আমরা বুড়িকে মেরে ফেলেছি

ইতালির টুরিস্ট সিটি ভেনিসের মূল আকর্ষন তার খালগুলো, খাল্গুলোকে কাজে লাগিয়েই শহর চলছে, লন্ডন, সেন্ট পিটারসবার্গ, আর্মস্টারডাম ইত্যাদি শহরের চমৎকার অতিথিপরায়নতার মধ্যে আছে নদী, নেভা নদী, রাইন নদী। নদী আমাদেরও ছিল, ঢাকার মধ্যেই ছিল, নদীর নাম বুড়িগঙ্গা। বুড়িগঙ্গায় গত দশ বছরেও নাকি মাছ নেই, আগে হেথায় সেথায় দু একটা শুশুক লাফিয়ে উঠত, এখন সেটাও নেই।

পৃথিবীর বসবাস অযোগ্য শহরের মধ্যে ঢাকা শহর এক নাম্বারে অবস্থান করছে, বেশ কয়েক বছর ধরেই প্রথম হৈ হৈ করছিল, শেষ মেষ হয়েই গেলো। বাতাসে ভয়াবহ সীসা, পানিতে লাখে লাখে জীবানু, আর অপরিকল্পনার চূড়ান্ত প্রমান শহরের বসতবাড়ি। মেট্রোপলিটনের বাতাস ধীরে ধীরে ফুরিয়ে আসছে, চিনে সাল্বুটামলের মতো ছোট ছোট স্প্রে তে পরিস্কার বাতাস বিক্রি শুরু হয়েছে, হয়ত আমাদের অদূর ভবিষ্যতে বাতাস কিনে টানতে হবে। এক বোতল পরিস্কার বাতাস ১০ টাকা মাত্র।

অথচ শহরটাকে আমরা সুন্দর করে সাজাতে পারতাম, বুড়িকে রক্ষা করে পর্যটন কেন্দ্র বানাতে পারতাম। অসম্ভব মনে হচ্ছে? আমার নিজের ধারণাকে ব্যবহার করে বলছি, দ্বিমত হলে অবশ্যই জানাবেন। সদরঘাট থেক লঞ্চ টার্মিনাল সরিয়ে আরো দূরে নিয়ে যেতাম, তাতে লঞ্চ টার্মিনাল যোগাগোগের ব্যবস্তাই থাকতো, ব্যবসাকেন্দ্র হয়ে উঠত না। বুড়িগঙ্গার পাড় ধরে তৈরি হয়েছে অসংখ্য টিনের চালা, বাশের উপর নদীর মধ্যেই এসব চালা। গরিবের আবাসিক হোটেল বলা হয়, রিকসাআলারা ২০ টাকা দিয়ে রাতে এখানে থাকে। এসব আবাসিক চালা হোটেলের মাধ্যমে যে পরিমান বর্জ্য নদীতে আসছে, সরকারী জায়গা নষ্ট হচ্ছে তা বলাই বাহুল্য। অথচ লঞ্চ টার্মিনাল সরিয়ে দিলে এসব আবাসিক চালার জায়গায় আমরা তৈরি করতে পারতাম- নদি তীরের রেস্তোরাঁ, একতালা লঞ্চেও বানানো যায় রেস্তোরাঁ। ঢাকা শহরের মানুষের থাকার যায়গার যেমন অভাব তেমন অভাব চিত্ত বিনোদনের, সিনেমায় আজকাল কেউ যায় না, ক্রিকেটের টিকেট সবার ভাগ্যে জোটে না, নভোথিয়েটারের শো সবার মন-পছন্দ হয় না, খুব সহজেই সদরঘাট থেকে-নারায়নগঞ্জ ২ ঘন্টার আপ ডাউন ট্রিপের ব্যবস্থা করা যেত, নদীর নীরবতা, সামান্য স্ন্যাকস, জুস- কোলা, সাইট সিয়িং ইত্যাদি একেবারে মন্দ হত না।

ভূটানের রাজার সন্তান হয়েছে পরশু, ভুটানের রাজা দেশজুড়ে গাছের চারা লাগিয়ে সন্তান বরন করে নিয়েছেন, আমি মাঝে মাঝে ভাবি আমাদের মাশরাফি-সাকিব-তামিমেরা ঢাকা শহরজুড়ে লাখ পাঁচেক গাছের চারা লাগাতে পারে না কি? নিশ্চিত ভাবেই বলতে পারি ক্রিকেটাররা এমন সিদ্ধান্ত নিলে বন বিভাগ, পর্যটন মন্ত্রানালয়ও এগিয়ে আসবে সাহায্য করতে।

দেশজুড়ে আমাদের ফিল্মস্টাররাও এমনটা করতে পারেন, গাছের চারা লাগাতে পারেন, নিজের শহরে, হাইওয়ের পাশে গাছের চারা লাগানো যায়, অক্সিজেনের পরিমানটা একটু বাড়ে, শহরের উপর একটু চাপ কমে, মানুষের একটু উপকার হয়।

আমাদের সংবাদিকরা দুটো কলাম রাখতে পারেন পত্রিকায়, শহরগুলোকে কিভাবে বাসযোগ্য করা যায় সেই মতামতের উপর, নিজের মতামত, মানুষের মতামত সেখানে ছাপানো যেতে পারে। একমাস জুড়ে বানিজ্য মেলা হয়, একমাস জুড়ে একটা কৃষিমেলাও করা যেতে পারে, সবাই সেই মেলার প্রমোশন করলে হয়ত মেলা বানিজ্য মেলার মতো লেগেও যেতে পারে।

পরিবর্তনের শুরু নাকি নিজেকে দিয়ে, বাসা থেকেই শুরু করা সম্ভব, বাসায় গ্যাসের চুলো জ্বালিয়ে কাপড় শুকালে সেইটা বন্ধ করুন, বর্জ্য ফেলার জন্য দুটো বালতি রাখতে পারেন, একটায় পচনশীল বর্জ্য, আরেকটায় পলিথিন, প্লাস্টিক, কাগজ। প্লাস্টিক-কাগজ বিক্রি করা সম্ভব, আর পলিথিন সম্ভব হলে পুড়িয়ে ফেলা সম্ভব, তাতে মাটি বাঁচে, মাছ বাচে, শহর বাঁচে।

বাসার ছাদে ডজন খানেক টমেটোর- আর কাঁচা মরিচের চারা বোনা খুব কঠিন কিছু না, এরা অযত্নেও বাড়ে, শীতের দুপুরে এরা ছোট ছোট টমেটো দেবে, কাচামরিচের ফুল দেবে, আমার মা বলে নিজের হাতে বোনা গাছের চারা নাকি সন্তানের মতো, একটা মায়া আসে ওদের জন্য, মায়াহীন কাঠ- ইট-সুরকির শহরে টমেটো-কাচামরিচের সাথে ফ্রি-তে না হয় মানবিক গুনাবলীরও একটা চর্চা করা গেলো।

আমি স্বপ্ন দেখি- শহর চিড়ে দুটো মেট্রো রেলের লাইন, প্রতি ঘন্টায় ৫০০০০ করে দুটো লাইনে এক লাখ যাত্রী আসা যাওয়া করছে, রাস্তার উপর চাপ কমেছে, পাবলিক ট্রান্সপোর্টের প্রতি ভরসা আসায় আমরা গাড়ি কেনা কমিয়ে এনেছি, ফিটনেস বিহীন গাড়িগুলো আমরা উঠিয়ে নিয়েছি, সকাল নয়টা থেকে সন্ধ্যা আটটা পর্যন্ত বড় রাস্তা, হাইওয়েতে আমরা রিকশা চলাচল বন্ধ করেছি। আমার ভাবতে ভালো লাগে, বুড়িগঙ্গাকে লালন পালন করে বাঁচিয়ে তুলেছি আমরা, ওর তীর জুরে সারি সারি বাতি, রেস্তোরাঁ, নদী জুড়ে ছোট ছোট যাত্রীবাহী ক্রুইজ। আমার মনে হয় একসময় আমরা আমাদের ভালবাসতে শিখে গেছি, প্লাস্টিকের প্যাকেটটা নদীতে ছুঁড়ে না দিয়ে, ডাস্টবিনে ফেলছি, সমস্ত শহরজুড়ে কুকুরের মতো পা উঁচিয়ে দেয়ালে প্রসাব করছি না।

আমি ভাবি আমরা স্কুল-কলেজে- বিশ্ববিদ্যালয়ে ধূমপান করবো না, পাবলিক ট্রান্সপোর্ট, রেস্তরাঁয় ধূমপান নিশিদ্ধ হবে চিরতরে, আমাদের নেতারা হাতির ঝিলে পোস্টার সেঁটে গান্ধা করবেন না, প্রচরণা করবেন বাড়ি গিয়ে গিয়ে।
অনেক স্বপ্নের কথা, সাধের কথা লিখলাম, নিজেরই অবাস্তব লাগছে, হয়ত তাই, আমরা আমাদের ভালোবাসি না, আমরা আমাদের সামনের প্রজন্মের কথা চিন্তা করি না একদমই, সেদিন ডিক্যাপ্রিও বলে গেলো ক্লাইমেট চেইঞ্জের কথা, সিনেটর বার্নি স্যান্ড্রারস অবিরত বলছেন, আমরা শুনি, মাথা নাড়াই, পরক্ষনে ভুলে যাই। গত কয়েক বছরে তাপমাত্রা পৃথিবীর বেড়েছে ১০ ডিগ্রী সেলসিয়াস, উন্নত জাতিরা সাবধান হচ্ছে, রি-সাইকেল করছে, ১০০ কেজি বর্জ্য প্লাস্টিস থেকে আবার ৯০ কেজি প্লাস্টিক বানাচ্ছে, কাগজ থেকে কাগজ, গাছ বাঁচাচ্ছে, নবায়ন যোগ্য শক্তিতে নির্ভর হচ্ছে, তেলের দাম কমে গেছে, এক ব্যারেল তেলের দামের থেকে ব্যারেলের দামই বেশি, অথচ আমাদের টনক নড়ে না, গ্যাস শেষ হয়ে গেলে আমাদের কি দিয়ে চলবে সেই ভাবনা আমাদের আসে না।

প্রতিদিন আমাদের বিদ্যুৎ ঘাটতি, প্রয়োজনের তুলনায় বেশি গ্যাস উদপাদন, ঢাকার নতুন বাসা বাড়িতে শুনেছি এখন আর গ্যাস সংযোগ দেয়া হয় না, টনক কি তবু নড়বে না?
আমি আবারো খুব খুব করে স্বপ্ন দেখি, আমাদের ছেলেমেয়েরা ডাক্তারি ইঞ্জিনিয়ারিং নামক চক্র থেকে বের হয়ে আসছে, পরিবেশবিদ হচ্ছে, নদী, বন নিয়ে গবেষনা করছে, পাখি-ডলফিল জরিপ করছে,পশু চিকিৎসক বাড়ছে, কৃষিবিদ বাড়ছে।

বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লীগে আমরা বরিশাল-ঢাকা-রংপুরকে সমর্থন দিয়েছি, নিজের শহর হওয়ায় সমর্থন দিয়েছি, নিজের শহরকে একবার ভালোবাসতেও শেখা দরকার। হয়ত বাসযোগ্য শহর আমাদের হাত ধরেই হবে, হয়ত আকাশ কুসুম কল্পনা করছি। হোক তবু কল্পনা, ভাবতে ভালো লাগে, নিজের পক্ষে যতোটুকু সম্ভব ততটুকুই না হয় করি আপাতত।

৪,০১২ বার দেখা হয়েছে

৫ টি মন্তব্য : “আমরা বুড়িকে মেরে ফেলেছি”

  1. আহসান আকাশ (৯৬-০২)

    গত ২০ বছরে মাত্র আড়াই বছর ঢাকায় থাকার সৌভাগ্য(!) হয়েছে। ছুটিছাটায় ঢাকায় গেলে আমার রীতিমত দমবন্ধ লাগে। এমনকি আমার ছেলেও দুবার ঢাকায় গিয়ে দুবারই অসুস্থ্য হয়ে পড়েছে।

    তোমার স্বপ্নগুলো কল্পনা করতে ভাল লাগে, কিন্তু বাস্তবরূপে দেখার মত কোন লক্ষন দেখতে পাই না। রাষ্ট্রীয় বা ব্যক্তিগত (গুটিকয়েক ব্যতিক্রম ছাড়া) এসব নিয়ে তেমন কোন সচেতনতাই চোখে পড়ে না।

    কিছুদিন আগেও 'ভবিষ্যত প্রজন্ম' এর জন্য চিন্তা বিষয়টা কেমন জানি ভেগ লাগতো, কিন্তু এখন নিজের হাতের মধ্যে ভবিষ্যত প্রজন্মকে ধরে রেখে ওরা কিসের মুখোমুখি হতে যাচ্ছে তা চিন্তা করে আসলেই শংকায় পড়ি।


    আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
    আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷

    জবাব দিন
  2. 🙂 বাহ্ বাহ্ বলে মিথ্যা সান্তনা দিতে চাই না। তবে ১টা কথা বলি। আমিও সপ্ন দেখি,সুধু ঢাকা নয় আমাদের দেশটাও তোমার পরিকল্পনার মতো সুন্দর করে সাজবে। আর হ্যা কবে হবে, কবে হবে,জানি না। তবে আজ থেকে নিজের কাছে নিজে প্রতিগ্যা করলাম। আমার দ্বার কখনো আমার দেশ নোংরা হবে না। জদিও অতিতেও আমি সচেতন ছিলাম তবে আজ থেকে প্রতিগ্যাবদ্ধ হলাম।নিজে ঠিক পথে হাটলেই তো অন্নকে সঠিক পথে হাটার অনুরোধ করতে পারবো।

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : আসাদ (৭৭-৮৩)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।