চার গুন শূণ্য = শূণ্য (পর্ব-০০১)

ঢাকা-চিটাগাং হাইওয়ে, ঘুটঘুটে অন্ধকার চারপাশ। রাত অনেক, দুইটা-তিনটা তো হবেই। হাইওয়ের পাশ দিয়ে হাটছি, কোথায় যাবো জানি না। এত রাত্রে এখানে আমি কি করছি তাও ঠিক মনে পরছে না। একটু পর সাই-সাই করে পাশ দিয়ে বাস চলে যাচ্ছে। দমকা বাতাস গায়ে এসে লাগছে, একটু একটু ভয়ও হচ্ছে, কখন যেন গায়ের উপর এসে চাপা দিয়ে চলে যাবে একটা গাড়ি।
একটা এম্বুলেন্স খুব জোরে জোরে সাইরেন বাজাতে বাজাতে পাশ কেটে চলে গেল। এম্বুলেন্সের হেডলাইটের আলোতে রাস্তার সামনের অনেকখানি জায়গা আলোকিত হয়ে গেল। কিছু একটা পরে আছে সামনে, রাস্তার একদম পাশেই। অন্ধকারে ঠিকমতো বোঝা যাচ্ছে না যদিও। কৌতুহল হলো অনেক, আসতে আসতে সামনে এগিয়ে গেলাম।
কাছে গিয়ে দেখছি জিনিসটা।
একটা মানুষ পরে আছে মনে হচ্ছে, কোন নড়াচড়া নাই। লাশের মতো নিশ্চুপ পরে আছে। মরে গেছে মনে হচ্ছে, বেশ আগেই।
রাস্তার পাশে একটা ডেড বডি পড়ে আছে, আমার অনেক ভয় হওয়ার কথা কিন্তু না কিছুই মনে হচ্ছে না। যেন এটা একটা সাধারণ ঘটনা, হাইওয়ের পাশে লাশ পরে থাকবে এইটাই তো স্বাভাবিক, এরকম একটা ভোঁতা অনুভূতি।
অন্ধকার একটু বেশিই মনে হচ্ছে এখন, অনেকক্ষন হয়ে গেল আর কোন গাড়িও আসছে না।

একদম নিশ্চুপ চারপাশ আর আমার সামনে একটা মৃত দেহ।

মেঘ সরে চাঁদটা বের হয়ে আসছে একটু একটু করে। মানুষটার চেহারা দেখা যাচ্ছে না, শুধু পায়ের কাছটা চাদের আলোয় আবছা আবছা বোঝা যাচ্ছে।
বাম পাটা যেন একটু নড়লো মনে হলো। সামনে আগায়ে ঝুঁকে দেখার চেষ্টা করলাম, বেঁচে আছে নাকি এখনো।

মেঘের আড়াল থেকে চাঁদটা বের হয়ে এসেছে, একাদশীর চাঁদ। অন্ধকার সরে গিয়ে পুরো এলাকা নিমিষেই পরিষ্কার হয়ে গেল।
লাশটার বাম পায়ের তালুটা নড়াচড়া করছে, সাধারণ নড়াচড়া না, কেমন জানি দপদপ করছে মনে হচ্ছে। ভালোভাবে দেখা দরকার। পকেট থেকে চশমাটা বের করে চোখে দিলাম।

তেলাপোকা, অজস্র তেলাপোকা, মুখ দিয়ে আকড়ে ধরে আছে পায়ের তালুটা। কিলবিল-কিলবিল করছে আর ডানা ঝাপটে চলছে পোকাগুলো। একটা আরেকটাকে টেনে ঠেলে ফেলে দেয়ার চেষ্টা করছে। দৃশ্যটা দেখে বমি চলে আসলো।
সরে আসতে যাবো, তখন চোখে পরলো যে মানুষটার চেহারা এখন একদম পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে।
মানুষটার চোখে একটা মোটা ফ্রেমের চশমা। একাদশীর চাঁদটা চশমার লেন্সের আয়নায় প্রতিফলিত হচ্ছে।
অবাক হয়ে আবিষ্কার করলাম রাস্তার ধারে পড়ে থাকা মানুষটা আর কেউ না, লাশটা আসলে আমিই।

হার্টবিট হঠাৎ করেই বেড়ে গেল, ঘাড়ের পাশে মনে হচ্ছে কেউ গরম নিঃশ্বাস ফেলছে। আমি ভয় পাচ্ছি, প্রচন্ড ভয় পাচ্ছি, আতংকে হাত-পা অবশ হয়ে যাচ্ছে। একটা অট্টহাসির শব্দে ঘোরটা কেটে গেল।
চমকে যেয়ে লাফ দিয়ে সরে দাড়ালাম।
চাঁদটা আবার মেঘের আড়ালে চলে যাচ্ছে। আবছা অন্ধকারে একটা ছায়ার দিকে চোখ পরলো, একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে, লাশটা থেকে সামান্য একটু দূরে, হাইওয়েটার ঠিক মাঝখানে। হাসছে, পাগলের মতো হাসছে।
হাসতে হাসতে চোখ-নাক দিয়ে রক্ত পরছে কিন্ত তাও হাসি থামছে না।

চাঁদটা পুরোপুরি মেঘের আড়ালে চলে গেল আবার। মেয়েটা হাসি থামিয়ে আমার দিকে চোখ তুলে তাকালো। উলটো দিক থেকে একটা বাস আসছে। বাসের হেডলাইটের আলোতে মেয়েটাকে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। চোখের মনিতে হেডলাইটের আলো ঝিকঝিক করছে।
বাসটা তীব্র স্বরে হর্ন বাজানো শুরু করলো। যে কোন মুহুর্তে মেয়েটার গায়ের উপর এসে পড়বে বাসটা। কিন্তু ওর চোখে-মুখে কোন ভয় নেই। তারপর খুব স্বাভাবিক স্বরে মেয়েটা আমাকে জিজ্ঞেস করলো, “রাহাত-রাহাত-রাহাত, তুমি চশমা ছাড়া কি কিচ্ছু দেখতে পাওনা?”

চিৎকার দিয়ে ছুটে গেলাম ধরতে। পারলাম না, আমি পৌছানোর আগেই বাসটা চলে এসেছে, তীব্র গতিতে ছুটে এসে ধাক্কা দিল মেয়েটাকে। বাম্পারের বাড়িতে পাখির মতো উড়ে গিয়ে রাস্তার পাশে পড়লো। মাথাটা তুলে ধরে জড়িয়ে ধরলাম। পাগলের মতো কাশতে শুরু করলো মেয়েটা, মুখ দিয়ে গলগল করে রক্ত পরতে থাকলো। কিছু একটা বলতে চেষ্টা করছিল, পারছিল না। আমি চিৎকার দিতে থাকলাম, দিতেই থাকলাম দিতেই থাকলাম।

সময়ঃ রাত তিনটা, স্থানঃ ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার
খুব জোরে চিৎকার দিয়ে ঘুম ভেঙ্গে গেল রাহাতের।
ওর পাশ শুয়ে থাকা লোকটা ঘুমের মধ্যে ধমক দিয়ে উঠলো, “হারামজাদা, আরেকবার যদি শব্দ করস একদম জবাই করে ফেলবো।”
রাহাত বোঝার চেষ্টা করলো ও এখন কোথায়। জেলখানার এই জায়গাটার নাম আমদানি ওয়ার্ড। খুনের আসামি থেকে শুরু করে সুন্দরবনের ডাকাত, কারাগারের প্রথমদিন সবার জায়গা হয় এই আমদানি ওয়ার্ডে। ওয়ার্ডের গার্ডকে টাকা দিতে পারে নাই রাহাত। ফলশ্রুতিতে ওর জায়গা হলো কেচি ফাইলে।
যারা অভিজ্ঞ ক্রিমিনাল তারা প্রথম দিনই গার্ডকে টাকা দিয়ে ম্যানেজ করে ফেলে, তাদের জন্য একটু আলাদা শোয়ার জায়গা আর রাহাতের মতো যারা টাকা দিতে পারে নাই তাদের জন্য এই কেচি ফাইল। ওয়ার্ডটা বেশ বড় তারপরও যারা টাকা দিতে পারে নাই তাদের সবাইকে এক কোনায় চাপাচাপি করে শোয়ানো হয়। একজন শোয়ার পর তার বুকের উপর পা দিয়ে আরেকজন শোয়। এত চাপাচাপি করে শোয়ানোর পরও সবার জায়গা হয় না এই কোনায়, তখন গার্ডরা এসে সবাইকে পা দিয়ে পাড়ায়, পাড়ায়ে-পাড়ায়ে চিপে-চুপে বাকিদেরও ঢুকানো হয় কেচি ফাইলে।
পুরো সময়টা রাহাতের একটা ঘোরের মতো কাটছিল, দুপুরের পরে জেল গেইটে আনা হয় ওকে। কোন কিছু বুঝে উঠার আগেই ওর জায়গা হলো এই আমদানিতে।
সারা রাত একটু নড়াচড়া করাও সম্ভব না, নড়তে গেলেই পাশের মানুষজন অশ্রাব্য ভাষায় গালি দেয়, মেরে ফেলার হুমকি দেয়, কখনো কখনো হয়তো মেরেও ফেলে, জেলখানায় সবই সম্ভব। গরম আর ক্লান্তিতে কখন যে ঘুম চলে আসছিল টেরও পায়নি রাহাত।
তারপর দেখল স্বপ্নটা। তারিনের হাসিটা এখনো কানে বাজছে।
রাত বাড়তে থাকলো, আজ আর ঘুম আসবে না। ছাদের সলতে উঠা সিমেন্টের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো রাহাত। তারিনের কথা মনে হচ্ছে, প্রথম দেখার কথা।

****তারিনের গল্প****
সময়ঃ দুই বছর পিছনে, সিদ্ধেশরী, মালিবাগ মোড়।

কালী মন্দিরের ঠিক পিছনের গলিটাতে তারিনদের বাসা। চারতলার পশ্চিমের ফ্ল্যাটটা ওদের, অনেকবছর হয়ে গেল এখানে। ওর রুমের ছোট বারান্দাটা বসলেই পাশের ফাকা জায়গায় দাঁড়ানো লম্বা নারিকেল গাছটায় চোখ পড়ে।
প্রথম প্রথম তারিন খুব অবাক হতো যে ঢাকার এরকম জায়গায় এই গাছটা এতদিন টিকে আছে কিভাবে। পরে বাসার কেয়ারটেকার মামার কাছে শুনছিল যে ঐ জায়গাটা নিয়ে নাকি অনেকদিন ধরে মামলা চলতেছে তাই আর কোন বিল্ডিং উঠে নি এখনো।
তারিনের যখন অনেক মন খারাপ থাকে তখন এই বারান্দায় এসে বসে থাকে ও। মাঝে মাঝে ভাবে যে যদি মানুষ না হয়ে ঐ গাছটার মতো হয়ে যাওয়া যেতো, নীরব দর্শকের মতো সব পরিবর্তনের সাক্ষী হয়ে থাকা যেত।
বারান্দায় দাঁড়িয়ে বাসার সামনের রাস্তাটার দিকে একবার চোখ বুলালো। প্রায় ফাকা রাস্তা, একটু পর পর টুংটাং বেল বাজিয়ে একদুইটা রিকশা যাচ্ছে। এখন বাজে সকাল নয়টা, রওনা দিয়ে দেয়া উচিত তাড়াতাড়ি। ক্লাস শুরু দশটা থেকে, এই সময়টাতে রিকশাও পাওয়া যায় না। বেশ খানিকটা হেটে গলির মোড় পর্যন্ত যাওয়া লাগে।
কিন্তু তারিনের আজকে কলেজে যেতে ইচ্ছা হচ্ছে না, এই ইচ্ছে না হওয়াটা অবশ্য বেশ কয়দিন ধরেই চলছে।
আবার চোখ বুলালো রাস্তার দিকে। সামনের দুই বাসা পরের বিল্ডিংটা নতুন হচ্ছে, কন্সট্রাকশনের কাজ অনেকটাই কমপ্লিট। সেটার পাশে একটা টঙের দোকান, এলাকার উঠতি বয়সের ছেলেদের কমন আড্ডার জায়গা হয়ে গেছে যায়গাটা। কালো সানগ্লাস পড়া লোকটা আজকেও বসে আছে দোকানটাতে। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যে তারিনের মতো ঐ লোকটাও একটু পরপর সামনের রাস্তায় চোখ বোলাচ্ছে। মনে হচ্ছে কারো জন্য অপেক্ষা করছে লোকটা।
আসলে মনে হচ্ছে না, লোকটা সত্যিই সত্যিই অপেক্ষায় আছে, তারিনের অপেক্ষায়।
গত এক সপ্তাহ ধরে লোকটা ওকে ফলো করছে, প্রথম প্রথম ভেবেছিল যে কিছু না, মনের ভুল। কিন্তু দুইদিন আগে যখন ইংরেজী স্যারের বাসা থেকে বের হয়ে দেখে যে লোকটা পাশের দোকানে চা খাচ্ছে তখনই ও সিউর হয়ে যায়। লোকটা ওকে ফলো করছে। ঐদিনের পর থেকে আর কোন লুকোচরি নেই তার, গতকাল তারিনের রিকশার পিছন পিছন বাইক নিয়ে কলেজের গেইট পর্যন্তও আসলো। আবার কলেজ শেষে বাসায় ফিরার পথেও একই কাহিনী।
বাসায় ফিরতে ফিরতে অনেক আতংক কাজ করতেছিল, এই লোকটা কেন ওকে ফলো করে চলছে। কোন খারাপ কিছু হয় যদি।
লোকটা মনে হয় টের পেয়ে গেছে যে তারিন দূর থেকে তাকে খেয়াল করছে। চোখ থেকে সানগ্লাসটা খুলে তাকালো এইদিকে।
ভয় পেয়ে রুমের ভিতর ঢুকে গেল ও। নাহ ঠিক করে ফেললো মনে মনে আজকে কলেজ না গেলেও চলবে।
মা খুব সকালেই শাহবাগ গেছেন, ডায়বেটিস টেস্টের ডেইট আজকে। সো কলেজ ফাকি দেয়ার জন্য বকা খাওয়ার চান্সও নাই।
রাত্রে ঘুমানোর আগে কৃষ্ণপক্ষ বইটা পড়ছিল, সেটাই আবার শুরু করবে ভাবলো। জানালার পর্দাটা টেনে দিয়ে রুম অন্ধকার করে দিলো তারপর বই নিয়ে শুয়ে পড়লো বিছানায়।
পড়তে পড়তে একটু ঘুম ঘুম ভাব চলে আসছিল, হটাৎ করে ফোনের আওয়াজে রেশটা কেটে গেল।
হাই তুলতে তুলতে মোবাইলটা হাতে নিলো। কে ফোন করলো আবার এই ভর দুপুরে?
কাশফি ফোন দিয়েছে। ওর বেস্ট ফ্রেন্ড প্লাস একমাত্র বান্ধবীও বলা চলে। ফোন ধরলো ও মনে মনে কাশফিকে বকা দিতে দিতে।
মোবাইলের ঐ পাশ থেকে কাশফির উত্তেজিত গলা ভেসে আসলো, “ঐ তারিন, তুই কই। আসিস নাই কেনো এখনো কলেজে?”
“আসবো নারে আজকে, শরীর ভাল লাগছে না”, সংক্ষেপে উত্তর দিলো তারিন। লোকটার কথা বলিবলি করে বলা হয় নি কাশফিকে।
“না না না, তোকে আজকে আসতেই হবে, আসতেই হবে। তোর মনে নাই আজকে আমাদের জামার অর্ডার দিতে যাওয়ার কথা। তুই এক্ষনি চলে আয়, আমি কলেজেই আছি।
আর খবরদার, আসবি না বলে ম্যাসেজ দিয়ে মোবাইল অফ করে রাখবি না কিন্তু। তাইলে কিন্তু তোর বাসায় এসে ধরে বেধে নিয়ে যাবো।”
কাশফিটা এরকমই, কথায় অমত হওয়ার কোন সুযোগই দেয় না। যা বলবে তা করবেই, ওর হাত থেকে কোন রক্ষা নাই।
“আচ্ছা ঠিক আছে, আমি আসছি” বলে ফোন কেটে দিল তারিন।
ফোন রেখে আবার বারান্দায় যেয়ে উকি দিল ও। নাহ লোকটাকে আশেপাশে দেখা যাচ্ছে না। যাক ব্যাটা মনে হয় তাহলে হতাশ হয়ে চলে গেছে। কলেজে তাহলে ঘুরেই আসি আর কাশফির সাথে আগেই প্ল্যান করা যে আজকে টেইলরসে যাবে।
রেডি হয়ে ফ্ল্যাটের নীচে নামলো ও, বাসার সামনে একটা ট্রাক দাঁড়ানো। মাল পত্র বোঝাই অনেক, ওদের বিল্ডিঙ্গেয় মনে হয় আসছে। নতুন ভাড়াটিয়া হবে হয়তো, মনে মনে ভাবলো। কেয়ারটেকার মামাকে জিজ্ঞেস করবে ভাবলো একবার, পরে দেখলো যে একটা ছেলের সাথে ট্রাক থেকে জিনিসপত্র নামানো তদারকি করছে মামা। ছেলেটা মনে হয় নতুন ভাড়াটিয়াদের কেউ। চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা, তারিনের দিকে একবার চোখ তুলে তাকালো আবার পরক্ষনেই মালামাল নামাতে মন দিল।
ভাগ্য ভাল, গেটের সামনেই একটা খালি রিকশা বসে ছিল। সেটাতেই উঠে পরলো, বাসা থেকে কলেজের গেট পর্যন্ত রাস্তা খুব বেশি না, দশ-পনের মিনিট লাগে।
রিকশা চলা শুরু করলো, সামনের টঙের দোকানটা পার হতে হতেই গলির মোড়ের দিকে দৃষ্টি পরলো ওর, হার্টবিট বেড়ে গেল তারিনের। সেই লোকটা রাস্তার বিপরীত দিক থেকে আসছে। নীচের দিকে দৃষ্টি দিয়ে ও রিকশার হুড চেপে ধরে বসে থাকলো।
লোকটার বাইকটা ঠিক রিকশার সামনে এসে থামলো। রিকশাওয়ালা বকা দিতে মুখ খুলতে যাবে কিন্তু লোকটার দিকে একবার তাকায়ে চুপ মেরে গেল।
বাইক থেকে নেমে লোকটা রিকশার পাশে এসে দাঁড়ালো, হাতে একটা পলিথিনের ব্যাগ। তারিনকে জিজ্ঞেস করলো, “কলেজ যাচ্ছো বুঝি, আজকে তো অনেক দেরি করে ফেললা।” এই কথা বলেই ফেলফেল করে হাসি দিলো একটা।
তারিন কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না। তখন লোকটা নিজের পরিচয় দিল, “আমি নাসির, রাশেদ চাচার ভাতিজা। ঐ যে নতুন বিল্ডিংটা হচ্ছে না, ঐটার কাজ সব আমিই তদারকি করি।”
“রাশেদ চাচা” নামটা তারিন আগেও শুনছে মনে হচ্ছিল কিন্তু কোথায় শুনছিল মনে করতে পারলো না। কিন্তু এই মুহুর্তে চুপ করে থাকাটাই ভাল হবে ঠিক করলো।
তারিনের চুপ করে থাকাটা যেন নাসির নামের লোকটাকে আরো উৎসাহিত করলো।
ওর দিকে পলিথিনের প্যাকেটটা বাড়িয়ে দিয়ে বললো, “নেও জুস খাও, আর চকলেটও আছে। ভালো চকলেট এই এলাকার দোকানে রাখে না। বেইলী রোডে যেয়ে নিয়ে আসছি, তোমার জন্য।”
“না, আমি এসব নিতে পারবো না। আমি তো চকলেট খাই না।”, বিব্রত স্বরে উত্তর দিলো তারিন।
“না, তোমাকে নিতেই হবে। এইটা তোমার জন্য আমার প্রথম গিফট। নিতেই হবে, চকলেট খাওয়া না তো কি হইছে আজকে খাবা।”, লোকটা হটাৎ করেই রেগে গেছে মনে হলো।
তারিন এইবার একটু জোরালো গলায় বললো, “ভাইয়া, থ্যাংক্স কিন্তু আমি নিতে পারবো না।”
এই বলে, রিকশাওয়ালা মামাকে বললো রিকশা চালানো শুরু করতে।
রিকশাওয়ালা যেই প্যাডেল মারতে যাবে তখনই লোকটা রিকশার হ্যান্ডেল ধরে আটকালো আর রিকশাওয়ালাকে একটা জোড়ে সরে ধমক দিল।
ভয় হতে লাগলো তারিনের, কি হচ্ছে এসব আর ওরই বা কি করা উচিত কিচ্ছু মাথায় আসছে না।
নাসির লোকটা একহাতে তারিনের হাত ধরে আরেকহাত দিয়ে পলিথিনের প্যাকেটটা গুজে দিতে চেষ্টা করতে থাকলো, আর বলতে থাকলো “আররে নেও না, চকলেটই ত। অন্য কিছু তো আর না।”
লোকটার বলার ভঙ্গিতে বিকৃত কিছু একটা ছিল, কথাটা শোনার পর গাটা শিরশির করে উঠলো।
ঠিক এমন সময় পাশ থেকে একজন ডেকে উঠলো, “এই মেয়ে, এই যে এইদিকে।”
পাশে তাকিয়ে দেখলো যে, বাসার নীচের সেই ছেলেটা দাড়িয়ে আছে রিকশার অপর পাশে।
“তোমাকে কেয়ারটেকার মামা খুজতেছে, ছাদের চাবি নাকি তোমাদের বাসায়? ঐটা একটু লাগবে। এক্ষুনি লাগবে।”, বললো ছেলেটা।
এরকম একটা সুযোগই তারিন চাচ্ছিল, ছেলেটা কথা শেষও করতে পারে নি, তার আগেই তারিন নাসির লোকটাকে বললো, “আমি যাই, চাবিটা দিয়ে আসি। ছাদের চাবি দিতে ভুলে গেছি জানলে বাড়িওয়ালা অনেক রাগারাগি করবে।”
লোকটা কিছু একটা উত্তর দিতে যাচ্ছিল কিন্তু তারিন সেই সুযোগ লোকটাকে দিল না। রিকশা থেকে নেমেই দ্রুত গতিতে বাসার দিকে হাঁটা দিল, আড়চোখে দেখলো যে সেই ছেলেটাও ওর পিছন পিছন বাসায় আসছে।
আর লোকটা বাইকের পাশে দাঁড়িয়ে এইদিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
“কই, কেয়ারটেকার মামা কই?” বিল্ডিং এর ভিতর এসে ছেলেটাকে প্রশ্ন করলো তারিন।
ছেলেটা ওর দিকে তাকিয়ে একটু হাসলো তারপর বললো, “ঐ কথাটা বানায় বানায় বলছি, দূর থেকে দেখে মনে হচ্ছিল যে লোকটা তোমাকে বিরক্ত করছে, তাই কেয়ারটেকারের কথা বলছি।”
আহ, হ্যা, তারিনের মনে পড়লো যে চাবি তো ও গতকালই মামাকে ফেরত দিয়ে দিছে।
ছেলেটাকে কি বলবো বুঝে উঠে পারছে না। সব কিছু কেমন জানি অনেক দ্রুত ঘটছে, লোকটাও যে আজকে এরকম কাহিনী করবে চিন্তাও করতে পারে নি। নাহলে আজকে কোনমতেই বাসা থেকে বের হতো না ও।
মৃদু স্বরে ছেলেটাকে বললো, “থ্যাংক্স”।
আরো কিছু বলতে চাচ্ছিলা কিন্তু ঐ মুহুর্তে বাসায় যেয়ে ঢুকতে পারলেই স্বস্তি তাই আর কিছু না বলে চুপচাপ সিড়ি দিয়ে উঠা শুরু করলো তারিন।

*সময়ঃ আজকের রাত, ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার*

আফজাল ঘুম আসছিল মাত্র কিন্তু মধ্যে দিয়ে নতুন মালটার চিৎকারে কাচা ঘুমটা পুরা মাটি হয়ে গেল। ওর এই নিয়ে তৃতীয়বার জেলে আসা তারপরও ওয়ার্ডের পাশের টয়লেটের গন্ধ এখনো সয়ে উঠতে পারে নি সে। আমদানী ওয়ার্ডে প্রায় আড়াইশ বন্দীর জায়গা হয় প্রথম রাত্রে। বাথরুম আছে দুইটা তারমদ্ধ্যে একটা আবার নষ্ট। তাই দেখা যায় ভোর হতে হতে ঐ এক বাথরুমের মল-মুত্রে গন্ধে ওয়ার্ড ভরে যায়। আফজাল এইবার একদম খালি হাতে জেলে ঢুকছে তাই গার্ডদেরকে টাকা-পয়সাও দিতে পারে নাই নইলে হয়তো বাথরুম থেকে একটু দূরে শোয়ার সিস্টেম করা যেতো।
নতুন মালটা কেমন জানি ঢিম মেরে শুয়ে আছে, একদৃষ্টিতে ছাদের দিকে চেয়ে আছে।”শালা কি পাগল নাকি”।
একবার নিজের আশপাশের দিকে চোখ বুলালো আফজাল, অনেকেই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। মনে মনে হাসলো সে, “হইছে ঘুম তোমাদের, চারটা তো প্রায় বাজে-বাজে, একটু পরই সবগুলারে উঠাবে ঘুম থেকে তারপর শুরু হবে আসল খেলা”।

চারটার একটু পরে গার্ডরা এসে হাজির। সব কয়েদীকে রুমের বাইরে নিয়ে যাওয়া হলো। চার জন্য করে একলাইন দিয়ে ছোট ছোট ফাইল বানানো হলো। এসব কিছুর তদারকি সালাম ভাই করতেছে দেখা যাচ্ছে। গতবার জেল খাটতে এসে চেনা হইছিল সালাম ভাইকে।
জোড়া খুনের আসামী, এলাকার মেম্বার আর তার ছেলেরে নাকি কোদাল দিয়ে এক কোপে খুন করে ফেলছিল এই সালাম ভাই। অনেকদিন ধরেই তার ঠিকানা ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার।
সালাম ভাই সবাইকে বলে দিলেন যে উনি যা যা বলবেন সব অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলতে, কেউ একটু এদিক সেদিক করলে কঠিন ব্যবস্থা নেয়া হবে। প্রত্যেক কয়েদীর নাম ডেকে হিসাব মেলানো হলো একবার, তারপর সবাইকে দুই পায়ের উপর ভর দিয়ে বসতে বলা হলো।
তারপর বললো যে, একটু পরই জেলার সাহেব নতুন কয়েদীদের দেখতে আসবেন। উনি আসলেই, সালাম ভাই দাঁড়িয়ে জোড়ে বলবে, “বন্দীরা, সা-ব-ধা-ন”। এই বলার সাথে-সাথে, খাঁড়ায়ে কয়েদীদের বলতে হবে, “আসসালামুআলাইকুম, স্যার”।
এইসব যখন বলা হচ্ছে তখন আমি আরেকবার আশপাশের মানুষজনদের দেখতে থাকলাম। জেলখানায় মানুষ বুঝে চলা হচ্ছে ভাল থাকার সবচেয়ে কার্যকরী উপায়। সালাম ভাই তার “সাবধান” বলার প্র্যাকটিস চালাতে থাকলো আর আমি খুজতে লাগলাম মুরগী, একটা নাদুস-নুদুস ফার্মের মুরগী।

৩,৭৯০ বার দেখা হয়েছে

৫ টি মন্তব্য : “চার গুন শূণ্য = শূণ্য (পর্ব-০০১)”

  1. ভুতের গল্প আমার সবচে প্রিয়। রাহাতের সপ্নটা পড়তেগিয়ে ভেবেছি লাম পাইছি একটা দারুন ভুতের গল্প তাই লাইট বন্ধকরে একটা কাথা মুরিদিয়ে (ভুতের গল্প পড়ার সিস্টেম) এই গরমেও ঘেমে নেয়ে পরছি আর ভয় অনুভব করছি।কিন্তু একটু পরদেখি এটা একজনের সপ্ন!! সুধুই এতকস্ট করলাম 🙁
    তবে, জাই হোক দারুন..... একটা গল্প হবে মনে হচ্ছে।
    পরের পরবের অপেক্ষায় থাকলাম 🙂

    জবাব দিন
  2. রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)

    ব্লগে স্বাগতম। নাম বাঙলায় করে দাও আর ব্রেকেটে কলেজে অবস্থানকাল।


    এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : লুৎফুল (৭৮-৮৪)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।