বোবা জোনাকিদের বিবমিষা

সকাল থেকেই বৃষ্টি পরছে, প্যাচপ্যাচে কাঁদা জমে গেছে রাস্তায়। জেলেপাড়ায় লণ্ঠন নিভে গেছে সব, বলহরির বাড়ির হারিকেনও বোধ করি নিভে গেছে। নদীপাড়ের দিকে তাকায় অমল, কয়েকটা নৌকা মাত্র মাছ ধরার জন্য তীর ছেড়ে গেল, এরমাঝে বলহরির নৌকা আছে কিনা অমল নিশ্চিত হতে পারলো না।

বলহরির বউ মারা গেছে গত বসন্তে, কলেরায়। শ্মশান পাড়ায় গড়াগড়ি দিয়ে কেঁদেছে বলহরি। একটা বোবা মেয়ে নিয়ে এরপর বলহরির বসবাস, জোছনা তার নাম। জোছনাকে বড় ভালো লাগে অমলের, বাড়ন্ত শরীরটা দেখলেই অমলের কামনা রেনু রেনু হয়ে ভেঙে ছড়ায় বাতাসে। বোবা মেয়ের সাথে কথা বলার কত চেষ্টা করেছে অমল, কিন্তু কথা তো কিছুই বোঝে না জোছনা।

বলহরির স্বচ্ছল সংসার, দুইটা নৌকা, চারটা জাল। কাঁচা টাকাও আছে কিছু। রঙিন শার্ট পরে বলহরি শুক্রবার গঞ্জে যায়, সুগন্ধী তেল কানের পাশের চুল চুইয়ে গালে গড়ায়, মেয়ের জন্য চুড়ি ফিতা কেনে বলহরি, ৩ টাকার টিকেট কেটে ভিসিআর এর লেট নাইট শো দেখে কাদেরর ছাপড়ায়, চোলাই মদের বোতল বগলে করে বাড়ি ফেরে। লোকে বলে বলহরি বিপদে মানুষকে টাকা দেয়, সাহায্য করে, কথা দিলে কথার বরখেলাপ করে না।

আর অমলদের সংসার ঠিক বিপরীত,বিধবা মা আর অমলের ছাপরা ঘরের সংসার, অমল কিস্তিতে মাছ ধরে সপ্তাহে তিন দিন, সেই টাকা দিয়েই সংসার চলে। ঘরের চালা এই বৃষ্টিতে পচেই গেছে, টিন কেনা হয়েছে কিছু আরো লাগবে কিছু, টাকায় কুলায় না। ফাইসা মাছ আর টেংরা মাছের জীবনে ইলিশ ধরা দেয় না, ইলিশেরা চলে যায় বাঁধানো শানের বাবুদের আড়তে।

চোলাই মদের বোতলে চুমুক চালায় অমল, শরীরটা অবশ হয়ে আসে অল্প অল্প। বলহরির বাড়ির দিকে পা বাড়ায় অমল। জোছনার জানালা বৃষ্টির কারণে বন্ধ, চিকন লোহার গজাল গলিয়ে জানালাটা খুলে ফেলে অমল। বলহরির নাক ডাকার আওয়াজ নেই, মাছ ধরতে গেছে আজ রাতে নিশ্চয়ই। অন্ধকার চোখে সয়ে আসতেই বিছানায় জোছনাকে দেখতে পায় অমল, ভারী বুকটা হাপরের মতো ওঠানামা করছে, ভীষণ ভালো স্বাস্থ্য জোছনার, হাত বাড়ায় জানালার শিক গলে সে। বৃষ্টির শব্দে কিছুই শোনা যাচ্ছে না আশে পাশের, ব্যাঙের ডাক ব্যতিত। খসখসে জামার উপর দিয়ে জোছনার বুকে হাত রাখে অমল, রাজ্যের সকল পেলবতা সেখানে, ছোট পলিথিনে ভরা দলাদলা মাখন বুঝি, একটা হাতে স্তন আঁটে না অমলের, কেঁপে ওঠে জোছনা, হাত সরিয়ে নিতে বাধ্য হয় অমল। একটু শীত শীতের জন্যই বুঝি গায়ে কাঁথা টেনে নেয় জোছনা। গভীর নিঃশ্বাস শোনে অমল, ঘুম ভাঙেনি তাহলে জোছনার।

এবারে গলার কাছে জামার ভেতরে হাত গলায় অমল, চামড়ার মসৃণতা দাস বাড়ির পুকুরের স্থির পানিকে হার মানায়। জামার মধ্যে আর কিছুই নেই, ঠাণ্ডা হাতে চলে আসে একটা স্তন, তর্জনী আর বুড়ো আঙুল দিয়ে স্তনবৃন্তটা ধরতেই ধড়ফড় করে মুচড়ে ওঠে জোছনা, হয়ত ব্যথায়, হয়ত ঠাণ্ডা হাতের কারণে। গো গো করে শব্দ করে জোছনা, ভীষণ ভয় পেয়ে যায় অমল।

দ্রুত জানালা ছেড়ে সরে আসে, দৌড়ে রাস্তায় ওঠে। ভয়ে বুকটা ধুপধুপ করছে অমলের এখনও। চিনে কি ফেলেছে ওকে জোছনা? জেলেপাড়ায় বহিদ্দার এর কাছে নালিশ করবে বলিহার জানতে পারলে? অজানা আতঙ্কে বার বার কাঁপতে থাকে অমল।
পায়ে কাঁটা ফুটতেই অমল চেতনা ফিরে পায়, একটা কৈ মাছের উপর পা পরেছে। বর্ষায় কৈ মাছ কানে লাফিয়ে হেঁটে এক জলাশয় থেকে অন্য জলাশয়ে যায়, পানি বদল করে। কৈ মাছের মাথাটা সাবধানে ধরে ফেলে অমল, পাশে আরো দুটো লাফাচ্ছে, সেই দুইটাকেও ধরে। মাছ কিভাবে ধরতে হয় সেটা জেলেদের সন্তানদের রক্ত থেকে রক্তে গড়ায়, শিখিয়ে দিতে হয়না। বিদ্যুৎ চমকালে অমল দেখে বড় সোনালী কৈ, পেটের কাছে হলুদাভ রং তাদের, মনটা হুট করে ভালো হয়ে যায় অমলের।

বিকাল থেকে দাস বাড়ির পুকুরপারে অপেক্ষা করছে অমল, বিকালে পানি তুলতে আসে জোছনা। আজ এখনও এলো না। বিরক্তিতে কয়েকবার থুতু ফেলে সে। তার সাথে একটা ঠোঙা, সেইখানে হরিদাসের নামকরা জিলাপি, কাউয়ার ঠ্যাঙ এর মতো চিকন চিকন প্যাচের জিলাপি, কিন্তু স্বাদে সব গঞ্জের সেরা। জোছনার জন্য কিনে এনেছে সে।
সন্ধ্যার দিকে জোছনা আসে, ঘাটে বসে পানি তুলতে, কলসী ভরে উঠে দাঁড়াতেই সামনে পরে অমল। ওর একটা হাতে জিলাপি ধরিয়ে দেয়, মুখে আঙুল দিয়ে শব্দ করতে মানা করে, হাতে ধরে নিয়ে যায় পাশের ক্ষেতের ঢালে।

– তোকে আমার খুব ভাল্লাগেরে জলদাসী
– খিল খিল খিল
– তোকে লয়ে গঞ্জে যাইতে ইচ্ছা করে
– খিল খিল খিল
– একটা সিনেমা দেখবার মন করে জোছনা
– খিল খিল খিল
– দেক তোর জন্য ঠোঁটের রং কিনাছি, সাবান কিনাছি
– খিল খিল খিল

হাতে সাবান আর লিপস্টিক গুঁজে দেয় অমল, মেয়েটি শুধু খিল খিল করে হাসছে, পরিস্কার ঘষা শামুকের খোলের মতো হাসি, সাবান নেড়ে চেড়ে দেখে জোছনা, আর অমল অধিকার করে নেয় জোছনার একটা স্তন। হাতের তেলোয় পিষতে থাকে, বাঁধা দেয় না জোছনা, মাঝে মাঝে আড়ষ্টতায় কেঁপে ওঠে, জিভ চালায় অমল জোছনার ঘাড়ে, বারে বারে ঘাড়ে জিভ নড়ে একটা জলঢোরা সাপের মতো। ঢালের জায়গায়তেই আধাশোয়া করে ফেলে জোছনাকে, অমলের শরীরের নীচে পরে যায় জোছনা।
কয়েকটা নীরব মুহূর্ত, কয়েকটা অজানা কৌতূহলের মুহূর্ত। আজানা আতংকে অমলকে ঠেলে সরিয়ে দেয় জোছনা, উঠে দাঁড়ায়। কিছুক্ষন চেয়ে থাকে অমলের চোখের দিকে, আবার খিল খিল করে হেসে কলস আর ঠোঙা নিয়ে দৌড়ে পালায়।

পেতে পেতে গিয়েও না পাওয়া নিস্তেজ করে তোলে অমলকে। তবুও একটা হাসি ফুটে ওঠে ওর ঠোঁটে। সেদিন রাতে তাহলে জোছনা বুঝতে পেরেছিল সবই, চিনেও ছিল বটে।

শুক্রবার নদীতে যাবার কথা থাকলেও,আর গেলনা অমল,ঘর থেকে বের হয়ে সিদ্ধান্ত বদল করে সে। গঞ্জের দোকানে দিয়ে একটু হাটাহাটি করল, নাপিতের দোকনে ঢুকে চুল সিথি করে আচড়ালো, রেডিওতে গান শুনলো কিছুক্ষণ। তপন- মজনুদের সাথে একটু গল্প করল। শরীরটা বিশেষ ভালো যাচ্ছে না, পেটের মধ্যে গ্যাস গ্যাস লাগছে। সন্ধ্যার দিকেই বাড়ির দিকে পা বাড়ায় অমল।

ঘরের সাথেই লাগোয়া পাকঘর, পাকঘরের বাইরে পিড়িতে বসে আছে মায়ের বেড়ালটা। কিন্তু সন্ধ্যার পর বিড়াল কখনও পাকঘরের বাইরে বের হয়না, কেউ আছে নাকি পাকঘরে? নিশব্দে ঘরে ঢোকে অমল, মাটিতে খসখস শব্দ তার কৌতূহল বাড়ায়, আলতো পায়ে হেটে পাকঘরের বেড়ার ফাঁকা দিয়ে উঁকি দেয়। তার মায়ের বুকের উপর গোঙাতে থাকা বলহরিকে চিনতে তার বেশি বেগ পেতে হয়না।

– আপনি কইছেন টিনের টাকা দেবেন
– দিমুনা কি কইছি, দিমু তো
– আপনি আশা দেখাইয়া আমার লগে এইরাম অত্যাচার করেন, আমি বহিদ্দারের কাছে নালিশ দিমু
– আরে ঢ্যামনা মাগী, কিছু নিবি কিছু দিবি না?
– কবে দেবেন আপনি টিন?
– দিমু, দিমু, তোর পোলা তো আর কেন্তে পারবে না, আমিই দিমু
– কবে দেবেন?
– সময় হইলেই পাবি, আরেকটু ফাক কর পা দুইটা, কর লক্ষ্মী কর।

ভীষণ বমি পায় অমলের, দৌড়ে ঘর থেকে বের হয়ে যায় সে, দাস বাড়ির পুকুরের ঢালে হড়হড় করে বমি করে। ঢালেই কাত হয়ে শুয়ে পরে অমল। অন্ধকার সব গ্রাস করে নিচ্ছে, জোনাকী পোকারা মাত্রই বের হতে শুরু করেছে, টিপ টিপ আলো জ্বেলে যেন জোনাকিরা অমলের ঘৃণার জানান দিচ্ছে, পুকুরের শাপলা পাতাটা আবছা হয়ে গেছে, একটা ঢিল তুলে শাপলা পাতাটার দিকে ছুঁড়ে মারে অমল, একটা ঢুপ শব্ধ হয়, বিশাল পুকুর এরপর স্থিরচিত্তে গ্রাস করে নেয় ঢিলটাকে।

( বহিদ্দার- জেলেপাড়ার মাতুব্বর, জলদাস/ জলদাসী- জেলেদের হিন্দু পদবী)

২,০৮৬ বার দেখা হয়েছে

২৫ টি মন্তব্য : “বোবা জোনাকিদের বিবমিষা”

      • রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)
        জামার ভিতর থিকা যাদুমন্ত্রে বারায় ডাহুক,
        চুলের ভিতর থিকা আকবর বাদশার মোহর,
        মানুষ বেবাক চুপ, হাটবারে সকলে দেখুক
        কেমন মোচর দিয়া টাকা নিয়া যায় বাজিকর।

        আমি লাকি যে হক সাহেবের যাদুর ছোয়া উপলদ্ধি করতে পারছিলাম।
        এই যুগের যারা কবিতা ল্যাখে তারা কি শুধু ল্যাখে না পড়েও?

        পরাণের গহীণ ভিতরের অলংকরণ, প্রচ্ছদ সব হক সাহেবের করা।

        শিমুল মুস্তাফার আবৃত্তিও খুব ভালো ছিলো।


        এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ

        জবাব দিন
  1. মোকাব্বির (৯৮-০৪)

    বলহরির আরেকটা চেহারা এভাবে প্রকাশ পাবে ধারণার বাইরে ছিল। :thumbup:


    \\\তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা
    অবুঝ শিশু হামাগুড়ি দিল পিতামাতার লাশের ওপর।\\\

    জবাব দিন
  2. তোমার লিখার সবচে বড় গুন হলো এইটা একই সাথে পড়া, দেখা এবং ছোঁয়া যায়। চিত্রকল্প চোখের সামনে এতোটাই স্পষ্ট থাকে যে মনে হয় হাত বাড়ালেই চরিত্রগুলি ছোঁয়া যাবে। এই গুন সবার থাকেনা।
    বরাবরেই মতই অসাধারন লিখা! 🙂 :clap: B-)

    জবাব দিন
  3. দিবস (২০০২-২০০৮)

    লেখাটা পড়ে মানিক বন্দোপাধ্যায় এর কথা মনে পড়ল। পদ্মা নদীর মাঝির ১টা ফিল পাচ্ছিলাম। সুন্দর একটা ছোটগল্প পড়লাম, ঘুম ভাঙ্গার পর,ঘুম ঘুম চোখে।


    হেরে যাব বলে তো স্বপ্ন দেখি নি

    জবাব দিন
  4. রকিব (০১-০৭)

    গল্পে অতিরিক্ত আদিখ্যেতা নাই, বাহুল্যের নামমাত্র গন্ধ নেই। দারুণ ভাবে গাথুনি দাঁড় করিয়েছো। অনেক দিন পর একটা গল্প পড়ার পর মনে হলো-- মনে থাকবে অনেকদিন। :hatsoff:


    আমি তবু বলি:
    এখনো যে কটা দিন বেঁচে আছি সূর্যে সূর্যে চলি ..

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : মোকাব্বির (১৯৯৮-২০০৪)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।