রবি ভাই ও অন্যান্য

রবি ভাইকে আমি চিনি বড় সংকটের সময়। আমার পকেটে তখন টাকা নেই। বাবার কথা না শোনার কারণে বাড়ি থেকে টাকা বন্ধ। মাও তার গোপনে জমানো টাকা দিতে সম্পূর্ণ অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। অপরাধ- নিজের টাকা কামানোর মুরোদ নেই অথচ বাপের টাকায় সিগারেট খাই। অবিচার আর কি।

একদিন ভুল করে ছোট ভাইকে নিয়ে ক্যাম্পাসে এসেছিলাম। দুপুরে কি কি যেন খাওয়ারও বায়না করেছিল। কিন্তু ভারি বিস্ময়ের সাথে ও লক্ষ্য করল দুপুরে আমার কাছে খাওয়ার টাকা থাকে না কিন্তু সিগারেট খাই গন্ডায় গন্ডায়। সে আমার সুবিধার্তেই আমার জন্য বরাদ্দ টাকাটা বাড়ানোর দাবি জানিয়েছিল বাসায়। যাতে আমার খাওয়াও ঠিক থাকে, ফোকাও। কিন্তু বাবার তীব্র জেরার মুখে ও নিজেকে ঠিক রাখতে পারেনি। বলেছে- আমি ভাত না খেয়ে সিগারেট খাই। না যেন বলেছিল- ভাতের মত সিগারেট খাই। ওই জাতীয় কিছু একটাই বলেছিল। আর যাই কোথা! ভাতও বন্ধ, সিগারেটও।

সেরকম সময়ে রবি ভাইয়ের সাথে পরিচয়। টিএসসির এক বড় ভাই চিনিযে দিলেন, এইটা রবি, বিচ্ছুর সম্পাদক। আমার কলেজ লাইফের ফ্রেন্ড।
রবি ভাই খুব নিবির্কারভাবে বললেন..
– সেটা তুই মনে করতিস, আমি না।
বড় ভাই যথেষ্ট স্মার্ট হওয়া সত্বেও বিভ্রান্ত হয়ে পড়েন, আর আমার রবি ভাইকে ভাল লেগে যায়।

তো সেই বড় ভাইই আমাকে দেখিয়ে বললেন
-এইটা টিটো। বাড়ি থেকে সিগারেট খাওয়ার অপরাধে ওর টাকা বন্ধ হয়ে গ্যাছে।
ব্যক্তিগত জীবনে রবি ভাইয়ের তীব্র ক্ষোভ আছে অভিভাবক শ্রেনীর প্রতি। আরো যখন শুনলেন সেটা সিগারেটের জন্য মুহূর্তে তার মধ্যে এক হাজি মহসিনের দেখা পেলাম। সাথে সাথে তিনি তার হাতের আধখাওয়া সিগারেটটা আমাকে দিয়ে দিলেন, যেটার দিকে অনেক্ষণ থেকেই আমার নজর ছিল।

আমাকে দেখে তার মায়া হবে না কেন? সিগারেট নিয়ে তার বিপ্লব তো সেই হাইস্কুল জীবন থেকে। তার বাবাও যখন শুনেছিলেন, তার গুণধর ছেলে এই স্কুল বয়সে সিগারেট ধরেছে তিনিও আমার বাবার মত টিফিনের টাকা বন্ধ করে দিলেন (সব বাবারাই দেখি একরকম… :bash: )
তবে রবি ভাইর বাবা আবার তার টিফিনের টাকা বাড়তি সুদসহ ফেরত দিতে বাধ্য হলেন কয়েক দিনের মধ্যেই। এই বাড়তি টাকাটা তার সিগারেটের জন্য বরাদ্দ।

খুব যে আপোষে তার বাবা এই টাকা দিয়েছেন সে কথা আমি বলব না, কিন্তু কোন বাবাই বা ছেলের অমঙ্গল চায়( আমার বাবার মুখে এই কথাটা এত বার শুনতে হয়েছে……..আসলে সব বাবারাই …..লাইক ফাদার…)?
রবি ভাইর বাবা প্রতিদিনই তার সিগারেটের টাকা দিতেন আর সাথে বলতেন,
– বাবা প্লিজ, শুধু সিগারেটই খাস, গাজা টাজা খাস না। এসব ভাল জিনিস না

রবি ভাই তার কথা রেখেছিলেন কি না সেটা তিনি আমাকে বলেন নি তবে সেই স্কুল জীবন থেকেই যে তিনি সংগ্রামী এটা হাজারবার বলেছেন। সেই আলোকেই তিনি আশ্বাস দিলেন, কোন চিন্তা নিও না। একেবারে ঠিক জায়গায়ই তুমি এসেছ। আজ থেকে তোমার দায়িত্ব আমার। সব ব্যবস্থা করতেছি।

তিনি আমাকে পিকক বারে নিয়ে গেলেন, শাহবাগ। দেশাত্মবোধের সাথে পুরো এক বোতল দেশি জিনিসের অর্ডার দিলেন। উদার ভাবে খাওয়ালেন। তারপর বললেন,
-কি মনটা হালকা লাগছে??
আমি সবিনয়ে বললাম,
– শুধু হালকা না ভাই, পাখির মত হালকা লাগছে। না, না, পাখি না, উড়ো জাহাজ। মনে হয় এখনি উড়ি।
আমি সময় নষ্ট না করেই ওড়ার চেষ্টা করলাম। নিজেকে রাইট ব্রাদার্সের ছোট ভাই না বড় ভাইর মত মত লাগছিল যেন। কিন্তু আমার এ পাইলট পরিচয় আশপাশের অনেকেই ভাল চোখে দেখল না। রবি ভাইর কিন্তু বেশ ভাল লাগল। তিনি আরো উৎসাহ দিতে লাগলেন। বললেন,
– বিল্ডিং পাশ কাটাইয়া উইড়ো। কাচ টাচ ভাইঙ্গো না। খুব সাবধান। দিন কাল ভালো না

টানা দশ মিনিট ওড়ার পর উচ্চতাজনিত কারণে আমি আমার ভিতরের সব উগড়ে দিলাম। প্লেনও থামল। এবার তার প্রস্তাব আরো মধুর।
– ঠিক এই অবস্থায বোতলটা( বাকী তখনও কিছুটা ছিল) নিয়া বাসায যাও।
বমিটা না করলে রবি ভাইর তীব্র উৎসাহে উড়ে উড়ে ঠিকই হযত পৌছাতাম বাসায়। আর তার মতই সংগ্রামে জয়ী একজন মানুষ হতে পারতাম। হোল না। একজন পরাজিত মানুষ হিসেবে আমি বিচ্ছুতে লিখতে শুরু করলাম।

সেই সুবাদে আরো কত গল্প জানলাম রবি ভাইর। স্কুল থেকে তিনি তখন তিনি কলেজে। এ বয়সটা বড় ভয়ংকর। ছেলেপিলেরা খারাপ পথে চলে যেতে পারে। তাই বাবারা ছেলেদের উপদেশ দেন,
– ঠিক ঠাক মত থাকিস বাবা, খারাপ ছেলেদের এড়িয়ে চলিস।
রবি ভাইর বাবাও প্রায় একই কথা বলতেন,
– ঠিক ঠাক মত থাকিস বাবা, অন্য ছেলেদের খারাপ করিস না ..

এই রবি ভাইকে নিয়ে শামসুন্নাহার আন্দোলনের সময় বিশাল বিপদে পড়লাম। না সেটা তার চিরায়ত অভ্যাস, পুলিশ দৌড়ানি দিলে ভুল করে পুলিশের দিকেই এগিযে যাওয়া নয়, এ গল্পটাও মদ নিয়ে।

আন্দোলনের ব্যার্থতা ভুলতে আমরা মানে আমি, আহসান, আর রবি ভাই আবারো পিককে। মনের জ্বালা মিটিয়ে খেলাম সেদিন। আর ধরলও পুলিশ। ভার্সিটির গ্যাঞ্জামের কারণে সেদিন সব জাযগার পুলিশ বেশ সজাগ। আমরা ধরা খেলাম শ্যামলী বাসস্ট্যান্ড।
আমি আর আহসান যাব ভিতরের দিকে আর সিএনিজ থেকে আমদের নামিয়ে রবি ভাই মিরপুর যাবেন। তাই পুলিশ চেক করার জন্য না থামালেও আমরা এমনিতেই সিএনজিটা ওখানেই থামাতাম। বৃদ্ধ ধরণের এক কনস্টাবল আমাদের পেয়ে যেন হাতে মোয়া পেলেন। তাড়াতাড়ি অফিসারকে ডাকলেন,
-স্যার……. স্যার……..আমার মনে হয় ওনারা ড্রিঙ্ক পান করছেন।

ড্রিঙ্ক কিভাবে পান কবে আমরা না জানলেও দেখা দেল অফিসারটি জানেন। আর তাই তিনি আমাদের দিকে দ্রুত এগিযে আসলেন। নামতে আদেশ দিলেন। গন্ধ শুকলেন। তারপর রবি ভাইকে বললেন,
– ছি: লজ্জা করে না আপনার এমন কোমলমতি ছেলদের সামনে ড্রিঙ্ক করতে?
রবি ভাই জানালেন,
– করে, অল্প অল্প করে।
অফিসার আবার বললেন,
-আপনাকে দেখে এরা যদি মদ খাওয়া ধরে( শালার পিটিস্যু)??
রবি ভাই টক শোর জ্ঞানিগুণীদের মত পরিমিত মাথা নেড়ে বললেন,
-সে রকম একটা সম্ভাবনা আছে।
অফসার একটু বিরক্তই হলেন যেন। বললেন,
-কি করেন আপনে?
আমি বলতে গিয়েছিলাম সাংবাদিক, তার এই পরিচয়ে অতীতে অনেক জাযগায়ই শুভ ফল পেয়েছি। কিন্তু রবি ভাই ইশারা দিলেন। যার অর্থ অফিসে এই উটকো ঝামেলা না যাওয়াই ভাল। মুখে বললেন,
– কবিতা লিখি।
– হ, আপনারে দেইখা সেইরকমই সন্দেহ হইছিল আমার। আর এরা??
-এরাও কবিতা লেখে। এ গ্রুপ অব পোয়েটস হেয়ার…

এরপর বেশ কিছুক্ষণ অফিসার কবিদের গুষ্ঠি উদ্ধার করলেন। রবি ভাইও কেমন করে যেন মনের অনেক অব্যাক্ত যন্ত্রনা অফিসার কে জানালেন। তাতে আরো বিরক্ত হয়ে অফিসার আমাদের দুজন মাসুম বাচ্চাকে ছেড়ে দিলেন আর রবি ভাইকে করলেন আটক।
কিন্তু আমরা তো রবি ভাইকে ছাড়া যেতে পারি না।শত হলেও উই আর গ্রুপ অব পোয়েটস…..

অবশেষে অফিসারটি আরো অনেক জ্ঞান দিয়ে বিচারের ভার রবি ভাইয়ের উপরই ছাড়লেন। বললেন
– আচ্ছা আপনেই বলেন, আমার জায়গায় আপনে হলে কি করতেন???
রবি ভাই আকাশ পাতাল ভাবলেন।
তারপর অনেক পরে বললেন
– এই রকমই করতাম,.. অনেক্ষণ লেকচার মেকচার দিয়া ছেড়ে দিতাম।

৩,১৮৮ বার দেখা হয়েছে

৪১ টি মন্তব্য : “রবি ভাই ও অন্যান্য”

  1. ফয়েজ (৮৭-৯৩)

    ওই টিটো, এত লেট কইরা লেখা দিলা ক্যান? :chup: :chup:

    তুমি জান না আমি বাসায় ল্যাপি খুলি না।

    থাক, যাউজ্ঞা, কাইল্কা পরুম এইটা।


    পালটে দেবার স্বপ্ন আমার এখনও গেল না

    জবাব দিন
  2. ফয়েজ (৮৭-৯৩)

    রবি ভাইয়ের সেন্স-অফ-হিউমার অসাধারন মনে হয়েছে।

    একটা প্রোগ্রাম দেখেছি, প্রোগ্রামের একটা জায়গায় উনি মোনালিসার সংগে একটু নাচলেন। এর পর পর্বের শেষে প্রশ্ন এল, "জীবনের কোন কাজটা আপনি আবার করতে চান", প্রশ্নটা একটু এদিক-উদিক হতেও পারে, রবি ভাই অবলীলায় বললেন "মোনালিসার সংগে আরেকবার নাচটা কি করা যায়"


    পালটে দেবার স্বপ্ন আমার এখনও গেল না

    জবাব দিন
  3. কাইয়ূম (১৯৯২-১৯৯৮)

    এইজন্যেই তোরে কইসিলাম ড্রিঙ্ক পান না কইরা কেক পান করতে 😀 😀
    তাইলে আর লেকচার মেকচার শুনন লাগেনা 😛
    অনেকদিন পর টিটোর লেখা, দারুন মজা পাইছি। জটিল :boss: :clap: :clap:


    সংসারে প্রবল বৈরাগ্য!

    জবাব দিন
  4. তারেক (৯৪ - ০০)

    আহ রবি ভাই! 🙂
    মিতু ভাবীর রান্নার কথা বললি না? সকালের নাস্তা+দুপুরের লানচ=বিচ্ছুতে একটা লেখা?
    রবি ভাইয়ের সব কিছুই ভাল লাগতো, লেখাগুলা ছাড়া। :))
    নাহ, মজা করলাম।
    কয়দিন আগে একটা নাটক দেখলাম ওনার, ওইটাও ভাল লাগছিলো। আর ইদানিং ওনার ব্লগগুলা পড়তেও খুব ভাল লাগে।
    আর পকেটের দুঃসময়ে বিচ্ছুতে আউলফাউল লেখার সুযোগ করে দেয়ার জন্যেও ওনার কাছে চিরঋণী থাকবো।


    www.tareqnurulhasan.com

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : টিটো রহমান (৯৪-০০)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।