এলোমেলো-২: ওয়ার্কশপ ও অন্যান্য

১.
অনেক বেসরকারী কোম্পানীতেই ওয়ার্কশপ বলে একটা ব্যবস্থা চালু আছে। সবাই মিলে অফিসের বাইরে একটা জায়গায় গিয়ে কিছু নির্দিষ্ট বিষয়ে আলাপ-আলোচনা করে। আমাদের ডিপার্টমেন্ট থেকে এইবার সিদ্ধান্ত নেয়া হল গাজীপুরের রাজেন্দ্রপুরে ব্র্যাক সেন্টারে ওয়ার্কশপ করা হবে (জায়গাটাকে BCDM বলে, কিন্তু এইটা মানে যে কি, তা আর জানা হলো না)। আলোচনার বিষয়বস্তু- আমাদের ডিপার্টমেন্টের পজিটিভ, নেগেটিভ দিকগুলো খুঁজে বের করা, কিভাবে নিজেদের আরও উন্নত করা যায়-এইসব হাবিজাবি আরও কত কি! আমাদের তো আর এত কিছু জানার দরকার নাই, কোম্পানীর টাকাতে সবাই মিলে নতুন একটা জায়গা ঘুরে আসা যাবে- এটাই যথেষ্ঠ! যথারীতি দুই-দিন ব্যাপী ওয়ার্কশপের প্ল্যান করা হল, বুধবার (১৩ই মে) সকালে ১১টার দিকে রওনা দিব, পরদিন সন্ধ্যায় চলে আসব। প্ল্যান দেখে আক্কেল গুড়ুম! দুই দিনে দম ফেলার সময় খুব কম, খালি আলোচনা আর আলোচনা। তারপরও আমরা দমে যাওয়ার পাত্র নই। নিজেদের জন্য গেঞ্জী বানিয়ে ফেলা হল, খেলার জন্য ক্রিকেট ব্যাট-বল আর একটা ফুটবলও কেনা হয়ে গেল। সাথে যাত্রাপথের জন্য ব্যাপক খানাপিনার আয়োজন তো আছেই।
বুধবার ১১টায় যাওয়ার কথা থাকলেও রওনা দিতে দিতে ১১:৩০ এর বেশী বেজে গেল। তিনটা মাইক্রোতে মোট আমরা ২১ জন। সারা রাস্তায় এরে-ওরে টিজ করতে করতে আর খানাপিনা চালাতে চালাতে ১:৩০ নাগাদ পৌঁছে গেলাম ব্র্যাক সেন্টারে। ওখানে মুহূর্তের মধ্যেই ফ্রেশ হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লাম লাঞ্চ করতে। খাওয়া-দাওয়া যথেষ্ঠ মুখরোচক হলেও দাম অনেক বেশী। জায়গাটা বেশ সুন্দর। সামনে বড়সড় একটা জায়গা, থাকার জন্য রুমগুলোও চমৎকার। কিন্তু এতকিছু দেখার টাইম ছিল না। কিছুক্ষনের মধ্যেই সেমিনার রুমে গিয়ে ওয়ার্কশপ শুরু। আড়াই ঘন্টার প্যাচালের সাথে হালকা নাস্তা- শেষ হল আমাদের প্রথম সেশন। সাথে সাথে ঝাঁপায়ে পড়লাম ফুটবল খেলতে। আর কয়েকজন শুরু করল ক্রিকেট। ১০-১৫ মিনিট ফুটবল নিয়ে দৌড়াদৌড়ির পর দেখি দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, নিঃশ্বাসও ঠিকমত নিতে পারছি না। হায়রে আমার স্ট্যামিনা, কই যে গেলি রে!!! 🙁 সন্ধ্যার পর আবার আরেকটা সেশন, আবার প্যাচাল। যাক, ৯:৩০ এর দিকে মুক্তি পেলাম। আবার ঝাঁপায়ে পড়লাম ডিনারে। ডিনার শেষে শুরু হল আমাদের আড্ডাবাজি, অন্তাক্ষরী খেলা। মাঝে তাসফিন ভাই (ফকক, ‘৯২-‘৯৮) এর সাথে উঠে চলে গেলাম পুরা জায়গাটা ঘুরে দেখতে। ফিরে এসে দেখি অন্তাক্ষরীতে আপুদের বিপক্ষে ছেলেদের দল একটু কোণঠাসা। বিপক্ষের যথেষ্ঠ সমীহ আদায় করেও শেষমেষ দলকে আর জেতাতে পারলাম না! তারপর রুমে এসে আমরা জুনিয়ররা শুরু করলাম আরেক প্রস্থ আড্ডাবাজি। শোভন ভাই (আবেদীন ভাই, ঝকক, ‘৯৩-‘৯৯) এর মনে হয় ক্ষীণ আশা ছিল ওনার আইবিএর পরীক্ষার জন্য হালকা প্রস্তুতি নেয়া। তাই ওনার রুমেই আড্ডার আসর বসিয়ে দিলাম। :grr: আড্ডাবাজি চলল রাত ৩:৩০ পর্যন্ত।
পরের দিন সকালে উঠে ব্রেকফাস্টের পর রাজ্যের বিরক্তি আর ঘুম নিয়ে শুরু করলাম আরেকটা সেশন। এমনিতেই মেজাজ বিলা, তার উপর এক ভাইয়া শুরু করল আজাইরা প্যাচাল। বিরক্ত হয়ে আমি আর তাসফিন ভাই শুরু করলাম উনাকে ব্যাপক হারে টিজ করা। এতক্ষন সবাই ঝিমাচ্ছিল, কিন্তু আমাদের একশনে সবাই দেখি হেভি চাঙ্গা হয়ে উঠল। আবেশীয় প্রভাবে আমাদের ডিপার্টমেন্টের বস্‌ ইখলাস ভাই-ও (রকক, ‘৮২-‘৮৮) দেখি উনাকে ক্ষ্যাপানো শুরু করলেন। মোদ্দা কথা, বোরিং সেশনটা হঠাৎ করেই আমরা খুব এনজয় করা শুরু করলাম। মাঝখানে হঠাৎ করেই আমার এক বন্ধুপ্রবর ফোন দিয়ে বসল। জিজ্ঞেস করলাম, কি ব্যাপার? বলল- আজ রাতে ১১:১৫ তে রাজশাহীর বাসে রওনা দিতে হবে আমার হলের রুমমেটের বিয়ে খাওয়ার জন্য। আমি তো আকাশ থেকে পড়লাম- আরে, বলে কি? আমি রাতে কখন বাসায় ফিরি ঠিক নাই আর ব্যাটা রাতের টিকেট কেটে রেখেছে। কিছুক্ষণ ধরে ওর শাপ-শাপান্ত করলাম ফোনে। বললাম, পরের দিন সকালের টিকেট কাট। কিন্তু, কপালের লিখন, না যায় খন্ডন! ঐ বাসেই যেতে হবে। কি আর করা! শালার আমার কপালটাই ফাটা। লাঞ্চ শেষে আবার আরেকটা সেশন, একেবারে সন্ধ্যা হয়ে গেল। সূর্য ডোবার সাথে সাথে আমার রাজশাহী যাওয়ার আশার প্রদীপও নিভে যাওয়া শুরু করল। ব্র্যাক সেন্টারের হ্যাচারীতে একদম তাজা মাছ কিনতে পাওয়া যায়। কয়েকজন ভাইয়া আর আপু দেখলাম মহা উৎসাহে মাছ কিনতে গেল। সব শেষ করে ব্যাগ গুছায়ে রওনা দিতে দিতে বেশ বেলা হয়ে গেল। ফেরার আগে ফটো সেশনে হঠাৎ করে বুঝতে পারলাম আমাদের সবার মধ্যে চমৎকার একটা টিম স্পিরিট চলে এসেছে। আমাদের এবারের ওয়ার্কশপে এটাই মনে হয় সবচেয়ে বড় পাওয়া। অফিসের বাইরের এই পরিবেশে প্রত্যেকের মধ্যে অন্য একটা মানুষকে যেন আবিষ্কার করলাম।

২.
বাসায় ফিরতে ফিরতে দেখি ৮:৪৫ বেজে গেছে। শালার থাকি ঢাকার এক মাথায়, আর বাস ছাড়বে আরেক মাথা থেকে। কিঞ্চিৎ অনিশ্চয়তা নিয়ে বাসায় ফ্রেশ হয়ে ব্যাগ গুছায়ে আল্লাহর নাম নিয়ে রওনা দিলাম বাস ধরতে। যাক্‌, সময়মতই পৌঁছে গেলাম বাস স্টেশনে। বাসে উঠে এদিক-ওদিক তাকালাম দু-একটা রাজকন্যাকে দেখতে পাবার আশায়। নাহ্‌! আমার কপাল ফাটাই। ভেবেছিলাম বাসে উঠে জব্বর একটা ঘুম দিব কিন্তু পিছনের সিটে একজন নাসিকা-গর্জন স্পেশালিস্টের কল্যানে সেটাও সম্ভব হল না। জোয়ার-ভাটার মত একটা ছন্দে নাসিকা গর্জন করলেও না হয় হত, কিন্তু না! উনি শুরু করলেন নানান ভেরিয়েশনে নাসিকা গর্জন। কানে হেডফোন গুঁজে দিয়েও শেষ রক্ষা আর হল না!
রাজশাহী পৌঁছলাম ভোর ৫টায়। হোটেলে গিয়ে দিলাম একটা ঘুম। দুই-আড়াই ঘন্টার ঘুম শেষে ব্রেকফাস্ট, তারপর বের হলাম রাজশাহী ভার্সিটি ঘুরে দেখার জন্য। ভার্সিটিটা বেশ সুন্দর। দুপুরে ফিরে আবার খাওয়া, একটু রেস্ট নিয়ে আবার বের হলাম- এবার আম আর লিচু কিনব। কিন্তু আমগুলা দেখে বাসায় কষ্ট করে নিয়ে যাওয়ার মত মনে হল না। আমের সিজন এখনও ভালোভাবে শুরু হয়নি। দেড় কেজি আম নিয়ে এসে রুমে সাবাড় করে ফেললাম। সাথে সাথে আবার বের হলাম-পদ্মা দেখব এবার। শেষবার পদ্মায় নৌকা চড়েছিলাম ২০০১ এ। আট বছর পর পদ্মার কাছে গিয়ে রীতিমত শক্‌ খেয়ে গেলাম। কোথায় সেই প্রমত্তা পদ্মা, চারদিকে দেখি চর আর চর! মনটাই খারাপ হয়ে গেল। সন্ধ্যার একটু পর বিয়ের অনুষ্ঠানে গিয়ে আবার আশাহত! রাজকন্যারা এখানেও নেই। কি আর করা! বিরস বদনে খাওয়া-দাওয়া, ফটো সেশন, তারপর রুমে গিয়ে সোজা ঘুম। পরদিন সকালের বাসে ঢাকায় রওনা দেয়ার মুহূর্তে মনে পড়ল- আরে, আজ না সন্ধ্যায় কলেজের পোলপাইনের সাথে গেট-টুগেদার আছে! কি কি সম্ভাব্য হাউ-কাউ হবে এই নিয়ে চিন্তা করতে করতে এক সময় ঘুমিয়ে পড়লাম। আধো ঘুম আধো জাগরণ দিয়ে শেষ হয়ে গেল রাজশাহী ট্যুরটা।

৩.
সন্ধ্যাবেলায় মিজানকে সাথে নিয়ে লোকাল বাসে ঝুলতে ঝুলতে চলে গেলাম বনানী। বুমার্সে গিয়ে দেখি অনেকগুলা পোলাপাইন। আমাদের কলেজের আমাদের ব্যাচের জন্য একটা গেঞ্জী বানানো হবে-এইটা নিয়া সবাই ব্যস্ত । কালোর উপর লালের একটা বর্ডার। দেখানো মাত্রই কয়েকটা হই-হই করা শুরু করল- মানি না, মানি না। এখানে মাত্র একটা হাউস কালার থাকবে, আর বাকীগুলা থাকবে না- এটা হতে পারে না। নাহ্‌, পোলাপাইন বড় হইল না! এবার ডিজাইন। একটা ঈগলের ডিজাইন ব্যাপক পছন্দ হইল। এখানে সবার নাম লেখা থাকবে, মোটামুটি সব ঠিকঠাক। এমন সময় একটা বলে উঠল, এইটা তো গোমতী হাউসের প্রতীক- এইটা মানি না! শুরু হইল আরেক প্রস্থ হাউ-কাউ। এর মধ্যেই আমরা খাওয়া-দাওয়া করলাম। খাওয়ার পর প্যাচাল আর হাউ-কাউয়ের মধ্য দিয়ে শেষ হয়ে গেল আমাদের গেট টুগেদার। বন্ধুত্বের ১৫টি বছর পার করে দেয়া আমরা এখনও আমাদের কাছে সেই কিশোরই রয়ে গেলাম।

৩,৯৮৮ বার দেখা হয়েছে

৪৫ টি মন্তব্য : “এলোমেলো-২: ওয়ার্কশপ ও অন্যান্য”

  1. কামরুল হাসান (৯৪-০০)

    একদিন তোর অফিসে দাওয়াত দিয়া কেক-কুক খাওয়াইলি না তো 😀


    ---------------------------------------------------------------------------
    বালক জানে না তো কতোটা হেঁটে এলে
    ফেরার পথ নেই, থাকে না কোনো কালে।।

    জবাব দিন
  2. নাজমুল হোসাইন

    তানভীর ভাই,পরের বার ট্রেনে যাইয়েন ।ঐখানে মেয়ে থাকার সম্ভাবনা অনেক বেশী।আর সুন্দর জায়গা দেখতে চাইলে গাজীপুর-ময়মনসিংহ রোডের বাম দিকে না গিয়ে ডান দিক দিয়ে cantt এর মধ্য দিয়ে ১৬ কিমি দূরে কাপাসিয়া ব্রীজে চলে যাবেন।
    বিঃদ্রঃ এই যাত্রায় নারীসঙ্গ ত্যাগ করবেন বলে কামনা করছি।

    জবাব দিন
  3. আহসান আকাশ (৯৬-০২)

    পড়ে খুব ভাল লাগল তানভীর ভাই।

    আসলেই ক্যাডেটরা চিরসবুজ।

    :thumbup: :thumbup: :thumbup:


    আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
    আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : জিহাদ (৯৯-০৫)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।