সাতরঙ্গা ভালোবাসা……

অনেক সময় ছোটো একটা ইংরেজি শব্দ এত বেশি অর্থ নিয়ে সামনে দাঁড়ায় যে তার প্রযোজ্য বাংলা প্রতিশব্দ বের করা রীতিমত দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে । ঠিক এই মুহুর্তে টিনএজার এর প্রতিশব্দ যেমন খুজে পাছ্ছিনা । এত সবুজ আবেগ , সীমাহীন স্বপ্ন আর শুভ্র কল্পনার সংমিশ্রনকে আর যাই হোক কৈশোর নামক শব্দ গ্লাসে পুরোটা আটকে রাখা যায়না , মনে হয় কিছুটা যেন ঠিকই ছলকে পড়ে । শুরুটা বোধহয় বেশি সাহিত্যিক হয়ে গেল ।

ক্লাস নাইন পার করে টেনে উঠার পর খেয়াল করলাম তাত্ত্বিক রসায়নের প্রতি বিতৃষ্ণার ব্যারোমিটার পাই পাই করে উপরে উঠলেও মানব রসায়নের প্রসঙ্গে রিডিংটা যেন ঠিক তার ব্যাস্তানুপাতিক । তবে এখনো মনে হয় সেই সময় ভৌত রসায়নের চেয়ে অভৌত রসায়নেরই ( ইমোশন ) চ্যাপ্টার বড় ছিল , বাইরে থেকে না বোঝা গেলেও । সম্ভবত আমার তত্ত্বকেই প্রমান করার জন্য আমার সবচেয়ে কাছের কিছু বন্ধু ঐ সময় প্রেমে পরেছিল ।  আশিকের ( ছদ্দনাম ) পা মচকে ছিল তারই প্রতিবেশীনীর ষড়যন্ত্রে । এক ছুটিতেই দেখা , কথা এবং অতঃপর…হাবুডুবু । আশিক অবশ্য আমার কাছে সবসময়ই ডিফেন্ড করত যে ও প্রতিরক্ষার কোনো সুযোগই পায়নি । প্রায়ই বলত, মেয়েটা কুড়ে ঘরের উপর এ্যাটম বোম মেরেছে , আমার কি দোষ ? আমি মনে মনে হাসতাম আর ভাবতাম , দোষ কি আর তোমার বন্ধু… দোষ যদি থাকে তো সে রানি ভিক্টোরিয়া আর তার স্বজাতির যারা টিনেজার শব্দটি এ দেশে আমদানি করেছে । তবে আমার ভাবনায় ওলট পালট শুরু হয় তার পর থেকেই । তীব্র আকাংখাও যে গলে গলে পরতে পারে তা মাঝ রাতে আশিক কে পাগলের মত কাদতে না দেখলে বুঝতাম না । আশিক ছিল আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু , ও তো এমন ছেলে নয় । তাছারা কলেজের পরিস্থিতিযে আমাদের কান্না কে আমাদের কাছে দুর্বোদ্ধ করে দিয়েছিল । আমি চুপচাপ ওর পাশে বসে থাকতাম , হয়তো বলার কিছু খুজে পেতাম না জন্য । আর ওর ফিলিংস গুলো বোঝার চেস্টা করতাম , দেখতে না পেলেও গায়ে আছড়ে পরা উত্তাপ ঠিকই টের পেতাম । মনে আছে বিদেশ ফেরত পিতার সাথে দেখা করার জন্য আশিক একবার একদিনের ছুটি পেয়েছিল ( আমরা তখন ক্লাশ ইলেভেনে ) । কিন্তু পুত্র যে পিতৃ শোকে কতটা কাতর সে বিষয়ে আমার যথেস্ঠ সন্দেহ ছিল । এবং অত্তন্ত যুক্তিসঙ্গত কারনেই  ছুটিতে পেটের পীড়া তার মেয়াদ আরো দুইদিন বর্ধিত করল । আমি হাসতাম , পেট ব্যাথাকে এত ধন্নবাদ বোধহয় আর কেউ দেয়নি । কিন্তু কি লাভ হল এত অধ্যাবসায় এর । ক্লাস টুয়েলভ এর শেষ দিকে আনএক্সপ্লেইনড দুরত্ত আর কলেজ শেষে কাজিনের হাত ধরে নবযাত্রা । মেয়েটি এইভাবেই উপসংহার টেনেছিল । আমি শুধু আশিকের নিরুত্তাপ মুখ দেখতাম , নিরবিকারভাবে । সেইবারই আমার প্রথম নিজেকে খুব ভাগ্যবান মনে হয়েছিল , আমি কোনো মেয়ের প্রেমে পরিনি ।

ক্লশ সেভেনেই জামান ( এবারো ছদ্দনাম ) আমাদের হাউসে বেশ আলোরন ফেলে দিয়েছিল । কারন চিরিয়াখানার জন্তুর মত সিনিওর দর্শকদের নানা প্রস্নের নিরস জবাব দিয়ে যখন তাদের প্রায়ই কুপকাত করে ফেলেছিলাম তখন এই জামান তাদের ঈদ ফিরিয়ে আনলো । কি মিয়া প্রেম কর ? জি ভাই , আমার গার্লফ্রেন্ড আছে । আমাদের সতের জনের ষোল জন ই আমরা অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়েছিলাম । পরে অবশ্য নিজেদের খুব বেকুব লেগেছে যখন জানলাম এর সুত্রপাত ও যখন ক্লাস থ্রিতে তখন থেকে । মাঝে মাঝেই বলতাম দোস্ত তোর ই লাইফ , আমাদের জীবন । মনে আছে তখন ছয় মাস শুধু জামান এর প্রেম কাহিনি শুনেই কাটতো , দাড়ি কমা সহ । প্রায় ই হাউজে জামানের গোলাপি চিঠি আসতো আর আমাদের দীর্ঘশাস পরত ( চিঠি গুল ওর হাতে আসত কারন স্যারদের মাথায় তখনও ক্লাস সেভেনের চিঠি ঐ দৃষ্টিতে চেক করার আইডিয়া আসেনি ) । জামানের রঙ্গিন প্যাড আর লাল নীল জেল পেনের ছয় বছর কোনো মেঘ ছারাই কেটেছিল । কিন্তু বাংলায় শনির প্রভাব বলে একটা কথা আছে বোধহয় । কোনো দিন ক্রিকেট মাঠে না যাওয়া জামানের প্রথম উইকেটও কলেজে থেকে বের হওয়ার পরই পরে । আমি ঘটনাটা বেশ কিছু দিন পর জানতে পারি , কারন আমি তখন বিএমএ তে দলাইমলাই হছ্ছি । পরে শুধু জানতে চেয়েছিলাম কিভাবে বললো । কিভাবে আর , আপনার সাথে যখন সম্পর্ক শুরু হয় তখন আমি খুব ছোটো ছিলাম , এখন মনে হছ্ছে আমি আপনার সাথে এডজাস্ট করতে পারবনা । তখন সে একাদশ স্রেনির ছাত্রী । হয়তো কথাটা ঠিক , মানুষের বড় হতেও তো সময় লাগে । বিশেষ করে তাদের । আমরাই শুধু বড় হতে পারলাম না । সবশেষে জামান বলছিল । এক লাইনে শুধু দুইটা মাত্র বাক্য কিভাবে আট বছরের উছ্ছাসকে আজীবনের দুঃসপ্ন করে দেয় ।

দুই জনি আমার খুব খুব কাছের দুই বন্ধু ছিল । তাই আপাত সাধারন এই দুইটি ঘটনা আজ এত সময় নিয়ে লিখতে ইছ্ছে হল । কারো সাথে প্রেম না করেও আমার মনে হয়েছিল দুই বিছ্ছেদের নীল আমাকেও স্পর্শ করেছে । যদিও পরে অনেক ভেবেও এর কোনো সদুত্তর আমি পাই নি। আমার দুই বন্ধুই খুব প্রমিজিং ছিল । এটলিস্ট একটু সুযোগ দিলেও তারা মনে হয় তাদের হাত ছারতে দিত না । কে জানে , তাদের হিসেবটাই হয়তো অন্নরকম ছিল । আর ততোদিনে আমি বিঃশাস অবিঃশাসেরও অনেক দূরে , দাড়িপাল্লাই ছুরে ফেলে দিয়েছিলাম ।

কলেজে প্রায় ই একসাথে রংধ্ধনু দেখতাম । বে নি আ স হ ক লা । কিন্তু কই , সাত রঙ তো পাছ্ছিনা । চারটা কি পাচ টা । ধুরছাই , রংধনুতে সাত রঙ কোনোদিন ই ছিলনা । আমরা তাই বলতাম । বোধহয় টিনেজার আমাদের কথায় বিধাতা মুচকি হেসেছিলেন । নইলে কি আর আজ সব এমন হত । আমার দুই বন্ধুই আজ নতুন করে মৌলিক রসায়ন পরছে ( এইবার আর সুযোগ নাই , একেবারে কালেমা পরে আর কি…) । এই আমিই তো এমন রসায়নবিদের পাল্লায় পরেছি , এখন ভৌত অভৌত রসায়নের সাথে উচ্চতর গনিতও করতে হছ্ছে । ভাগ্যিস কলেজে রংধনুর চার পাচটা রঙ দেখতাম । বিধাতা মনে হয় সবার জন্যই দুই তিনটা রঙ আলাদা করে রাখেন । সাধে কি আর বলে উস্তাদের মাইর শেষ রাতে । এখন শুধু একটাই প্রার্থনা , ফিকে হয়ে যাওয়া এই সবুজ রঙ যেন কলেজের মত আবার গাঢ় হয়…………।

৩,৬৩১ বার দেখা হয়েছে

৪৩ টি মন্তব্য : “সাতরঙ্গা ভালোবাসা……”

  1. মাসরুফ (১৯৯৭-২০০৩)

    🙂 অসম্ভব সুইট একটা লেখা।আমার মত কর্কশ মানুষেরও হৃদয় ছুঁইয়ে গেল।আচ্ছা তৌহিদ ভাই, আপনি , আহসান ভাই এঁরা কিভাবে উর্দির আড়ালে কঠোর জীবনের মাঝেও বুকের ভেতরের স্পর্শকাতরতার শিখরে যে আবেগ-তা এত মধুরভাবে রক্ষা করে চলেন!অনেক ভাল লাগল ভাইয়া-আশা করি আপনার রাসায়নিক বিক্রিয়ায় প্রত্যাশিত ফলাফল অবশ্যই পাবেন।দাওয়াত আশা করছি কিন্তু!

    জবাব দিন
  2. সায়েদ (১৯৯২-১৯৯৮)
    আচ্ছা তৌহিদ ভাই, আপনি , আহসান ভাই এঁরা কিভাবে উর্দির আড়ালে কঠোর জীবনের মাঝেও বুকের ভেতরের স্পর্শকাতরতার শিখরে যে আবেগ - তা এত মধুরভাবে রক্ষা করে চলেন!

    মাসরুফের বিস্ময়ে বিস্ময়াবিষ্ট হতে হতেও হলাম না। কারণ আমি খানিকটা হলেও কঠোর জীবনের মাঝেও বুকের ভেতরের স্পর্শকাতরতার শিখরে যে আবেগ - তা এত মধুরভাবে কিভাবে রক্ষা করে চলা যায় তা জানি। অন্তত কাছের কয়েকজনকে দেখে বুঝেছি। হিরম্ময় সেই ছয় বছরের "মুগ্ধ অচিনপুর" যে পিছু ছাড়ে না! মনের ভিতর আকুলি বিকুলি করা সেই উচ্ছাস সততই প্রকাশিত হবার সুযোগ খোঁজে। কিন্তু সবখানে কি তা পারা যায়? সিসিবি সেই বিরল একটা সুযোগ। এটা এমন একটা জায়গা যেখানে মন প্রাণ ঢেলে উজাড় করে দেয়া যায় সবকিছু। মনে হয় যেন কিছুই হারাইনি, আমি বুঝি এখনও সেই সময়েই আছি।
    জয়তু সিসিবি।
    শাবাস তৌহিদ :clap: ।


    Life is Mad.

    জবাব দিন
  3. কামরুলতপু (৯৬-০২)

    বহুৎ মন খারাপ আমার ঈদের দুদিন আগে দেশ ছেড়ে এখানে এসে দেখি ঈদ প্রায় শেষ। তাই আর কি করা সম্বল মোর সিসিবি খানি ধরলাম। অনেক নতুন লেখা ( আসলে ইচ্ছা করেই দেশে একটা লেখাও পড়িনাই এই মন খারাপ সময়ে কাজে লাগবে ভেবে) । শুরু করলাম এই লেখাটা দিয়ে। খুব ভালো লাগল ভাইয়া। সবচেয়ে ভাল লাগল জিহাদ,মাশরুফ,সামিয়া পরিচিত নামগুলা দেখে আর অনেক নতুন লেখক দেখে।
    @মুহিব
    তুই কি রংপুরের মুহিব ঐ যে গোলক নিক্ষেপ এ কলেজে ফার্স্ট হইতি। আমার কথা মনে আছে? সিলেটের কামরুল। সেই হকির সাতদিনের কথা মনে আছে নাকিরে?

    জবাব দিন
  4. মাসরুফ (১৯৯৭-২০০৩)

    তৌহিদ ভাই,ঈদ মোবারক।ঈদের জামাত থেকে এসে সায়েদ ভাই আর আপনাকে লিখলাম।বাকিদের কল করার ইচ্ছে আছে।মন খারাপ করবেন না ভাইয়া-আপনার হয়ে আমি ডাবল আনন্দ করে নেব!ঈদ মোবারক!

    জবাব দিন
  5. হাসনাইন (৯৯-০৫)

    ভাইজান,
    ঈদের দিনের সকালটা মধুর হইয়া গেল। মধু ঝরতেছে ভাই নাইলে এমুন মিঠা কেন?? :boss:
    ভাই তাও কিছু রঙ দেখছেন আমি-ত রঙ কই পাওয়া যায় সেটাই জানিনা। 😛
    সবশেষে ঈদের শুভেচ্ছা লওন। 😀

    জবাব দিন
  6. তৌফিক (৯৬-০২)

    ভালোবাসার ব্যাপারে আমার দেখা ঘটনাগুলা মিশ্রিত। চরম চাপের মধ্যেও অবিচল থাকতে দেখেছি আর সামান্য কারণে ভেঙে যেতেও দেখেছি। তবুও বালক বালিকাদের ভালোবাসাবাসি থামানো যাবে না, যার মরার কথা সে তো মরবেই। লেখাটা হইছে একেবারে :gulli:

    জবাব দিন
  7. কাহিনী কি? সবাই ধুপধাপ এতো দারুন লেখা শুরু কইরা দিলো ক্যামনে?
    আমার তো অবস্থা কেরোসিন। এই মাত্র একটা লেখা পইড়া হাসতে হাসতে গড়াগড়ি দিলাম আবার এখন এইটা পইড়া মনডা কেমন উচাটন হইয়া গেলো। চোক্ষে পানি আসি আসি করতেছে।
    অখন আমি কই যাই?

    জবাব দিন
  8. আহ্সান (৮৮-৯৪)

    আমার বলার কিছু ছিলোনা...না গো...
    তৌহিদ, কি যে বলবো, ঠিক বুঝে উঠতে পারছিনা...
    তবে বুকের মাঝের কষ্টের সাথে রংধনুর নীল রঙের যে সখ্যতা হয়ে গেছে তা অনুভব করেছি...
    বিধাতা সবাইকে সুখী করুক...।

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : সায়েদ উল হাসমত (৯২-৯৮)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।