“মৌলানা সলায়মান রাজাকারের মুখে স্পঞ্জের স্যান্ডেলের বাড়ি”

রাশিয়া আসার পর থেকেই শুনছি রব ভাইয়ের কথা। উনি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। আজ একজন প্রবাসী মুক্তিযোদ্ধার কিছু কথা তুলে ধরার চেষ্টা করব।

সরদার মোঃ আব্দুর রব মুক্তিযুদ্ধের সময় ৯ ও ১০ নাম্বার সেক্টরে যুদ্ধ করেছিলেন,মূলত ৯ নাম্বার সেক্টরে মেজর জলিলের অধীনে। যুদ্ধে যাবার গল্প শুনতে চাইলে গল্প বললেন ভাই। ফেব্রুয়ারী মাসে পাকিস্তান থেকে ছুটিতে বাড়িতে বেড়াতে আসেন রব ভাই এর চাচা শেখ কাতিবুর রহমান,যিনি তৎকালীন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে হাবিলদার পদে কর্মরত ছিলেন। তখন সর্ব পাকিস্তানে উত্তপ্ত অবস্থা। ৭ই মার্চ ভাষণ শোনার পর আর ফেরত যাননি সেনাবাহিনীতে। ২৮ মার্চ রব ভাইদের বাড়ি পুড়িয়ে দেয়া হয়। তখন তিনি নিজের বড় ভাই সরদার মোঃ আব্দুর রউফ কে নিয়ে কাতিবুর রহমানের বাহিনিতে যোগ দেন। কাতিবুর রহমান ছিলেন একজন দক্ষ সৈনিক ও অত্যন্ত বুদ্ধিমান।তিনি সবাইকে নিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন।

রব ভাইয়ের সাথে আর কারা যুদ্ধ করেছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন আব্দুল হাই বিশ্বাস,নজির আহমেদ, ও ৬ শ্রেণীর বালক মোঃ মতিউর রহমানের নাম।তিনি বলেন এরা প্রতেকে ছিলেন অকুতোভয় যোদ্ধা ও জাতির সেরা সন্তান।
আর একটি ছোট তথ্য জানা যায়, সমগ্র বাংলাদেশ ১৬ ডিসেম্বের স্বাধীন হলেও, কিছু পাকিস্তানী সৈন্যদের সাথে নিয়ে রাজাকাররা খুলনা সদর মুক্ত হতে দেয়নি। তখন রব ভাইদের দল খুলনা উপশহরে অবস্থান গ্রহন করে। তখনকার বাগদাঙ্গা আনসার বাহিনীর ক্যাম্প ছিল রাজাকারদের ঘাটি। চারিদিকে বৃষ্টির মত গুলি চলছে, মাথা নিচু করে রয়েছেন রব ভাইদের দলের সকলে। সবার চোখকে ফাকি দিয়ে ক্যাম্পের দিকে হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে যায় বালক মোঃ মতিউর রহমান। জয় বাঙলা বলে গ্রেনেড চার্জ করেন মোঃ মতিউর রহমান।প্রচণ্ড শব্দে কেউ বুঝতে পারেনি কি হয়েছে, রব ভাই দেখেন বালক মোঃ মতিউর রহমান শুয়ে আছেন,এগিয়ে যান তিনি। বালক মোঃ মতিউর রহমান তাকে বলেন ” রব ভাই আমার পেটের কাছে খুব গরম লাগছে”।
রব ভাই তাকে কোলে তুলে পাগলের মত ছুটে যেতে থাকেন নিজেদের ক্যাম্পের দিকে। পথে মারা যান বালক মোঃ মতিউর রহমান। মতিউর রহমান একবারের জন্যও বুঝতে পারেননি তিনি গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন,পুরো পেট রক্তে ভেসে গিয়েছিল তার। বলতে বলতে কেদে ফেলেন রব ভাই, নিজেও পানি ধরে রাখতে পারিনি।
খুলনা শহর স্বাধীন হয় ১৭ ডিসেম্বের দিবাগত রাতে।

রব ভাই মুলত যুদ্ধ করেন নড়াইল, লোহাগড়া ও যশোর সদরে। যশোরের অবস্থা তখন খুব খারাপ। দিনে দিনে রাজাকাররা পুরো শহর দখল করে নিয়েছিলো। পিছু হটার এক পর্যায়ে শিমুলিয়াতে তাদের ঘিরে ফেলে রাজাকাররা।তখন প্রচণ্ড বৃষ্টির দিন।আর একটু পিছিয়ে বিছালি করিডর এর কাছে পৌঁছে যান রব ভাইরা। চারিদিকে রাজাকার। বিছালিতে এক ডোবার মধ্যে আশ্রয় নেন রব ভাই ও আর ২ জন। পানিতে ডুবে শুধু নাক উচু করে বেচে ছিলেন ২ দিন।
নড়াইল শহরে তখন মৌলানা সলায়মান রাজাকারের যুগ। নড়াইল আইডব্লিউটিএ লঞ্ছ ঘাট ছিল তাদের ঘাটি। প্রত্যেক দিন হিন্দু যুবক ও মুক্তিযোদ্ধা সন্দহে জবাই করা হত কাউকে না কাউকে। জল্লাদের নাম ছিল আকমল জল্লাদ। গলাকাটার পর মৌলানা সলায়মান ও জল্লাদ আকমল একসাথে মদ্য পান করতেন। আর পিছনের ওয়েটিং রুম এ চলত গনধর্ষণ।

রব ভাই আর বলেন,বাংলাদেশের উপর অত্যাচার চালিয়েছে রাজাকার বাহিনি,মুলত রাজাকার বাহিনী। কারন নড়াইল ,শিমুলিয়া অঞ্চলে সেনাবাহিনী ঢুকতে পারেনি, শুধু বোটে করে পাহারা দিয়েছে,কিন্তু রাজাকাররা বাড়ি বাড়ি গিয়ে মানুষ ধরে এনে মেরেছে।
স্বাধীনতার পর দল বল ছেড়ে দিয়ে সলায়মান রাজাকার হজ করতে যান। ফিরে এসে এলাকার মাতুব্বর বনে যান।কোন এক কেসের হাজিরা দিতে একবার আদালতে যান মৌলানা সলায়মান, সেখানে উপস্থিত ছিলেন রব ভাই। আদালত চলাকালীন সময়ে তিনি উঠে দাঁড়ান। ” তোর উপর লানত পরবে” এই বলে তিনি নিজের স্পঞ্জের স্যান্ডেল খুলে মৌলানা সলায়মানের উপর ঝাপিয়ে পড়েন। দুটো বাড়ি দেন তিনি। এক বাড়িতে আবার মৌলানা সলায়মানের টুপি খুলে পড়ে।
আদালত অবমাননার অভিযোগ আনা হয় রব ভাইয়ের নামে। দুই দিন কারাগারে রাখা হয় তাকে,পরে উপরস্থ কর্মকর্তাদের তৎপরতায় মুক্তি পান তিনি, অভিযোগ তুলে নেয়া হয়।
এরপর তিনি রাশিয়া চলে আসেন, সেন্ট পিটার শহরে। মেকানিকাল ইঞ্জিনেরিং এ স্নাতক শেষ করেন,রাশিয়া সরকারের বৃত্তিতে এম এস করেন পাওয়ার ইঞ্জেনিরেইং এ। বিয়ে করেন রাশিয়াতে। এখন নিজের বেবসা রয়েছে। আর আমাদের রব ভাবী নিখুঁত বাঙলা বলতে পারেন।
আপনি অনেক ভাল থাকবেন রব ভাই,আমাদের সবার শুভ কামনা আপনার জন্য।

৭০৩ বার দেখা হয়েছে

৮ টি মন্তব্য : ““মৌলানা সলায়মান রাজাকারের মুখে স্পঞ্জের স্যান্ডেলের বাড়ি””

  1. আহসান আকাশ (৯৬-০২)

    দারুন কাজ করেছ হামীম :thumbup: সরদার মোঃ আব্দুর রবকে :salute:


    আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
    আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : হামীম (২০০২-২০০৬)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।