ইহাকে পাওয়া এবং শিক্ষণীয় বিষয়সমূহ

তখন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সবেমাত্র পাশ করে বের হয়েছি। আমি আর আমার মত কয়েকটা অথর্ব ছাড়া সবারই চাকরী হয়ে গেছে। হলে নিজের কম্পিউটারে সারাদিন ফিফা খেলি। যখন খেলতে খেলতে বিরক্ত হয়ে যাই তখন সিনেমা খুঁজতে বের হই। দুই-একটা সিনেমা জোগাড় হয়ে গেলেই সিনেমা দেখতে বসে যাই। মোকাদ্দেস (ককর, ৯৪-০০) ফ্রি থাকলে আমার রুমে চলে আসে। দুইজন মিলে ছবি দেখি, আড্ডা মারি অথবা নেশাগ্রস্তের মত F.R.I.E.N.D.S. দেখতে থাকি পর্বের পর পর্ব। খাওয়া নিয়ে খুব একটা চিন্তা করিনা। হলের ক্যান্টিন বয়কে আগেই টাকা দেয়া থাকত, ও নিয়ে আসত সময়মত। এইভাবেই খুব সুন্দর আরামের দিন কাটিয়ে যাচ্ছিলাম। তখন হঠাৎ করেই একদিন আমার বহুআরাধ্য টেলিযোগাযোগ প্রতিষ্ঠান থেকে মৌখিক পরীক্ষার ডাক এল।

আমি যখন পাশ করে বের হয়েছিলাম তখন টেলিযোগাযোগ প্রতিষ্ঠানে চাকরী বেশ আরাধ্য একটা বস্তু ছিল। যথারীতি আমারও পণ ছিল ওখানেই চাকরী করার। ওখানে আগেই লিখিত এবং মৌখিক পরীক্ষার অভিজ্ঞতা থেকে বুঝলাম যে এবার খুব ভাল পিছলা খাওয়ার প্রস্তুতি না নিয়ে গেলে খবর আছে। পিছলা খাওয়া মানে এমনভাবে উত্তর দেয়া যাতে প্রশ্নকর্তা খুব ভালোভাবে চেপে না ধরতে পারে। যেমন- আমাকে আগেরবারে প্রশ্ন করা হয়েছিল, “তুমি একা একা না টিমের সাথে কাজ করতে পছন্দ কর?” আমি মনে মনে ভাবলাম টিমের পক্ষেই যাই, তারপর ক্যাডেট কলেজের টিম স্পিরিট নিয়া একগাদা বক্তৃতা দিয়ে দিব। কিন্তু কিসের কি? টিমের পক্ষে সায় দিতেই প্রশ্নকর্তা চেপে বসলেন এবং বললেন, “তার মানে তুমি একা একা কাজ করতে পছন্দ করনা।” আমি সাথে সাথে বেঁকে গিয়ে নানানভাবে বুঝানোর চেষ্টা করে শেষে বুঝে গেলাম যে এইবার আর হচ্ছেনা। পরে এক বন্ধুর কাছে শুনেছিলাম এই প্রশ্নের সঠিক উত্তর নাকি হবে “আমি দলগত লক্ষ্য অর্জনের জন্য একা একা কাজ করতে পছন্দ করি।” আমার মত বেকুব আগে থেকে এইসব শিখে না গেলে ভাইবাতে জীবনেও পারবেনা। তাই এইবার পিছলা খাওয়ার মত সম্ভাব্য প্রশ্ন এবং উত্তর যাচাই-বাছাইয়ে লেগে গেলাম।

লিখিত পরীক্ষার দিনটি চলে এল। সময়ের বেশ আগেই চলে গেলাম যথাস্থানে। রিসেপশনে এক ব্যাটার সামনে একটা লিস্ট আছে। মৌখিক পরীক্ষায় যারা অংশগ্রহণ করবে তাদের সেখানে নামের পাশে স্বাক্ষর দিতে হবে। সদ্য স্বাক্ষর করে আসা এক ব্যাচমেট পরীক্ষার্থিনীর দিকে হাসি হাসি মুখে তাকিয়ে আমিও গেলাম সেখানে স্বাক্ষর করতে। কিন্তু , একি? লিস্টে আমার নাম কোথাও নাই। নাই মানে নাই-ই! পারলে মাইক্রোস্কোপ যোগাড় করে সেটা দিয়ে আমার নাম খুঁজি। মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। সামনের রিসেপশনিস্ট ব্যাটাকে যতই বুঝাই যে আমাকে মৌখিক পরীক্ষার জন্য ডাকা হয়েছে, সে ততই বুঝতে চায় না। কাঁচুমাচু হয়ে অনেক্ষণ অনুনয়-বিনয় করার পর ব্যাটা কি মনে করে এইসব পরীক্ষা যিনি নিয়ন্ত্রন করেন সেই ভাইকে ফোন দিয়ে আমাকে ফোনটা ধরিয়ে দিল। আমার স্বপ্নভঙ্গ করে সেই ভাইও বলে বসলেন, “আপনার নাম লিস্টে নাই,তার মানে আপনাকে ডাকা হয়নাই।” আমি এখন কই যাই? প্রায় কান্না-কান্না কন্ঠে বললাম, “ভাইয়া, প্লিজ একবার লিস্টটা চেক করে দেখুন।” উনিও কি মনে করে রাজি হয়ে গেলেন এবং কিছুক্ষণ পর বললেন, “তাই তো, আপনার নাম তো আসলেই লিস্ট থেকে বাদ পরে গিয়েছিল।” আমি যেন আমার হারানো জীবন খুঁজে পেলাম।

প্রচন্ড ঝড় কিংবা জলোচ্ছ্বাসের পর যেসব মানুষেরা বেঁচে যায় তাদের আর কিছু হারানোর থাকেনা,তারা হয়ে উঠে সাহসী । তেমনি আমিও মৌখিক পরীক্ষার ঠিক আগ মুহূর্তে প্রচন্ড রকমের আত্মবিশ্বাসী হয়ে গেলাম। এরপর ভাইবা বোর্ডের প্রশ্নকর্তাদের বাউন্সারগুলো হুক করে উড়িয়ে দিলাম সীমানার বাইরে, আর অফ স্ট্যাম্পের বাইরের শর্ট-পিচ বলগুলোর তো কথাই নেই। অবশ্যম্ভাবী প্রতিক্রিয়ার মতই কিছুদিন পর শর্ট-লিস্টেড তিনজনের মৌখিক পরীক্ষায় আবার আমার ডাক পড়ল।

আমার হল ছিল পলাশীতে। হলের খুব কাছের একটা জায়গা থেকে “উইনার” নামের একটা বাস গুলশান পর্যন্ত যেত। সকালে তাড়াতাড়ি বের হয়েছি দেখে ভাবলাম, বাসেই যাই। ওখানে আগে পৌঁছে বসে থাকা চেয়ে বাসেই কিছুটা সময় ব্যয় করি। বাসে উঠে বসলাম, বাস যথাসময়ে ছেড়েও দিল। বাসটার যাত্রাপথে বসুন্ধরা সিটির সামনে দিয়ে গিয়ে কারওয়ান বাজার ক্রস করে হোটেল সোনারগাও দিয়ে যাওয়ার কথা। বসুন্ধরা সিটির কাছাকাছি পৌঁছানোর একটু আগে বাসটা যেন হঠাৎ করেই থেমে গেল। আমি অবাক হয়ে খেয়াল করলাম, সামনে বিশাল এক জ্যাম। সব জ্যামই একসময় ছুটে যায়, এটা চিন্তা করতে করতে আমি অপেক্ষা করতে থাকলাম। কিন্তু সেই সময়টা তখন আর আসছেনা, চল্লিশ-পয়তাল্লিশ মিনিট ধরে বাস একই জায়গায় থেমে আছে। কিছুক্ষণ পর কোন এক উপদেষ্টার গাড়ী, খুব সম্ভবতঃ প্রধান উপদেষ্টার, কারওয়ান বাজার অতিক্রম করে ফার্মগেটের দিকে যাচ্ছিল তখন বুঝতে পারলাম কেন এতক্ষন ধরে একজায়গায় বসে আছি। সেই জ্যাম ছুটল, বাসও চলতে লাগল গুলশানের দিকে। বাস থেকে নেমে দৌড়াতে দৌড়াতে রিকশা ধরে যখন যায়গামত পৌঁছলাম, ততক্ষনে আধাঘন্টার মত দেরী হয়ে গেছে।

কিছুটা মন খারাপ, ভয় আর উৎকন্ঠা মিশ্রিত অনুভূতি নিয়ে ভিতরে ঢুকে অপেক্ষমান বাকী দুই পরীক্ষার্থীর দিকে তাকিয়ে বুঝলাম ভাইবা তখনও শুরু হয়নি। ভাইবা যে দুইজন নিবেন তাদের মধ্যে একজন মিটিং এ ব্যস্ত থাকায় ভাইবা পিছানো হয়েছে। স্বস্তির সুবাতাসটা টের পেয়ে মনে মনে আল্লাহকে ধন্যবাদ জানানো শুরু করলাম। তার কিছুক্ষণ পর একেকজনকে ডেকে নিয়ে ভাইবা নেয়া হল। আমি খুব একটা ঘাবড়ে না গিয়ে ভালভাবেই শেষ অংশটুকু পার করে গেলাম।

এত চড়াই-উৎরাই পার করে তিন সপ্তাহ পর যখন চূড়ান্তভাবে নির্বাচিত হওয়ার ফোন কলটি পেলাম তখন মনে মনে বলতেই হল, “পাইলাম, আমি ইহাকে পাইলাম।”

শিক্ষণীয় বিষয়সমূহঃ

১. পরীক্ষার আগে নানানরকম ভেজাল হইতেই পারে, তাতে হাল ছাড়া যাবেনা।
২. ভাইবাতে পিছলা খাওয়া টাইপ প্রশ্নের জন্য ভালোভাবে প্রস্তুত থাকতে হবে।
৩. এখন তো উপদেষ্টারা নাই, তাই পরীক্ষার সময় বিশিষ্ট মন্ত্রীদের সম্ভাব্য যাত্রাপথ এবং যাত্রাপথের সময়সূচী সম্পর্কে আগে থেকে ওয়াকিবহাল থাকাই ভাল।
৪. মন্ত্রীদের যাত্রাপথ বা তার সময়সূচী ম্যানেজ করতে না পারলে লিখিত বা মৌখিক পরীক্ষার সময় বাস ব্যবহার না করাই উত্তম। আর যদি বাস ব্যবহার করতেই হয় তাইলে কিন্তু খুব,খুব খিয়াল কইরা।

৩,৩৯৯ বার দেখা হয়েছে

১১১ টি মন্তব্য : “ইহাকে পাওয়া এবং শিক্ষণীয় বিষয়সমূহ”

  1. কাইয়ূম (১৯৯২-১৯৯৮)

    চমৎকার ঝরঝরে লেখা :clap:
    পোলাটা কেন যে এত ঢং করে লেখা নিয়া, বুঝিনা 😡
    আহারে সবসময় বিভিন্ন ভাইবাতে পুল হুক তো দূরের কথা নো বলে রান আউট হইতে হইতে টায়ার্ড হয়ে গেলুম 😀 পুরা বাংলাদেশ টিম :(( :((
    তানভীরের লেখা চালু থাকুক, ফয়েজ ভাই তো আছেনই না লেখলে অরে পাঙ্গানির লাইগা 😀


    সংসারে প্রবল বৈরাগ্য!

    জবাব দিন
  2. রায়হান আবীর (৯৯-০৫)

    *

    মজা পাইলাম।

    *

    ফ্রিকের মতো সিরিয়াল দেখা শুরু করেছিলাম গতবছর নভেম্বর থেকে। সারারাত জাগতাম- প্রিজন ব্রেক, হিরোজ, গ্রেস এনাটমি, লস্ট, প্রাইভেট প্র্যাকটিস, ৪৪০০ গিলতাম। অবস্থা এমন হয়ে গেছিল- স্বপ্ন দেখতাম ইংলিশ এ। হাতের কাছে সব সিরিয়াল দেখে ক্ষ্যামা দিসিলাম। তারপর আবার এই ছুটিতে শুরু করছি। অনেকের কাছেই শুনছি ফ্রেন্ডস তাদের দেখা সেরা সিরিয়ালগুলোর একটি। আমি মাঝে মাঝে স্টার ওয়ার্ল্ডে দেখছি। কিন্তু গত কয়েকদিন হয়- এক ফ্রেন্ডের কাছ থেকে ডিভিডি নিয়ে আসছি। এক রাতে দুই সিজন দেখে ফেলছি। "জোয়ি" নামে আরেকটা সিরিয়াল আছে- সেটাও দেখছি দুই সিজন। মারাত্মক।

    *

    ক্যাডেট কলেজে ভাইভা পরীক্ষা দিয়ে যখন আমি বের হই- তখন আমি আব্বুকে বলছিলাম, আমি চান্স পাবো নিশ্চিত। যদিও ভাইবার একাডেমিক ৯০% প্রশ্নের উত্তর আমি পারি নাই। কিন্তু মনে হচ্ছিল পাবো।

    সেই থেকে আমি জীবনের একটা ব্যাপারে সিউর- যে ভাইবায় কোনদিন কেউ আমাকে আটকাতে পারবে না। তাই একটলের ইন্টার্শীপের সময় যখন HR থেকে আমাকে বললো- দুই জনকে ইন্টার্ন হিসেবে নেয়া হবে এবং তার জন্য হবে ভাইভা পরীক্ষা। তখন থেকেই আমি সিউর হয়ে যাবে। এতই সিউর ছিলাম যে, আইইউটির ইন্ডাশট্রিয়াল এটাচমেন্টের জন্য চার মাসের আগে থেকেই যে ফরম ফিলাপ করতে হয় সেইটা করি নাই। ভাইভায় আমার সাথে যারা ক্যান্ডিডেট ছিল- সবাই পাশ করা। একমাত্র আমিই ছিলাম থার্ড ইয়ারের আবাল। কিন্তু চান্স পাইতে অসুবিধা হয় নাই। যদিও এখন মনে হইতাছে না পাইলেই ভালো হইতো।

    *

    হায়রে জাম। এটা নিয়াও কাহিনী আছে। তাতে মন্তব্য ব্লগ থেকে বড় হয়ে যাবার আশংকা রয়েছে।

    *

    কার কাছ থেকে শুনছিলাম টেলিকমের ভাইভার উত্তরে কী বলতে হয়, তার একটা চোথা আছে। আইইউটির কোন বড় ভাই হবে। টেলিকমে যাওয়ার যদিও কোন ইচ্ছা একটেলে দুই দিন যেয়ে আর নাই- তারপরও কোনদিন যদি হয় তাহলে সেইটা দিয়া ট্রাই দেওয়া যাবে।

    জবাব দিন
  3. বাংলাদেশের Star World,প্রায় জায়গাতেই indian টা। কি যে বোরিং ! এখন দেখি ঐ খানে PB, সিজন ২ দেখাচ্ছে। অথচ Fox এ কি না সিজন ৪ প্রায় শেষ।

    লিংকন এর আবার তো এসব সিরিয়াল না দেখলে রাতে ঘুম ঠিকমত হয় না, aktel এর ইন্টারনশীপ টা তো এ জন্য, ও করলোই না।
    😀

    জবাব দিন
  4. রহমান (৯২-৯৮)

    😮 😮 😮
    তানভীর লেখা দিসে???
    জাইগা আছি না স্বপ্ন দেখতেছি :-B ? আমি তো আবার বেশি স্বপ্ন দেখি 😀 😛

    তানভীর, লেখা পড়তে আরাম লাগে। লেখনা কেন? ডজিং কমাও, সিসিবিরে সমদ্ধ করো, আর কলেজরেও আগাইয়া নেও 😉

    জবাব দিন
  5. ফয়েজ (৮৭-৯৩)

    তানভীর লেখা এখনও পড়ি নাই। হাল্কা দৌড়ের উপর আছি। তুমি, মরতুজা লিখছ দেখলাম। সায়েদের একটা লেখা পড়া হয় নাই। রবিন দেখলাম ব্লগ মারছে। আরও দুইটা পোষ্ট আছে।

    তুমি লেখা দিছ এই খুশি তে :frontroll: দেয়ার জন্য লাগাইছ। বাকি বাতচিৎ পরে হবে।

    বাই


    পালটে দেবার স্বপ্ন আমার এখনও গেল না

    জবাব দিন
  6. হাসনাইন (৯৯-০৫)

    ৪৪০০, PB, heroes কি জিনিস আইইউটি না আসলে বুঝতাম না... প্রথম প্রথম একেবারে নেশা লেগে গেছিল PB এর জন্য, যা এখনো আছে। আমার রুমে আবার এইগুলার একজন ব্যাপক ফ্যান আছে, তাই আমারে বেশি কষ্ট করতে হয় না এইগুলা জোগাড় করতে।

    যেই সাবজেক্ট নিয়া পড়তাছি... চাকুরী খুইজা খুইজা মরণ লাগবো। 🙁
    এর চেয়ে তৌফিক ভাইয়ের মত প্রফেশনাল স্টুডেন্ট হওয়া ব্যাপক ভালা। :thumbup:

    জবাব দিন
  7. ফয়েজ (৮৭-৯৩)

    দূর আমার সিরিয়াল টিরিয়াল ভাল লাগে না। এক বসাতে দেখুম তা না সারা মাস, সারা বছর খালি ভ্যানর ভ্যানর করে এইগুলা।


    পালটে দেবার স্বপ্ন আমার এখনও গেল না

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : তানভীর (৯৪-০০)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।