প্রহর শেষের আলোয় রাঙ্গা-৬

প্রহর শেষের আলোয় রাঙ্গা-১
প্রহর শেষের আলোয় রাঙ্গা-২
প্রহর শেষের আলোয় রাঙ্গা-৩
প্রহর শেষের আলোয় রাঙ্গা-৪
প্রহর শেষের আলোয় রাঙ্গা-৫

আমাকে আগের বারের মত আবার গ্রুপমেট হিসেবে পেয়ে স্বাতীর কি খুব খারাপ লেগেছিল? মনে হয় না! অন্যান্য ল্যাবগুলোতে যেখানে ৫ জনের গ্রুপ সেখানেও দেখা গেল আমরা দুইজন একসাথে পরে গেলাম। আমাদের জীবন আবার চলতে লাগল আগের মতই, পার্থক্য শুধু এখন আমাদের বেশী দেখা হয়। ক্লাস শেষ করে স্বাতী আগের মত প্রতিদিন সরাসরি বাসায় যায়না। কোন কোন দিন আমরা একসাথে দুপুরের খাবার খেয়ে নেই, তারপর চলে যাই লাইব্রেরীতে। স্বাতী আমাকে পড়া বোঝায়, আমি বোঝার চেষ্টা করি। গ্রীষ্মের রৌদ্রতাপ দিন দিন প্রখর হতে থাকে, স্বাতীর মুখে বিন্দু বিন্দু ঘামের ফোঁটা দেখতে থাকি, লাইব্রেরীর শীতল আশ্রয়ে আমাদের সময় চলতে থাকে। এই সময়ের মাঝেই ল্যাব, পরীক্ষা, ক্লাসগুলো আবর্তিত হতে থাকে। এর মধ্যেই ক্লাসের একজন হঠাৎ প্রস্তাব দিয়ে বসল- চল, সবাই মিলে একদিন পিকনিক করে আসি। আমি কিঞ্চিৎ বিরক্তই হলাম, এই গরমে কি দরকার রে ভাই পিকনিক করার! কিন্তু, ক্লাসের সবার মাঝেই বেশ আগ্রহ দেখা গেল। আসলে একদিন সবাই মিলে কোথাও যাওয়া, তারপর হুড়োহুড়ি করে আবার ঐদিনই চলে আসা- এটা আমার মোটেও পছন্দ না। ঘুরতে যদি যেতেই হয় তাহলে সমুদ্রের কাছ থেকে ঘুরে আসতে সমস্যাটা কই? এই কথাটা মনে মনেই বলতে চেয়েছিলাম, কিন্তু হঠাৎ মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল। সবাই কেমন অবাক হয়ে আমার দিকে ঘুরে তাকাল। আমি অপ্রস্তুত হয়ে বোকার মত তাকিয়ে রইলাম। মেয়েঘেঁষা আরাফাতটা হঠাৎ করেই বলে উঠল- দারুণ আইডিয়া। এই প্রথম আরাফাতকে আমার বিরক্তিকর মনে হল না!

কক্সবাজারে দুইদিনের ছোট্ট ট্যুরে ক্লাসের অনেককেই উৎসাহী দেখা গেল। একজন স্যারকেও রাজী করানো গেল আমাদের সাথে যাওয়ার জন্য, ভার্সিটির অনুদান পাওয়ার আর কোন উপায় নেই যে! তাছাড়া কোন শিক্ষক সাথে না থাকলে অভিভাবকরাও তাদের মেয়েদের এইসব ট্যুরে যেতে দেন না। আরাফাতটাকে দেখা গেল খুব উৎসাহের সাথে সবার কাছ থেকে চাঁদা নিয়ে বেড়াচ্ছে। স্বাতী যাবে কিনা সরাসরি জিজ্ঞেস করার সাহস ছিলনা। তাই খেয়াল করতে লাগলাম। চাঁদা তোলার দ্বিতীয় দিন স্বাতী যখন তার ব্যাগ থেকে আরাফাতকে টাকা বের করে দিল, তখন আমার খুব খুশীতে চিৎকার দিয়ে উঠতে ইচ্ছে হল! সেই রাতে নিজের ছোট্ট বিছানাতে শুয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করেও একফোঁটা ঘুমুতে পারিনি। শুধু স্বাতীর কথাই চিন্তা করে গেলাম!

বুধবার রাতে আমরা সবাই রওনা দিলাম কক্সবাজারের উদ্যেশ্যে। বৃহস্পতিবার সারাদিন আর শুক্রবার সকালটা ওখানে থেকে দুপুরে ফেরার জন্য রওনা দিব। বাসের মাঝামাঝি ডানদিকে জানালার দিকে একটা সিটে বসে গেলাম আমি, সাথে সবসময় আমার সাথে থাকা কাঁধে ঝুলানোর ব্যাগটা। পাশে এসে বসল আসিফ। জানালার পাশের আমার এই সিটটার দিকে তার লোভাতুর দৃষ্টি অনুভব করতে পেরে ভাবলাম, আমি তো এখন ঘুমিয়েই পড়ব। তাই ওর সাথে সিট বদল করে ফেলি। সিটটাতে হেলান দিয়ে আরাম করে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিতে গিয়ে স্বাতীকে আবিষ্কার করলাম আমার এক সারি সামনের বা দিকের জানালার পাশের সিটটাতে, একমনে জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। ও কি চিন্তা করছে বা কাকে দেখছে জানিনা, তবে সেই মুহূর্তে নিজেকে তার চিন্তার কেন্দ্রবিন্দু ভাবতে খুব ইচ্ছা হল! মায়াবী জ্যোৎস্না ছড়িয়ে দেয়া আকাশের ঐ চাঁদটার সাথে আমিও জেগে রইলাম সারারাত!

কক্সবাজারের কলাতলী মোড়ের একটু আগে রাস্তাটা উঁচু থেকে যখন ঢালু হয়ে যায়, তখন হঠাৎ করেই সমুদ্রটাকে দেখতে পাওয়া যায়। প্রাথমিক মুগ্ধতা কাটতে না কাটতে আরেকটু সামনে এগুলেই ঢেউয়ের গর্জন শুনিয়ে দেয়া সমুদ্রটা তার বিশালত্ব দেখিয়ে দেয়। ভোরের মিষ্টি রোদে এই বিশালত্ব দেখে ক্লাস ইলেভেন-এ এক্সকার্শনে এসে বিস্ময়ে মুগ্ধ হওয়া কিশোরটাকে আমি আমার মাঝে আবার আবিষ্কার করি। স্বাতীর দিকে তাকাই। এটাই যে ওর প্রথম সমুদ্রদর্শন, ওর মুগ্ধ, অবাক হওয়া দৃষ্টিটা দেখে আন্দাজ করে নিতে অসুবিধা হল না! বাস থেকে নেমে সমুদ্র থেকে কাছাকাছি দূরত্বের একটা হোটেলে আমাদের জন্য বুকিং দেয়া রুমগুলি ভাগাভাগি করে নিলাম। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই সবাই ফ্রেশ হয়ে ব্রেকফাস্টের জন্য হাজির। বুঝলাম, সমুদ্রের কাছে যাওয়ার জন্য কারও আর তর সইছে না! তড়িঘড়ি করে নাস্তাটা সেরে নিয়ে কিছুটা পথ হেঁটে সবাই চলে আসলাম বিশাল জলরাশির খুব কাছে। সমুদ্র থেকে ভেসে আসা ঠান্ডা বাতাসটা আমাদের সবার ক্লান্তি যেন এক মুহূর্তেই কেড়ে নিল!

সবাই বিস্ময় নিয়ে সমুদ্র দেখে, আর আমি সেই বিস্মিত মুখগুলো দেখি। শীতল হাওয়ায় উড়তে থাকা স্বাতীর খোলা চুল দেখি। ওর চুলগুলো আগে কি এত বড় ছিল? উত্তর খুঁজে পাই না। আমি অন্যরকম স্বাতীকে দেখি, নিজের অন্য অনুভূতি আবিষ্কার করি। সমুদ্রে উল্লাসরত উচ্ছ্বসিত বন্ধুদের দেখি। মোহাবিষ্ট আমি দুপুরে কখন খেয়ে যাই টের পাইনা, কিংবা দুপুর পেরিয়ে কখন বিকেল, সন্ধ্যা হয়ে আসে তাও টের পাইনা। শুধু সমুদ্রের কোলে অস্ত নেয়া লালচে সূর্যটা চোখে গেঁথে যায়। রাতে যখন চারদিক শান্ত হয়ে আসে আর চাঁদটা আকাশে খুব স্পষ্ট হয়ে উঠে তখন ঢেউয়ের গর্জন শুনি, সমুদ্রের মাঝে সাদা ফসফরাস দেখার চেষ্টা করি। একেকটা ঢেউ যখন পায়ের খুব কাছে এসে আছড়ে পড়ে তখন অব্যক্ত, অপ্রকাশিত অনুভূতিগুলোকে মনের চারপাশে আছড়ে পড়তে টের পাই। চোখের পলকে সময় কিভাবে কেটে যায় তা টের পাইনা। শুক্রবার রাতে হলে এসে নিজের ছোট্ট বিছানায় যখন শুলাম,অব্যক্ত কথাগুলো বলার জন্য মনের ভিতর একটা ছটফটানি অনুভব করলাম। বুঝলাম, আর দেরী করা যাবেনা। কিন্তু, সহজ কথা যায় না যে বলা সহজে!

(চলবে)

২,০৪৭ বার দেখা হয়েছে

৩০ টি মন্তব্য : “প্রহর শেষের আলোয় রাঙ্গা-৬”

  1. রকিব (০১-০৭)

    ১ম :tuski: :tuski:
    সিরিজটার একনিষ্ট ভক্ত আমি।
    তানভীর ভাই, এই পর্বের জন্য তো প্রতীক্ষার অবসান ঘটলো, পরেরটা এট্টু তাড়াতাড়ি দিয়েন।


    আমি তবু বলি:
    এখনো যে কটা দিন বেঁচে আছি সূর্যে সূর্যে চলি ..

    জবাব দিন
  2. শার্লী (১৯৯৯-২০০৫)

    সরল চকিত চাহনি
    এক মুহূর্তের আবেগ
    সহজ এই অনুভুতি

    ভালো লাগার কষ্ট
    কষ্টের মত সুখ
    হৃদয়ের হাহাকার

    সমুদ্রের লোনা বাতাসে
    যেন বা বেড়ে যায়
    আর মনের কোনে
    দোল দিয়ে যায়
    তোমার চুলের সুবাস।

    আজ বড় বলতে ইচ্ছে করে
    ভালবাসি, ভালবাসি শুধু তোমায়।

    জবাব দিন
  3. সানাউল্লাহ (৭৪ - ৮০)

    যাক! অবশেষে কক্সবাজার। খারাপ না, সূর্যোদয় বা সূর্যাস্তের সময় বালুর মধ্যে পাশাপাশি বইস্যা মনের কথাটা কইয়া ফালাও। 😀 😀 😀 নইলে আবার একটা সুযোগ হারাইবা!! 😉


    "মানুষে বিশ্বাস হারানো পাপ"

    জবাব দিন
    • সানাউল্লাহ (৭৪ - ৮০)

      আর ওই যে শামুকের খোলের চাবির রিংয়ে "I LOVE U" লেখা থাকেনা? মুখে কইতে শর্মাইলে ১০টাকা দিয়া কিন্যা ওইডা একটা উপহার দাও!! বয়সটা তো ওইডারই!! :shy: :shy: :shy:


      "মানুষে বিশ্বাস হারানো পাপ"

      জবাব দিন
    • মাহমুদ (১৯৯০-৯৬)

      সানা ভাই,

      গল্পের নায়ক+নায়িকা আর সমুদ্রতীরে নাই।

      শুক্রবার রাতে হলে এসে নিজের ছোট্ট বিছানায় যখন শুলাম

      কাজেই, কক্সবাজারের বালুর উপর বসা অবস্থায় 'কি করিতে কি করিতে হইবেক' বিষয়ক আপনার অভিজ্ঞ মতামতে হবে না, কার্জন হলের আশেপাশের কোন চিপাচাপিতে অবস্থানরত সম্ভাব্য নায়ক-নায়িকার জন্য পরামর্শ দেন। ;;;


      There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx

      জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : robin

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।