পথের পাঁচালীর পঞ্চাশ বছর-২

প্রথম পর্ব
[আগের পর্ব শেষ করেছিলাম ইন্টেলেকচুয়াল মন্তাজ দিয়ে।এটা নিয়ে কিছু কথা বলার প্রয়োজন বোধ করছি।মন্তাজ ব্যাপারটি রাশিয়ান চলচ্চিত্রকার আইজেনস্টাইনের আবিষ্কার। মন্তাজ শব্দটার সাথে যেহেতু ইন্টেলেকচুয়াল শব্দটি যোগ হয়েছে কাজেই এটা অন্তত বোঝা যায়, বুদ্ধিবৃত্তিক দৃশ্য তৈরি জাতীয় কিছু একটা। হ্যা, আসলেই তাই। ইন্টেলেকচুয়াল মন্তাজ সম্পূর্ণ ভিন্নরকম দুটি দৃশ্য পরপর একটি তৃতীয় অর্থকরী দৃশ্য তৈরি করে, যার মাধ্যমে বুদ্ধিবৃত্তিক একটি সিকোয়েন্স দাঁড়িয়ে যায । সূত্রটা হলো ১+১=৩। কিভাবে? খুব সহজ একটা উদাহরণ দেই- দৃশ্য ১. এক লোক ছুরি হাতে একটি দরজার দিকে এগিযে গেল + দৃশ্য ২. একটি মেয়ে রুমের ভিতর আয়নার সামনে চুল আচড়াচ্ছে(দুটি দৃশ্যের কিন্তু কোনে মিল নাই)= দৃশ্য ৩. দরজার নিচ দিয়ে রক্ত গড়িয়ে আসে(এই দৃশ্যটা একটি পূর্ণতা দিল)। খুনি মেয়েকে খুন করছে এমন করে দেখাতে হলো না। যাক আগের লেখাটা কন্টিনিউ করছি………….]

আবার ইন্দির ঠাকুরনের হাত থেকে ঘটি গড়িয়ে পরার প্রতিকী দৃশ্যটি বলে দেয় বৃদ্ধার প্রাণপাখিও গড়ালো বলে। শেষ দৃশ্যে অপুর মুখের ক্লোজআপের পরে যখন গরুর গাড়ির ঘুরন্ত চাকা দেখানো হলো তখন বুদ্ধিমান দর্শককে বলে দিতে হয়না, এই ছেলেটির জীবন এমন-ই গতিময় হবে। কিংবা পড়তে বসে অপুর উৎকীর্ণ হয়ে ট্রেনের শব্দ শোনাও যেন বাইরের পৃথিবীর প্রতি ওর অমোঘ টানকেই বোঝায। অন্য একটি দৃশ্যে হরিহর(অপুর বাবা) ফিরে আসে বাড়ি। দুর্গা তখন মৃত। ঝড়ের দৃশ্যের মাধ্যমে দূর্গার মৃত্যু দৃশ্য দেখানো হয়। ফিরে হরিহর ঝড়ের তান্ডব দেখে মন্তব্য করে `দুটো দিন অপেক্ষাও করতে পারল না’। এ যেন ঝড়কে নয় দূর্গাকেই বলছে…

এবার পথের পাঁচালীর ডিটেইল প্রসঙ্গ। অপু আচার আনতে যায় বাড়ির কোনে। দেয়ালে কাঁচা হাতে লেখা দেখা যায় `শ্রী অপূর্ব কুমার’।শিশু নতুন যখন লিখতে শিখে তখন নিজের নাম ও লেখার জ্ঞান জাহির করার জন্য এমন করেই বাড়িময় লিখে রাখে। আবার, বৃষ্টিতে ভিজে দূর্গার মৃত্যু হলে পরবর্তীতে একা স্কুলে যেতে গিয়ে আকাশের মেঘলাভাব দেখেই অপুর ফের ছাতা হাতে বের হওয়া অপুকে বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড় করায়। পাশের বাড়ির বউ এসে যখন সর্বজযাকে দুর্গার নামে চুরির অভিযোগ করে দু-চারকথা শুনিয়ে যান তখন সর্বজয়া রাগে দুর্গাকে মেরে ঘর থেকে তাড়িয়ে দেন। অপু কিন্তু অপরাধ না করেও ভয়ে সাথে সাথে বই নিয়ে বসে যায় পড়তে। এর চেয়ে যৌক্তিক দৃশ্য আর কি হতে পারে!

পথের পাঁচালীর চরিত্রায়ণও নিখুঁত। আনাড়ি অভিনেতাদের কাছ থেকে অমন নিখুঁত অভিনয় শৈলী বের করাও সহজ কম্ম নয়। বিশেষত ইন্দির ঠাকুরণের চরিত্রটি। অবশ্য চুনিবালা দেবী সঠিকভাবেই উৎরে গিয়েছেন। যেমন- বাঁশঝাড়ে তার মৃত্যু দৃশ্যটি।বসা অবস্থায় একটি মৃত্যুদেহ যেভাবে টুপ করে পড়ে যায় সেভাবেই তাকে অভিনয় করতে হবে। দৃশ্যটি সম্পূর্ণই চুনিবালার উপর নির্ভর করছিল। বৃদ্ধা এতই নিখুঁতভাবে হেলে পড়েন যে, সত্যজিৎকে দ্বিতীয় শট আর নিতে হয়নি। মনে পড়ে দোকানদার কাম শিক্ষক তুলসীদাসকেও। একই সাথে তিনি দোকান সামলান, দুষ্ট বালক সামলান, নিজের শরীরও সামলান অথচ আড্ডায় ছেদ পড়ে না একদম। এমন কি পথের পাঁচালীর কুকুর বিড়ালও যেন স্ক্রীপ্ট গিলে খেয়েছিল।

পথের পাঁচালী তৈরি করতে গিয়ে অসংখ্যবার তাৎক্ষণিক বুদ্ধির পরিচয় দিতে হয়েছে সত্যজিৎকে। যেমন-কাশবনে অপুর দুর্গাকে খোঁজার দৃশ্যটি। অপু চরিত্রধারী সুবির বন্দ্যোপাধ্যায় কিছুতেই সেটা পেরে উঠছিল না।সত্যজিৎ তখন কাশবনে আড়ালে তিন দিকে তিনজনকে দাঁড় করিয়ে দেন। অপু যখন কাশবনে দুর্গাকে খোঁজে তখন আড়াল থেকে তারা সুবীর বলে ডাকতেই অপু থমকে দাঁড়িয়ে তাদের খুঁজতে থাকে। আর ছবিতে আমরা দেখলাম কি টেনশন নিযে অপু দুর্গাকে খুঁজছে। আরেক দৃশ্যে মিষ্টিওয়ালার পিছনে দুর্গা ও অপুর দৌড়ের সাথে একটি কুকুরও জুড়ে দিলেন পরিচালক।কিন্তু কুকুর কেন দৌড়াবে ওদের সাথে? পরিচালক তাই দুর্গার হাতে মিঠাইধরিয়ে দিলেন যার লোভে আদতেই কুকুরও জুড়ল ছোটা…।
সিনেমায় বিয়ের দৃশ্য মানেই খরচান্ত ব্যাপার। প্রচুর সাজ গোজ, অনেক মানুষ, অনেক ফুল ইত্যাদি ইত্যাদি। অর্থ সংকটের কারণে সত্যজিৎ এই দৃশ্য কেবল রান্নার বিশাল আয়োজন দেখিয়েই পুরো বিষয়টা বুঝিয়ে দিলেন। খরচও বাঁচল আবার বিয়ের দৃশ্যেও পেল নতুন মাত্রা।

পথের পাঁচালীর রাতের দৃশ্য ছাড়া পুরোটাই দিবালোকে ধারণ করা হয়েছে। যেহেতু বোড়াল গ্রামে(যেখানে পথের পাঁচালীর শ্যুটিং হয়) তখনও বিদ্যুৎ পৌঁছায়নি তাই রাতের দৃশ্য সেখানে করা সম্ভব ছিলো না। রাতের দৃশ্য করা হয়েছে সেটে। দিবালোকে ধারণকৃত দৃশ্যগুলোর মধ্যে বৃষ্টির দৃশ্যও ছিলো। কিন্তু বিদ্যুতের অভাব দৃশ্যগুলোর কোনোরকম আলোকস্বল্পতা ঘটায়নি। দুর্গার মৃত্যু দৃশ্য যেমন লো-কি লাইটে ধারণ করা হয়েছে তেমনি আনন্দের দৃশ্যগুলো(পোকামাকড়ের দৌড়ঝাপ, শিশুদের আনন্দযাত্রা, অপু দুর্গার বৃষ্টিতে ভেজা, পুজার দৃশ্য ইত্যাদি) তোলা হয়েছে হাই কি লাইটে। অন্যান্য শটও নিখুঁতভাবে ধারণ করা হয়েছে, এরকমই চলচ্চিত্রের ব্যাকরণ মেনে।

পথের পাঁচালী সে বছরই কান চলচ্চিত্র উৎসবে সেরা হিউম্যান ডক্যুমেন্টরীরর পুরস্কার লাভ করে। তবু পথের পাঁচালী নিয়ে সমালোচনা হয়েছিল। বলা হয়েছিল সত্যজিৎ ভারতীয় মন মানসিকতার নন। এক রাজনৈতিক নেত্রী তো বলেই ফেলেছিলেন, সত্যজিৎ রায় পথের পাঁচালীর মাধ্যমে ভারতের দারিদ্র বিক্রি করে খেয়েছেন। কথা উঠেছিল ইংরেজী সাবটাইটেল করা নিয়েও। তবে এসব দাযে তাকে দুষ্ট করা যায় না। কারণ সত্যজ্যিতের মত বাংলা অনুরাগী খুব কমই আছেন। তার প্রমাণ মেলে তার লেখা অসংখ্য বইপত্রে(৪০ এ শুরু করলেও অনেক লেখকই সারাজীবনে তারমত এত বই লিখতে পারেননি)। বরং ভারতীয় একটি চলচ্চিত্রকে তিনি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পরিচয় করিযে দিয়েছিলেন। আর দারিদ্রের ব্যাপারে বলতে হয়, এই চলচ্চিত্রটিতে কোনো মানুষ ভিলেন ছিলো না। ভিলেন ছিল দারিদ্র। কাজেই এরকম একটি চলচ্চিত্রে দারিদ্র উপেক্ষা করা সহজ ছিল না, যেমন ছিলো না ডি সিকার `বাইসাইকেল থিফ’ এ।

উপরের বর্ণনা পুরোটাই পথের পাঁচালী চলচ্চিত্রটির ৫০ বছরে তার মান দর্শকের কাছে ঠিক ঠাক থাকার রহস্য ফিরিস্তির সার সংক্ষেপ।এবার ভিন্ন প্রসঙ্গ।ঠিক প্রসঙ্গ নয়- জিজ্ঞাস্য, কৌতুহল কিংবা বিস্ময়ও বলা যেতে পারে। আজ থেকে ৫০ বছর আগে পথের পাঁচালীর মত এমন শক্তিশালী আন্তর্জাতিক মানের চলচ্চিত্র তৈরি হওয়া সত্ত্বেও দুই বাংলার( উপমহাদেশের কথা বললাম না কারণ মুম্বাইয়ের উত্তরণ ঘটেছে। অবশ্য নকল ছবিরও উত্তোরণ হয়েছে খুব) মূলধারার সিনেমাগুলোর বেহাল দশা কেন? শুধু পথের পাঁচালীই নয়, সত্যজিৎ এরপরও অনেক ছবি করেছেন যা প্রায পথের পাঁচালীর মতোই বা পথের পাঁচালীর চেয়েও শক্তিশালী। এমনকি ছবিগুলো বাণিজ্যিক ভাবেও সফল।তবু আজকাল আর্টফিল্ম(যদিও সব ফিল্মেই আর্ট থাকে ;)) ), বাণিজ্যিক ফিল্মজনিত বিভাজন কেন?

পথের পাঁচালীকে আমি কেবল একটি চলচ্চিত্র হিসেবেই দেখি না বরং এটি একটি সংগঠন।গ্রুপ ওযার্ক, সাংগঠনিক দক্ষতা, চলচ্চিত্রের পরিমিতি বোধ তৈরি, সুস্থ্য ধারার চলচ্চিত্রের প্রতি আগ্রহ ইত্যাদি বিষয়গুলোই তাকে একটি চলচ্চিত্র সংগঠন প্র্যাকটিস করে।পথের পাঁচালীতে এর সবই ছিল।

তাই পথের পাঁচালী হয়ে উঠতে পারতো বাংলার চলচ্চিত্র সংসদকর্মীদের কাছে ব্যকরণের মত। এর প্রেরণায় সমমানের আরো অনেক চলচ্চিত্র তৈরি হতে পরতো। তৈরি হতে পারতো সত্যজিতের মতো আরো অনেক তরুণ চলচ্চিত্রকার। তবু কেন হলো না? সিনেমা একটা খরচান্ত শিল্প বলে? ভালো ফিল্মের দশর্ক নেই বলে? দুটো সমস্যাই পথের পাঁচালীর ক্ষেত্রেও ছিলো। তবু সে মুক্তি পেয়েছিলো, ৫০ বছর আগে, ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির বাইরে…
কিন্ত তেমন আর একটাও কেন হলো না?

জ্ঞানীরা ভাবতে থাকুক। এই ভাবনায় যেন আর ৫০ বছর না পেরোয় সেই আশায় দিনগুনি।

[ মাটির ময়না ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির বাইরে হলেও এমনকি আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেলেও ঠিক পথের পাঁচালীর সাথে তুলনাযোগ্য নয়। বাংলাদেশে দহন নামে শেখ নিয়ামত আলির একটি চলচ্চিত্র আছে যেটায় পথের পাঁচালীর কাছাকাছি স্বাদ পেয়েছি]

৩,১০৭ বার দেখা হয়েছে

৪৩ টি মন্তব্য : “পথের পাঁচালীর পঞ্চাশ বছর-২”

  1. মুহাম্মদ (৯৯-০৫)

    খুব সুন্দরভাবে লিখেছেন টিটো ভাই। পথের পাঁচালী যতবার দেখি ততবারই নতুন একটা রহস্য উন্মোচিত হয়। আর্টের মধ্যে যে লুকোচুরি আর রহস্য থাকে পথের পাঁচালীতে তার কোন কমতি নেই। সিনেমার মন্তাজ বা ট্র্যাকিং প্যানিং সবার জানার কথা নয়, কিন্তু এটা ঠিক যে শৈল্পিক সিনেমা অনেক দেখলে সে ধরণের একটা সেন্স তৈরি হয়ে যায়। যে সভ্যতার মানুষের এই সেন্স বেশি তারাই শৈল্পিক সিনেমার কদর বেশি করে।

    তবে আমার যেটা মনে হয় প্রাচীন গ্রিস, মধ্যযুগীয় ইতালি এবং বিপ্লবকালীন ফ্রান্স ছাড়া আর কোন সভ্যতাতেই শিল্প এবং জনপ্রিয় সংস্কৃতি একসাথে মিশে যায় নি। বর্তমানেও পৃথিবীর প্রায় সব দেশে জনপ্রিয় সংস্কৃতি আলাদা, শিল্প আলাদা। যারা জনপ্রিয় সংস্কৃতির ছায়ায় বড় হন এবং তার এস্কেপিস্ট বিনোদন মাধ্যমগুলো দেখে মাঝেমাঝে জীবন থেকে পালিয়ে যান তাদের পক্ষে শিল্পের মূল্যায়ন সম্ভব না। শৈল্পিক মূল্যবোধ সমাজের বেশি মানুষের মধ্যে থাকে না এবং বর্তমানে এটাই স্বাভাবিক। তবে দেশ ভেদে এই মূল্যবোধ সম্পন্ন মানুষের সংখ্যায় তারতম্য দেখা যায়। যেমন ফ্রান্স বা সুইডেন এ এখনও শৈল্পিক মূল্যবোধ সম্পন্ন মানুষের সংখ্যা যথেষ্ট, যার ফলে আর্টিস্টিক সিনেমাগুলো সে সব দেশে জনপ্রিয়তা পায়, তবে অবশ্যই ব্লকবাস্টার না। হলিউডের ভাল মানের সিনেমা খুব কম সময়ই ব্লকবাস্টার হয়। সেদিক থেকে হলিউড কমার্শিয়াল এবং বলিউড কমার্শিয়াল এর আর্থিক সাফল্য অনেক বেশি। সত্যজিৎ নিজেও জানতেন যে তার সিনেমা উত্তম-সুচিত্রার সিনেমার মত আর্থিক সাফল্য পাবে না কিন্তু সময়ের স্রোতে কেবল তারটাই টিকে থাকবে। তাই শৈল্পিক সিনেমার ক্ষেত্রে লাভ যতটা না দরকার তার চেয়ে বেশি দরকার লোকসান না হওয়া। সিনেমার মূল স্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লে তো সমস্যা।

    পথের পাঁচালীর প্রভাব কেন বাংলা চলচ্চিত্রে পড়লো না সে সম্পর্কে আমার মত বলি:

    উপমহাদেশের সিনেমায় যে প্রভাব একেবারে পড়েনি তা না। পথের পাঁচালী মুক্তি পাওয়ার পরপরই কোন প্রভাব দেখা যায়নি। কিন্তু ভারতে প্যারালার সিনেমা নামে যে আন্দোলন শুরু হয়েছে সেটার মূলবিন্দু কিন্তু পথের পাঁচালীকেই বলা হয়। কিন্তু প্যারালাল সিনেমা মূল স্রোত থেকে সরে গেছে। ইতালিতে যেমন বাইসাইকেল থিফ পুরো নিউরিয়েলিজম এর জন্ম দিয়েছে, ফ্রান্সে যেমন ত্রুফোদের সিনেমা নিউ ওয়েভের জন্ম দিয়েছে ভারতের প্যারালাল সিনেমা তেমন কিছু করতে পারেনি, প্যারালালই রয়ে গেছে। প্যারালাল সিনেমা একটি বিকল্প পথ যা খুব কম মানুষই ব্যবহার করে। এরকম হওয়ার কয়েকটা কারণ এরকম হতে পারে:

    - মৃণাল সেন বা ঋত্বিক ঘটকরা অতিরিক্ত রাজনীতি এবং সমাজ সচেতন হয়ে পড়েছেন। সমাজের মানুষের সাথে যোগাযোগ করতে ব্যর্থ হয়েছেন। যার ফলে সমাজের মানুষকে নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার মত কোন পরিচালক সত্যজিতের পরে আর আসে নি। সত্যজিতের বারিমান বা ফেলিনির মত সিনেমা করার যোগ্যতা ছিল কিন্তু সমাজ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার ভয়ে তিনি তা করেন নি। বারিমান এবং ফেলিনিও কিন্তু সমাজ বিচ্ছিন্ন নন।

    - আর্টের জগতে কোন বিপ্লব হতে হলে একাধিক শিল্প মাধ্যমের সমন্বয় সাধন করতে হয়। সেভেন্থ আর্ট একা কতদূর যাবে! ইরানী নিউ ওয়েভের সাথে ইরানী কাব্য আন্দোলন একাকার হয়ে গেছে। জার্মানির এক্সপ্রেশিনজম আন্দোলনের সাথে তখনকার এক্সপ্রেশনিস্ট চিত্রকলার গভীর সম্পর্ক ছিল। আসলে এই উত্তরণের যুগ গুলোতে মানুষের একটা বড় অংশ শিল্পীদের সাথে যোগাযোগ স্থাপনে সক্ষম ছিল।

    - আর্টের কদর করার মত অবস্থায় বোধহয় বাংলার মানুষ পড়েনি। বাংলাদেশে তো সম্ভাবনা অনেক কম, যুদ্ধ-বিগ্রহ আর সামাজিক আন্দোলনেই এক শতক পার হয়ে গেছে, স্থির হয়ে শিল্পের প্রতি মনোযোগী হওয়ার সময় কেউ পায় নি। কলকাতার অবস্থা সে তুলনায় অনেক ভাল। এক নকশাল ছাড়া কলকাতা তো প্রায় শান্তই বলা চলে। সে অনুসারে কলকাতার শৈল্পিক অগ্রগতি ভালই হয়েছে, তবে অবশ্যই পুরো সমাজের কথা ভাবলে যথেষ্ট নয়। বলিউডের সংস্কৃতিবিমুখ সিনেমার প্রভাবে জনপ্রিয় সংস্কৃতি সবসময়ই শিল্পের সাথে একটা বৈরীভাব বজায় রেখেছে এবং এখনও রেখে চলেছে।

    - সিনেমা প্রচণ্ড আন্তর্জাতিক। আমার মনে হয় বাংলা সাহিত্য ভাল রকমই বিশ্ববিমুখ, নিজেকে নিয়েই অধিকাংশ সময় ব্যস্ত থেকেছে। কসমোপলিটান সংস্কৃতির প্রভাব না থাকাও এর একটা কারণ। এ কারণে হয়তো বা বাংলা কবিতা, নাটক বা উপন্যাস সিনেমায় খুব বেশি প্রভাব ফেলতে পারে নি।

    - বাংলায় বোধহয় মঞ্চ নাটকের সাথে সিনেমার যোগাযোগ খুব একটা হয়নি। বারিমানের মত একজন চলচ্চিত্রকারের জন্ম হলে বাংলার জন্য অনেক ভাল হতো। কারণ এ অঞ্চলের মঞ্চ নাটক বেশ সমৃদ্ধ। বারিমানের মত একাধারে মঞ্চ ও চলচ্চিত্র পরিচালকদের পক্ষে তাই দুয়ের সংযোগ সাধন খুব সহজ হতো।

    অনেক কথা বলে ফেললাম...

    জবাব দিন
  2. টিটো রহমান (৯৪-০০)
    প্রাচীন গ্রিস, মধ্যযুগীয় ইতালি এবং বিপ্লবকালীন ফ্রান্স ছাড়া আর কোন সভ্যতাতেই শিল্প এবং জনপ্রিয় সংস্কৃতি একসাথে মিশে যায় নি।

    :thumbup:

    আর্টের জগতে কোন বিপ্লব হতে হলে একাধিক শিল্প মাধ্যমের সমন্বয় সাধন করতে হয়। সেভেন্থ আর্ট একা কতদূর যাবে! ইরানী নিউ ওয়েভের সাথে ইরানী কাব্য আন্দোলন একাকার হয়ে গেছে। জার্মানির এক্সপ্রেশিনজম আন্দোলনের সাথে তখনকার এক্সপ্রেশনিস্ট চিত্রকলার গভীর সম্পর্ক ছিল। আসলে এই উত্তরণের যুগ গুলোতে মানুষের একটা বড় অংশ শিল্পীদের সাথে যোগাযোগ স্থাপনে সক্ষম ছিল।

    :hatsoff: এই যুক্তিটা আমার বেশি পছন্দ হয়েছে। সপ্ত কলার সমন্বয়ে যে চলচ্চিত্র তার অন্তত একটিতেও বিপ্লবটা দরকার। বংলাদেশে ষাটের দশকে সাহিত্য নিয়ে যে বিপ্লবটা হলো সেটার সাথে ফিল্মটা ম্যাচ করে গেলে একটা চান্স ছিল.........

    এনিওয়ে....আমরা আনিব রাঙা প্রভাত.......... :awesome: :awesome: :awesome:
    তোর মন্তব্যের জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ।


    আপনারে আমি খুঁজিয়া বেড়াই

    জবাব দিন
  3. তানভীর (৯৪-০০)

    দোস্ত...চমৎকার বিশ্লেষণধর্মী একটা লেখা। পথের পাঁচালী নিয়ে আসলে যত প্রশংসা করি, ততই কম হয়!

    যাক, পাঁচতারা পাওয়ার মত একটা লেখা লিখলি। আমি আবার প্রাপ্য বুঝায়ে দিতে দেরী করি না। :-B

    জবাব দিন
  4. দিহান আহসান

    মুগ্ধ হয়ে এবারেরটাও পড়লাম।

    দেখিস একদিন তুই, কামরুল, তোরাও … :boss:

    :thumbup:
    যাই এই খুশীতে ফ্রিজ থিকা মিষ্টি খাইয়া আসি গা 😛

    অফটপিকঃ এবার তাড়াতাড়ি করে উপন্যাসটাও শেষ করেন। 😡

    জবাব দিন
  5. রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)

    হাফিয,
    লেখা খুব ভালো হইছে।
    আমার জানামতে ইন্দির ঠাকরুন অভিনয়ের সঙ্গে জড়িত ছিলেন।
    যদিও ঐ সময় তিনি পাড়ায় বাস করছিলেন।


    এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : তানভীর (৯৪-০০)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।