এ ট্রিপ টু রিমেমবার-২

[নবাবের মত অফিসে এসে আরাম করে মাত্র ল্যাপটপ খুলছি, দেখি মেসেঞ্জারে তানভীরের নক, ব্লগ লিখে ফেলছে,একটু পরেই পাবলিশ করবে। ড্রাফট কপি পড়তে বসলাম…ওমা,একি!এত ছোট কেন??শুরু না হতেই শেষ! তানভীর আস্বস্ত করল,এটার সিরিজ হবে। আমার মাথায় তৎক্ষণাৎ হাজার ওয়াটের বাত্তি জ্বলে উঠল আর বুদ্ধি দিয়ে বসলাম,তাইলে রিলে সিরিজ কর! বলেই বুঝলাম, মামা!গলদ জওয়াব!! আমি তো খাল কাইটা কুমির আনিনাই, পুরা কুমিরের খালে পা ডুবায়ে দিছি!
যে বা যাহারা লেখক এর জায়গায় তানভীরের বদলে টুম্পা দেখে দুবার চোখ কচলে নিচ্ছেন, তাদের জন্য এই দুখভারি ইতিহাস। যাই হোক, এইসব ইতিহাস বাদ দিয়া এখন চলেন যাই, আমরা পোখরা ঘুরে আসি…
..
]

পোখরায় আমাদের দিন শুরু হল হোটেলের ছাদে ফিশটেল/মাচ্ছাপুচ্ছ্রে দেখা দিয়ে। সূর্যের আলো ঠিকরে তার শ্বেতশুভ্র চূড়া জ্বলজ্বল করছে। আহাহা…কি দেখলাম! প্রথম দর্শনেই সব্বার ভীষন আপন লেগে গেল দুরদুরান্ত থেকে দেখা ঐ পাহাড়টাকে। পশ্চিমদিক থেকে দেখতে এর চূড়াটা মাছের লেজের মত,তাই তার এ নাম। মাচ্ছাপুচ্ছ্রের দুই পাশে সারে সারে দাঁড়ানো হিউঞ্চুলি আর অন্নপূর্ণা রেঞ্জ।পাহাড় সমান মুগ্ধতা নিয়ে ছাদের ঢালু টালি বেয়ে নেমে আসলাম আমরা,দিন যে সবে শুরু …

হোটেলের ছাদে আমরা, পিছনে ফিশটেল

হোটেলের ছাদে আমরা, পিছনে ফিশটেল

পেটপুরে নাস্তা করে আমরা নেমে পড়লাম আগের রাতে ম্যাপ দেখে করা প্ল্যান এক্সিকিউশনে। হোটেলের একটু সামনেই দোকান থেকে মহা উৎসাহে সাইকেল ভাড়া করা ফেলা হল।ব্যাপক উদ্দীপনার সাথে প্রথম মোড়টাও ঠিকঠাক পার হয়ে গেলাম সবাই। মজাটা টের পেলাম তার ঠিক একটু পরেই যখন চড়াই শুরু হল। মাঝ রাস্তায় এসেই সবার দম শেষ,গলা টলা শুকায়ে পুরা সাহারা মরূভূমি… তৎক্ষণাৎ আমরা গোল মিটিং করে প্ল্যান-বি ঠিক করে ফেললাম। সাইকেল ফেরত দিয়ে এবার শুরু হল মাইক্রো জার্নি।

১০০ রুপী দিয়ে কেনা পোখরা সিটির ম্যাপ

১০০ রুপী দিয়ে কেনা পোখরা সিটির ম্যাপ

বিন্দ্যবাসিনী মন্দির দিয়ে আবার শুরু হল পোখরা দর্শন। মন্দিরে এক চক্কর ঘুরে রওনা দিলাম মাহিন্দ্রা গুফা’র উদ্দেশ্যে। ছোট একটা পার্কের মত জায়গা, ঢুকে প্রথমেই সিঁড়ি চলে গেছে মাটির নিচে, শুরুর কিছুটা অংশ পাকা করা,এরপর জাস্ট মাটি। একটু ভিতরে ঢুকতেই নিজেকে আন্ধা মনে হইল,কিচ্ছু দেখিনা! চশমা নিতে ভুলে যাওয়ায় নিজের উপর খানিকটা রাগ লাগতেছিল,আন্ধার দেখে সেই দুঃখ ভুলে গেলাম। আস্তে আস্তে অন্ধকার সয়ে আসল চোখে,আমরাও অল্প বিস্তর ধাক্কা খেতে খেতে আগাতে লাগলাম। গুহার মাঝামাঝি দেখি এক শিবলিঙ্গ,পুজারী ও আছেন সাথে। অবশেষে গুহার আরেক প্রান্তে সরু আলোর রেখা দেখা গেল। গুহার অন্ধকার যুগ পার হয়ে হাতে পায়ে মাটি মাখামখি হয়ে এক্সিট পয়েন্ট দিয়ে বের হয়ে আসলাম একে একে!
কথায় বলে ন্যাড়া নাকি বেলতলায় দুবার যায়না। আমরা গেলাম,আবারো। মাহিন্দ্রা গুফা’র বগলমেহি আরেকটা গুফা,ব্যাট কেইভ। অবশ্য এইবার আমরা কিঞ্চিত চালাক হইছি পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে,তাই মনে করে একটা চার্জলাইট ও ভাড়া করে নিতে ভুললাম না। ঢুকেই সবার প্রশ্ন, ব্যাট কেইভে ঢুকলাম, রবিন ও সাথেই আছে, মাগার ইয়ে ব্যাটম্যান কিধার হ্যায়?? অচিরেই সেই উত্তরও পাওয়া গেল। কেইভের মাঝে এক জায়গায় ছাঁদ জুড়ে দেখা গেল রবিনের বস দের,আই মিন ঝাঁকভর্তি কালাবাদুড় দের।

ব্যাট কেইভ

ব্যাট কেইভ

গুফা পর্ব শেষে আমাদের মূল লক্ষ্য হল ডেভিড’স ফল (david’s fall)। সেখানে যাওয়ার পথেই পড়ে গুরখা মিউজিয়াম, কে.আই.সিং পুল আর ভদ্রকালী মন্দির। পুল থেকে পোখরার ঠিক বুক চিরে বয়ে চলা ষ্বেতী নদীর দারুণ ভিউ দেখা যায়। তিনটা স্পটেই একটু করে বুড়ি ছুঁয়ে গেলাম, আর সেই সাথে ভাবওলা কিছু ফটোসেশন তো আছেই।
ডেভিড’স ফল নিয়ে অনেক কথা আগেই শুনে আসছিলাম। জনৈক ডেভিড সাহেব হঠাৎ করে ভেসে আসা পাহাড়ী স্রোতের ঢল থেকে স্ত্রীকে বাঁচাতে গিয়ে মারা যান,সেইথেকেই এই নামকরন।(বেচারা ডেভিড সাহেব! এই যুগে এই ভুল মানুষে করে!!) আসলেই জোশ একটা জায়গা। আকাঁবাঁকা পাহাড়ী পথ বেয়ে, কোথাও কোথাও বিপন্ন সব গর্ত তৈরী করে ঝর্ণা বয়ে চলেছে তার নিজস্ব ছন্দে । প্রকৃতীর অদ্ভূত শিল্পকর্মে স্তব্ধ আমরা তাকিয়েই রইলাম অনেকক্ষণ এই স্রোতস্বিনীর পানে…

ডেভিড'স ফলের সামনে টুম্পা-জহুরুল

ডেভিড'স ফলের সামনে টুম্পা-জহুরুল

ফিউয়া লেক থেকে দেখা যাচ্ছে মাচ্ছাপুচ্ছ্রে

ফিউয়া লেক থেকে দেখা যাচ্ছে মাচ্ছাপুচ্ছ্রে

ডেভিড’স ফল এর ঠিক পাশেই পোখরার সবচে বিখ্যাত ট্যুরিস্ট স্পট, ফিউয়া লেক। লেকের মাঝে ছোট্ট একটা দ্বীপে বরাহী মন্দির। ঢুকে কিছুক্ষণ কারো মুখে কোন কথা সরলো না। যতদূর চোখ যায় শুধুই নীল আর নীল। লেকের টলটলে কাকচক্ষু জল ঘিরে রেখেছে পাহাড়ের নীল গালিচা। সময় নষ্ট না করে দুইটা নৌকা ভাড়া করে আমরা নৌবিহারে নেমে পড়লাম। দুই দিন ধরে হিন্দি বলে বলে জান খারাপ, নৌকায় উঠেই তাই শুদ্ধ বাংলায় আড্ডা শুরু হয়ে গেল। আমাদের অবাক করে দিয়ে মাঝি ভাই ও দেখি বাংলায় কথা বলে উঠল। আমরা তাকে বাংলাদেশের কথা বললাম এবং হঠাৎ করেই এই ভিন দেশে বসে নিজের দেশের প্রতি অন্যরকম এক ভালোবাসার টান অনুভব করলাম। দিন দুনিয়ার আড্ডায় আর গানে একসময় ধীরে ধীরে পশ্চিমের আকাশটা জুড়ে লালচে আভা ছড়িয়ে পড়ল। এতক্ষণ বকবক করতে থাকা এই আমরা হঠাৎ ই নিশ্চুপ হয়ে শুধু চেয়ে রইলাম । মাচ্ছাপুচ্ছ্রে তখনো অস্তগামী সূর্যের লালচে কিরণ টুকু বিলিয়ে দিচ্ছে হ্রদের স্বচ্ছ্ব বুকে……

(চলবে…)

৪,৭২৬ বার দেখা হয়েছে

৫৯ টি মন্তব্য : “এ ট্রিপ টু রিমেমবার-২”

  1. আন্দালিব (৯৬-০২)

    প্রথম ব্লগ হিসেবে খুবই চমৎকার লেখা! নেপালের বর্ণনা পড়ে অনেক গুছিয়ে লিখেছেন বুঝা যায়।
    তানভীর ভাইয়ের ব্লগে একবার বলেছি, দেখি আপনি পরের পর্ব দিয়ে দিলেন! এখন এখানে পরের পর্বের কথা বললে সেটা কে লিখবেন? 😕

    জবাব দিন
  2. ওয়াহিদা নূর আফজা (৮৫-৯১)

    আজকে বাসায় তারাতাড়ি যেতে হবে। সিসিবি এক ঝলক দেখেই বন্ধ করে দিব ভেবেছিলাম। লেখকের জায়গায় তোমার নাম দেখে পড়তে শুরু করলাম। খুব সুন্দর লেখা। তোমার বর জহুরুল? আর কোন নাম আছে? তুমি কোথায় কাজ করো?

    অফটপিকঃ সিসিবিতে দিন দিন নারী লেখকদের সংখ্যা বাড়ছে দেখে খুবই ভাল লাগছে।


    “Happiness is when what you think, what you say, and what you do are in harmony.”
    ― Mahatma Gandhi

    জবাব দিন
  3. টুম্পা (অতিথি)

    সবাইকে অনেক অনেক অনেক ধন্যবাদ এত মন্তব্যের মাধ্যমে আমাকে উৎসাহিত করার জন্য 🙂 🙂
    আমার বাসার পিসিতে খুবি ট্রাবল দিচ্ছে, কারোই মন্তব্যের 'জবাব দিন' অপশন এ লিখতে পারছিনা ~x( পিসির প্রব্লেম ঠিক হলেই সবাইকে অ্যানসার দিব ।
    আর একটা কথা না বললেই না, আমার প্রথম লেখাও কখনোই হতো না যদি তানভীর তাড়া না দিত। ওর গুতাগুতির চোটেই এই লেখা। সো, অল দি ক্রেডিটস গোজ টু তানস !

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : আহমদ (৮৮-৯৪)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।