সাংহাইয়ের পথে পথে-১

ইউয়ুন গার্ডেনের সম্মুখ ভাগআপনি যদি ঘুরতে ঘুরতে কখনো সাংহাই চলে আসেন তবে প্রথমে কোথায় যাবেন? চোখবন্ধ করে চলে যান ইউয়ন গার্ডেন (ইউ গার্ডেন)। আধুনিক রমরমা এত আকর্ষণ থাকতে কেন আমি আপনাকে প্রথমেই একটি ক্ল্যাসিকাল বাগানবাড়ির কথা বলছি তার অবশ্য কারণ আছে।
‘ইউ গার্ডেন দ্যা ফরবিডেন সিটি’ ওল্ড সাংহাইয়ের উত্তর-পূর্বের অ্যানরেন ঝিতে অবস্থিত। তদানিন্তন মীং সম্রাজ্যের সরকারী কর্মকর্তা প্যান ইউনডন বৃদ্ধ বয়সে বাবা মায়ের সুখ ও শান্তি নিশ্চিত করতে এটি তৈরি করেন। তৈরির কাজ শেষ হয় ১৫৭৭ সালে।কিন্তু গত চারশত বছরে এর অনেক পরিবর্তনও হয়েছে।মীং সম্রাজ্যের শেষের দিকে ১৭৬০ সালে এই বাগানবাড়ি প্যান পরিবারের কাছথেকে কিছু বণিক এটা কিনে নেন এবং প্রায় বিশ বছর সময় নিয়ে সংস্কারের কাজ করেন। উনবিংশ শতাব্দীর আফিম যুদ্ধের সময় আবারও বিশাল ক্ষতির সম্মুখীন হয় এই বাগানবাড়ি। তারপর চীন সরকারের তত্ত্বাবধানে ১৯৫৬-১৯৬১ সালে এই বাগানবাড়ির সর্বশেষ সংস্কার কাজ সারা হয় এবং সাধারণ জনগণের জন্য উন্মুক্ত করা হয়। প্রস্তর শিল্প
সর্বমোট ৫ একর জমির উপর অবস্থিত এই বাগানবাড়ি আকারে খুব বেশি বড় না হলেও এর আকর্ষণ আপনি ছোট করে দেখতে পারবেন না। ছোট-বড় প্যাভিলিয়ন, হল , পাথুরে টিলা,জলাশয়ের বিশেষত্ব আপনাকে দারুণভাবে আকর্ষণ করবে। চারিদিকে আপনার চোখে পড়বে সুনিপুণ শিল্পের নজরকাড়া নকশা। সবই চীনের আভিজাত্যে ভরা শৈল্পিক নিদর্শন। অসংখ্য স্থ্যাপত্যের মধ্যে মূলত ছয়টি স্থান আপনার নজর কেড়ে নেবে – সানসুই হল,ওয়ানহুয়া চেম্বার, দিয়ান চুং হল,হুইজিং হল,ইউহুয়া হল এবং ভিতর বাগান। বাগানে ঢুকতেই আপনার চোখে পড়বে গ্রেট রকারি(পাথরের টিলা) । এই পাথরগুলা ইয়ানজি নদীর সবচেয়ে পুরাতন পাথর।উচ্চতায় প্রায় ৫০ ফুটের এই টিলা থেকে আপনি পাখির চোখে পুরো বাগানবাড়ি দেখতে পারবেন। এই পাথুরে টিলার পাদদেশেই রয়েছে কুইজিয়াও হল।কুইজিয়াও হলকে ঘিরে আছে ২০০-৩০০ বছর বয়সের কয়েকটি গাছ এবং ফুলের বাগান।এর নিস্তব্ধতা আপনাকে বিমোহিত করবে নিশ্চিত।
সানসুই হল মূলত অতিথি আপ্যায়নের জন্য তৈরি করা হয়েছিল ১৭৬০ সালে। পরে অবশ্য সমাজের গুণিজনের বিভিন্ন অনুষ্ঠান এখানে আয়োজন করা হত।সানসুই হলেই উচ্চতা প্রায় ৩০ মিটার এবং মূল বাড়ির রয়েছে আরও ৫টি হল।বাগানের এই অংশই আয়তনে সবচেয়ে বড়। সানসুই নামকরনের পিছনে রয়েছে ছোট্ট ইতিহাস।“ হিস্ট্রি অফ দি লেটার হাং ডাইনেস্টি” বই থেকে এই নাম নেয়া হয়েছে যার অর্থ দাঁড়ায় ভাগ্যবান এবং শুভলক্ষণ যুক্ত।
ইউল প্যাভিলিয়ন এবং ওয়ানহুয়া চেম্বারে এসে আপনার চোখ হবে চড়কগাছ।বড় বারান্দা,জলাশয়, উঠান নিয়ে বাগানের এই অংশ।ওয়ানহুয়া চেম্বার মূলত নির্জন সময় কাটানোর জন্য তৈরি করা হয়। এই চেম্বারের সামনের একটি গাছ আছে যেটি এইবাগানের প্রতিষ্ঠাতা প্যান নিজেই লাগিয়ে ছিলেন ৪০০ বছর আগে। দিয়ান চুং হল
ওয়ান হুয়া চেম্বারের পুর্বেই দিয়ান চুং হল। হেক্সু হল,রিলিক হল, এনসিয়েন্ট ওয়েল প্যাভিলিয়ন ও জলসা ঘর মিলিয়ে এর অবস্থান। ১৮৫৩-৫৫ সালে এই হলটিই জিয়াওদাও হুই নামক একটি বিদ্রোহী গ্রুপের প্রধান কার্যলয় হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছিল।তৎকালীন চীং / কুইং রাজাদের বিরুদ্ধে তাদের ছাপানো মুদ্রা ও লিফলেট গুলা এখানে আজও রাখা আছে।
বাগানের সবচেয়ে বড় সঞ্চিত ধন হলো জেড পাথর। এটি প্রায় ১১ফুট উঁচু এবং এতে আছে ৭২টি ছিদ্র। মজার ব্যাপার হচ্ছে আপনি যদি যে কোন একটি ছিদ্রের নিচে একটি আগরবাতি জ্বালিয়ে ধরেন তবে সুবগুলান ছিদ্রদিয়ে ধোঁয়া বের হতে দেখবেন। একই ভাবে যদি উপরের ছিদ্রে পানি ঢালা হয় তবে তা সবগুলা সেই পানি উপচে পড়বে।
ইউয়ুন গার্ডেনের সব গুলো হল বা বাড়িই তৈরি ট্রিপিক্যান চাইনিজ স্থাপত্যকলায়। কাঠের উপর খোদাই করা সুনিপুণ কারুকাজ আপনার মনকে আপ্লুত করবে বারংবার। চাইনিজ স্থাপত্যকলার অনিবার্য টপিক ডুগং দিয়েই প্রত্যেকটি ঘরের একাধিক ছাদ তৈরি করা হয়েছে। চোখ আটকে যাবে চাইনিজ ক্যালিওগ্রাফিতে মনের অজান্তেই। ড্রাগন ওয়াল গুলার কারুকার্য আপনাকে স্মরণ করাবে তাদের সংস্কৃতিতে ড্রাগনের পদচারনাকে। টেরাকোটার কাজ খুব বেশী চোখে না পড়লেও আপনার মন ভরানোর জন্য রয়েছে যথেষ্ট ।
বাগানবাড়িতে ঢুকার আগেই রয়েছে সিটি গড টেম্পল।পারলে একবার ঢুঁ মেরে আসতেও পারবেন। এছাড়া বিশাল এলাকাজুড়ে আছে ইউয়ুন বাজার। মূলত এখানে চাইনিজ টি হাউজ গুলা থাকলেও এখন সবকিছুই পাওয়া যায় এখানে। তাদের সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য সকল উপাদানে পসরা সাজিয়ে বসেছে দোকানীরা।
হাজারো দর্শনার্থীর কৈলতানে বাগানের বাহিরের অংশ সর্বদা মুখরিত থাকলেও যখন আপনি বাগানে প্রবেশ করবেন তখন খুঁজে পাবেন প্রকৃতির নীবিড় ছোঁয়া, চেনাজানা তিলোত্তমা সাংহাইয়ের বাহিরে এক দন্ড শান্তি। চাইনিজ স্থাপত্যকলা
( চলবে)

৪,১১৯ বার দেখা হয়েছে

১০ টি মন্তব্য : “সাংহাইয়ের পথে পথে-১”

    • তানভীর (২০০১-২০০৭)

      পারভেজ ভাই, ধন্যবাদ পড়ার জন্য 🙂
      ইউয়ুন গার্ডেনে যখন গেলাম তখন বাগানের একটি লিফলেট টিকেটের সাথে দিয়েছিল কাউন্টার থেকে। পরে ফেরার সময় একটা পুস্তিকাও কিনে নিয়েছিলাম। সেখান থেকেই জেনেছি মূলত। সাথে ইন্টারনেট তো আছেই.... পড়ার ও মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ জানাচ্ছি আবারো। ভালো থাকবেন।


      তানভীর আহমেদ

      জবাব দিন
    • তানভীর (২০০১-২০০৭)

      মোস্তাফিজ ভাই, সত্যই চীনা স্থাপত্যকলায় তাদের নিজস্বতা ও প্রাচুর্যতা ফুটে উঠে সর্বদা। হাজার বছরের ইতিহাস আজো ধারন করে রেখেছে তারা। সাংহাইয়ের থেকে নর্থে আরও বেশী। ইচ্ছা আছে তিয়ানজিন, কুইনহানদাও,ডালিয়ান,কফেডিয়ানসহ অন্যান্য শহরগুলো চোষে বেড়ানোর।
      ধন্যবাদ পড়ার জন্য।ভালো থাকুন। (সম্পাদিত)


      তানভীর আহমেদ

      জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।