বারি কোথায়?

আমি মোটামুটি নিশ্চিত যে হেডিং দেখেই আপনারা মনে করবেন, ছেলেটা একদম ট্রাস। সামান্য বাড়ি লিখতেও বাড়াবাড়ি রকম বানান ভুল করে।কিন্তু বিশ্বাস করুন হে প্রিয় ব্লগারগণ- আমি বানান বিশারদ নই, তবু আজও বাড়িকে বাড়ি বলে চিনতে পারি। এই বারি সেই বাড়ি নয়। এ এক অন্য বারি, যার অনেক গল্প বলার আছে।

বারি আমার বন্ধুর নাম। ভাল নাম মোহাম্মদ আব্দুল বারি। আমার কলেজ জীবনের প্রথম রুমমেট। সাতক্ষীরার কলারোয়ায় ওর বাড়ি।

ক্লাস সেভেনে ভর্তি হয়ে, আদতেই আমার অবস্থা শ্রীহীন পথের কুকুরের মত হল। ও সে তুলনায় শেফার্ড। বেশ মানিয়ে নিয়েছে । বড় ভাইয়েরা যা বলছে নির্দ্বিধায় শুনছে। আমিও যে শুনি না, তা নয়। তবে কি আমার শরীরের শব্দগ্রহণকারী যন্ত্রটি বোধকরি উল্টো করে বসানো। ভাইয়া যদি বলেন- আমার জন্য বাথরুম রেখো ..আমি তখন বথরুম রেখে নিজে গোসল টোসল করে চলে আসি। ভাইয়া যখন বলেন- বাথরুম রেখেছ? আমি বলি-দৌড়ে কুলাইতে পারি নাই। ভাইয়া আবার বলেন- তাইলে তুমি গোসল করছ কেমনে? আমি বলি- ভাইয়া, আহসান বেসিনে মোজা ধুইতেছিল সেই ফাঁকে আমি কাম সাইরা ফালাইছি 😀 ।
আবার ভাইয়া বলেন- বাম হাতে কাটা চামচ ধরতে হয় আর ডান হাতে ছুরি। আমি প্রায়শই বাম হাতে ছুরি ধরে ডান হাতে কাটা চামচ নেই। আমার এই ডানবাম স্বভাব বড় ভাইদের পছন্দ হয় না। বিশেষত আমার ডান আর বামের ভাইয়াদের। কারণ মুরগীর হেলিকপ্টার টুকরাটা ছিটকে হয় ডানের অথবা বামের ভাইয়ার প্লেটেই পড়ে।

আমার তুলনায় বারি অনেক নিরাপদ। ওর নিজের গোসল না হলেও ভাইয়াদের বাথরুম ঠিকই রাখে। আর সে কারণেই দুপুর বেলা নিশ্চিন্তে নাক ডেকে ঘুমাতে পারে। আমি তখন চারবার ফ্লোর মুছে কিভাবে সেটাকে সাতবার বলব সেই ফন্দি আঁটি।

এমন অনেক কিছুতেই আমরা বিপরীত ছিলাম। ও কুচকুচে কালো, আমি একটু ফর্সা। ওর হাতের লেখা দুর্দান্ত(যদিও কলেজে এটা একটা গুরুতর অপরাধ, এর শাস্তি পুরো কলেজ জীবন দেয়ালিকা লিখে ভোগ করতে হয়), আমার হাতের লেখা একটু খারাপ। ও সারাক্ষণ টিপটপ, আমি একটু অগোছাল।

উফ! ‘একটু’ বলার অভ্যাসটা আমার আজো গেলো না! আমরা দুই রুমমেট এদিক থেকেও বিপরীত। আমার ‘একটু’ বলার অভ্যাস আর ওর ‘বিশাল’ বলার অভ্যাস। দুয়েকটি নমুনা দেই
আমি বলি- ভাইয়া, একটু বাথরুমে যাব?
ও বলে- ভাইয়া, বিশাল পিসাপ লাগছে।
আমি বলি- এবারের ভ্যাকেশনে এই একটু ঘুরতে গেছিলাম দূরে ….
ও বলে- যা বিশাল একটা ঘোরা দিলাম না এইবার!

ততদিনে আমাদের আব্দুল বারি কলেজে বেশ আলোচিত একটি নাম। নাম শুনেই সবার ‘বাড়ি’র কথা মনে পড়ে । ভেরী কম্যুনিকেটিভ।এবং আলোচনাযোগ্য। যার পরিচয় মিলল ক্লাসে নাম পরিচয়ের দিন। স্যার আমাদের মেহেদিকে জিজ্ঞেস করলেন- বাড়ি কোথায়? ও নির্বিকার ভাবে বলল- আমার পাশে।
স্যার ওর উপর মহা বিরক্ত হলেন।বললেন
-বাড়ি বুঝ না বাড়ি? তোমার বাবা মা ভাই বোন যেখানে থাকে। যেখান থেকে তোমার মত ত্যাদোড় ছেলে আসছে…….
এরপর বারির পালা।
-নাম কি?
-স্যার বারি
-কানে শুন না নাকি? বাড়ির কথা জিজ্ঞেস করি নাই। নাম জিজ্ঞেস করছি
-স্যার আমার নামই বারি।মোহাম্মদ আব্দুল বারি
-ওহো, তাই বল ব্যাটা।
স্যার হেসেই খুন। মজা লোটারও চেষ্টা করেন
– বারি, বাড়ি কোথায়?

এটা প্রতিষ্ঠিত যে কলেজ স্টাফদের বুদ্ধি সাধারণত হাটুতে থাকে ( তাদেরই জমিনে পদাঘাত বেশি করতে হয় কিনা!)। কিন্তু তারাও বারি আর বাড়ি নিয়ে বেশ জমিয়ে ফেললেন। বিশেষত সালেহ স্টাফ। তিনি এমনিতেই রসিক মানুষ। আমাদের প্যারেড করাতেন লেফট-রাইটের বদলে, ‘আকাশ খাব-আমি আকাশ খাব না’ ব্যবহার করে। প্যারেডের শুরুতেই চেস্ট টান টান করে তিনিও চিৎকার- বাড়ি কোথায়? বারিও চেস্ট টান টান করে বলে-এই যে এখানে স্টাফ।
-আমি বলছি বাড়ি কোথায়?
– কলারোয়া স্টাফ।
এই বারি আর বাড়ির প্যাচে বারির চেহার হয় দেখার মত। উদভ্রান্ত হোমোসেপিয়েন্স।

আরো কিছুদিন গেলে ‘চিকেন রান’ এর মত সমফার্মে থাকার কারণে আমাদের হৃদ্যতা বাড়ে। তবু আমদের বৈপরিত্য লঘু হয় না।
ও একরুমে, আমি অন্য রুমে। ও থার্ড স্ট্যান্ড করে, আমি তিন মার্কের জন্য স্টার না পেয়ে ফার্স্ট ডিভিশান। ও শুধুমাত্র ক্লাসের বই পড়ে(পপি গাইডের যে কোনো প্রশ্নের ৪ টা অপশন সহ মুখস্থ থাকত ওর, শেষে গোলমাল পাকিয়ে ফেলত আসল উত্তর কোনটা) আমি ক্লাসের বই বাদ দিয়ে আর সব বই পড়ি।ও এ্যাথলেটিক্স আর সাতারের কারণে সর্বোচ্চ মেডেলের অধিকারী, আর আমার একখানা মাত্র মেডেল। তাও ক্যারামে। ওর ধারণা ক্যারাম পেশির খেলা, আমি সেখানে বুদ্ধি খাটাই। ও প্রশাসনের সহায়ক হাউস প্রিফেক্ট হয়, আর আমি কলেজের অপরাধ জগতের সিন্ডিকেট সদস্য।

তবু দুজনই মানবিকে থাকার কারণে শত বিরোধ থাকা সত্বেও আমাদের মানবিকতা জেগে ওঠে। আমরা পরস্পরকে সাহায্য করি। ক্লাস টুয়েলভে আমরা আবার রুমমেট হই। ও আমাকে পড়া বুঝিয়ে দেয়, বিনিময়ে আমি মাঝে মাঝে ওকে চুরি করে আনা ডাবটা, লিচুটা ভাগ দেই।

এরকমই এক সময়ে আমাদের অপরাধ সিন্ডিকেট সিদ্ধান্ত নেয়, মাছ খাব। অনেকদিন থেকেই কলেজ ফোয়ারার মাছগুলিকে বিকেলের নাস্তার ভাগ দিয়ে দিয়ে বড় করেছি।এতদিনে ওদের সময় হয়েছে ঋণ শোধ করার। তাছাড়া প্রস্তাবটা যখন ওঠে তখন মনে হচ্ছিল এই মাছের স্বাদ না নিলে সারা জীবন বিস্বাদই থাকতে হবে।
বারিকে জানালাম অপারেশনের আগের দিন। যেহেতু আমাদের রুমেই রান্নাবান্না হবে, কাজেই ওর অনুমতির একটা ব্যপার থেকেই যায়। ওকেও বেশ উৎসাহী মনে হল।
ডাইনিং থেকে তেল, মসলা, স্টীলের প্লেট, শুকনা চিকন কাঠ সবই সংগ্রহ করলাম। ডানোর কৌটাটাও পাশ দিয়ে কেটে রেখেছি, যেখানে সহজেই কাঠ দেয়া যায়। যথা সময়ে আসাদ বারিকে তুলতে গেলো। রাত তখন একটা। ও যথারীতি নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে। তবে আমরা যতই ডাকি ওর নাক তার চেয়েও বেশি ডাকে। শেষে বিরক্ত হয়ে আমরা মানে আমি, সিরাজ, আসাদ, জাবির মশারী নিয়ে রওয়ানা হলাম মাছ ধরতে। ধরলামও গোটা বারো। ভারি পিছলা মাছ। তবে আমাদের শ্রম আর মেধা তার চেয়েও পিছলা।
যা হোক ডানোর কৌটার উপর স্টিলের প্লেট দিয়ে বেশ করে তেল মসলা দিয়ে রাধলাম সেই মুন্ডুহীন(আমাদের ধারণা ছিল মাথা সেদ্ধ হবে না, তাই ফেলে দিয়েছিলাম) মাছ। আর ঠিক তখনই দেখা গেল বারি দুই গড়ান দিয়ে উঠে বসল। হাত দিয়ে চোখ ডলতে ডলতে বলল
– বিশাল পিসাপ লাগছে।
রাগে আমাদের শরীর জ্বলতে লাগল।
আমরা সবাই শ্রমের মূল্য রচনাটি কন্ঠস্থ করেছিলাম। তাই শ্রমহীন মানুষ আমাদের করুণার পাত্র। সেই করুণা থেকেই বললাম- যা, বাথরুমে যা। কারো সাথে যেতে হবে?
ও তবু বাথরুমে না গিয়ে বিছানায় মোচড়াতে লাগল। আবার তাড়া দিলাম। এবার ও বলল- ‘যাই…কিন্তু যেই বিশাল গন্ধ নাকে লাগিয়ে দিয়েছিস তাতে না পারছি ঘুমাতে না পারছি বাথরুমে যেতে।’

বারি পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্স করেছে, ইকোনোমিক্স-এ । আমি নৃ-বিজ্ঞানে। পাশাপাশি ডিপার্টমেন্ট, পাশাপাশি হল, তবু আমাদের দেখা হত কদাচিত। তার কারণেও আছে বৈপরিত্য। ও যথারীতি পড়াশুনায় ব্যস্ত, আর আমি টিএসসিতে বসে বসে দেশ জাতি উদ্ধার করি, সিনেমা দিয়ে পৃথিবী পাল্টানোর স্বপ্ন দেখি।

এইতো সেদিন হাসানের সাথে দেখা হল লাইব্রেরীর সামনে। ও আমাদের আরেক মানবিক বন্ধু। ইকোনোমিক্স-এই পড়েছে। এ কথা সে কথার পর জিজ্ঞাসা করলাম- বারি কোথায়?
ও বেশ দুঃখ দুঃখ গলায় বলল- তুই আসলেই মানুষ না। এত দিনেও জানিস না আমার বাড়ি নলসিটি।
আমি বলি- আরে,আমাদের আব্দুল বারি কোথায়?
ও বলল- ওহ..ও স্ট্যান্ড চার্ট এ জব করছে। খুলনায়।

হ্যা, বারি আর বাড়ি নিয়ে আমাদের এখনও ‘একটু’ ভুল হয় তবে সেটা ‘বিশাল’ ভুল নয়।

৫,৬৭২ বার দেখা হয়েছে

৪৯ টি মন্তব্য : “বারি কোথায়?”

  1. তাইফুর (৯২-৯৮)

    চমৎকার নামকরণ আর অসাধারণ ওপেনিং ... (খুব ভাব নিচ্ছি যেন আমি লেখালেখির খুব সমঝদার ... অবশ্য তোদের লেখা পড়ে পড়েই আজ আমার এই অবস্থা)

    খুব খুব খুব ভাল লাগসে ...

    (তারেকের একটা লেখার সূত্র ধরে 'বউ কথা কও' পড়ার পর থেকে আমি তোর 'পাংক্ষা' হই গেছি)


    পথ ভাবে 'আমি দেব', রথ ভাবে 'আমি',
    মূর্তি ভাবে 'আমি দেব', হাসে অন্তর্যামী॥

    জবাব দিন
  2. সায়েদ (১৯৯২-১৯৯৮)
    ....কিন্তু তারাও বারি আর বাড়ি নিয়ে জমিয়ে ফেললেন। বিশেষত সালেহ স্টাফ। তিনি এমনিতেই রসিক মানুষ। আমাদের প্যারেড করাতেন লেফট-রাইটের স্থলে আমি আকাশ খাব-আমি আকাশ খাব না ব্যবহার করে।প্যারেডের শুরুতেই চেস্ট টান টান করে চিৎকার- বাড়ি কোথায়? বারিও চেস্ট টান টান করে বলে-এই যে এখানে স্টাফ।

    আমি স্বাক্ষী, আমি স্বাক্ষী :)) :)) এই ঘটনা আমি বেশ কয়েকবার ক্লোজ আপ দেখছি - শুনছি 😀 ।

    বারীর ডিটেল জানতে পেরে মজা পাইলাম :hug: ।
    টিটো, দারুন তোমার শব্দ নির্বাচন, বাক্য গঠন আর প্রসঙ্গ অবতাড়নার কৌশল।
    ভালো লাগছে।


    Life is Mad.

    জবাব দিন
  3. মুসতাকীম (২০০২-২০০৮)

    টিটো ভাই আমরা কলেজে গিয়া দুই বারি ভাইর গুনগান শুনছি একজন কালা বারি ভাই আরেকজন ধলা বারি ভাই। কোন বারি ভাই নাকি হাউজ মাস্টার এর সামনে দিয়া ডাব পাইরা আনতো। এই দুঃখে হাউজ মাস্টার বদরুদ্দোজা স্যার তার মহান ডায়লগ দিছিল,

    আমি জীবনে দুইটা ভুল করছি। এক. বারিরে হাউজ প্রিফেক্ট বানাইছি। দুই. বানুরে বিয়ে করছি।

    (বিঃ দ্রঃ বানু ম্যাডাম ছিল আমাদের পৌরনীতির শিক্ষিকা। উনি যা ছিল ভাই 🙁 তা পরে একসময় বর্ণনা করব)
    এই ঘটনার সত্য মিথ্যা আমি জানি না। সবই শোনা ঘটনা।


    "আমি খুব ভাল করে জানি, ব্যক্তিগত জীবনে আমার অহংকার করার মত কিছু নেই। কিন্তু আমার ভাষাটা নিয়ে তো আমি অহংকার করতেই পারি।"

    জবাব দিন
  4. আহসানুল ময়েজ

    দোস্ত হাসতে হাসতে পেটে খিল লাগার অবস্থা
    অফিসের কলিগরা বলে ময়েজ পাগল হয়া গ্যাছে কাল থ্যাইক্যা ছুটি
    😀 :)) =)) :goragori: আমার হাসিটা এই ভাবে শুরু হইছিলো।


    আহসানুল ময়েজ

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : তাইফুর (৯২-৯৮)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।