড়ের মতো, লম্বা লাইন করে। আকাশ থেকে দেখলে কেউ ভাববে, এই খাকি রঙ এর পিঁপড়ে গুলো আবার কারা?
খেতে যেতে একদমই ইচ্ছে করে না তাশফিনের। খেতে যাওয়া মানেই টেবিলে কারো গায়ে পানি ফেলে দেওয়া, চামচ থেকে ডাল ছিটকে পরে পোষাকে দাগ হয়ে যাওয়া এবং এসবের মাশুল হিসেবে দুপুরের বিশ্রামের সময়ের অর্ধেকেরও বেশি সময় জুড়ে দেয়ালে ঠ্যাং তুলে হাত দিয়ে মাটিতে ভর দিয়ে থাকা! গত কয়েক সপ্তাহ ধরে তাশফিনের দুপুর গুলো এভাবেই কাটছে। তারচাইতে অনেক ভালো ফুটবল মাঠের পাশের শিরিষ গাছের ছায়ায় শুয়ে ঘাসের ডাঁটি চাবাতে চাবাতে শরতের নীল আকাশে নানান মূর্তির রূপ নেওয়া আশ্চর্য্য মেঘদল দেখা। একদিন ফুটবল মাঠে ঘাসের ডাঁটি চাবিয়ে দেখেছে তাশফিন, স্বাদ মন্দ না। একটা ঘাস আছে যার ডাঁটির গোড়াটা বেশ মিস্টি! কোনটা
আবার তিতকুটে, ওয়াক! সবুজ ঘাসের বুকে হলুদ ঠোঁট ডুবিয়ে পোকা খুঁজতে থাকা খয়েরি শালিকদেরও দেখা যেতে পারে। গেটের সামনের রাস্তা দিয়ে আচমকা কোন বড় গাড়ি শব্দের ঢেউ তুলে চলে গেলে চকিত পাখিগুলো হঠাৎ উড়াল দেয়! দৃশ্যটা ভারি অদ্ভুত লাগে তাশফিনের। তাশফিনের দলছুট পিঁপড়ে হতে ইচ্ছে করে। কবিতার সেই পিঁপড়ের মতো, ”পিপীলিকা পিপীলিকা, দলবল ছাড়ি একা……”।
দলছুট হলেই সমস্যা। বড় সড় কোন লাল পিঁপড়ে হয়তো গর্জে উঠবে। তারপর তাকে ডেকে নিয়ে বলবে সিঙ্গেল লাইন ভাঙ্গা মানে মহাপাতকের কাজ করা। এই জন্য তাকে নরকের সপ্তম স্তরে দীর্ঘদিন দগ্ধ হতে হবে। পাপের প্রায়শ্চিত্য করবার জন্য তাশফিনকে তাই মধ্যদুপুরের তপ্ত পিচের রাস্তায় (অথবা পাশের স্যাঁতস্যাতে ঘাস অথবা ড্রেনে…কোনটাই কম নয়!) ডিগবাজি, গড়ানো কিংবা কান ধরে হাঁটু গেড়ে বসে থাকতে হবে। তাশফিন বুঝে উঠতে পারে না একটু বাইরে আসলে কি হয়? পিঁপড়ে সমাজে কি দলছুট পিঁপড়ে থাকে না? নাকি সেখানেও বড় বড় ডেঁয়ো পিঁপড়ে গুলো এভাবে ছোট ছোট কাল পিঁপড়েগুলোকে শুঁড় উঁচিয়ে দাবড়ে বেড়ায়?
‘তাশফিন কভার আপ’! বাঁজখাই কন্ঠে নিজের নাম শুনে ভাবনার সূতোটা ছিঁড়ে যায় তাশফিনের। দেখে, আনমনে ভাবতে ভাবতে সামনের মুকুলের সাথে বেশ একটা দূরত্ব তৈরী হয়েছে তার। সে পিছিয়ে পরেছে মানে পেছনের বাকীরাও পিছিয়ে পড়ছে। ফলে ঘড়ির কাঁটায় বাঁধা সময় থেকে কিছু মূহুর্ত পিছিয়ে পড়তে হচ্ছে সবাইকে। গুরুতর অপরাধ। শাস্তি পাবার জন্য মানসিক ভাবে প্রস্তুত হয় তাশফিন।
কিন্তু তাশফিনকে অবাক করে দিয়ে আর কিছুই করেন না কলেজ ডাইনিং হল প্রিফেক্ট শাহনূর ভাই। বোধ হয় আজকের লাঞ্চের মেন্যুটা তার খুব প্রিয়। তাশফিন ব্যাপারটা বেশ লক্ষ্য করেছে। লাঞ্চে প্রিয় খাবার থাকলে বেশ ফুরফুরে মেজাজে থাকেন শাহনূর ভাই। ছোটখাট ব্যাপারে ধমকের উপরেই ছেড়ে দেন। আজ যেমন তাশফিন পার পেয়ে গেলো। অথচ গতকাল জুতার ফিতে বাঁধতে গিয়ে পিছিয়ে পড়া শাহীনকে পুরোটা পথ ডিগবাজি খাওয়ালেন শাহনূর ভাই। শাহনূর ভাই বোধ হয় মাছ পছন্দ করেন না, তাই মাছের ঝাল শাহীনের উপর ঝেড়ে দিয়েছেন! ভাগ্যিস আজ খিচুড়ি।

২.
দ্বিতীয় তলার মাঝামাঝি একটা রূমে থাকে ওরা চারজন, তাশফিন, চয়ন, রাশিক আর ইমন। ইমন এদের মধ্যে সিনিয়র। ক্লাস এইটে পড়ে,থাকে দরজার পাশের বিছানাটাতেই। বাকী তিনজন ক্লাস সেভেন, ক্যাডেট জীবনের আয়ূ মাত্র তিন চার মাস। এরমধ্যেই রাশিকটা অনেক ভাব নেওয়া শুরু করেছে। সবকিছুতেই একটু দাদাগিরি ফলানো, সবজান্তার মত মন্তব্য করা। ইমনের আড়ালে সিনিয়র ভাইদের হাস্যকর হাস্যকর সব নামকরণ করা। এসব নাকি করতে হয়, এটাই নিয়ম। রাশিক বলে চয়নটা এখনো বাচ্চা, বাড়ির কথা ভেবে কাঁদে, মায়ের লেখা চিঠি পড়ে কাঁদে, ফেলে আসা প্লে স্টেশনটা এখন ওর দস্যি ছোটবোনটার দখলে এসব মনে করে কাঁদে। আর রাশিক তাই নিয়ে চয়নকে খেপায়। একটু কান্নাকাটি করলেও চয়ন ভালো ছেলে। কলেজে আসার আগে সে তার স্কুলের ফার্স্ট বয় ছিলো। তার আগের স্কুলের হেডমাস্টার তো তাকে ছাড়তেই চায়নি, তার বাবাকে অনেক করে বুঝিয়েছে চয়নকে রেখে দেবার ব্যাপারে। চয়নের বাবার একটাই কথা, ”বোঝেনই তো বদলীর চাকুরি”। বাবাটা কেন যে হেডমাস্টার স্যারের কথাটা শুনলো না। অবশ্য একদিক দিয়ে ভালোই হয়েছে। চয়নরা যে হাউসে থাকে , সেই হাউসটার নাম এক বিখ্যাত মনীষীর নামে। তিনি নাকি জীবনে কখনো মিথ্যা কথা বলেননি। চয়নের ইচ্ছা সেও ঐ মনীষীর মতো হবে। তারপর ওর নামে একটা ক্যাডেট কলেজের হাউসের নাম হবে। ঢোকার মুখেই ওর ছবি, সংক্ষিপ্ত জীবনী থাকবে। খাবারের শেষে ডাইনিং হল প্রিফেক্ট বলবে চয়… অ… অ …অ …ন হাউ…উস, সবাই একসাথে উঠে যাবে, কি অদ্ভুত। অনেকগুলো মানুষের সাথে মিশে থাকবে ওর নাম! ভাগ্যিস রাশিকটা এই স্বপ্নের কথা জানে না, জানলে আর উপায় থাকতো না। তবে হাউসের রঙ টা বদলাতে হবে। রংটা হবে কমলা, চয়নের প্রিয় রঙ। প্রিয়ন্তীকে কমলা জামায় অদ্ভুত সুন্দর লাগে। শেষ যেদিন স্কুল ছেড়ে চলে আসে চয়ন সেদিন ক্লাস ফেয়ারওয়েলে কমলা একটা জামা পড়ে এসেছিলো প্রিয়ন্তী। বিকেলের মরা আলোয় এতো সুন্দর লাগছিলো প্রিয়ন্তীকে! ছবিটা এখনো চোখে লেগে আছে… ভাবতেই একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে আসে চয়নের।

(একটা আইডিয়া বেশ ক’দিন ধরেই মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। অফিস শেষে ‘দিবানিশি’ বাসের জন্য টিকেট হাতে সিঙ্গেল লাইনে অপেক্ষা করতে করতে সিঙ্গেল লাইন নিয়ে একটা কিছু লেখার তাড়না। সাহস করে লিখে ফেললাম, সামনে হয়তো চলবে, হয়তো চলবেনা। এখন বলতে পারছিনা, তবে নিজেকে বেশ ‘ভারমুক্ত’ লাগছে!)

৩২ টি মন্তব্য : “সিঙ্গেল লাইন”

  1. সানাউল্লাহ (৭৪ - ৮০)

    আজ ফকক'র রিউইনিয়ন প্রস্তুতি কমিটির একটা সভা ছিল। ওখানে রিউইনিয়নের সময় কি কি খেলা হতে পারে এ নিয়ে দীর্ঘ বক্তব্য দিচ্ছিলেন ফারুক মজিদ ভাই। সিসিবির প্রিন্সিপাল হিসাবে মানে বিষয়টা মাথায় রেখে, আমি একটি প্রতিযোগিতার প্রস্তাব দিয়েছি। ৩০তম ব্যাচের পর ২০টি ব্যাচের মধ্যে প্যারেড গ্রাউন্ড :frontroll: দিয়ে ফুল চক্কর প্রতিযোগিতায় প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয়কে পুরস্কৃত করা। 😀 😀 😀

    আইডিয়াটা কেমন? কি বলেন কাইয়ুম ভাই? :grr: :grr: :grr:


    "মানুষে বিশ্বাস হারানো পাপ"

    জবাব দিন
  2. কামরুল হাসান (৯৪-০০)

    ভালো হয়েছে। আরো লিখ।
    তোর তো আজকাল প্রায়ই 'গল্প প্রসব বেদনা' হয়। 😀


    ---------------------------------------------------------------------------
    বালক জানে না তো কতোটা হেঁটে এলে
    ফেরার পথ নেই, থাকে না কোনো কালে।।

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : কাইয়ূম (১৯৯২-১৯৯৮)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।