এলোমেলো-৬: সিনেমা পারাদিসো

কোন এক সুন্দর সকালে মোকা (মোকাদ্দেস,ককর, ‘৯৪-‘০০) আমার হাতে একটা ডিভিডি ধরিয়ে দিয়ে বলল, “মুভিটা দেখ, তোর ভালো লাগবে”। তখন হলে থাকি, মুক্ত-স্বাধীন জীবন। ঘুরাঘুরি, আনন্দ, গান শোনা আর মুভি দেখার জীবন। ও হ্যাঁ, মাঝে মধ্যে একটু-আধটু পড়াশোনার জীবনও। আমরা একই হলে থাকতাম, রুম ছিল কাছাকাছি। যা বলছিলাম…মোকা সাধারণত “হাই থট”-এর মুভি দেখে, আমাদের মত ম্যাঙ্গো পাবলিকের এন্টেনার উপর দিয়ে চলে যায় এসব ছবি। খুব বোরিং সময় যাচ্ছে আর হাতের কাছে নতুন কোন মুভি নাই- এই ধরণের পরিস্থিতিতে সাধারণত মোকার কাছ থেকে ছবি নেয়া ছাড়া আর কোন বিকল্প থাকত না। ডিভিডির কাভারটা দেখলাম, বেশ আকর্ষণীয় মনে হল। কিন্তু তারপরও মুভিটা দেখার মত যথেষ্ঠ আগ্রহ পাচ্ছিলাম না। রেখে দিলাম টেবিলের উপর। তার পরেরদিন কিংবা তারও পরের দিন টাইম-পাস করার জন্য ছবিটা দেখতে বসে গেলাম। ভাগ্যিস ছবিটা দেখতে শুরু করেছিলাম- নাহলে আমার সবচেয়ে প্রিয় ছবিটা আমার কখনও দেখা হয়ে উঠত না!

নুয়োভো সিনেমা পারাদিসো (Nuovo Cinema Paradiso) বা শুধুই সিনেমা পারাদিসো- ছবিটার কাহিনী একজন বিখ্যাত পরিচালকের জীবনের ঘটনা নিয়ে। ছবিটি শুরু হয় এক বৃদ্ধ মহিলার ফোন দিয়ে। উনি ফোনে বারবার খুঁজতে থাকেন তার ছেলে সালভাতোর (Salvatore) কে। ৩০ বছর ধরে বাসায় না ফেরা তার ছেলেকে আলফ্রেডোর মৃত্যুসংবাদ দেয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েন তিনি। গভীর রাতে বাসায় ফিরে সালভাতোর তার গার্লফ্রেন্ডের কাছে শুনতে পায় সংবাদটি, তারপর তার নষ্টালজিয়ার সাথে সিনেমা আমাদের নিয়ে যায় ৩০ বছর আগের সিসিলির সেই ছোট্ট শহরটিতে।

‘৫০ এর দশকের দিকের কাহিনী, একটা সিনেমা হল- ‘নুয়োভো সিনেমা পারাদিসো’কে ঘিরে ঐ শহরের বিনোদন। শিশু থেকে শুরু করে একেবারে বৃদ্ধ পর্যন্ত সবার বিনোদনের জায়গা এই সিনেমা হলটি। আর এই সিনেমা হলের প্রজেকশনিস্ট হলো বৃদ্ধ আলফ্রেডো। দোতালায় ছোট্ট রুমটিতে সারাদিন কাজ করে চলা এই বৃদ্ধের কাজকর্মে ব্যাপক আগ্রহ সালভাতোরের। সালভাতোরের ডাক নাম হল তোত্তো (toto- উচ্চারণ “ত” আর “ট” এর মাঝামাঝি)। ওকে অনেক বুঝিয়ে কিংবা ধমক দিয়েও প্রজেকশন রুমের আকর্ষণ থেকে দূরে সরানো যায়নি। পরীক্ষার হলে নকল সরবরাহের বিনিময়ে আলফ্রেডোর কাছ থেকে কাজ শেখার প্রতিশ্রুতিটুকু ঠিকই আদায় করে নেয় ছোট্ট তোত্তো। তারপর আলফ্রেডোর সাথে গভীর বন্ধুত্ব হয়ে যায় ওর। এরই মাঝে এক দুর্ঘটনায় সিনেমা হলটি পুড়ে যায়, ছোট্ট তোত্তো ওকে উদ্ধার করলেও চিরতরে অন্ধ হয়ে যায় বৃদ্ধ আলফ্রেডো। শেষ হয়ে যায় শহরবাসীর বিনোদন- তাই তড়িঘড়ি করে আবার তৈরী করা হয় সিনেমা হলটি, আর তাতে প্রজেকশনিস্ট-এর কাজ দেয়া হয় ছোট্ট তোত্তোকে কারণ ও আর অন্ধ আলফ্রেডো ছাড়া শহরে আর কেউই প্রজেকশনিস্ট-এর কাজ করতে পারত না । তারপর থেকে ডানা মেলতে থাকে সিনেমার কাহিনী। প্রজেকশন রুমে কাজ করতে করতে সালভাতোরের বেড়ে উঠা, ভিডিও শুট করতে গিয়ে এলেনাকে আবিষ্কার করা, তার প্রেমে পড়া, অন্ধ আলফ্রেডোর দার্শনিক কথাবার্তা- এ সব কিছুর সাথে আমাদের অনুভূতিগুলোও বদলাতে থাকে…আনন্দ, কষ্ট, হাসি, কান্না…সবকিছু।

১৯৮৮ সালে নির্মিত এই ইটালীয় ছবিটি শ্রেষ্ঠ বিদেশী ছবির পুরস্কার জিতে নেয় ১৯৮৯ সালের অস্কারে। ১৫৫ মিনিটের এই ছবিটি পাশের দেশে বানিজ্যিকভাবে সফল না হওয়ায় ছোট করে নামিয়ে আনা হয় ১২৩ মিনিটে। তারপর বানিজ্যিকভাবে দারুণ সফল হয় ছবিটি। সাথে জয় করে নেয় বোদ্ধাদের মনও। পরে ২০০২ সালে যুক্তরাজ্যে ১৭৩ মিনিটের পূর্ণ ছবিটি প্রকাশ করা হয় Cinema Paradiso: The New Version নামে। আবহসঙ্গীত কিংবা ছবির মেকিং নিয়ে আমার কিছু না বলাই ভালো, শুধু বলতে পারি আমি প্রত্যেকবারই ছবিটা দেখেছি মন্ত্রমুগ্ধের মত। আপাতত মুভিটা থেকে কয়েকটা ছবি দিয়েই শেষ করি, আগ্রহীরা শীঘ্রই মুভিটা দেখে ফেলবেন আশা করি। 🙂


এই কাভারটা দেখেই ছবিটা দেখতে আগ্রহী হই! ;;;

প্রজেকশন রুমে কাজ করছে আলফ্রেডো, পাশে আগ্রহী তোত্তো

প্রজেকশন রুমে কাজ করছে আলফ্রেডো, পাশে আগ্রহী তোত্তো

ছবি বানানোর আগ্রহের শুরু সেই ছোটবেলা থেকেই.....

ছবি বানানোর আগ্রহের শুরু সেই ছোটবেলা থেকেই.....

ছোট্ট তোত্তো

ছোট্ট তোত্তো

এলেনার প্রেমে মুগ্ধ তরুণ সালভাতোর

এলেনার প্রেমে মুগ্ধ তরুণ সালভাতোর

নষ্টালজিক সালভাতোর....

নষ্টালজিক সালভাতোর....

উইকিপিডিয়ার লিংক আছে এখানে

৬২ টি মন্তব্য : “এলোমেলো-৬: সিনেমা পারাদিসো”

  1. ফয়েজ (৮৭-৯৩)
    ঘুরাঘুরি, আনন্দ, গান শোনা আর মুভি দেখার জীবন। ও হ্যাঁ, মাঝে মধ্যে একটু-আধটু পড়াশোনার জীবনও।

    :khekz: :khekz: :khekz:
    তানভীর কইছে এই কথা, 😀

    নাহ দুনিয়াতে আর ইনসাফ বইলা কিছু থাকলো না।


    পালটে দেবার স্বপ্ন আমার এখনও গেল না

    জবাব দিন
  2. ওয়াহিদা নূর আফজা (৮৫-৯১)
    ডিভিডির কাভারটা দেখলাম, বেশ আকর্ষণীয় মনে হল।

    পোলাপান বড় হইয়া গেছে। তাই আর দিদিগিরি কইরা ঝাড়ি লাগাইলাম না।


    “Happiness is when what you think, what you say, and what you do are in harmony.”
    ― Mahatma Gandhi

    জবাব দিন
  3. মইনুল (১৯৯২-১৯৯৮)
    ঘুরাঘুরি, আনন্দ, গান শোনা আর মুভি দেখার জীবন। ও হ্যাঁ, মাঝে মধ্যে একটু-আধটু পড়াশোনার জীবনও।

    পরীক্ষার সময় এলে আমাদের ব্যাচের কিছু ছেলে কান্নাকাটি করতো ... ফেল করবো, ফেল করবো বলে। দুয়েক টার্ম পরেই বুঝলাম, ওরা আসলে A এর নীচে পাওয়াকে ফেল করা হিসেবে গন্য করে। এইখানে লেখকের একটু আধটু পড়াশোনা মানে কিন্তু পুরো ছয় ঘন্টা পড়াশোনা (ক্লাশ টাইম বাদে) বোঝাচ্ছে ......

    জবাব দিন
  4. রকিব (০১-০৭)

    ছবিটা ডাউনলোড দিতে হবে। 😀
    তানভীর ভাই লেখা দিলেন তাইলে, এইবার কাইয়ুম ভাইয়ের জন্য অপেক্ষা। 😛

    ও হ্যাঁ, মাঝে মধ্যে একটু-আধটু পড়াশোনার জীবনও।

    এই বিশেষ লাইন পড়িয়া একখানা পুরাতন স্মৃতি মনে পড়িয়া গেল।
    এসএসসি পরীক্ষা; বাংলা দ্বিতীয় পত্র। প্রায় ৬টা অবজেকটিভ ভুল গিয়েছে, ২টা কনফিউশান। মন মেজাজ খানিকটা খারাপ। হঠাৎ জনৈক বন্ধুপ্রবরকে দেখলাম কেমন বিষণ্ন দৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। ওর পরীক্ষা খারাপ হওয়া প্রায় অসম্ভব। তারপরো জিজ্ঞাস করলাম, কেমন হয়েছে? বেশ লম্বা একখান দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, "দোস্ত ভালো না, বোধহয় প্লাস পাওয়া হবে না রে।" বিশাল একখান ধাক্কা খেলাম। ডাইনিং হলে গিয়েও দেখি এক চামচ ভাত নিয়ে নাড়াচাড়া করে, কিছুই খায় না। ওর দুস্খ দেখে আমার কিঞ্চিত যেই আক্ষেপ ছিলো সব দূর হয়ে গেলো। হাউসে গিয়ে কথোপকথনটুকু তুলে দিচ্ছিঃ

    - খুব খারাপ হইছে।
    - আমি এতটা আশা করি নাই দোস্ত।
    -অবজেকটিভ কি ৮-১০ টার বেশি ভুল গেছে।
    মাথা নাড়লো।
    এবারে আমি প্রমাদ গুণি, তাহলে শিউর শালায় বড় করে ভাব সম্প্রসারণ, চিঠি লিখতে গিয়ে রচনাই বাদ দিয়ে আসছে। কাতর স্বরে জিজ্ঞেস করি,
    -দোস্ত, প্রশ্ন কোনটা বাদ পড়ছে; কত মার্ক ছাড়ছিস।
    ছলছল চোখে তাকিয়ে আবারো একোটা ইয়া লম্বা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে শালা আহাম্মকে বলে, "দোস্ত, রচনার শেষ দুই পেজে হাতের লেখা এত জঘন্য হইছে যে কি বলবো; আমারে হয়তো জিরোই দিবে।"
    আমি বাকরুদ্ধ।


    আমি তবু বলি:
    এখনো যে কটা দিন বেঁচে আছি সূর্যে সূর্যে চলি ..

    জবাব দিন
  5. আছিব (২০০০-২০০৬)

    হায়রে,এ জগতে হায় সেই বেশি চায়..................... 😡 .
    তানভীর ভাই,একটু আধটু পড়াশুনা আমরাও করি,কিন্তু যতই ,একটু আধটু পড়াশুনা করি,তার "বিপরীত আনুপাতিক হারে" বুয়েটের বাঁশ খাই। :bash: :chup:
    তয় আপনার মত এত বিনয়ী না আমরা,সারাজীবনে তো মনে হয় দ্বিতীয় হননাই,তাই না?ইসসিরে,আরো এক-আধটু কম পড়তে পারলেন না!!! :duel:
    অফ টপিকঃ বস,সিনেমাটা দেখছি আগেই,জটিলস....... ... :boss:

    জবাব দিন
  6. কামরুল হাসান (৯৪-০০)
    ঘুরাঘুরি, আনন্দ, গান শোনা আর মুভি দেখার জীবন। ও হ্যাঁ, মাঝে মধ্যে একটু-আধটু পড়াশোনার জীবনও।

    এই জন্যেই তখন তোরে বলতাম দোস্ত ভালো কইরা পড়াশুনা করিস। নইলে আমাদের মতো ভালো রেজাল্ট করতে পারবি না।
    এখন হাতে হাতে ফল পাইছিস তো ? কোন রকম টাইনা টুইনা বোর্ডে ফার্স্ট।


    ---------------------------------------------------------------------------
    বালক জানে না তো কতোটা হেঁটে এলে
    ফেরার পথ নেই, থাকে না কোনো কালে।।

    জবাব দিন
  7. টিটো রহমান (৯৪-০০)

    প্রেজক্টেরর মুখ হালকা একটু ঘুরিয়ে দেয়ালে প্রোজেকশন.....হলের বাইরে অনেক দশর্ক...কেউ কেউ নৌকায় বসেও দেখছে....এর মেধ্যে হঠাৎ বৃষ্টি......

    আহ কি অসাধারণ দৃশ্য.....

    ব্যাটেলশিপ পটেমকিনের সিঁড়ির দৃশ্যের পর এই দৃশ্যটাই আমার সবচেয়ে প্রিয়

    একই পরিচালক ম্যালিনিও বানিয়েছেন.....এবং েসখানে যে শহরটি দেখিয়েছেন ঠিক সেখানটায় নাকি এটা শ্যুটিং করেছেন...অথচ চেনাই যায় না..........

    ছবিটা দেখামাত্র পছন্দের তালিকায় ৫ এর মধ্যে চলে আসবে গ্যারান্টি 😀

    থ্যাংকু দোস্ত....তোর লেখাটার জন্য


    আপনারে আমি খুঁজিয়া বেড়াই

    জবাব দিন
    • তানভীর (৯৪-০০)

      চমৎকার মন্তব্য দোস্ত!

      আমি তো এইসব মেকিং, এফেক্ট এগুলা বুঝিনা- তাই এসব নিয়ে লিখিনি।

      এই ছবিতে আমার প্রিয় দৃশ্য হচ্ছে- যখন সালভাতোর বাসায় ঢুকে তখন তার বৃদ্ধা মা উল বোনা বাদ দিয়ে দরজার দিকে ছুট দেয়। এতদিনের কষ্ট করে বোনা উল যে ছুটে যাচ্ছে সেদিকে তার কোন খেয়ালই নেই। ছোট ছোট দৃশ্য দিয়ে কতকিছু বুঝানো যায়!

      জবাব দিন
  8. কাইয়ূম (১৯৯২-১৯৯৮)

    মুভিটা কেন জানি মনে হচ্ছে বিটিভি তে কোন মুভি অব দ্যা উইক বা কোন উৎসবের ছবি হিসাবে দেখাইছিলো ৯০ এর কোন সময়ে। ঐ সময় ব্যাপক ফিল্মবোদ্ধা ছিলামতো, তাই সব বুঝে ফেলছিলাম :-B
    একদেখাতেই মুগ্ধ হবার মতোই একটি ছবি। :thumbup:

    তানভীর একটু আধটু পড়াশোনার মাঝে মাঝে আধা চিমটি লিখলেও আমরা কিছু ভালো লেখা পাই। এই একটা জায়গায় পোলাটার ফাকিবাজির কোন কারণ পাইলামনা 😡 ব্লগ লেখার জন্য বোর্ড স্ট্যান্ড টাইপের কিছু চাল করমু নাকি ;;)


    সংসারে প্রবল বৈরাগ্য!

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : বন্য (৯৯-০৫)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।