আজ শ্রাবণের আমন্ত্রণে

১.
রাতুল—- রাতুল—-
অনেক অনেক দূর থেকে ভেসে আসছে গলাটা। ঠিক চেনা নয়, আবার অচেনাও নয়। কেমন ঘোর লাগা সে সুর। রক্তে বান ডেকে যায়। ছুটে যেতে ইচ্ছে করে। তবু যাওয়া হয় না। যাবেই বা কেমন করে সে। সেতো এখন মাঝ নদীতে। পানির হালকা ঢেউয়ে নৌকোটা দুলছে। কাল রাত থেকেই মুষল ধারে বৃষ্টি। সকালে প্রফুল্লকে খবর দেয়া হয়েছিল নৌকো নিয়ে আসতে। তারা যাবে অনেক দূর।

ছইয়ের নিচে গুটি কয়েক মানুষ তারা, গুটিসুটি মেরে আছে। প্রবল বর্ষণে ধোয়াশা হয়ে আছে চারদিক। বৈঠার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। কেবল ঘোলা জলের উপর ঘন জলের মুর্ছনা। এর মাঝে আবার কে ডাকে? পাড় কি তবে দূরে নয়?

রাতুল শুয়ে আছে মায়ের কোলে। সবারই বেশ শীত শীত লাগছে। মা রাতুলকে আঁচল দিয়ে ঢেকে দিয়েছেন। তবে, তাতে পা ঢাকা পড়েনি। মায়ের উষ্ণতার পুরো সুখ ভোগ করতে পারছে না সে।

বড় আপা কি একটা গল্পের বই নিয়ে উঠেছে। ভর দুপুরেও সান্ধ্য আলোয় সে ঠিক সুবিধে করে উঠতে পারছে না। এমনকি কালো ফ্রেমের চশমাটা পড়ার পরেও নয়। এমনিতে আপার চোখের পাওয়ার ঠিকই আছে। তবে রঞ্জু কাকুর কিনে দেয়া চশমাটা এমন আলো আঁধারের টানাপোড়নে প্রায়ই সে ব্যবহার করে।

আব্বা বসেছেনে ছইয়ের শেষ প্রান্তে, মাটির চুলাটা ঘেষে। টিফিন ক্যারিয়ারে খাবার না আনলে এতণে মাকে বসে যেতে হতো চোঙা নিয়ে। শ’খানেক ফু দিয়ে চোখের পানি-নাকের পানি এক করে ফেলতে হতো। অতপর হয়ত স্যাঁতস্যাঁতে চুলায় দেখা যেত আগুনের হলকা। সবাই যার যার শরীরের ভেজা অংশগুলো শুকিয়ে নিতো সে আগুনে।

রাতুল—- রাতুল—-
নাহ! ভারি যন্ত্রণা হোলো দেখছি। এই কেরে ? সামনে আয়। অমন দূর থেকে ডাকছিস কেন রে? এমন বৃষ্টি মাখা দূপুরে কেউ কাউকে অমন করে ডাকে নাকি? ঘরে বসে থাকতে পারলি না? তোর কি এমন মায়ের কোল নেই?

রাতুল মায়ের আঁচলটা টেনে দেয়ার চেষ্টা করে পায়ে। হালকা টানে আঁচল আসছে না, তাই হাঁটুটাকে আরো কোলের দিকে টেনে নেয়। রাতুলের ঘুমটা পুরোপুরি ভাঙে তখনি।

সাধারণত ঘুম তার অনেক আগেই ভাঙে। মসজিদে যখন ফজরের আজান হয়, ঠিক তখন। মসজিদটা তাদের বাড়ির লাগোয়া। রাতুল নামাজ পড়ে না। তবে বাবা পড়েন। যে সমস্ত বাবারা নিজে নামাজ পড়েন তারা চেষ্টা করেন নিজের ছেলে-মেয়েদের নামাজে আগ্রহী করতে। বাবা কখোনো তা করেন নি। এমনকি ফজরের ওয়াক্তে বাবা যখন ওজু করে ফেরেন আর রাতুল যায় হালকা হতে, তখন ওদের দেখা হয়ে যায় কলের কাছে। তবু বাবা একদিনও ওকে নামাজের কথা বলেন নি।

আজো রাতুলের ঘুম ভেঙেছিল আজানের সাথে সাথে। কিন্তু বাইরে প্রবল বৃষ্টি থাকায় পেট চেপেচুপে শুয়ে ছিল বিছানায়। তারপর আধোঘুম আর আধো জাগরণে বেলা যে কতটা গড়িয়েছে, কে জানে?

রাতুল—- রাতুল—-
এই রে..। পৃথ্বু ডাকছে। পাঁচ নম্বরী ফুটবলটা সারিয়ে ফেলেছে বোধ হয়। উত্তর পাড়ার ছেলেগুলোও চলে এসেছে হয়ত। বিকেল কি তবে হয়েই গেলো? আধোঘুম আর আধো জাগরণে একটা দিন কাটিয়ে দিল সে!
রাতুল—-
কি রে?
ঘুমাচ্ছিলি নাকি?
হুম।
কি ঘুম রে বাবা। গেট টা খোল।
খোলা নেই?
খোলা থাকেলে তোকে ডাকি রে বোকা?
আচ্ছা আসছি..
তাড়াতাড়ি…ভিজে চুপসে হয়ে গ্যাছি। বাইরে খুব ঠান্ডা..

রাতুলদের একতলা বাড়িটা পাঁচ কাঠা জমির উপর। পিছন দিকটায় সোয়া দুই কাঠার উপর তাদের বাড়ি আর বাকিটায় বাবার বাগান। ভেষজ থেকে বনসাই, ফুলজ কিংবা ফলজ সব রকমের গাছ আছে সেখানে। তার মাঝখানে বাড়িতে ঢোকার সরু রাস্তাটাকে ভীষণ রুগ্ন মনে হয়। যেন দুটো উদ্যানকে সরু আইল দিয়ে আলাদা করা হয়েছে। বাড়ির ডান কোনে কলপাড় আর বাথরুম না থাকলে পুরোটাকে জংলি আখ্যা দেয়া যেতো।

বাসায় ছাতাটা নেই। তার মানে বাবা বেরিয়েছেন। রাতুল বারান্দা থেকে তোয়ালেটা মাথায় পেঁচিয়ে ঘর থেকে নামল। পুরোনো মান্ধাতা আমলের লোহার গেট। আংটাটা জং ধরে শক্ত হয়ে থাকে। হালকা ক্যাচ ক্যাচ শব্দ তুলে গেটটা খুলল সে।

পৃথ্বু আদতেই কাক ভেজা হয়ে আছে। ঠান্ডায় তার লিকলিকে হাত পা সদৃশ হাড় ক’খানা ঠক ঠক করে কাঁপছে। এক হাতে তার ফুটবল, অন্য হাতে ইলিশ মাছ। গেট দিয়ে ঢুকতে ঢুকতে বলল-
আজকের খেলা বাতিল করে আসলাম।
কেন? কেন?
পৃথ্বু ইলিশ মাছটা উঁচু করে বুকের কাছটায় তুলে বলল-
মাঠে এই পর্যন্ত পানি।
রাতুল তার বলার ভঙ্গিতে হেসে ফেলল।
ধুর তাই হয় নাকি?
হ্যারে সত্যি বলছি। ভেসে যাচ্ছে সব। কম তো আর বৃষ্টি হয় নি সেই রাত থেকে।
ত্ইু কি তাহলে ভেসে ভেসে আসলি?
হুম। ফুটবল সারাতে বাজারে গ্যাছি। হঠাৎ দেখি এই ইলিশটা সাঁতার কাটতে কাটতে তোদের বাসার দিকেই আসছে। অমনি ওর পিঠে চড়ে বসলাম।
খেলার প্রতি কত উৎসাহ থাকলে এই ঝড়-জলের মধ্যে ফুটবল সারাতে বের হয় মানুষ! ফুটবলে উৎসাহ ক্যাটাগরীতে একটা জাতীয় পদক থাকা উচিত। রাতুল আবারো হেসে ফেলল। পৃথ্বুটা এত্ত বানিয়ে বানিয়ে বলতে পারে!
মাছটা রাতুলের হাতে ধরিয়ে দিয়ে পৃথ্বু চলে গেল কলপাড়ে। সেখান থেকেই বলল-
ভ্যবলার মতো দাঁড়িয়ে আছিস কেন রে? মাছটা রান্নাঘরে রেখে আয়? আওে, আংকেল পাঠিয়েছেন। বাজারে দেখা হলো তার সাথে। জানিস, আজকে অনেক ইলিশ উঠেছে বাজারে। বেশ নাকি সস্তা।

রাতুল রান্নাঘরে মাছটা রেখে মাথার গামছাটা খুলে এক হাতে নেয়। অন্য হাতে একটা ট্রাউজার নিয়ে আসে পৃথ্বুর জন্য। কল পাড়ের দিকে তাকিয়ে দেখে সটান হয়ে পড়ে আছে পৃথ্ব্।

৬,৯০১ বার দেখা হয়েছে

৭৬ টি মন্তব্য : “আজ শ্রাবণের আমন্ত্রণে”

  1. ওয়াহিদা নূর আফজা (৮৫-৯১)

    লেখায় টানটান ভাব আছে। অনেক ছোটখাট ব্যাপার তুলে ধরেছ। তারমানে খুব ভালো খেয়াল করো চারপাশ।


    “Happiness is when what you think, what you say, and what you do are in harmony.”
    ― Mahatma Gandhi

    জবাব দিন
  2. কামরুল হাসান (৯৪-০০)

    প্রতিদিন একটা কৈরা পর্ব দিবি, বেশি ঝুলাইস না কইলাম।
    ধইরা মাইর দিমু।

    ভালো হইতেছে।

    তোর মেইল পাইছি, সময় কইরা স্ক্রিপ্টটা নিয়া বসুম।


    ---------------------------------------------------------------------------
    বালক জানে না তো কতোটা হেঁটে এলে
    ফেরার পথ নেই, থাকে না কোনো কালে।।

    জবাব দিন
  3. কাইয়ূম (১৯৯২-১৯৯৮)

    গল্পের দুই অংশের জাক্সটাপজিশন (বাংলা কী হবে? 🙁 ) দেখেই বুঝা যাচ্ছে নেক্সট পার্ট প্রায় রেডী 😀
    সো, তাড়াতাড়ি দিয়া দিস।
    সংযমের মাসে আবার বেশি বেশি সংযম করিসনা লেখার ক্ষেত্রে :clap:
    :thumbup:


    সংসারে প্রবল বৈরাগ্য!

    জবাব দিন
  4. সানাউল্লাহ (৭৪ - ৮০)

    বহুত দিন পর সিসিবিতে উপন্যাস। এমনিতেই কয়েকটা ঝুইল্যা আছে, শেষ হইয়াও হইলো না..........
    তুমি একই কাম কইরো না। ঝটপট লিখতে থাকো। আমরা গোগ্রাসে গিলতে থাকি। আর উপন্যাস বেশি দিন ঝুলাইয়া রাখলে লেখাটা বেদিশা হইয়া যায়।
    ভালো হয়েছে প্রথম পর্বটা। :hatsoff:


    "মানুষে বিশ্বাস হারানো পাপ"

    জবাব দিন
  5. কামরুল হাসান (৯৪-০০)

    মামা, এডিট করতে গিয়া লেখাটার কিছু অংশ ফালাইয়া দিছিস মনে হয়।
    ঠিক কইরা দে।


    ---------------------------------------------------------------------------
    বালক জানে না তো কতোটা হেঁটে এলে
    ফেরার পথ নেই, থাকে না কোনো কালে।।

    জবাব দিন
  6. মুহাম্মদ (৯৯-০৫)

    নামটা খুবই পছন্দ হয়েছে। রবী ঠাকুরের এই গানটা মাঝেমাঝেই শুনি।
    উপন্যাস পড়া এখনও শুরু করিনি। আরও কয়েকটা পর্ব ছাড়েন, তারপর একসাথে শুরু করবো।

    জবাব দিন
    • টিটো রহমান (৯৪-০০)
      শেষে এসে দেখি চরম মোচড় দিলি গল্পে!

      হা হা...এক ছোট্ট আপু মেইলে বলছে কমার্শিয়াল হয়ে যাচ্ছি। পাঠক ধরে রাখার জন্য । মেগা সিরিয়াল টাইপ এন্ডিং........

      সে ভুল বলে নাই 😛 😛 :khekz:

      পরের পর্ব ভাবতাছি..খুব শিগগিরই দিয়া দিমু


      আপনারে আমি খুঁজিয়া বেড়াই

      জবাব দিন
  7. তাইফুর (৯২-৯৮)
    রাতুল শুয়ে আছে মায়ের কোলে। সবারই বেশ শীত শীত লাগছে। মা রাতুলকে আঁচল দিয়ে ঢেকে দিয়েছেন। তবে, তাতে পা ঢাকা পড়েনি। মায়ের উষ্ণতার পুরো সুখ ভোগ করতে পারছে না সে।

    ... ... ... ... ... ... ...

    রাতুল মায়ের আঁচলটা টেনে দেয়ার চেষ্টা করে পায়ে। হালকা টানে আঁচল আসছে না, তাই হাঁটুটাকে আরো কোলের দিকে টেনে নেয়। রাতুলের ঘুমটা পুরোপুরি ভাঙে তখনি।

    অসাধারণ ... প্রতিটা ডিটেইল আবার খুব চমৎকার ভাবে কন্টিনিউ করছিস ...

    রাতুল আর পৃথ্বুর বয়স আন্দাজ করার চেষ্টা করলাম খুব ... তখনই মনে হল পুরো উপন্যাস একবারে হাতে পেলে ভাল হত ... উপন্যাস পড়া শুরু করলে এবং ভাললাগা শুরু হইলে আমার টয়লেট ব্রেকেও যাইতে মঞ্চায় না ...

    অনেকদিন পর টিটো টাইপ লেখা পেলাম ... বেশি ঝুলাইস না প্লিজ ... লেখার কন্টিনিউয়েশন রাখতে তোর যেমন কষ্ট হবে ... পড়ার কন্টিনিউয়েশন রাখতে পাঠকেরও তেমন কষ্ট হবে।


    পথ ভাবে 'আমি দেব', রথ ভাবে 'আমি',
    মূর্তি ভাবে 'আমি দেব', হাসে অন্তর্যামী॥

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : টিটো রহমান (৯৪-০০)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।