আলো

১.
বাবুপুরা গ্রামের হাফ কিলো দক্ষিণে রেল লাইনটা সোজা পূর্ব থেকে পশ্চিমের দিগন্তে মিশেছে যেন। এই গ্রামের দু’তিন ক্রোশের মধ্যেও কোন স্টেশন নেই। তবু জোছনা রেল লাইনের পাশে বসে ট্রেনের অপেক্ষায় আছে। চারদিকের অন্ধকার এখানো কাটেনি। তবে পূবের আকাশ ফর্সা হয়ে আসছে। ট্রেন আসতে সেই আটটা বাজবে। সে পর্যন্ত অপেক্ষা করতে সে রাজী আছে। তবে এর মধ্যেই তার বাবা আজীজ চেয়ারম্যান টের পেয়ে যাবেন যে, সে বাড়ি থেকে পালিয়েছে। তারপর ট্রেন আসার আগে হয়ত তাকে ফিরিয়ে নিতে আসবেন। জোছনা সে পর্যন্তও অপেক্ষা করতে রাজী আছে।
সে তো বেশ স্পষ্ট করে লিখেই এসেছে। সে চলে যাচ্ছে। ট্রেনে করে। আর কোনদিন ফিরবে না।

তার বাবা নিয়ম মাফিক জীবনে অভ্যস্ত। বাড়ির মসজিদের মুয়াজ্জিনের আজানের আগে ওঠেন তিনি। কতবার এমনও হয়েছে মুয়াজ্জিনকেই আজান দিতে ডেকে তুলেছেন বাবা। উঠেই তিনি কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করেন বাড়িময়। আধিভৌতিক অন্ধকারে টর্চ জ্বেলে এটা ওটা দেখেন তিনি। বাড়ির কোন গাছটা কতটুকু হয়েছে, কোন গরুটা দুর্বল হয়ে পড়ছে। তারপর ওজু করে চলে যান ফজরের নামাজে। ততক্ষণে জোছনাকেও উঠতে হয়। কেবল জোছনা নয় এ বাড়ির প্রতিটা প্রাণীকেই উঠতে হয়। বাবা নামাজ থেকে ফিরে জোছনার হাতে এক কাপ চা খান। আজও এই রুটিনের ব্যত্যয় হবে না। তবে আজ তিনি চা পাবেন না। আর তখনই জোছনার খোঁজ পড়বে। তার খোঁজ মানেই তার ঘর, তার ঘর মানেই তার চিঠি যেখানে স্পষ্ট করে তার চলে যাওয়ার কথা লেখা আছে। পড়ার পরই হয়ত বাবা তাকে ফিরিয়ে নিতে আসবেন। অথবা পাত্তাই দেবেন না। জোছনা তুমুল উত্তেজনা নিয়ে অপেক্ষায় আছে সেই ক্ষণটার।

জোছনা প্রতীক্ষায় থাকুক আমরা নজর দেই তার বাড়ি থেকে চলে আসার কারণের দিকে।

২.
মা মরা বড় অভাগী মেয়ে জোছনা। তার মা তাকে জন্ম দিতে গিয়েই নাকি মারা যান। এই গল্প এতবার সে শুনেছে যে সে নিজে যেন এখন পুরো ঘটনা স্পষ্ট দেখতে পায়।
তার মা আমেনা বেগম ছিলেন মৃত প্রসবা। বেশ কয়েকবার এমন হওয়ার পর বাবা তাকে নিয়ে কোন মাজারে যান। ইমাম সাহেব এসবকে কুফরী কাজ বলেছিলেন। বলেছিলেন ইসলামে মাজার করা নিষেধ আছে। লাভের লাভ কিছুই হয়নি। মাজার থেকে ফিরেও আরো এক মৃত সন্তানের জন্ম দেয় সে যথাপূর্বম। তখন সবাই তাকে পরামর্শ দেয় শহরে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়ার জন্য। আজীজ সাহেব রাজী হননি। ডাক্তারের ক্ষমতা কি আল্লাহর চেয়ে বড় নাকি? জবাবে তাদের পারিবারিক মসজিদের মুয়াজ্জিন কাম ইমাম হিজরত আলী বলেছিলেন- আপনি তেনারে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যান সেটাই মনে হয় আল্লাহ চান। আজীজ সাহেব পাত্তা দেননি। এই গাঁয়ে তার কথাই সব। আর তার কথা সামান্য মাইনের ইমামের কথায় টলে না।
এই সময় আমেনা বেগম বেশ একটা বুদ্ধি করেন। তার ভাইকে খবর দেন। বুদ্ধি পরামর্শ করেন। সে অনুযায়ী পরবর্তী প্রসবের ঠিক মাসখানেক আগে আজীজ সাহেবকে না জানিয়ে বাপের বাড়ি চলে যান তিনি। আজীজ সাহেব শিকদার বাড়ির দীর্ঘদিনের অমিমাংসিত শালিসি করতে গিয়েছিলেন। এই দিনটার অপেক্ষাতেই ছিল আমেনা বেগম। তখন শারীরিক ভাবে খুবই দুর্বল সে। পেট ভারী। আগে থেকে পরিকল্পনা ছিল বলে ভাই তার এলাকা থেকে নৌকা নিয়ে এসেছিলেন। এই এলাকার কোন মাঝির ধরে ক’টা মাথা যে আজীজ সাহেবকে না জানিয়ে তার বৌকে বাপের বাড়ি পৌঁছে দিবে। তার এই ভাই-ই ডেলিভারীর সময় তাকে শহরে নিয়ে গিয়েছিলেন।
মাস দুয়েক বাদে বেশ ফুটফুটে একটি পুত্র সন্তান নিয়ে খুশি মনে বাড়ি ফেরেন আমেনা বেগম। ভেবেছিলেন পুত্রের মুখ দেখে হয়ত আজীজ সাহেব তার আগের অপরাধটা ক্ষমা করে দেবেন। ভুল ভেবেছিলেন তিনি। আসা মাত্রই তাকে আবার বাপের বাড়ি পাঠাতে উদ্যত হয়েছিলেন আজীজ সাহেব। শেষে কান্না কাটি, পায়ে আছড়ে পড়া, কত কি!

আজীজ সাহেবের মেজাজ জেনেও আমেনা বেগম এমন সাহসী উদ্যোগ কি করে নিয়েছিলেন সেটা জানতে হলে গ্রামের নিয়ম কানুন সম্পর্কে একটু জানতে হবে। সেই সময় বিজ্ঞানের প্রসার এতটা হয়নি। গ্রামের মানুষ ভ্রান্ত কিছু ধারণার উপর বেঁচে থাকে, কিংবা মরে যায়। এই যেমন আমেনা বেগমের কথাই ধরা যাক। বারবার মৃত সন্তান প্রসব করে সে মোটামুটি ‘অপয়া’ খেতাব পেয়ে বসেছিল। ক্ষমতাবানের বউ বলে হয়ত সবাই সামনে বলত না, তবে তার শ্বাশুড়ি ছাড়ত না। এমনকি মাজার থেকে ফিরেও যখন আরেক মৃত সন্তান প্রসব করেছিল তখন শ্বাশুড়ি আজীজ সাহেবকে আর একটা বিয়ের কথা বলেছিলেন। কাজেই আমেনা বেগমের এ বাড়িতে টিকে থাকা নিয়ে সংশয় তৈরী হয়েছিল। সে কারণেই এমন সাহসী উদ্যোগ নিতে বাধ্য হয়েছিলেন তিনি।

আমেনা বেগম তার এক পুত্র নিয়েই বেশ সন্তুষ্ট ছিল। কিন্তু আজীজ সাহেব নয়। এই ঘটনার পাঁচ বছর পর আবার সন্তানের চেষ্টা নিলেন তিনি। যখন দেখলেন আমেনা বেগম জীবিত প্রসব করে, তাও আবার পুত্র সন্তান, আবার না জানিয়ে বাপের বাড়ি যাওয়ার রাগটাও অনেকটা পড়ে এসেছে, তখন। তাতে তার লাভ ছিল। একটি মাত্র ছেলে না থেকে তার যদি গন্ডায় গন্ডায় ছেলে থাকে তাহলে তার ক্ষমতার আরো বৃদ্ধি হয়। আরো দশটা গাঁয়ে তার কদর বাড়ে।

আগের মতই আমেনার জন্য আতুঁরঘর তুলে দিলেন গোয়াল ঘরের পাশটায়।সারাদিন সেখানে থেকে থেকে অতিষ্ট হয়ে উঠতো আমেনা। তবু নিয়ম বলে কথা। আতুঁর ঘরে সবার প্রবেশও সংরক্ষিত ছিল। কেবল কাজের মেয়ে আম্বিয়ার মা আসত খাবার নিয়ে। কথাবার্তা যা হত তার সাথেই।
-বেগম সাব, এইরম স্বামীর ঘর করার চাইতে দোজোখে থাকাও ভাল। আপনার বাপ ভাইরা তো বড়লোক, যান না, তাগো কাছে গিয়া থাকেন।

আম্বিয়ার মার কথায় কাজ হয়েছিল। আমেনা বেগম চলে গিয়েছিলেন। তবে ভাইদের কাছে নয়, বাপ আর মায়ের কাছে। বছর দশেক আগেই গত হয়েছিলেন তারা। আমেনা বেগম চলে গেলেন, রেখে গেলেন এই জোছনাকে।

৩.
জন্মের পর থেকে বেশ ক’বছর জোছনা জানে না সে কিভাবে বড় হল। তবে শুনেছে সে নাকি তার দাইমার দুধ খেত। তারও জোছনার প্রায় সমবয়সী একটি মেয়ে ছিল। একটু বড়। তবে শৈশব থেকে কৈশোর জোছনার বন্ধু বলতে সেই মেয়েটাই, কুসুম।
জোছনার এও জানা নেই তার বাবা তাকে আদর করত কিনা। পুত্র প্রত্যাশী কেউ মেয়ে পেলে অখুশি হওয়ারই কথা। শুধু এইটুকু মনে আছে তার বাবা একবার কি এক কারণে অন্ধকার রাতে গোয়াল ঘরে আটকে রেখেছিলেন। পরবর্তীতে এ ঘটনা হয়ত বাবাই ভুলে গেছেন কিন্তু তার মনে আছে। অন্ধকার রাত, চারদিক শুনশান, একলা একটা ছোট্ট মেয়ে, কাঁদতে কাঁদতে চোখও শুকিয়ে কাঠ। সেদিন গাই গুলোকে ওর বড় আপন মনে হয়েছিল। অন্তত মানুষের চেয়ে নিরাপদ।

আরো একবার তাকে এমন অন্ধকারের শিকার হতে হয়েছে, সে বেশিদিন আগের কথা নয়। ক্লাস ফোর পর্যন্ত পড়ার পড়েই বাবা তার পড়ালেখা বন্ধ করে দিলেন। তার চারপাশ অন্ধকার হয়ে এল। ফাইভের ক্লাস শুরু হলেই সে চুপি চুপি ক্লাস করতে গিয়েছিল। কিন্তু বাড়িতে আজীজ সাহেবের চোখকে তো আর ফাঁকি দেয়া যায় না। ঠিকই জানলেন । তারপর এক গভীর রাতে হুঙ্কার দিলেন
– এত স্কুলে যাওয়ার শখ! যা, এখন স্কুল ঘর থেকে ঘুরে আয়।
তারপর একটা গাছের ডাল দিয়ে বললেন
– এই ডাল পুতে আসবি স্কুলের মাঠে। আমি সকালে গিয়া দেখব।
তখন রাত বারো টা কি একটা বাজে। গ্রামে অল্পেই নিশুতি নামে। একা একা তাকে পাড়ি দিতে হয় মাইল খানেক পথ।
তবু বাবাকে সে ভালবাসে, কারণ তার মা মারা যাওয়ার পর তার আরো দুঃখ বাড়াতে বিয়ে করেনি লোকটা। বউ নেই, মা মরা মেয়ে জোছনার প্রতি স্নেহ আছে বিশেষ। কেবল পুরোনো কিছু ধ্যান ধারণা লোকটাকে অমানুষ করে দেয় মাঝে মাঝে।

এই যেমন জোছনার ভাই রফিকের কথাই ধরা যাক। তার থেকে বছর পাঁচেকের বড়। বাপের টাকায় খায় দায় আর ঘুরে বেড়ায়। বাবা মেয়ে বলে জোছনাকে পড়াতে না চাইলেও রফিকের পড়ার ব্যাপারে বেশ সিরিয়াস ছিলেন। কিন্তু ক্লাস এইটের পর ঠেলেও তাকে আর স্কুলে পাঠানো গেল না। বাবা বাধ্য হয়ে বছর দেড়েক আগে বিয়ে দিয়ে দিলেন। সেখানেও তার ক্ষমতা প্রসারের ব্যাপার ছিল। আর ছিল বিশাল অংকের যৌতুক। এলাকায় তার মতই আরেক প্রভাবশালী লোক আনিস খাঁ। তার কিশোরী মেয়েকে বউ করে আনলেন ঘরে। যৌতুকে ঘর ভরে গেল আজীজ সাহেবের।

ইমাম সাহেব অবশ্য বেশ কয়েকবার চেষ্টা করেছেন এ বিয়ে ঠেকাতে। চেয়ারম্যানের ছেলের বিয়ে কিশোরীর সাথে হল কি শিশুর সাথে হল তাতে ইমামের কিছু যেত আসত না। কিন্তু ইসলামী শিক্ষায় আরো জ্ঞানী হওয়ার জন্য ইমাম সাহেব প্রায়ই শহরে যান। এছাড়াও তার পরিবার থাকে শহরে। সেখানে গেলে সমাজ সম্পর্কে তার জ্ঞান আরো বাড়ে। আজীজ সাহেবের পছন্দ না হলেও তিনি এ সুযোগটা হিযরত আলীকে দেন। এলাকার সবচেয়ে জ্ঞানী আর শিক্ষিত ইমাম পুষছেন বলেই তো বাজারের চেয়েও তার বাড়ির মসজিদে জুম্মাবার বেশি ভীড় হয়।
ইমাম সাহেব শহরে গিয়ে শিখেছেন কেনো অল্প বয়সী মেয়েদের বিয়ে বিপজ্জনক, কেন যৌতুক নেয়া অপরাধ। সেই জ্ঞানই তিনি আজীজ সাহেবকে দিতে চেষ্টা করেন। কিন্তু আধুনিক নিয়ম কানুনে ভরসা নেই তার, যেমন নেই ইমামের কথায়। তবে এই বিষয়গুলো হিযরত আলী জোছনাকে শেখান। আজীজ সাহেব তার স্কুলে যাওয়া বন্ধ করলেও পর্দা রেখে এখনও কোরান শিক্ষাটা চালিয়ে যাচ্ছেন। ইমাম তাকে শেখায়। এই কোরান শিক্ষার মাঝে জোছনার আচমকা কোন প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে এই সমস্ত জ্ঞান বিলি করেন।
সে কারণেই এই বাল্য বিবাহের ঘোর বিরোধী ছিল জোছনাও।

কিন্তু আজীজ সাহেবকে দমিয়ে রাখা কষ্ট। তার উপর অসচেতন রফিকেরও কোন অমত ছিল না। কাজেই বিয়েটা হতে দেরী হয়নি। আজীজ সাহেব বিয়ের পরদিনই রফিককে ডেকে ফরমান জারি করেন
– বিয়ে করেছিস, এবার তাড়াতাড়ি আমি তোর ছেলের মুখ দেখতে চাই
রফিক তার বাবার কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করে। দু’মাসের মাথায় রফিকের বউ নাজমা গর্ভবতি হয়ে পড়ে।
প্রায় সমবয়সী বলে নাজমার সাথে বন্ধুত্ব হতে দেরী হয়নি জোছনার। তাই ইমামের শিক্ষা কিছুটা হলেও নাজমাকে দিতে চেষ্টা করেছে। নাজমা অত শত না বুঝলেও এটা বুঝেছিল যে অল্প বয়সে সন্তান নিলে মেয়েদের শারিরীক ঝুঁকিতে পড়তে হয়। এমনকি অনেক সময় এর পরিনাম মৃত্যু পর্যন্তও গড়ায়। সে ভয়ে ভয়ে কথাটা তার স্বামীর কানে তোলে। অশিক্ষিত রফিক খুব একটা কেয়ার করে না।
নাজমা গর্ভবতী হওয়ার মাস খানেকের মধ্যেই একটা ঘটনা ঘটে। নাজমা খবর পায় তার বান্ধবী কুসুম মারা গেছে।
কুসুমের সাথে তার ছিল গভীর সখ্যতা। সেই শৈশব থেকে। এমনকি কৈশোরে যখন তার শারিরীক পরিবর্তন গুলি হয় তখন বেশ ঘাবড়ে গিয়েছিল সে। লজ্জায় কোনকিছু সে কাউকে বলতে পারত না। সে জানত এসব বিষয় অন্য মেয়েরা তার মায়ের কাছ থেকে শোনে। কিন্তু তার তো মা নেই। তাই কুসুমই ছিল তার একমাত্র ভরসার জায়গা। কুসুম তার চেয়ে খুব বেশি বড় ছিল না। বছর খানেক হবে হয়ত। এই বড়তেই সে যেন তার অভিভাবক বনে গিয়েছিল।
ঠিক সেরকম সময়ে হুট করে একদিন কুসুমের বিয়ে হয়ে যায়। বেশ অসহায় হয়ে পড়ে জোছনা। মাঝখানে তার গর্ভবতী হওয়ার কথা শোনে। এমনকি সন্তানের জন্ম দিতে বাপের বাড়িতেও আসার কথা ছিল। কিন্তু তার বদলে তার মৃত্যুর খবর আসে।
জোছনা খুব ভয় পেয়ে যায়। বাবা আর ভাইকে বোঝাবার চেষ্টা করে। বাবা ধর্মের কথা মানে বলে হিযরত আলীকে দিয়েও কথা বলিয়েছে সে। কিন্তু কোনো কিছুতেই কোনো কাজ হয় না।

জোছনা তাই অন্য পদ্ধতি ধরেছে। সে চেষ্টা করছে নাজমার ঝুঁকি কমাতে। সে পরিবার পরিকল্পনা আপার কাছ থেকে বিভিন্ন বই নিয়ে এসেছে নিরাপদ মাতৃত্বের। সেই অনুযায়ী যতœআত্তি করছে নাজমার। সারাক্ষণ থাকছে পাশে পাশে। তার এই বাহুল্য নিয়ে আজীজ সাহেবের ও রফিকের কম কথা শুনতে হয়নি। দুনিয়ায় যেন এক নাজমাই সন্তান নিচ্ছে, আর কেউ বুঝি সন্তান নেয় না। তবু জোছনা কিছুই মানছে না। কারণ পরিবার পরিকল্পনার বই পড়তে গিয়ে সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তার মত মাতৃহারা আর একটি শিশুও যেন আর না জন্মায়।
নাজমার ডেলিভারীর সময় প্রায় হয়ে আসে। তখন সে প্রসবকালীন স্বাস্থ্য সচেতনতা বিষয়ে পড়ে আর সেই অনুযায়ী কাজ করে। ডেলিভারীর জন্য নাজমাকে হাসপাতালে নিতে চেয়েছিল, কিন্তু আজীজ সাহেবের বাড়ির বউ ঘরের বাইরে বের হতে পারবে না। তার বাবার সাফ জবাব।

তখন সে তাদের প্রাক্তন দাইমাকে নিয়ে যায় প্রশিক্ষণের জন্য । দাইমাও উৎসাহী হয় কারণ মাত্র কিছুদিন আগে এক অশিক্ষিত দাইয়ের হাতে মরণ হয় তার মেয়ে কুসুমের।
প্রস্তুতি শেষ হলে হলেও দেখা যায় শেষ মুহূর্তে বেশ অসুস্থ হয়ে পড়ে নাজমা। দাই মা জানান তার হাতে আর কিছু নেই। এখন এক আল্লাহ আর দুই ডাক্তার বাঁচাতে পারেন। আজীজ সাহেব আল্লার হাতেই সব ছেড়ে দিতে চাইলেন। তখন আবার ইমাম সাহেব তাকে তার স্ত্রীর মৃত্যুর কথা স্মরণ করিয়ে দেন। বউয়ের কষ্ট দেখে রফিকও ডাক্তারের কথা বলে। কিন্ত তাতে নিয়ম টলে না।

অতএব জোছনাই দৌঁড়ায় ডাক্তার আনতে। হিযরত আলী তার সঙ্গ দেয়। ডাক্তার এনে দেখে নাজমার অবস্থা যায় যায়। ডাক্তার এলে নিরাপদ ডেলিভারীর মাধ্যমে একটা পুত্র শিশুর জন্ম দেয় নাজমা।
এমন দৃশ্যে বোকা রফিকও কেঁদে ফেলে।

৪.
তারও কিছুদিন পর
রফিক বেশ সাবধানী এখন। নিয়মিত সে নাজমার প্রসব পরবর্তী যতœ নিচ্ছে । নিয়ম করে স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্রে যায়। স্বাস্থ্য কর্মী আপা এলে নিজেই উৎসাহী হয়ে অনেক কিছু জেনে নেয়। এসব জেনে এখন সে গর্ভনিরোধক ব্যবহার করে । এমনকি ছোট পরিবার করার জন্য আর একটি সন্তান নেবে বলে ঠিক করেছে। তবে সেটা এই ছেলের বয়স ৪ হলে তারপর । বাবার ঘর ছেড়ে সে আলাদা ঘর নিয়েছে। হাটে নিজের চেষ্টায় একটা দোকান ও দিয়েছে।
আর জোছনা? বিয়ের কথা অনেকদিন থেকেই চলছিল তার। তবে সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তার বয়স ১৮ হওয়ার আগে সে কোনো মতেই বিয়ে করবে না । তবে এবারের ছেলেটাকে বুঝি ঠেকানো গেল না। ছেলে ব্যবসা করে। খুব বড়লোক। বংশ, চেহারা ইত্যদি দেখে গলে গেছে আজীজ সাহেবের মন। এমন ছেলে হাত ছাড়া করা মানে লক্ষ্মী পায়ে ঠেলা।
ঠিক এরকম এক সময় জোছনা ঘর ছাড়ল, শেষ রাতে। আর লিখে আসল-
বাবা,
মা, কুসুমের মত ভাবীকেও পর তুমি মরণের দিকে ঠেলে দিয়েছিলে। তবু তোমার শিক্ষা হল না? এবার আমাকেও একই দিকে ঠেলতে চাইছ? তিলে তিলে ওইভাবে মরার চেয়ে নিজে একবারে মরাই ভাল। আমি চলে যাচ্ছি। ট্রেনে করে। আর কোনদিন ফিরব না। মায়ের পাশেই পারলে কবর দিও। আর ক্ষমা কর
ইতি

৫.
পূবের আকাশ লাল করে সূর্য উঠেছে। রেল লাইনের পাশে গাছটায় হেলান দিয়ে ঝিমুনির মত এসেছিল জোছনার। ট্রেনের শব্দে আড়মোরা ভাঙে সে। ট্রেন কাছাকাছি চলে এসেছে! সময় ঘনিয়ে এসেছে তার। একটা দীর্ঘ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ইঠে দাড়ায় সে। তাকাবেনা ভেবেও তাকায় সে ফেলে আসা গ্রামের দিকে। দেখে উত্তর দিক থেকে একটা লোক দৌড়ে আসছে। আকার প্রকার দেখে লোকটাকে জোছনার বাবার মতই লাগছে।

* যে যে বিষয়গুলো থাকাটা বাধ্যতামূলক ছিল [ইসলামের নামে ভ্রান্ত গ্রামীণ বিশ্বাস, অস্বাস্থ্যকর জন্ম পদ্ধতি, শিশু নির্যাতন, মেয়েদের প্রতি বৈষম্য, যৌতুক প্রথা, সন্তান গ্রহণে অন্যের সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়া, মেয়েদের বয়:সন্ধিকালীন পরিবর্তন, বাল্য বিবাহের কুফল, নিরাপদ মাতৃত্ব, গর্ভকালীন সেবা, দাই প্রশিক্ষণ, নিরাপদ প্রসব, প্রসব পরবর্তী সেবা, গর্ভ নিরোধক ব্যবহার, যথা সময়ে পরিবার পরিকল্পনা গ্রহণ ও ছোট পরিবার]

২,৫৪৪ বার দেখা হয়েছে

৪১ টি মন্তব্য : “আলো”

  1. মাহমুদ (১৯৯০-৯৬)

    গল্পের গাঁথুনী বেশ ভালো। কিন্তু গল্পের মূল ভাবটায় শক্ত দ্বিমত।
    যতই পড়ছিলাম, ততোই এই প্রচারমূলক ভাবটা স্পষ্ট হয়ে উঠছিলো। সবশেষে সেটাই দেখলাম সংক্ষেপে।

    শুধু এইটুকুই বলি, গল্পের অন্তর্নিহিত 'মেসেজ'টা একেবারে একপেশে। উদাহরণ দেই,

    কেবল পুরোনো কিছু ধ্যান ধারণা লোকটাকে অমানুষ করে দেয় মাঝে মাঝে।

    নতুন অনেক ধ্যান-ধারণাও অমানুষ বানায়। যেমন, জাতীয়তাবাদ।

    এরকম আরো আছে। তবে এরজন্য দায়টা তোমার না, দায় আমাদের তথাকথিত 'বিজ্ঞানসম্মত' উন্নয়ণ-বিষয়ক জ্ঞান যেটা ধর্মীয় গোঁড়ামীর যায়গায় আরেকটা নতুন গোঁড়ামী নিয়ে এসেছে।


    There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx

    জবাব দিন
    • টিটো রহমান (৯৪-০০)

      বস এই গল্পে প্রেজেন্টেশনের স্টাইল ছাড়া আমার আর কোন দায় নেই..........পুরো ব্রীফের পয়েন্টগুলো গল্পে যেন উঠে আসে আমার দায়িত্ব ছিল সেটা...

      টিবিতে উন্নয়নমুলক যে নাটিকা গুলো হয় সেরকম একটা কিছুই তারা বানাতে বলেছিল....আমি সেটাকে একটু সাসপেন্স টাসপেন্স এনে ফিল্মের উপোযোগী করেছি.........

      ৩৫ মিনিটের একটা ফিল্মে একসাথে এত বিষয় টানলে সেটা আসলে কতটুকু এফেক্টিভ সেটাও একটা প্রশ্ন. তবু এরা যুগের পর যুগ এই করে আসছে.......

      আপনার মূল্যবান মতামতের জন্য :salute:


      আপনারে আমি খুঁজিয়া বেড়াই

      জবাব দিন
  2. ফয়েজ (৮৭-৯৩)

    ভালো লিখেছো।

    চরিত্রের বাধ্যবাধকতা আছে কিনা বুঝছিনা। গ্রামের পুরোনো ধাইকে দিয়ে পজিটিভ কিছু বলাতে পার কিনা ভেবে দেখ। মানে ধাই নিজেও বলছে ডাক্তার দেখানো দরকার, যেটা সে তার অভিজ্ঞতা দিয়ে বুঝতে পারছে।

    ধাই প্রথা নিয়ে কিছু কুসংস্কার আছে, সেটাও ভেংগে ফেলা দরকার।


    পালটে দেবার স্বপ্ন আমার এখনও গেল না

    জবাব দিন
  3. আহসান আকাশ (৯৬-০২)

    বরাবরের মতোই অসাধারন... যে ম্যাসেজ দিতে চেয়েছিলেন সেটা অত্যন্ত সুন্দর ভাবে ফুটে উঠেছে... :boss: :boss: :boss:


    আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
    আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷

    জবাব দিন
  4. মেহবুবা (৯৯-০৫)

    আর এক টা সুন্দর জিনিস লিখে ফেললেন ভাইয়া......।। :boss:
    খুব বেশি সুন্দর হইসে......। :clap:
    শেষ টা খুব ড্রামাটিক হইসে। :clap: :clap:
    আহারে আমাদের মাসরুফ ভাই রে পারট টা দিয়া দেন না 😀

    জবাব দিন
  5. কামরুলতপু (৯৬-০২)

    ভাইয়া আপনার লেখা মানেই অন্যরকম কিছু।
    সময়ের সংকটে ছিলাম কিছুদিন তাই লেখা পড়িনি তাড়াহুড়োর মধ্যে। আজ পড়লাম। এইটার কাজ শেষ হলে জানায়েন। (পাবেন ধরে নিচ্ছি)

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : ফয়েজ (৮৭-৯৩)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।