এলোমেলো-৩: বান্দরবান

রাজশাহী থেকে ঘুরে আসছি মাত্র দুই দিন হল- এমন সময়ে জনি বলল, “চল, এই উইকএন্ডে বান্দরবান ঘুরে আসি”। আমার যদি অনেক টাকা থাকত তাহলে আমি সারা দুনিয়া ঘুরে বেড়াতাম। আফসোস্‌, এত টাকা তো আমার নাই! তারপরও আল্লাহ যা দিছেন তা দিয়ে আমার মত একলা মানুষের মোটামুটি দেশের এমাথা-ওমাথা ঘুরে আসা যায়। ফলাফল- জনির প্রস্তাবে আমি সাথে সাথে রাজী। অফিস থেকে বৃহস্পতিবার ছুটি নিতে হবে। বুধবার রাতে রওনা দিব, দুইদিন ঘুরব আর শনিবারে ফিরে আসব- এই হল আমাদের প্ল্যান। যাব আমরা পাঁচ জন- আমি, জনি, অপু, মৌ (অপুর বৌ) আর মাজু। সৌদিয়ার একটা এসি বাস পাওয়া গেল বান্দরবান যাওয়ার, রাত ১১টায় ছাড়ে। মাজু ঐটার টিকেট কাটল আর অপু পর্যটনের মোটেলে দুইটা রুমের বুকিং দিয়ে ফেলল। আমার কষ্ট শুধু ব্যাগ গুছানোর আর বাস ছাড়ার আগে বাস স্টেশনে যাওয়ার। কি আর করা- কিছু কষ্ট তো মেনে নিতে হয়ই! বাসে উঠে এদিক-ওদিক তাকালাম যদি কোন রাজকন্যা দেখতে পাওয়া যায়! বুঝলাম, রাজকন্যারা রাতের বাসে চলাচল করতে বিশেষ আগ্রহী না। কানে ইয়ারফোন গুঁজে দিয়ে আধো ঘুম আধো জাগরণের মধ্য দিয়ে আমার বাস যাত্রা চালায়ে যেতে লাগলাম।
পর্যটনের মোটেলটা মেঘলা নামের চমৎকার একটা জায়গায়। ওখানে পৌঁছলাম ভোর ৭টায়। একটা রুমে ব্যাগ রেখে ফ্রেশ হয়ে সকালের নাস্তাটা ওদের হোটেলেই সেরে নিলাম। খাওয়া খুব একটা খারাপ না, তবে দাম একটু চড়া। যে দুইটা রুমে আমাদের উঠার কথা, ওখানে উঠতে পারলাম না, ভিআইপি গেস্ট নাকি লাঞ্চ করে তারপর রুম ছাড়বেন। অতক্ষন তো অপেক্ষা করার সময় নাই, তাই অন্য দুইটা রুম নিয়ে নিলাম। তিনতলায় কোনার দিকে দুইটা রুম। বাকী তিনটাকে রুমে রেখে আমি আর অপু রওনা দিলাম বান্দরবান শহরের দিকে। ভাগ্যিস, পথে একটা সিএনজি পেয়ে গিয়েছিলাম, নাহলে এই পাহাড়ী পথে হাঁটতে হাঁটতে খবর হয়ে যেত! আমরা যেসব জায়গায় যাব তার একটা লিস্ট আগেই করা ছিল। ঐ লিস্ট অনুযায়ী প্রান্তিক, ন্যাচারাল পার্ক, মেঘলা আর নীলাচলের যাওয়ার জন্য একটা জিপ ভাড়া করে নিয়ে আসলাম। প্রান্তিক জায়গাটা একটা লেকের মাথায়। কিছুটা নির্জন, কিছু দূরে পাহাড়, লেকের পানিতে মেঘের ছায়া- আমার খুব ভাল লেগে গেল জায়গাটা। ওখান থেকে চলে গেলাম ন্যাচারাল পার্কে। কয়েকটা পশু-পাখি একটা জায়গায় খাঁচাবন্দী করে রাখা, সাথে অনেক রকমের গাছ। উষ্ণ আর আর্দ্র আবহাওয়ার জন্য কিনা জানিনা, এই জায়গাটা আমার মোটেও ভালো লাগেনাই। অবশ্য ওখানের আমগুলো দেখে খুব লোভ হচ্ছিল। সেখান থেকে চলে এলাম মেঘলা- আমাদের মোটেলের কাছাকাছি একটা স্পটে। সবুজ পানির লেকের উপর দুইটা ঝুলন্ত ব্রীজ, কয়েকটা কৃষ্ণচূড়া গাছ- বেশ সুন্দর স্নিগ্ধ একটা জায়গা। হাঁটতে লাগলাম একটা ব্রীজের উপর। শেষ মাথায় দেখি একটা বৌদ্ধ ভিক্ষু একটা মেয়ের সাথে কথা বলছে- দুজনের মুখেই কেমন যেন একটা অপরাধী ভাব। ভিক্ষুদের প্রেম করার অনুমতি আছে কিনা জানি না, তবে বোকাসোকা চেহারার এই ভিক্ষুটার প্রতি বেশ মায়া জন্মায়ে গেল। বেশ কিছুক্ষন ওখানে বিশ্রাম নিয়ে, নিজেরা নিজেরা গল্প করে চলে এলাম। ড্রাইভারটার মনে হয় বেশ তাড়া ছিল, তাই সে বলতে লাগল- নীলাচলের রাস্তা বন্ধ, ওখানে এখন যাওয়া যাবেনা। অগত্যা মোটেলে আমাদের ফিরে আসতে হল। এত ক্লান্ত ছিলাম যে, দুপুরের খাওয়াটা শেষ করেই সাথে সাথে একটা ছোটখাট ঘুম দিয়ে ফেললাম। বিকেলে বান্দরবান শহরে একটু ঘোরাঘুরি করে সন্ধ্যার মধ্যে আবার রুমে ব্যাক করলাম। তার কিছুক্ষন পরেই শুরু হল বৃষ্টি। ইসসস…দিনের বেলায় বৃষ্টিটা হলে মনে হয় আরো উপভোগ করতে পারতাম! ওখানেই রাতের খাবার শেষ করে চুটিয়ে কার্ড খেললাম, তারপর সোজা ঘুম। এর মধ্যে অবশ্য মাজু প্রায়ই তার আমেরিকা প্রবাসী বউয়ের সাথে ব্যস্ত থাকত। প্রেমিক-প্রেমিকারা যখন ফোনে অনেক্ষন কথা বলে তখনই আমার বিরক্ত লাগে, আর এই ব্যাটা তো বিবাহিত। মানুষ এত কিসের যে কথা বলে বুঝি না!!
পরদিন সকালে আবার মোটেলে নাস্তা, তারপর ওদেরকে দিয়েই একটা জিপ ভাড়া করায়ে নিলাম- আগেরদিনের বেয়াদব ড্রাইভারটাকে নিয়ে আর ভ্রমণ করার ইচ্ছা ছিল না। এবার যাব চিম্বুক, নীলগিরি, শৈলপ্রপাত,স্বর্ণমন্দির আর যদি সম্ভব হয় তাহলে নীলাচল। বেশ লম্বা পথ, মাঝখানে মিলংছড়িতে নেমে দুপুরের খাবারে অর্ডার দিয়ে আসলাম। এখানে নাকি ২ ঘন্টা আগে থেকে খাওয়ার অর্ডার দিয়ে দিতে হয়। চিম্বুক, নীলগিরির রাস্তাটায় অনেক বাঁক, পথটাও বেশ উঁচু-নিচু। আমাদের ড্রাইভার দেখি এই রাস্তায়ও বেশ স্পীড তুলে দিল- দারুন উপভোগ্য হয়ে উঠল এই ভ্রমনটা। চিম্বুক চলে আসলাম- খুব সুন্দর আর উঁচু একটা জায়গা। পাশে বেশ কয়েকটা পাহাড়, সেখানে মেঘের ছায়া- লিখে এই সৌন্দর্য্য ঠিক বোঝানো সম্ভব না। তারপর নীলগিরির দিকে রওনা, ওটা আরও উঁচুতে। পথটা চমৎকার, যেকোন একটা বাঁক হঠাৎ করেই ফাঁকা হয়ে যায়, সাথে দেখা যায় নিচের চমৎকার দৃশ্যগুলো-ঠিক যেন ছবির মতন! নীলগিরিতে যখন পৌঁছলাম তখন আমরা বেশ ক্লান্ত। কিন্তু ক্লান্তিটাকে মুহূর্তের মধ্যেই দূর করে দিল এই অসম্ভব সুন্দর জায়গাটি। এই জায়গাটা বাংলাদেশের- এটা বিশ্বাস করতে বেশ কষ্ট হচ্ছিল। প্রাণ ভরে উপভোগ করে নিলাম এখানকার সৌন্দর্য্যটুকু। মনে আশা ছিল মেঘেদের খুব কাছাকাছি দেখতে পারব, কিন্তু সে আশা পূরণ হয়নি। তাতে কি, যা দেখেছি তাই তো যথেষ্ঠ। এবার তো নীলগিরিতে থাকা হল না, পরের বার অবশ্যই থাকব। এই উঁচু পাহাড়ের চূড়ায় তারাগুলোকে কাছ থেকে দেখার ইচ্ছা আছে যে! নীলগিরি থেকে মিলংছড়িতে এসে দুপুরের খাওয়াটা সেরে নিলাম, পথে অবশ্য শৈলপ্রপাত দেখলাম, কিন্তু খুব একটা আকর্ষণীয় কিছু মনে হল না। মিলংছড়ি রেস্তোরাটা বেশ উঁচুতে, ওখান থেকে চারপাশটা বেশ সুন্দর দেখা যায়। তখন জানলাম ওখানে থাকার ব্যবস্থাও নাকি আছে। ওখান থেকে বৌদ্ধদের স্বর্ণমন্দির। খুব যে দৃষ্টি আকর্ষক- তা না, আবার খারাপও না। এবার নীলাচল যাওয়ার চেষ্টা। এই ড্রাইভারও জানাল নীলাচল যাওয়া যাবেনা, রাস্তায় কাজ চলছে। বললাম- ঠিক আছে, যতদূর যাওয়া যায় যাব। ভাগ্যিস যেতে চেয়েছিলাম- নাহলে আরেকটা সুন্দর জায়গা মিস্‌ করতাম। যখন নীলাচলে পৌঁছলাম তখন বিকেল পেরিয়ে প্রায় সন্ধ্যা। বিমোহিত হয়ে উপভোগ করলাম সূর্যের ডুবে যাওয়ার দৃশ্যটুকু। নিচে শহরের জ্বলে উঠা আলোগুলোকেও খুব সুন্দর লাগছিল। একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে চলে এলাম আমাদের রুমে। পরদিন সকালেই ছেড়ে চলে যেতে হবে এই সুন্দর জায়গাটিকে। আমি জানি এখানে এটাই আমার শেষ আসা নয়। আমার মনের ভিতরের একটা অংশ বলে আমি একদিন ঠিক হারিয়ে যাব এই পাহাড়ে। সবার থেকে দূরে, যেখানে কেউ আমাকে চিনে না, কোন কোলাহল স্পর্শ করে না আমাকে। শুধু সাদা মেঘেরা এসে স্পর্শ করে যাবে আমাকে। উঁচু পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে মুগ্ধ হয়ে আকাশটাকে দেখব, দেখব পাশের পাহাড়গুলোকে আর ভুলে যাব আমার ফেলে আসা জীবনটাকে।

৪,১৭৩ বার দেখা হয়েছে

৪১ টি মন্তব্য : “এলোমেলো-৩: বান্দরবান”

  1. মইনুল (১৯৯২-১৯৯৮)
    আমার মনের ভিতরের একটা অংশ বলে আমি একদিন ঠিক হারিয়ে যাব এই পাহাড়ে। সবার থেকে দূরে, যেখানে কেউ আমাকে চিনে না, কোন কোলাহল স্পর্শ করে না আমাকে। শুধু সাদা মেঘেরা এসে স্পর্শ করে যাবে আমাকে। উঁচু পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে মুগ্ধ হয়ে আকাশটাকে দেখব, দেখব পাশের পাহাড়গুলোকে আর ভুলে যাব আমার ফেলে আসা জীবনটাকে।

    কখনই পারবানা ............ 🙁 🙁 🙁 🙁

    চমৎকার লেখা তানভীর .........

    জবাব দিন
  2. কামরুল হাসান (৯৪-০০)

    আফসোস কয়েকবার রাঙ্গামাটি ঘুইরা আসলেও আইলসামির কারণে বান্দরবন যাওয়া হয় নায় এখনো। কিন্তু ইচ্ছা আছে।

    ছবি ছাড়া ভ্রমনকাহিনী দেয়ায় তানভীররে মাইনাস।


    ---------------------------------------------------------------------------
    বালক জানে না তো কতোটা হেঁটে এলে
    ফেরার পথ নেই, থাকে না কোনো কালে।।

    জবাব দিন
  3. কাইয়ূম (১৯৯২-১৯৯৮)

    চান্স পাইলেই পাহাড়ে যাই 😀
    বান্দরবান, খাগড়াছড়ি আর রাঙ্গামাটি তিন জায়গাতেই কয়েকবার কইরা গেছি। কিন্তু এখনো মনে হয়, যতবারই যাই না কেন এই জায়গাগুলোর সৌন্দর্য্য সারা জীবনেও দেখে শেষ করা যাবেনা। আমারতো ইচ্ছা আছে যদি কোনদিন কিছুটা হলেও টাকা পয়সা হয় তাহলে পাকাপাকি ভাবে থাকতে চইলা যামু ওইখানে। B-)
    তানভীর ভালো লিখছিস। ছবি কই x-(
    আর আজকে খেয়াল করলাম তোর ১২টা লেখা হইছে। এতদিনে মাত্র ১২ টা পোস্ট x-( 😉


    সংসারে প্রবল বৈরাগ্য!

    জবাব দিন
    • তানভীর (৯৪-০০)

      কাইয়ূম ভাই, পাহাড়ে পাকাপাকি ভাবে থাকতে গেলে আপনার বাসায় আমার জন্য একটা রুম রাইখেন। ঘন ঘন আপনার ওখানে বেড়াতে যাব। 😀 😀
      খাগড়াছড়ি এখনও যাইনাই, 🙁 কিন্তু যাওয়ার খুব ইচ্ছা আছে।
      ছবি হাতে পাওয়া মাত্র একটা ছবি ব্লগ দিব, কিন্তু ছবি কবে হাতে পাব তা বলতে পারিনা। 😛 😛 আপনাকে তো কত কইরা বললাম একটা ক্যামেরা কিন্যা দিতে! 🙁
      আপনার পোস্ট কয়টা?? আপনি পরের পোস্ট কবে দিবেন?? x-( x-( 😛 দেখি, এলোমেলো সিরিজে আর কয়টা লেখা দেয়া যায়! এইটা নিয়মিত চালায়ে যাওয়ার একটা ইচ্ছা আছে। 😀

      জবাব দিন
  4. মাহমুদ (১৯৯০-৯৬)

    ধন্যবাদ তানভীর, বান্দরবনকে মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য।

    এইবার ভরা বর্ষায় বান্দরবন যাবার ইচ্ছে আছে। :dreamy:


    There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx

    জবাব দিন
  5. আমিন (১৯৯৬-২০০২)

    বান্দরবানে লাস্ট গেছিলাম ২০০৭ সালে তার আগে কিউক্রিডাং গেছিলাম ২০০৫ সালে। জায়গাটারে ভালা পাই।
    সিসিবি থেকে বান্দরবানে যাওয়ার উদ্যোগ নেয়া যায় কি???

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : মাহমুদ (১৯৯০-৯৬)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।