রাশিয়ার দিনলিপি

রাশিয়ার তুষারপাতে রাশিয়ানদের ঘোরাফেরা, বরফ-কেলী সাজলেও বাংলাদেশীদের সাজে না। ক্লাস শেষ করেই সোজা হোস্টেলে ফিরে আসা হয়, বইপত্তর ঘাটতে ভালো লাগে না বেশিক্ষন তাই হাত চলে যায় সুখপাঠ্যতে, মাঝে সাঝে সিনেমা। সম্প্রতি পড়া বইয়ের পাঠক প্রতিক্রিয়া।

7170325512_3d7981c2da-209x300

রাশিয়ার দিনলিপি
– সৈয়দ নাজমুদ্দিন হাশেম

সর্বপ্রথম সচলায়তনে বইটির একটি পাঠক প্রতিক্রিয়া পড়ে বইটির প্রতি আগ্রহ জাগে। তখন থেকেই মনে ছিল বইটির কথা। বইমেলায় শুদ্ধস্বর এর স্টল থেকে কিনে ফেললাম বইটি। সাথে ছিলেন সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন মইন বায়েজিদ। ক্যাপ্টেন মইন ভাই মুখ বাঁকিয়ে বললেন- ব্যাটা তুই-ই তো রাশিয়া থাকিস, রাশিয়ার দিনলিপি তুই পড়ে কি করবি?

কর্মসূত্রে সৈয়দ নাজমুদ্দিন হাশেম সোভিয়েত ইউনিয়নে গিয়েছিলেন ১৯৮০-র- দশকের দ্বিতীয় ভাগে। লেখক নিজে সারাজীবন সমাজতন্ত্রে আস্থা রেখেছিলেন। তাই তার সোভিয়েত যাত্রা ছিল অনেকটাই স্বপ্নভূমিতে পদার্পনের।
বইটি মোটা দাগে তার ভ্রমনের ডায়েরী কিন্ত নিছক তা নয়। লেখকের ইতিহাসপ্রেমী মন খুঁজে ফিরেছে লেনিনগ্রাদের ইতিহাস, যুদ্ধ ও বিপ্লবের ইতিহাস। বিচিত্র সব জ্ঞান উঠে এসেছে তার লেখার মাঝে। যে বিষয়েই লিখছেন সেইখানেই এসে পরেছে নানা প্রসঙ্গের চোখ ধাঁধানো বহুবর্নিল আলো।

বইটির প্রথম অধ্যায় অপরাজেয় লেনিনগ্রাদ। যেই শহরের বর্তমান নাম সেন্ট পিটার্সবার্গ। লেনিনগ্রাদবাসীর যুদ্ধকালীন সময়ের তীব্র দুঃখ কষ্ট আর প্রতিরোধের উপাখ্যানের বর্ননা আছে অধ্যায়টিতে।

লেনিনগ্রাদ শহর তখন অবরুদ্ধ। জর্মন সেনারা শহর ঘিরে রেখেছে। পুরো শহরজুড়ে প্রচন্ধ অভাব সাথে প্রচণ্ড হাড় কাঁপানো শীত। খাবারের দৈনন্দিন বরাদ্দ নেমে এসেছে ১২৫ গ্রাম ওজনের এক টুকরো পাউরুটিতে। যার অর্ধেকই গমের বদলে মেকি পদার্থের সমন্বয়ে প্রস্তুত। প্রতিদিন মারা পারছে শত শত লোক।

বর্ননা আছে পিস্কারেভস্কোয়ের গোরস্থানের। সেখানে সংরক্ষিত আছে আছে ছোট স্কুলছাত্রীর তানিয়ার রোজনামজা। একটি পাতায় লেখা-

জেনিয়া আজ সাড়ে বারোটায় মরে গেল। আজ ডিসেম্বর ২৮, ১৯৪১
দাদী আম্মা ২৭ জানুয়ারি, ১৯৪২ বিকালে মারা গেলেন।
১৭ মার্চ সন্ধ্যা ৬ টায় লেকা মরল।
১৩ এপ্রিল বিকেল ২ টায় ভাসিয়া চাচা মরে গেলেন
১০ মে ১৯৪২ বিকেল চারটায় মরলেন লিওশা চাচা
মামনি গেলেন ১৩ মে।
পুরো পরিবার মৃত, সকলেই মৃত।
বাকি রইল শুধু তানিয়া।

সকল স্থলযোগসূত্র বিছিন্ন হয়ে লেনিনগ্রাদ মৃতপ্রায়, তবু অপরাজিত। নগরীর মানুষরা যখন আশা ছেড়েই দিয়েছে বেঁচে থাকার তখন ১৯৪১ সালের ২২ নভেম্বর সে অবিস্মরণীয় দিন এল। খাবার দাবার জ্বালানী শীতবস্ত্র নিয়ে সেদিন প্রথম ট্রাকের কাফেলা ল্যাদোগা হ্রদের হালকা বরফের আস্তরণের ওপর দিয়ে অবরুদ্ধ লেনিনগ্রাদে পৌছায়। কত ট্রাকচালকের ছিন্ন বিছিন্ন দেহ বোমার আঘাতে সমাহিত হয়েছে ল্যাদোগা হ্রদে। তবু থামেনি জীবনশিখা প্রজ্বলিত রাখার শেষ চেষ্টা।

বর্ননায় উঠে এসেছে অপরাজেয় সকল শব্দসৈনিকদের গল্প। অবরুদ্ধ লেনিনগ্রাদ যখন সমগ্র দুনিয়া থেকে বিছিন্ন তখন লেনিনগ্রাদ বেতার অপরাজিত তরঙ্গ ছড়িয়ে পড়ছে রাশিয়া সহ সারা দুনিয়াজুড়ে। জর্মনরা যখন প্রচার করছে লেনিনগ্রাদের মৃত্যু কয়েক ঘন্টার ব্যপার মাত্র তখন শব্দ সৈনিকেরা বেতারে চালিয়ে যাচ্ছেন তাদের যুদ্ধ আর প্রেরণাদান।

অবরুদ্ধ বাংলাদেশের মানুষ যেমন দীর্ঘ নয় মাস স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের আওয়াজের জন্য কান পেতে ছিল, ঠিক তেমনি সমগ্র লেনিনগ্রাদবাসী কান পেতে থাকতো লেনিনগ্রাদ বেতারের জন্য।

সেই বেতারে ভাষণ দিয়েছিলেন লেনিনগ্রাদের সন্তান সুরস্রষ্টা দিমিত্রি শাস্তাকোভিচ। তিনি বলেছিলেন- আমি আপনাদের আশ্বাস দিতে চাই যে আমরা অপরাজেয়।
তিনি বলেন শত বাধার মধ্যে বসেই তিনি তার সপ্তম সিন্মোফনির প্রথম ও দ্বিতীয় ভাগ রচনা করছেন।

আর্মেনিয়ার ক্রন্দসী বলে খ্যাত আন্না আখমাতোভাও জলন্ত লেনিনগ্রাদের স্ফুলিঙ্গে প্রজ্বলিত বেতারে ভাষণ দিয়ে সবাইকে প্রেরনা দিয়েছিলেন।

বর্ননায় উঠে এসেছে লেনিনগ্রাদের সব চমৎকার স্থাপত্য এর কথা। সেন্ট আইজ্যাক, পিটার ও পল দুর্গ, স্মনলি ইনস্টিটিউট, আর্মিতাজ( হেরমিটেজ), পিটারহফ প্রাসাদ ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি ( অনেক অনেক কিছু বোঝানোর অর্থে)

আর্মিতাজের( হেরমিটেজ) এর কথা দুই কলম না লিখলে বইটির অপমান করা হবে। প্রথমে সল্প পরিসরে এর প্রাসাদ খুলে দেয়া হলেও, ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে এর রূপ ও যৌবন।

অষ্টাদশ শতকে একটি চমৎকার সওদাবাজি করে আর্মিতাজ। প্যারিসের কাউন্ট বদোয়ার কাছ থেকে ১১৯ টি শিল্পকর্ম তারা ক্রয় করে। এর মধ্যে নয়টি রেমব্রান্ট, ছয়টি ভ্যান ডাইক, চারটি ভ্যান অস্টাড এবং তিনটি জাকোব ভ্যান রুইসডালের সৃষ্টি।
আগেও রেমব্রান্টের কিছু কর্ম তারা সংগ্রহ করেছিল তাই এখন হল্যান্ডের বাইরে আর্মিতাজেই রেমব্রান্টের বৃহত্তম সংগ্রহ মজুদ।

রেমব্রান্ট এর চিত্রকর্ম বর্তমানে যেগুলো আর্মিতাজে ( হেরমিটাজে) সংরক্ষিত আছে-

#ফ্লোরা
#আব্রাহামস স্যাকফিরাইস ( আব্রাহামের পুত্রবলি)
#ড্যানে
#Portrait of Baertje Martens
#দ্য হোলি ফ্যামিলি উইথ এঞ্জেলস
#ওল্ড ম্যান ইন এন আর্ম চেয়ার
#কানে দুল পরিহিতা তরুনী
#দাড়িওয়ালা পুরুষ
# লাল পোশাক পরিহিত বৃদ্ধ ইত্যাদি

আর তার সকল চিত্রকর্মের বর্ননা পাবেন এখানে।

এছাড়াও আর্মিতাজের সংগ্রহশালা ভারী থেকে ভারী-তর হয়েছে ভ্যান ডাইকের সেলফ পোট্রেট এবং অন্য বিখ্যাত চিত্রকরদের ব্যাকাস, ডোবা, নর্তকী, মাংশ ভক্ষনের আগে- ইত্যাদি সব মনোহর চিত্রকর্মে।
যারা দেখতে আসেন আর্মিতাজ তারা ভেতরের ১২ মাইলই পায়ে হেঁটে ঘুরে দেখেন। এটি দুনিয়ার সবচেয়ে বড় সংগ্রহশালা। আর্মিতাজে ৪০০ টি কামরায় প্রায় ৩০ লাখ দর্শনীয় সামগ্রী আছে।

সোভিয়েত ইউনিয়ন বিপ্লব ও রক্তের দেশ। লেখকের মাধ্যমে আমরা জানতে পারি রুশ বীরদের কথা। অব্যর্থ লক্ষভেদী স্নাইপার ভাসিলি জাইতসভকে দেখতে পাই। তিনি বলেছিলেন- আমাদের কাছে ভলগার অপর পারের কোন অস্তিত্ব নেই। তার এই কথাটি প্রেরণাস্বরূপ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তিনি ২৪২ জন জর্মনের খুলি উড়িয়েছিলেন। তিনি চার দিন লড়ে অপরায়জেয় জর্মন মেজর কোয়েনিগকে হত্যা করেন।

দুঃসাহসী নাবিক মিখাইল পানিকাখার কথা জানতে পারি, তিনি বুকে গ্রেনেড বেঁধে শত্রু ট্যাঙ্কের উপর ঝাঁপিয়ে পরেছিলেন। ছিলেন সিগন্যাল কর্মী পুতিখভ, তিনি দাঁত দিয়ে বিদ্যুৎবাহী তার মেরামত করতে গিয়ে স্বেচ্ছায় প্রান দেন, কারণ তার হাত আর কাঁধ গুলিতে বিছিন্ন হয়ে গিয়েছিল।

একজন গোলন্দাজ ছিলেন যিনি গুলি ফুরিয়ে যাবার কারণে একটি জর্মন মেশিনগানকে বন্ধ করতে পারেননি। তাই তিনি হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে নিজের শরীর মেশিনগানের মুখে আটকে মেশিনগান বন্ধ করার চেষ্টা চালান।

আমরা পাই মেয়ের কাছে লেখা বাবার চিঠি-

১৮ সেপ্টেম্বর, ১৯৪২

প্রানপ্রিয় মিলা ( লুদমিলা)

চিঠির সাথে একটি নীল ঝুমকো ফুল পাঠালাম। ভাবো দেখি চারিদিকে যুদ্ধ,রক্ত, লাশ, গোলা বারুদ তার মাঝে ফুটেছে এই ফুলটি। ফুলটি বেড়ে উঠে আকাশের দিকে হাত বাড়িয়েছিল কিন্তু গোলা তাকে বোটা থেকে বিছিন্ন করেছে। আমি যদি তখনি তাকে না তুলে নিতাম সে বুটের তলায় পিষ্ট হয়ে যেত। আমার যতক্ষন রক্ত আছে ততক্ষন লড়ে যাবো, যাতে কোন ফুলকে আর বুটের তলায় পিষ্ট না হতে হয়। আমার কথা যদি পুরোপুরি না বুঝতে পারো, মাকে জিজ্ঞাসা করো, সে তোমায় বুঝিয়ে বলবে।

গার্ড মেজর
দিমিত্রি পেত্রাকভ।

বাবা যুদ্ধ থেকে ফিরে আসেননি, তাই ছোট্ট মিলার মূর্তিতে এখনও ফুল গুঁজে দিয়ে আসে দর্শনার্থীরা।

বইটির শেষ অধ্যায় -সোভিয়েত খাদ্যসম্ভার

সোভিয়েত ইউনিওন তথা রাশিয়ার খাদ্যসম্ভার লেখককে পূর্ন তৃপ্তি দিয়েছিল, বর্ননা এবং অধ্যায় এর বিশালতায় তার প্রমান পাওয়া যায়।
রুশদের খাবার সবসময় শুরু হয় জাকুস্কি দিয়ে। অর্থাৎ স্টার্টার। এই রীতির প্রচলন করেন স্কান্ডেনেভিয়া থেকে আগত রাজকুমার রুখির।

জাকুস্কি তৈরি করা হয় নানাবিধ খাবারের মিশ্রন দিয়ে। একই থালায় থাকে অর্ধেক করে কাটা ডিমসেদ্ধর ওপর ছোট মাছ ভাজা ( লেটুস পাতা ও বিলেতি বেগুন দিয়ে সাজানো) সাথে থাকবে লাল পেঁয়াজ কুঁচি, বেগুন কুঁচি, গাজর, ও ছোট লাউয়ের কুঁচি ভাজি। থাকবে ব্লিনি ( গমের আটার পাটিসাপটা) এবং পরিবেশন করা হবে লাল ও কালো ক্যাভিয়ার, থাকবে বাটি ভর্তি গরম মাখন ও মাসকলাই।

রাশিয়ানদের ইকরা এবং ক্যাভিয়ার প্রীতি এখনও চোখে পড়বার মতো।
জাকুস্কির দ্বিতীয় অংশে থাকছে আস্পিক পাতার উপর মাছ ও গরুর জিভ ( ভাজি) অতিরিক্ত আরেক পর্ব ইকরা ও ক্যাভিয়ার আসবে। থাকবে আলুর সালাদ ও টক ননি।
সাথে থাকতে পারে বকরির চটকানো কলিজা ও বাটি ভর্তি টক ননি। হেরিং মাছে ডিম আসবে লেবুঢ় রস তেলে মিশ্রিত হয়ে।
মাংসের সালাদে থাকবে- মুরগীর ছোট করে কাটা বটি। সেদ্ধ আলু, গাজর, শশা, ডিম এবং লেটুস পাতা দিয়ে সাজানো।

লেনিনগ্রাদের বিখ্যাত বরমা সরুয়ার কথা না বললে নয়- হরিনের মাংস, বিট, গাজর,আলু দিয়ে তৈরি এই সুপ পরিবেশন করা হয় মাটির রং বেরং এর হাঁড়িতে। সাথে থাকবে টাটকা গরম গোল রুটি ও ইকরা।

আর্মেনীয় খাবার আমাদের মতোই শাহী, এরা সকালে হালকা খেলেও দুপুরে ভোজ সারে ভেড়া অথবা বকরির পায়ের রোস্ট, ঘন দই, সাথে থাকে মরিচ, রসুন ও দারচিনি ও সিরকায় ভেজানো জলপাই।

জর্জিয়ার সুরুয়া আর একটি চমৎকার খাবার। ভেড়া অথবা খাসির মাংস, পেঁয়াজ দিয়ে চটকানো, সাথে থাকবে বাগদা চিংড়ি, টমেটো চটকানো, ধনে, ভাপে সেদ্ধ চাল ইত্যাদি।

রাশিয়ার দিনলিপি বইটি একটি সুখপাঠ্য, অনলাইনে পিডিএফ ভার্শন এখনও দেখিনি। যাদের সুযোগ রয়েছে তারা সংগ্রহ করে পড়তে পারেন।

১,৭৮৯ বার দেখা হয়েছে

৩ টি মন্তব্য : “রাশিয়ার দিনলিপি”

মওন্তব্য করুন : রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।