ঝরে না পড়া সূর্যমুখীদের কথা

কেমন যেন ঝাপসা লাগছে চারিটা দিক। সিলিং এর দিকে এক দৃষ্টিতে চেয়ে আছি। সিলিং এর ইন্টেরিয়র কালারটা যে কি ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। কখনো সাদা, কখনো হলুদ, আবার কখনোবা হালকা গোলাপী লাগছে। কেমন যেন একটা ঘোর লাগা ভাব। সিলিং ফ্যানটার দিকে তাকিয়ে থাকতে ভালোই লাগছে। ছন্দিত গতিতে চরকির মত ঘুরে যাচ্ছে অনবরত। আচ্ছা এই সিলিং ফ্যান এর কয়টা পাখা? তিনটা? নাকি চারটা? ঠিক এই প্রশ্নটাই আমাকে ক্যাডেট কলেজ ভর্তি পরীক্ষায় ভাইভাতে জিজ্ঞাসা করেছিলেন একজন আর্মি অফিসার।

” হাউ ম্যানি ব্লেডস আর দেয়ার অন দ্যাট ফ্যান?”

উত্তরটা মুখস্ত ছিল কোচিং এর কল্যানে। “মে আই টার্ন অফ দ্যা ফ্যান বিফোর আই আনসার, স্যার?”

কেন জানি হঠাৎ জানতে ইচ্ছা করছে এই ফ্যানের কতগুলো পাখা। জানার উপায় নেই। কারন আমার পক্ষে উঠে গিয়ে সুইচটা বন্ধ করা সম্ভব না। ডান পা-টাতে কোন অনুভূতি নেই। বাম পায়ে অনুভূতি আছে, প্রচন্ড যন্ত্রনার একটা অনুভূতি। তবে অনুভূতিহীনতার চেয়ে যন্ত্রনার অনুভূতি শ্রেয়। সিলিং ফ্যানটা থেকে মনোযোগ সরাতে আশেপাশে তাকানো যায়। তবে সেটাও সম্ভব না। ঘাড়টা নাড়ানো যাচ্ছে না অদ্ভূত কারনে।

প্রচন্ড একটা ঘোরলাগা অনুভূতি হচ্ছে। ঠিক যেমনটা হয়েছিল বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে “উইড” বা “গাঁজা” নামক বস্তুটার ধোয়া প্রথম আস্বাদন করার পর। মস্তিস্কে কেমন শীতল একটা আবেশ ছড়িয়ে পড়েছিল। যে কোন ভাবনাই প্রচন্ড গভীর লাগছিল।

মনে পড়ে ঠিক সেই ঘোর লাগা অবস্থায় ফোন করেছিল শ্রাবনী। ঠিক কি কারনে ফোন করেছিল মনে নেই। শুধু মনে আছে মেয়েটা বুঝে ফেলেছিল যে নেশা করেছি। পরবর্তী দুই সপ্তাহ সে আমার সাথে কোন কথা বলেনি। শ্রাবনী…যার চুলগুলো তে শ্রাবন মেঘের আঁধার। শ্রাবনীর কথা যখন এসেই গেল, তার সম্পর্কে একটু বলি। কেন জানি বলতে ইচ্ছা হচ্ছে।

এই মেয়েটার সাথে আমার পরিচয় জনবহুল কোন এক বাসের ভীড়ে। আমার বাসা গ্রামে হবার কারনে প্রতিবার ভার্সিটি আসার সময় আমাকে দুই ধাপে জার্নি করা লাগে। এই বাস পরিবর্তনের কারনে সবসময় দ্বিতীয় জার্নির অনেকটা আমাকে দাঁড়িয়ে আসতে হয়। সেবার আমার যত্নশীল মা আমাকে বস্তাভর্তি চিড়া-মুড়ি দিয়ে পাঠিয়েছেন অনেকদিন আর কোন ছুটি নেই বলে। এসমস্ত জিনিস নিয়ে বাসের ভিড়ে নিজের ভারসম্য রক্ষায় হিমশিম খাচ্ছিলাম। হঠাৎ এক নারীকন্ঠের ডাকে চমকে তাকাই। এই বিশ্ব সিট-মন্দার দিনে রমনী একাই দুই সিট দখল করে বসে আছে। অবাক হয়েছিলাম বেশ। ঐটুকু ছোট্ট শরীরের জন্য দুই সিট কেন লাগবে আমার উর্বর মস্তিস্কে ঢোকেনি।

-তুমি রুদ্র না? এম. ই – এ সেকশান?
-হুম… কিছুটা অনিশ্চিত কন্ঠে উত্তর দিলাম।
-তাই বলো। আমি তো তোমার সেকশানে। চিনো না তুমি আমাকে?
-ও… আবারও অনিশ্চিত কন্ঠে উত্তর দিলাম। আসলেই চিনি না।
-সিট পাইতেছ না? এইখানে বসো।

এখানে একটা ব্যাপার বলা দরকার। আমি পুরোপুরি গোড়া ইসলামিক পরিবারের ছেলে। আমার চাচা-ফুফু, তাদের ছেলেমেয়ে সবাই মাদ্রাসায় পড়েছে। ক্যাডেট কলেজে চান্স পেয়ে যাবার কারনে শুধুমাত্র আমিই কিছুটা মুক্তবিহঙ্গ। মেয়েদের সাথে না মেশার জন্য পরিবার থেকে কঠিন শিক্ষা আছে। চাচাতো-ফুফাতো বোনের সাথেও আমরা কখনো মিশি নাই। এ কারনেই হয়তো আমি মেয়েটাকে চিনি না।

-এই সিটে কেউ নাই? ইতস্তত হয়ে বললাম।
-আরে ধুর। দুইটা সিটই আমার। তুমি বসো।
-না থাক। একটু পরই অন্য সীট ফাঁকা হবে।

মেয়েটা হঠাৎ খপ করে আমার কব্জি ধরে “ঐ পোলা, সমস্যা কি?” টাইপ একটা কঠিন দৃষ্টি নিক্ষেপ করে টেনে বসিয়ে দিল। আমি মনে মনে তওবা পড়তে লাগলাম। হে আল্লাহ, আমার এ কঠিন পাপ তুমি ক্ষমা করো।

আল্লাহ আমার পাপ মার্জনা করলেন নাকি বাড়িয়েই চললেন জানিনা, কিন্তু সেদিনের পর থেকে মেয়েটার সাথে আমার সখ্যতা বেড়েই চললো। প্রথমদিকে হলে নোটপত্র দিতে যাওয়া, পড়া বুঝিয়ে দেওয়া এসব দিয়ে শুরু। আমি আবার কিঞ্চিত ভাল ছাত্র। প্রথম সেমিস্টারে সর্বোচ্চ সিজিপিএ নিয়ে যন্ত্রকৌশল বিভাগে প্রথম হয়েছিলাম। সেই সূত্র থেকে নোট, পড়া বোঝানো, সেখান থেকে বন্ধুত্ব, আস্তে আস্তে ঘণিষ্ট বন্ধুত্বে ব্যাপারটা রুপ পায়।

নামের স্বার্থকতা রেখে শ্রাবনী বর্ষা খুব ভালোবাসে। ঠান্ডাজনিত সমস্যা থাকার পরও নিয়মিত আমাকে তার সাথে বর্ষাস্নান করতে হয়, তারপর কঠিনভাবে জ্বরে পড়তে হয়। অতঃপর তার সাথে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে হাজিরা দিতে হয়। আমাকে যন্ত্রনা দিয়ে মেয়েটা সপ্তম স্তরের আনন্দ অনুভব করে। আনন্দ কেটে যাওয়ার পর সে বেদনার অষ্টম স্তরে পৌছে যায়। বিচিত্র নারীপ্রাণ।

যেহেতু বাল্যকাল থেকে আমি বালিকাসঙ্গ বিবর্জিত, দিন কয়েকের মধ্যে ভেঙ্গেচুরে শ্রাবনী নামক মেয়েটার প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম। সমস্যা হলো বাংলা সিনেমার সেই যুগটা এখন আর নেই যে যুগে কোটিপতির মেয়ে মোটর মেকানিকের ছেলের প্রেমে পড়ে যেত। অতঃপর চৌধুরী সাহেবকে এই মর্মে নোটিশ পাঠাতো যে টাকা দিয়ে ভালোবাসা কেনা যায় না। এখন হিন্দী সিরিয়ালের যুগ। সবাই অত্যন্ত ক্লাস সচেতন। সবাই চেষ্টা করে নিজের সমমনা নয়, সমমানের একটি পরিবারের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করতে। আমরাও ব্যাতিক্রম না। শ্রাবনী বুঝতে পারে আমার ভালোবাসা টা। আমিও বুঝতে পারি যে সে বুঝতে পারছে ব্যাপারটা, এবং কোন ভবিষ্যত না থাকা সত্ত্বেও বন্ধুত্ত্বের প্যাকেজে হালকা মৌন প্রশ্রয় দিচ্ছে। এই ব্যাপারটাও খারাপ না। সমাজের আমার মত রুদ্রদের জন্য তো আবার এটাই অনেক।

শ্রাবনী প্রসঙ্গ তোলার কারন মেয়েটার কথা এই মুহূর্তে আমার খুব মনে পড়ছে। সম্ভবত সে ওয়ার্ডে এসেছিল, এবং আমার হাতটা ধরে খুব কেঁদেছে। অথবা আমি কোন স্বপ্ন দেখেছি। অদ্ভূত কোন ওষুধ কিংবা কড়া সিডেটিভ এর কারনে মস্তিস্ক পরাবাস্তব জগতে বসবাস করছে।

২.

বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর থেকে দিনগুলো খুব দ্রুত কাটতো। প্রচন্ড ব্যস্ততার মধ্যে।ব্যস্ততার কিছুটা কাজে, বেশিটাই অকাজে। পড়ালেখার পাশাপাশি আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় খেলাধুলা, বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডেও অংশগ্রহন করতাম। আমার পরিবারের কাছে অবশ্য পড়ালেখা ব্যতীত সমস্তই অকাজ। যা হোক, এসমস্ত কাজ এবং অকাজ উভয়েই বেশ পারদর্শিতা থাকার কারনে বন্ধুমহল এবং সিনিয়রমহলে বেশ শীঘ্রই পরিচিতি লাভ করলাম।

প্রথম সেমিস্টারের দু’মাস পার করার পরপরই অর্থকষ্টে পড়লাম। আসলে আমার প্রাইমারী স্কুলের হেডমাস্টার বাবার পক্ষে তিন ছেলেমেয়ের খরচ টানা সম্ভব না। বুঝলাম নিজের খরচ নিজেই চালাবার সময় এসেছে। আনিস ভাইয়ের দ্বারস্থ হলাম। আনিস ভাই নামক লোকটি আমার থেকে সাত-আট বছরের বড়। হিসেব মতে তার আরো তিন-চার বছর আগেই ভার্সিটি পাস করে যাবার কথা। রাজনৈতিক কারনে পারেননি শুনেছি। উনি ছাত্র রাজনীতির সাথে জড়িত। একটি বিশেষ দলের সহ-সভাপতি। আমার জেলাতেই উনার বাসা। জেলা সমিতির মাধ্যমে পরিচয়।

উনার কাছে গিয়েছিলাম একটা ট্যিউশানি ঠিক করে দিবেন সে আশায়। রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব বলে কিছুটা চিন্তিত ছিলাম। কিন্তু সপ্তাহখানেকের ভিতর তিনি আমাকে বেশ স্ফীত বেতনের একটা টিউশানি জোগাড় করে দিলেন। ভেবেছিলাম বিনিময়ে হয়তো তার দলে যোগদান করার প্রস্তাব দিতে পারেন। কিন্তু সেরকম কিছু হলো না। আমার অর্থসংকট কেটে গেল। আমি আবার বিভিন্ন “কাজ” এবং “অকাজে” ব্যাস্ত হয়ে গেলাম।

আজ সকালবেলা থেকে কিছুটা সুস্থ অনুভব করছি। শরীরের অনেক জায়গায় অনুভূতি ফিরে এসেছে। আমাকে আধশোয়া করে রাখা হয়েছে। জানালাটাও আজ খুলে দেয়া হয়েছে। প্রকৃতির আলো দেখতে পারছি। গত আটচল্লিশটা ঘন্টা দিন-রাতের কোন হিসাব ছিল না আমার কাছে। সূর্যটা জানালার পর্দার লেভেল থেকে বেশ ডানদিকে সরে গেছে। রোদটা সরাসরি এসে মুখের উপর পড়ছে। অস্বস্তিকর ব্যাপার। তবে এই ব্যাপারটা আমি অনেক ছোটবেলাতেই রপ্ত করেছি…ঘটনাটা বলি।

তখন সবে আমি স্কুলে যাওয়া শুরু করেছি। যেটাই দেখি, “এটা কি?” বলার বয়স চলছে তখন। স্কুল থেকে ফেরার পথে একটা সূর্যমুখী ফুলে ভরা ক্ষেত পড়তো। একদিন আমি বাবাকে ক্ষেতটা দেখিয়ে বললাম “এটা কি বাবা?”

-এটা একটা ফুল বাবা। সূর্যমুখী ফুল।
-সূর্যমুখী ফুল কেন বাবা?
– কারন এই ফুল সবসময় সূর্যের দিকে মুখ করে থাকে।
– বাবা সূর্য তো অনেক গরম…সূর্যের দিকে কেন মুখ করে থাকে? ওদের কষ্ট হয় না?
-হা হা হা…সূর্যের গরমকে ওরা ভয় করে না বাবা…ওরা অনেক সাহসী ফুল।

এই সাহসী ফুলের ভক্ত হয়ে গেলাম হঠাৎ আমি। মাঝেমাঝেই ক্ষেতের ভিতর গিয়ে শত সূর্যমুখীর মত সূর্যের দিকে মুখ করে থাকতাম। এর জন্য জীবনে কত মার খেয়েছি তার ঠিক নেই। প্রত্যেক মানুষের ছোটবেলা থেকে একটা নেশা থাকে যা সে সুযোগ পেলে বড় হয়ে যাবার পরও করতে চায়। আমি চোয়াল শক্ত করে রোদে মুখ পোড়াতে লাগলাম। কিছুক্ষন পর একজন নার্স তড়িঘড়ি করে এসে পর্দা টেনে দিল। তারপর আমার সারা মুখে ওয়াটার ট্রিটমেন্ট দিতে লাগলো। আমি আবার ঘুমিয়ে পড়লাম।

৩.

পরদিন সকালেই আনিস ভাই হাসপাতালে এসেছিলেন পুলিশ নিয়ে। উল্লেখ্য আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি রাজনৈতিক দলের দু’টি শাখা আছে। আনিস ভাই বিশেষ একটির প্রধান নেতা। তিনি কেস ফাইল করাতে চান, আমার জবানবন্দি দরকার। আমাকে গোটা বিশেক নাম হাতে ধরিয়ে দিয়েছিলেন আগেই। নামগুলোতে চোখ বুলিয়েছিলাম একবার। সবই তার প্রতিপক্ষ দলের ছাত্র। দু’একটা মিল থাকলেও বেশিরভাগই নির্দোষ। চতুর্থ বর্ষের ফার্স্ট বয়ের নামও দেখলাম সেখানে। তিনি রাজনীতির সাথে জড়িত থাকলেও মেধাবী ছাত্র। আমার একটা উক্তিতে তখন অনেকগুলো নিষ্পাপ ছাত্রের ক্যারিয়ার ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। আমি আনিস ভাইকে নামগুলা ফেরত দিয়ে বললাম ” ভাই একটারেও তো চিনি না। আমি তো শুধু পড়ে পড়ে মার খাইছি। কে মারছে দেখার সুযোগ পাই নাই।”

আনিস ভাই কিছুক্ষন ক্রুব্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন আমার দিকে। তারপর গটগট করে হেঁটে বেরিয়ে গেলেন। জানি আনিস ভাইকে রাগানো ঠিক হলো না। আমার মা-বাব আমার এই অবস্থা সম্পর্কে কিছুই জানেন না। সমস্ত চিকিৎসার দায়িত্ব আনিস ভাই নিয়েছেন। জানি না তিনি এখন খরচ দেয়া বন্ধ করে দিবেন কিনা।

ঘটনাটা শুরু গত ডিসেম্বরে। আমাদের ভার্সিটিতে কোন শহীদ মিনার নেই। বিভিন্ন মিটিং-সমাবেশে ভিসি স্যার অনেকবার শহীদ মিনার নির্মানের আশ্বাস দিলেও তা কখনো বাস্তবায়ন হয় না। সেবার প্রতিবাদটা একটু জোরেসোরেই শুরু হয়েছিল আন্দোলনের সামনের কাতারে ছিলেন রাজনৈতিক নেতারাই, পিছনে আমরা সাধারন ছাত্রজনতা। একটা প্রাইমারী স্কুলেরও শহীদ মিনার থাকে, বিশ্ববিদ্যালয়ে নেই এই লজ্জা আমাদেরকে কুরে কুরে খায়।

জোরালো আন্দোলনের প্রভাবেই হয়তো ক্যাম্পাসে শহীদ মিনার স্থাপনের একটা মোটা অংকের বিল সেবারই পাশ হলো। সবার ভিতর একটা খুশি ছড়িয়ে পড়লো রাতারাতি। অনেক বড় বাজেট এসেছে, সম্ভবত বিশাল একটা শহীদ মিনার হবে এবার। একুশে ফেব্রুয়ারীতে মনে মনে শহীদদের আত্মার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েই তুষ্ট থাকতে হবে না।

মূদ্রার উল্টাপিঠটা দেখা বাকি ছিল। বাজেট আসা সত্ত্বেও শহীদ মিনার নির্মানের কোন কাজ শুরু হলো না। রাজনৈতিক দলগুলোও আর কোন আন্দোলন করলো না। সবকিছু কেমন যেন আগের মত শান্ত হয়ে গেল। শহীদ মিনার ব্যাপারটা পুরা যেন উদ্বায়ী পদার্থের মত হাওয়ায় মিশে গেল। আমরা গোটা কয়েকজন বেশ হতভম্ব হয়ে গেলাম। বুঝলাম স্বপ্নটা স্বপ্নই থেকে যাবে। আর এটাও বুঝে গেলাম কোন রাজনৈতিক আন্দোলনই ব্যক্তিগত স্বার্থের ঊর্ধ্বে নয়। আমরা মানতে পারলাম না ব্যাপারটা।

বিভিন্ন পোস্টার বানিয়ে দেয়ালে দেয়ালে লাগাতে থাকলাম। সাধারন ছাত্রদের কেউ কেউ উৎসুক দৃষ্টিতে দু’মিনিট তাকায়, তারপর চলে যায়। কেউ কেউ ফিরে দেখেই না।  শুধুমাত্র রাজনৈতিক ছাত্ররা আগ্রহভরে দেখত এবং ক্রুব্ধ দৃষ্টি নিক্ষেপ করতো। পোস্টারে কাজ না হওয়াতে অন্য পথ ধরলাম। ভার্সিটির পাবলিক একটা ফেসবুক গ্রুপে শহীদ মিনার বাজেটের টাকা ভাগাভাগি নিয়ে তথ্যবহুল একটা নোট লিখলাম। এতে বেশ কাজ হলো। আমাদের সাথে আরো গোটা বিশেক ছাত্রকে পেলাম। আন্দোলনটা আরো সংগঠিত ভাবে করার সিদ্ধান্ত নিলাম। এভাবে ভার্চুয়াল জগতে বেশিদূর আগানো যাবে না। রাস্তায় নামতে হবে।

একুশে ফেব্রুয়ারী সকাল থেকে আমরা গোটা চল্লিশেক ছাত্র ভার্সিটির রাস্তায় মানববন্ধন করলাম ব্যানার-ফেস্টুন সহ যেগুলাতে অনেক নগ্ন সত্য লেখা। পথচারী সকল মানুষ উৎসুক হয়ে দেখতে লাগলো। কেঁচো খুড়তে তখন সাপ বের হওয়ার অবস্থা।

ভার্সিটির শিক্ষকের আসনে অধিষ্ঠিত বিভিন্ন নীতিনির্ধারক তথা গডফাদারদের নির্দেশে তাদের শিষ্য ছাত্ররা অস্ত্রপাতি হাতে রাস্তায় নেমে এলো। আমাদের কোন রাজনৈতিক ব্যাক আপ নেই। সুতরাং এটা শুধুই একমুখী আক্রমন হবে বলাই বাহুল্য। প্রথমে ভীতি প্রদর্শন করা হলো। আমাদেরকে অবাক করে দিয়ে  গোটা বিশেক ছাত্র তাতেই চম্পট দিল। যারা বাকি ছিলাম তাদের উপর শারীরিক নির্যাতন শুরু করা হলো। সহ্য করতে না পেরে আরো অনেকেই আন্দোলন ত্যাগ করলো।

আমার রক্তে তখন একটা জেদ চেপে গেছে। হার মানতে ইচ্ছা করলো না। আমার উপর অত্যাচার চলতেই লাগলো। আন্দোলন প্রত্যাহার এবং ফেসবুক নোট মুছে দিতে বলা হলো। আমি অস্বীকৃতি জানালাম। আমার গালে হঠাট একজন প্রচন্ড জোরে চড় কষে বসল। আমার মস্তিস্কে হঠাৎ দপ করে আগুন জ্বলে উঠলো। গোটা বিশেক সশস্ত্র ক্যাডারের সামনে তার তলপেটে প্রচন্ড জোরে একটা লাথি কষে বসলাম। তারপর আর কিছু ঠিকমত মনে নেই। রড পাইপের ঝড় নেমে এলো আমার উপর। জ্ঞান হারাবার আগ মুহূর্তে চোখের সামনে লাল আলো দেখছিলাম।

মাথাটার ভিতর প্রচন্ড তীক্ষ্ণ একটা যন্ত্রনা হচ্ছে হঠাৎ। এখন অনেক রাত। নার্সরা হয়তো বাইরে গল্প করছে। তাকে দাকার শক্তি আমার এই মুহূর্তে নেই। যন্ত্রনায় ফেটে যাবে মাথা টা। শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল অবশ একটা অনুভূতির স্রোত খেলে গেল। শরীরটা অস্বাভাবিক ভাবে কাঁপতে শুরু করেছে। হঠাৎ আমার মনে হতে থাকে আমি মারা যাব।

নার্স ছুটে এলো শব্দ পেয়ে। আমাকে দেখে সিরিঞ্জে তড়িগড়ি করে একটা কেমিক্যাল পুল করে আমার বাম হাতে পুশ করলো। তারপর আবার ওয়াটার ট্রিটমেন্ট দিতে শুরু করলো। আধো আলোয় নার্সের কিঞ্চিত শংকিত মুখটা দেখা যায়। কেমন একটা মায়া লাগে আমার। প্রথম থেকেই অনেক যত্নে রেখেছে আমাকে। “ক্রিমিয়ার যুদ্ধের” ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেলের কথা মনে পড়ে যায়। যে রাতের বেলা আলো হাতে রোগী দেখে বেড়াত। সে আলোয় “লেডি উইথ দ্যা ল্যাম্পের” মুখে যুদ্ধের মৃতপ্রায় রোগীরা জীবনের আলো খুঁজে নিত।

আমার মস্তিস্কটা আবার অবশ হয়ে আসে। ঘোলাটে লাগছে চারিদিক। আমার গ্রামের সূর্যমুখী বাগানটার কথা মনে পড়ছে। একদিন ঝড়ের পর সেখানে গিয়ে দেখছিলাম সমস্ত গাছ মুড়ে গেছে, সমস্ত ফুল ঝরে গেছে। কাঁদতে কাঁদতে বাসায় এসে বাবার কাছে নালিশ দিয়েছিলাম ঝড়ের বিরুদ্ধে। বাবা হাসতে হাসতে বলেছিলেন,

“সূর্যমুখীরা কি এত সহজে মরে রে পাগল ? গাছ নেই তো কি হয়েছে, বীজটা তো মাটিতেই রয়ে গেছে। আগামীবার দ্বিগুন সূর্যমুখী ফুটবে।”

আমাকে অবাক করে দিয়ে সেবার সত্যিই দ্বিগুন সূর্যমুখীতে ছেয়ে গিয়েছিল ক্ষেত।

শেষকথাঃ

রুদ্রের অবস্থা চূড়ান্ত খারাপের দিকে রুপ নেয়ায় তাকে রাজধানীতে উন্নত চিকিৎসার জন্য নেয়ার পথে মস্তিস্কে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে তার মৃত্যু হয়। তার এই মৃত্য সাধারন ছাত্রসমাজ সহজভাবে নেয়নি। পরবর্তী সপ্তাহখানেক দেশের বিভিন্ন বিভাগীয় শহরে প্রেসক্লাবের সামনে মৌন মোমবাতি মিছিলে অংশ নেয় হাজার হাজার শিক্ষার্থী। রুদ্রের বিশ্ববিদ্যালয়ে খুব শীঘ্রই দেশের দ্বিতীয় বৃহৎ শহীদ মিনার নির্মানের কাজ শুরু হয়।

রুদ্রের মা ও বোনেরা রুদ্রের মৃত্যুকে আজও সহজভাবে নিতে পারে না। ক্ষনে ক্ষনে চঞ্চল রুদ্রের ছবি ভেসে ওঠে সামনে। রুদ্রের বাবা রুদ্রের মৃত্যুর পর একফোঁটা চোখের জল ফেলেননি। শূন্য দৃষ্টিতে স্কুলের শহীদ মিনারটার বেদিতে বসে সময় কাটান আজকাল।

টিভি চ্যানেলগুলোতে যখন হাজার হাজার শিক্ষার্থীর এই মৌন মিছিল দেখায়, প্রথম কাতারে সবসময় শ্বেতশুভ্র কাপড় পরিহিত একজন তরুনীকে নিশ্চল নয়নে মোমবাতি হাতে দেখা যায়। শ্রাবনীকে তারপর থেকে কখনো রঙ্গীন পোশাকে দেখা যায় নি।

সবচেয়ে অদ্ভূত খবর হলো, এই ঘটনার পর সারাদেশব্যাপী হঠাৎ একটা বিরাট ছাত্রগোষ্ঠী একতাবদ্ধ হয়েছে যাদের সাথে কোন রাজনৈতিক দল বা সংগঠনের যোগাযোগ নেই।

উপরোক্ত গল্পে কেউ সত্য কোন কাহিনীর ছায়া খুঁজে না পাওয়াই ভাল। খুঁজে পেলে আরো  ভাল।

১,৭৮৯ বার দেখা হয়েছে

২২ টি মন্তব্য : “ঝরে না পড়া সূর্যমুখীদের কথা”

  1. শরিফ (০৩-০৯)

    মীরজাফর মানে যেমন বিশ্বাসঘাতক তেমনি ছাত্ররাজনীতির অপর নাম হয়ে দাঁড়িয়েছে সন্ত্রাসবাদীদা এবং নিজেদের আখেরি গুছানো । এদেশের বর্তমান ছাত্র রাজনীতি দিয়ে দেশ ও জাতির কল্যাণ সম্ভব নয় ।

    উপরোক্ত গল্পে কেউ সত্য কোন কাহিনীর ছায়া খুঁজে না পাওয়াই ভাল।

    তা এই গল্পের প্রথমেই বুঝেছিলাম 😀

    লেখা ভাল হইছে :thumbup:

    জবাব দিন
  2. রেজা শাওন (০১-০৭)
    সূর্যমুখীরা কি এত সহজে মরে রে পাগল ? গাছ নেই তো কি হয়েছে, বীজটা তো মাটিতেই রয়ে গেছে। আগামীবার দ্বিগুন সূর্যমুখী ফুটবে।”

    চমৎকার..বাস্তবতা রুঢ় হবেই। তারপরও আশাবাদী হতে সমস্যা কোথায়?

    জবাব দিন
    • নাজমুস সাকিব অনিক (০৩-০৯)

      ছাত্র রাজনীতির একটা বিরাট অংশ জুড়ে রয়েছে শিক্ষকরা...বুয়েটে কিছুদিন আগে আজীবন বহিস্কৃত ছাত্ররা শুনলাম সবাই পরীক্ষায় অংশ নিয়েছে...আর ঐ আন্দোলনে যেসব সাধারন ছাত্র সামনের কাতারে ছিল তাদেরকে পরীক্ষায় অংশগ্রহন করতে দেয়া হয়নি...

      কই ফুটবে সূর্যমুখীরা? মাটিই তো অনুর্বর... 😐

      জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : রেজা শাওন (২০০১-২০০৭)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।