প্রহর শেষের আলোয় রাঙ্গা-৫

প্রহর শেষের আলোয় রাঙ্গা-১
প্রহর শেষের আলোয় রাঙ্গা-২
প্রহর শেষের আলোয় রাঙ্গা-৩
প্রহর শেষের আলোয় রাঙ্গা-৪

রেজাল্ট দেয়ার দিনটি চলেই আসল। আমি আবার ঘুমকাতুরে মানুষ। আয়েস করে সকালের ঘুমটা দিয়ে ব্রেকফাস্ট করে রেজাল্ট আনতে গিয়ে কয়েকটা ক্লাসমেটকে খুঁজে পেলাম। আবার কয়েকটাকে দেখলাম রেজাল্ট নিয়ে হাসিমুখে বের হয়ে আসছে। নিশ্চয়ই ভাল করেছে, নাইলে এই দিনে তো এত হাসি বের হওয়ার কথা না! কিন্তু তার মাঝে কোথাও স্বাতীকে দেখতে পেলাম না! ধুর ছাই! স্বাতী রেজাল্ট নিয়ে চলে যায়নাই তো? মনটাই খারাপ হয়ে গেল! কিছুক্ষণ এদিক-ওদিক ইতঃস্তত ঘুরাঘুরি করলাম। মরার ঐ রেজাল্ট আনতে যেতেও ইচ্ছা করছেনা! স্বাতী না আসলে রেজাল্ট দিয়েই বা কি হবে! এক কোনায় চুপচাপ বসে থাকলাম। আরাফাতটাকে যথারীতি ক্লাসের মেয়েগুলার সাথে দেখা গেল, ফাজিলটা আবার পাঞ্জাবীও পড়ে এসেছে। মেজাজ খিঁচরে গেল। প্রায় দুপুর হয়ে এসেছে, খেতেও ইচ্ছা করছে না! শীতের সূর্য্য না উঠা হাড়কাঁপানো দিনগুলো শেষে একদিন যখন সূর্যের আলো দেখা যায় তখন সেই আলোতে অনেক আশা মেশানো থাকে। রিকশা দিয়ে স্বাতীকে মেইন গেট দিয়ে ঢুকতে দেখে আমি যেন সেই আশার আলোটাকেই দেখতে পেলাম।

চট্‌ করে উঠেই চলে গেলাম রেজাল্ট দেয়ার জায়গাটাতে। স্বাতীর কাছাকাছি গিয়ে এমন একটা ভান করলাম যেন আমিও ঠিক এই সময়টাতেই রেজাল্ট নিতে এসেছি! খুব অবাক হয়ে করে জিজ্ঞেস করলাম, রেজাল্ট এনেছ? ও বলল- না, তুমি? আমিও মাথা নেড়ে না বললাম। তারপর কিছু না বলে দুইজনই গেলাম রেজাল্ট আনতে। লাইনটা খুব বেশী বড় না। হঠাৎ করেই হার্টবিট অনেক ফাস্ট হয়ে গেল। এখন যদি আমার রেজাল্ট খুব খারাপ হয়, তাহলে স্বাতী আমাকে কি ভাববে? ধুর! এখন মনে হচ্ছে রেজাল্ট আগে তুললেই পারতাম, তাহলে অন্তত অপমানিত হওয়ার চান্স তো থাকত না! স্বাতীকে দেখলাম নিচের দিকে কেমন একটা ভীরু ভীরু দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে। কি মনে করে ও পিছন ফিরে আমার দিকে তাকাল আর তখন আমি হেসে দিলাম। এই হাসিটা অনায়াসেই যাবতীয় ভয় দূর করে দেয়ার হাসি হতে পারত, কিন্তু না, হয়ে গেল ক্যাবলামার্কা হাসি। বেচারীকে আরেকটু ভয় পাইয়ে দেয়ার জন্য মনে হয় ওটা যথেষ্টই ছিল। ওর দৃষ্টিটাকে ফ্যাকাসে হয়ে যেতে দেখলাম। আমাদের সামনের লাইন আস্তে আস্তে ফাঁকা হয়ে গেল, আমরা রেজাল্ট নিয়েও নিলাম। ওর চোখে আনন্দের একটা ঝিলিক দেখতে পেয়ে এতটাই মুগ্ধ হয়ে তাকিয়েছিলাম যে নিজের রেজাল্টটুকু দেখে নেয়ার কথা মনেও পড়ল না! ও তখন আমাকে জিজ্ঞেস করল, মুখ শুকনো কেন? রেজাল্ট খারাপ হয়েছে? কিছুটা থতমত খেয়ে হ্যা-না কি বলব বুঝতে না পেরে দুর্বোধ্য একটা আওয়াজ করলাম। আমার খুব কাছে পাশাপাশি এসে ও যখন আমার হাতে ধরা রেজাল্ট শীটটা দেখতে লাগল তখনও আমার নিজের রেজাল্ট জানা হয়ে উঠল না। স্বাতীর পিঠ ছাড়ানো চুলের সুগন্ধী আমাকে আমার ছোটবেলার প্রিয় বেলীফুল গাছটা থেকে ভেসে আসা গন্ধের কথা মনে করিয়ে দিল।

হাটতে হাটতে ওকে জিজ্ঞেস করলাম, খেয়েছ? মাথা নেড়ে বলল- ছোটবোনটাকে স্কুল থেকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে ফ্রেশ হয়েই এখানে চলে এসেছি। বললাম- বাসায় ফিরতে তো দেরী হয়ে যাবে, চল এখানেই খাই। ভালো রেজাল্টের ঘোর কাটেনি বলেই মনে হল, সাথে সাথে রাজী হয়ে গেল। ছাত্রের কিঞ্চিৎ সাফল্যের খুশীও হয়ত এতে থাকতে পারে কিন্তু তা প্রত্যাশা করার লোভটুকু না হয় নাই করলাম। খেতে খেতে স্বাতী বলল- আমি ভেবেছিলাম তুমি ম্যাথে আরেকটু ভালো করবে। বলতে চেয়েছিলাম, তুমি না পড়ালে তো এই নাম্বারটাও পেতাম না। কিন্তু বললাম, কি জানি? আমি এই নাম্বারেই খুশী। খাওয়া শেষে ও যখন নিজের পার্সের দিকে হাত বাড়াচ্ছে তখন বললাম- আজ আমি বিল দিয়ে দেই? তোমার ভালো রেজাল্টের অনারে। স্বাতী যখন হেসে দিল তখন ওর চোখে আমি ওর মনের হাসিটাও দিব্যি দেখতে পেলাম। সেই মুহূর্তটিকে ক্যামেরায় আটকে রাখার মত ক্ষমতা কোন মানুষের আছে কিনা সেই বিচারে না গিয়ে একটা ক্যামেরার জন্য আফসোস করে গেলাম!

পরের সপ্তাহ থেকে ক্লাস শুরু। রেজিস্ট্রেশনের দিন আমাদের আবার দেখা হল কিন্তু খুব একটা কথা হল না। দেখতে না দেখতেই ক্লাসও শুরু হয়ে গেল। আবারও একগাদা ক্লাস আর ল্যাব, সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে ক্লাস করতে যাওয়ার ঝক্কি, ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে স্বাতীকে দেখে ভালোলাগা আর দিনশেষে একগাদা ক্লাস করার ক্লান্তি। প্রথম ল্যাবটাতেই দুইজন করে গ্রুপ করতে বলা হল। কিন্তু এইবার আর লটারীর হাতে ভাগ্য সঁপে দেয়ার কোন ইচ্ছাই হল না। প্রচন্ড ইচ্ছা হচ্ছিল স্বাতীর সাথে আবার গ্রুপ করার।আস্তে করে বলে উঠলাম,আগের বারের গ্রুপিংটাই রাখলে কি ভাল হয় না? একজন বলে উঠল, গতবার তো কয়েকটা ল্যাব ছিল, কোনটা? আমি বললাম- যেটাতে দুইজনের গ্রুপিং ছিল। আগের টার্মের কেমিস্ট্রি ল্যাবের গ্রুপিংটাতে কয়েকজনের আপত্তি থাকলেও ঝামেলা এড়ানোর জন্য এই প্রস্তাবে অধিকাংশেরই সমর্থন পাওয়া গেল। ছোটবেলায় শুনতাম অনেকে ইচ্ছাশক্তির সাহায্যে অনেক কিছু করতে পারেন। আজ নিজেকে তাদের একজন মনে হতে লাগল।

(চলবে)

৭,২৫৯ বার দেখা হয়েছে

৬৬ টি মন্তব্য : “প্রহর শেষের আলোয় রাঙ্গা-৫”

  1. ফয়েজ (৮৭-৯৩)

    কিরে ভাই, খালি চুলের ঘ্রান......।

    এইটা দেখি পুরা ভোদাই নায়ক......। আমাগো মাস্ফু হইলে এতক্ষনে কত কি কইরা ফেলত। ;))


    পালটে দেবার স্বপ্ন আমার এখনও গেল না

    জবাব দিন
  2. তাইফুর (৯২-৯৮)

    মির্জাপুরের মঞ্জুর (৯২-৯৮) এর একটা ঘটনা মনে পরে গেল। ৯৮ সালে ও তখন মেডিকেল ভর্তি কোচিং করে। ক্লাস ঠিক মত করত না ... সাপ্তাহিক পরীক্ষার হলে প্রশ্নপত্র নিয়া তব্ধা ধইরা বইসা থাকতে দেইখা পাশের সিটের এক মায়াবতী খাতা দেখাইছিল ... বিনিময়ে মঞ্জুর মামু পরীক্ষা শেষে মায়াবতীরে একটা কবিতা লেইখা দিছিল

    আমারো তো ভেসে গ্যাছে অঞ্জলী স্রোতে
    রয়ে গ্যাছে শুধুই সমর্পন
    কাঙ্গালের ঐশ্বর্য্য কাদে
    মরে নিঃস্ব হাতে

    তানভীর প্রতিদিন সকালে উইঠা এক পর্ব করে পড়তে চাই ... 😀
    খুব ভাল লাগতেছে ...


    পথ ভাবে 'আমি দেব', রথ ভাবে 'আমি',
    মূর্তি ভাবে 'আমি দেব', হাসে অন্তর্যামী॥

    জবাব দিন
  3. রাশেদ (৯৯-০৫)

    নাহ তানভীর ভাই আপ্নে লোক ভালা না 🙁 এত ছোট ছোট করে গল্প দিলে হবে না 🙂 লেখার সাইজ আর বড় করা যায় না? দুই পর্ব একসাথে দিলে কেমন হয়? আশা করি মাইন্ড করবেন না। আসলে এক পর্ব পড়ে আবার কয়েকদিন অপেক্ষা করতে ভাল লাগে না 😀 ভাল থাকবেন তানভীর ভাই।


    মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়

    জবাব দিন
    • তানভীর (৯৪-০০)

      লেখার সাইজ তো বড় করা যায়। এই যেমন ধর এডু-মডু যদি ফন্টের সাইজ আরেকটু বড় করে দেয় তাহলে লেখাও বড় হবে। :-B
      অফিস থেকে বাসায় ফিরে এক পর্ব লিখতেই জান খারাপ হয়ে যায় রে ভাই, দুই পর্ব তো খুব কষ্টকর ব্যাপার। দেখি, নেক্সট পর্ব বেশ বড় করে দিব। 🙂

      তুমিও ভাল থাইক। 😀

      জবাব দিন
  4. রাশেদ (৯৯-০৫)

    আমরা জানি তানভীর ভাই ভাল ছাত্র আবার নায়কও ভাল ছাত্র 😉 ভাইসব আপ্নেরা কি বুঝতে পারছেন এইখানে আসলে একটা অতীত ইতিহাস উঠে আসছে 😀


    মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়

    জবাব দিন
  5. সানাউল্লাহ (৭৪ - ৮০)

    তানভীর : তুমি এখনো ক্লাস আর ল্যাবেই থাকবা ঠিক করছো? আমি কইছিলাম এই এক্টু রিকশায় ঘুরাঘুরি........ আবার কেউ কেউ কইছিল বইমেলা, বোটানিকাল গার্ডেন, তাছাড়া আমাদের বন্ধু শাহাদাতের গাজীপুরের বাগানবাড়িও আছে!! :grr: :grr: :grr:


    "মানুষে বিশ্বাস হারানো পাপ"

    জবাব দিন
  6. রহমান (৯২-৯৮)

    এবারের পর্ব পড়ার আগেই নিচের দিকে দেখে নিলাম 🙂 । (চলবে) দেখে মহা আনন্দে পড়া শুরু করলাম 😀 ।

    সুতরাং বুঝতেই পারছ পাঠকেরা কি চাচ্ছে? এটা হলো "পাবলিক ডিমান্ড" এর মতো "রিডার্স ডিমান্ড" :guitar:

    গল্পতে এখনও ব্রেক টানিনাই, আগাতে দিচ্ছি নিজের মত। দেখা যাক কি হয়

    :thumbup: :thumbup:

    এইতো বুদ্ধিমান ছেলের মতো উত্তর তোমার। আগাতে দাও আরো। কাহিনী তো মাত্র শুরু...

    জবাব দিন
  7. আদনান (১৯৯৭-২০০৩)

    আমারো এরকম একটা সিচুএশন প্রাক্টিকালী চলতেসে (খুব বেশি সিমিলার না অবশ্য)... শুধু ডিরেক্টলী বলতে পারতেসি না এই আর কি!!

    প্লট হারায় গেলে কইয়েন আমি আসি লগে। এক্সপেরিএন্স শেয়ার করুম্নে।

    জবাব দিন
  8. নাঈম (৯৪-০০)

    তানস,

    তোর গল্প নিয়ে টেনসনে পরে যাচ্ছি। কিভাবে শেষ হবে ভাবছি, তবে নায়ক নায়িকার এখন কোন ভিলেন আসে নাই, তাই মনে হচ্ছে চলবে অনেক দিন।

    চালাইয়া যা, বেশ মজা লাগছে। আশা করি তোর জীবনেও শীতের সূর্যের দেখা হবে, , তাড়াতাড়ি 😉

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : সহল (৯৪-০০)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।