বাঁচি অন্যের জন্য

এটা প্রায় দেড় বছর আগের কথা। বারডেম হাসপাতালে গিয়েছিলাম ব্লাড ডোনেট করতে। একজন প্রৌঢ়, বয়স ৭০/৮০ হবে, ডায়াবেটিক। ইঁদুর জাতীয় কোন প্রাণীর কামড় থেকে ইনফেকশন, সেখান থেকে গ্যাংগ্রীন, তাই পা কেটে ফেলতে হবে। ভদ্রলোকের পরিবার-পরিজন সবাই সেখানে উপস্থিত। ছেলে-মেয়ে, তাদের স্বামী-স্ত্রী-সন্তান। সবাই বিহারী। ভাঙ্গা ভাঙ্গা উর্দু, আরও ভাঙ্গা ইংরেজী, এবং তার চেয়েও করুণভাবে ভাঙ্গা বাংলা মিলিয়ে কোন এক ভাষায় তারা আমার সাথে কথা বলছিলেন। যার শতকরা ৯০ ভাগই আমার বোঝার ক্ষমতার বাইরে। তবে এটা বুঝেছিলাম যে একজন অপরিচিত মানুষ স্বেচ্ছায় রাত ১০টার সময় এসেছে, এটা তাদের কাছে অনেক বড় একটা ব্যাপার। যা হোক, কাগজপত্র পূরণ-ক্রস ম্যাচিং স্যাম্পল এবং সব শেষে ব্লাড ড্র করার পর তাঁর দুই ছেলে আমাকে বাইরে নিয়ে গেলেন। ডিনার করে এসেছি-একথা বার বার বলার পরও জোর করে ধরে কাচ্চি বিরিয়ানি খাওয়ালেন (বলতে লজ্জা নেই, ব্লাড ডোনেশনের পর এই ব্যাপারটা মজাই লাগে)। তারপর ফিরে এসে ভদ্রলোককে দেখতে গেলাম। সম্ভবত কোন সেডাটিভ দিয়ে তাঁকে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছিলো। এরপর আমি চলে যাওয়ার সময় তার পরিবারের প্রায় সবাই আমার সাথে বাইরে এলেন। রাত ১২টার মত বাজে। নিজেরা দৌড়াদৌড়ি করে আমাকে বুয়েট পৌঁছে দেবার জন্য একটা রিকশা ঠিক করে দিলেন। সবশেষে রিকশায় করে আমি যখন চলে আসছিলাম, তখন তারা তাদের দুর্বোধ্য ভাষায় আমাকে কিছু একটা বলার চেষ্টা করছিলেন। আমি সেই কথাগুলো বুঝিনি, কিন্তু তারা কি বলতে চেয়েছেন তা ঠিকই বুঝেছি। মানবিক অনুভূতিগুলো বোঝাবার জন্য কোন ভাষার দরকার পড়ে না। তাদের চোখের দিকে তাকিয়েই তাদের কৃতজ্ঞতাবোধটুকু বুঝে নেওয়া যায়। এরপর আরো অনেকদিন এই পরিবারটার সাথে আমার যোগাযোগ ছিলো। প্রায়ই আমাকে ফোন করতেন। মনে আছে, পরের দিন আমি ক্লাসে ছিলাম। এমন সময় ফোন করে আমাকে তারা জানান যে অপারেশন সাক্সেসফুল। এরপর সময়ের সাথে সাথে কোন একভাবে পরিবারটার সাথে আমার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।

তার কয়েক মাস পরের ঘটনা। কোন এক বিচিত্র কারণে কোন হাসপাতাল তা মনে পড়ছে না। এখানেও একজন বৃদ্ধ, সরকারী অফিসে কোন একটা ছোটখাটো পদে চাকরী করতেন, অনেকদিন আগেই রিটায়ার্ড। তাঁর স্ত্রী অসুস্থ, ব্রেস্ট ক্যান্সার। পেনশনের সব টাকা খরচ করে, ভিটেমাটি বেচে, সকল সঞ্চয়, নিজের শেষ কপর্দকটুকুও খরচ করে গত ২ বছর ধরে স্ত্রীর চিকিৎসা করাচ্ছেন। তিনি নিজেও জানেন, স্ত্রীর বাঁচার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। তাও তিনি সারাদিন পড়ে থাকেন হাসপাতালে, তাঁর স্ত্রীর পাশে। নিজের নাওয়া-খাওয়ার কোন ঠিক-ঠিকানা নেই। তাঁদের এই নিঃস্বার্থ, নিখাদ ভালোবাসা দেখলে কিউপিডও লজ্জা পাবে। যাই হোক, সেই ব্যাপারে আমি লিখছি না। বৃদ্ধ আমাকে একটা টং-এ নিয়ে গেলেন, চা, কেক, বন, কলা খাওয়ালেন; আর আমাকে বললেন তাঁর জীবনের কথা, তাঁর স্ত্রীর কথা, পরিবারের কথা। না, তিনি আমাকে পোলাও-বিরিয়ানি খাওয়াননি, তাঁর সে সামর্থ্য ছিলো না। কিন্তু তিনি আমাকে এমন একটা জিনিস দিয়েছেন, যার মূল্য পৃথিবীর আর কোন কিছু দিয়ে মাপা যায় না; যে জিনিসটা পাওয়ার জন্য আমি সারাজীবন সংগ্রাম-সাধনা করতে রাজী আছি। তিনি আমাকে মন থেকে আশীর্বাদ দিয়েছেন, আমার মাথায় হাত রেখে দোয়া করার সময় আমাকে জড়িয়ে ধরে ঝরঝর করে কেঁদে দিয়েছেন! নিজেকে খুব ছোট মনে হচ্ছিলো সে সময়। কি করেছি আমি? আমি কি আসলেই এর যোগ্য? এমন কি করতে পেরেছি? জীবন থেকে দুটো-তিনটে ঘন্টা ব্যয় করলাম, এই তো! ওই সময়টায় হলে থেকেও যে বেশ উজির-নাজির মেরে ফেলতাম এমনও তো না। সে তো মুভি দেখে, গেম খেলে, পলাশীর মোড়ে আড্ডা মেরেই নষ্ট করতাম!

তবে এই দুটো ঘটনা থেকে একটা জিনিস বুঝতে পারলাম। সেটা হল, আরেকজন মানুষের মুখে হাসি ফোটানো খুব কঠিন কোন কাজ না। একজন মানুষ যখন প্রাচুর্যের মধ্যে থাকে, শারীরিক, মানসিক, অর্থনৈতিক- সব দিক দিয়ে স্বচ্ছল থাকে, তাকে খুশী করাটা হয়ত অত সোজা না, তাই সে এই ব্যাপারটা বুঝতেও পারে না; কিংবা বোঝার চেষ্টা করে না। কিন্তু সেই না বোঝার সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্য খুব কম সংখ্যক মানুষের থাকে। বিশ্বাস করুন, আপনার আশেপাশে এমন অনেক মানুষ আছে, আপনার মুখের একটা কথাও যার কাছে অনেক বড় পাওয়া।

এতক্ষণ ধরে এত কিছু লিখলাম, এখনো আসলে যা বলতে চাচ্ছি সেই বিষয়টাতেই আসিনি। কয়েকদিন আগে খবর পেলাম যে আমার পরিচিত একজনের মধ্যে সুইসাইডাল বিহেভিয়ার দেখা যাচ্ছে। শেষ পর্যন্ত সে আত্মহত্যা করেনি, হয়ত সে তার স্বাভাবিক চিন্তাধারা ফিরে পেয়েছিলো। কিন্তু সবার ক্ষেত্রে এই ব্যাপারটা হয় না। তার প্রমাণ প্রতিদিন একবার খবরের কাগজে চোখ বুলালেই পাওয়া যায়। আর কারণগুলোও ঘুরেফিরে কয়েকটা জেনেরিক ক্যাটাগরিতেই পড়ে যায়। ব্যর্থ প্রেম, পারিবারিক সমস্যা ইত্যাদি ইত্যাদি। ব্যক্তিগতভাবে আমি আত্মহত্যাকে সর্বোচ্চ পর্যায়ের কাপুরুষত্ব মনে করি। আমার কাছে আত্মহত্যা মানে জীবনের কাছে পরাজিত হয়ে যাওয়া। অনেকে প্রশ্ন তুলবে, যে আত্মহত্যা করে, তার পরিস্থিতিতে না পড়লে আমি কখনই তাদের মানসিক অবস্থাটা বুঝতে পারব না- তাই আমার ধারণাটাও ভুল। হয়ত সেটাই সত্যি। আবার এটাও সত্যি হতে পারে যে, সেরকম পরিস্থিতিতে আসলে আমিও পড়েছি, কিন্তু নিজের জীবনকে শেষ করে দেবার মত ভয়াবহ চিন্তাটা মাথায় আসেনি। যেটাই সত্যি হোক, এই ব্যপারে আমি নিশ্চিত যে, একজন সুইসাইডালের চেয়ে অন্তত এখন আমার চিন্তা ভাবনা পরিষ্কার, স্বচ্ছ। আমার মাথায় শুধু একটা প্রশ্ন, আমার জীবন কেন অন্য কেউ কিনে নেবে? অন্য কারো একটি কথা বা একটি কাজ কেন নির্ধারন করবে যে আমি বাঁচব কি বাঁচব না? আমার জীবন কি শুধু ঐ একজন-দুজন মানুষকে নিয়েই?

এই যে প্রথমদিকে এত বকবক করলাম, তার একটাই উদ্দেশ্য। অন্য মানুষকে নিজের মৃত্যুর কারণ না, বরং অন্য মানুষকে বেঁচে থাকার কারণ বানাও। খুব কাছের কেউ কষ্ট দিয়েছে? জানি সেটা সহ্য করা কঠিন। কিন্তু আরও অনেক মানুষ যে তুমি চলে গেলে কষ্ট পাবে, আরো অনেক মানুষকে যে চাইলেই তুমি খুশি করতে পারতে পারতে তাদের কি হবে? তুমি যে কষ্ট পেলে, তা তোমার পাওনা না, কিন্তু তার শোধ নেওয়ার জন্য আরো যতজনকে কষ্ট দেবে, তাদেরও কি সেটা প্রাপ্য? তাহলে তোমাকে কষ্ট দেওয়া সে মানুষটা আর তোমার মধ্যে পার্থক্য কি থাকল? মানুষকে খুশি করা খুব সহজ। একটু চোখ-কান খোলা রাখলেই বোঝা যায় তা। আর সে জন্য খুব বেশি কিছু করাও লাগে না, শুধু মুখের দুটো কথাও অনেকের জীবন পরিবর্তন করে দিতে পারে। তোমার একটা কথা, একটা উপদেশ, একটু হাসি, একটু অনুপ্রেরণা, একটা ছোট্ট সাহায্য, বা নিজের জীবনের কিছুটা সময় তাকে দেওয়া-অনেকের কাছে অনেক বড় কিছু; হতে পারে সে আপন পরিবারের কেউ, কোন আত্মীয়, একজন বন্ধু, কিংবা নিতান্তই অপরিচিত কেউ। কিন্তু তাদের জন্য হলেও আমাদের বাঁচা দরকার। নিজের জীবনকে আনন্দময় করতে না পারি, অপরেরটাতো করা যায়। এবং বেঁচে থাকার জন্য এটুকুই অনেক বড় কারণ। আর পুরোন একটা কথা তো থেকেই যায়, কোন সমস্যাই চিরস্থায়ী নয়। সব কিছুরই একটা মেয়াদ থাকে। জীবনের দুঃখ-কষ্টগুলোও এই নিয়মের বাইরে নয়।

পৃথিবীতে বেঁচে থাকাটাই সবচেয়ে আনন্দের কাজ। অভিমানের মৃত্যুতে কোন সুখ নেই, কোন গৌরবও নেই। যদি কখনো মৃত্যুর একটা কারণও মাথায় আসে, তার বিপরীতে বেঁচে থাকার এক হাজারটা কারণ খুঁজে বের করা যায়। এটাই এই প্রকৃতির অদ্ভুততম সৌন্দর্য। সেই সৌন্দর্যটা যেন সবাই আমরা উপলব্ধি করতে পারি, আমরা যেন অপরের জন্য বাঁচতে শিখতে পারি।

৮০৫ বার দেখা হয়েছে

২ টি মন্তব্য : “বাঁচি অন্যের জন্য”

মওন্তব্য করুন : নাফিস (২০০৪-১০)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।