স্বাধীনতাযুদ্ধে ভিনদেশী বন্ধুরা

১৯৭১.
২৬৬ দিন।
তিরিশ লক্ষ জীবন। যেখানে হিসাব করলে দাঁড়ায় প্রতি মিনিটে প্রায় ৮ টি প্রাণ। অগণিত মা- বোনের সম্ভ্রম আর শত- সহস্র মানবিকতা বিরোধী অপরাধের বিনিময়ে আমরা পেয়েছি পাঁচ বর্ণের একটি শব্দ  “ বাংলাদেশ”। আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে বাংলা মায়ের দামাল ছেলেদের অবদান অনস্বীকার্য কিন্তু বহির্বিশ্বে অনেক বন্ধু ছিল যারা এই বাংলা মায়ের জন্য যুদ্ধে নেমেছিল। তবে তাঁদের যুদ্ধটা ছিল একটু ভিন্ন। তাঁদের যুদ্ধ ছিল এই ছোট্ট ব-দ্বীপটাতে সত্যিকার অর্থে কি ঘটছে তা বিশ্ববাসীকে অবগত করা। বাংলাদেশের ৪১ তম স্বাধীনতা দিবসে  শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করি সেইসব নিবেদিত প্রাণ মানুষগুলোকে।

১৯৭১ এর পঁচিশে মার্চের সেই ভয়াল রাত থেকে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা আমদের দেশে গণহত্যা শুরু করে। যেটি বিংশশতাব্দীর অন্যতম নৃশংস হত্যাকাণ্ড। তাদের এই ভয়াবহ হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা সারাবিশ্বের মানুষের কাছে পৌঁছায় কয়েকটি তথ্যচিত্রের মাধ্যমে। অ্যান্থনি মাস্কারেনহাসের “ দ্যা রেপ অফ বাংলাদেশ”, রবার্ট পেইনের “ ম্যাসাকার”, সুসান ব্রউনমিলারের “ এগেইন্সট আওয়ার ওয়ীলঃ মেন, ওমেন অ্যান্ড রেপ” ছিল সারা পৃথিবীর মানুষের কাছে দর্পণ স্বরূপ।

পশ্চিমা সাংবাদিকেরা নিষ্ঠার সাথে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করে গেছেন সেই ভয়াল দিনগুলিতে। ব্রিটেনের মার্ক টুলী ( বিবিসি), সাইমন ড্রিংক ( দি ইন্ডিপেনডেন্ট), উইলিয়াম ক্রলী ( বিবিসি রেডিও),  মারটিন ওয়ালকোট ( দি গার্ডিয়ান) ছাড়াও মার্কিন লরেন জোরকিন্স ( দি নিউজওয়ীক) ও ডন কগীন ( দি টাইম) সেইদিনগুলোতে জীবনটাকে একহাতে নিয়ে কাজ করে গেছেন আমাদের দেশের স্বাধীনতার জন্য।

ব্রিটেনে তখন ক্ষমতায় কনজারভেটিভ দল। প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হেথ। কিন্তু লেবার পার্টির পিটার শোর (১৯২৪-২০০১) এবং জন স্টোনহউস (১৯২৫-১৯৮৮) তৎকালীন সরকারকে  চাপ প্রয়োগ করতে থাকেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে। তারাই হেথ সরকারকে অবিহিত করেন সত্যিকারে এই দেশটিতে কি ঘটছে। তারা বলেন ব্রিটিশ সরকারের উচিৎ বাংলাদেশে যে গণহত্যা চলছে তার বিরুদ্ধে কমনওয়েলথ ভুক্ত দেশগুলোর কাছ থেকে সমর্থন আদায় করা। এর পরপরই হেথ সরকারের টনক নড়ে। অপরদিকে মার্কিনীরা যুদ্ধের শুরু থেকে পাকিস্তানকে সমর্থন করে যাচ্ছিল। নিক্সন সরকার ব্যাপারটা খুঁতিয়ে দেখতে সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডিকে পাঠান এই দেশে। তিনি সেই সময় ভারতের শরণার্থী শিবিরগুলো ঘুরে দেখেন। এরপর তার রিপোর্টের ভিত্তিতে নিক্সন সরকারের টনক নড়ে। পরে এই ভদ্রলোকই মার্কিনমুলুকে  অবহিত করেন সব রাজনৈতিক নেতাদের এবং সাধারণ জনগণকে।

My friend came to me, with sadness in his eyes; told me that he wanted help, before his country dies; Although, I couldn’t feel the pain; I knew I had to try
— “Bangladesh,” George Harrison, Concert for Bangladesh, 1971

সঙ্গীত যে যুদ্ধের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে সেটা প্রমাণ করেছিলেন বঙ্গ মায়েরই দুই সন্তান পণ্ডিত রবি শঙ্কার ও আলী আকবর খাঁ। তারা ১লা অগাস্ট ’১৯৭১  দুনিয়া কাঁপানো ব্যান্ড দল “ বিটলস ” এর জর্জ হ্যারিসনের সাথে যোগ দিয়ে নিউইয়র্ক-এর ম্যাডিসন স্কয়ারে আয়োজন করেন “ কনসার্ট ফর বাংলাদেশ ”। এছাড়া আমেরিকান বাউল শিল্পী জন বেইজ এর “ বাংলাদেশ ” গানটি সাধারণ জনগণকে বাংলাদেশের গণহত্যা সম্পর্কে অবিহিত করে। এই মানুষগুলোর কথা কমবেশি সবাই জানলেও আরও যারা ওই অনুষ্ঠানে ছিলেন তাদের নামগুলো একটু কম উচ্চারিত হয়। তারা হলেন বব ডিলন, এরিক ক্লিপটন, বিলি প্রিষ্টন, বিঙ্গ স্টার এবং লিওন বাসেল।

অ্যালান গিন্সবার্গ। মার্কিন কবি ও সাহিত্যিক। তিনি যুদ্ধের সময় বাংলাদেশে আসেন ও ভারতে অবস্থিত শরণার্থী শিবির পরিদর্শন করেন। অতঃপর তার লেখা “ সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড ” কবিতাটি পশ্চিমা বুদ্ধিজীবীদেরকে অবগত করে তোলে সত্যিকার অর্থে কি ঘটছে এই ছোট্ট দেশটিতে।

এবার যার কথা বলছি তিনি ফ্রান্সের সাহিত্যে নোবেল( ১৯৬০) বিজয়ী সাহিত্যিক আন্দ্রে মারলাক্স( ১৯০১-১৯৭৬)। তিনিই সেদেশের জনগণকে অবিহিত করেন আমাদের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে। এমনকি সেপ্টেম্বরের দিকে নিজে জনসম্মুখে ঘোষণা দেন যে তিনি “ মুক্তিবাহিনীতে” যোগ দিতে চান।  শেষ পর্যন্ত যুদ্ধে যোগ দিতে না পারলেও স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশে এসেছিলেন তিনি।

এই ক্ষেত্রে পাকিস্তানী দুইজন কবির কথা না বললেই নয়। একজন আহমেদ সেলিম। বাংলাদেশের স্বাধীনতার যুদ্ধে তিনি বাংলাদেশের পক্ষ নেওয়ায় তাকে কারাবাস করতে হয়েছিল। পরে তিনি শহীদ জননী জাহানারা ইমামের           “ একাত্তরের দিনগুলি ” উর্দুতে অনুবাদ করেন। যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে তিনি প্রায় ৫০ টি ছোট গল্প লিখেন যেখানে পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর নির্যাতন ও গণহত্যার কথা ফুটিয়ে তুলেন। অপর জনের নাম তারেক আলী। তার কণ্ঠ সর্বদা পাকিস্তানী সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিল।

জাপানের অধ্যাপক সুয়শি নারা মুক্তিযুদ্ধের সময় জাপান- বাংলাদেশ মৈত্রী সমিতি গঠন করেন। সমিতির মাধ্যমে ত্রাণসামগ্রী কিনে নিয়ে যান কলিকাতার সল্ট লেকের শরণার্থী শিবিরে। পরে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে ১৯৭৪ থেকে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত চাকুরী করেন। প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আধুনিক ভাষা ইন্সটিটিউট তার হাতেই গড়া।

মুক্তিযুদ্ধের সময় এইসব বিদেশী বন্ধু-সুহৃদরা বাংলাদেশকে যে কতটা আপন করে নিয়েছিলেন সেটা অনুধাবন করা যায় তাদের প্রচেষ্টাগুলোর দিকে তাকালে। তারা আমাদের দেশটাকে আপন করে নিয়েছিলেন। কেউবা নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করেছেন। এবার স্বাধীনতা দিবস উৎযাপনের সময় আমাদের এইসব বন্ধুদেরকে অবদানের স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য বাংলাদেশ সরকার যে প্রকল্প হাতে নিয়েছে সত্যিই তা প্রশংসার দাবীদার।

 

( বিঃ দ্রঃ  আমার এই তালিকা কোনভাবেই সকল বিদেশী মুক্তিযোদ্ধাদের কে একত্রিত করেনা। আমি চেষ্টা করেছি যারা বহির্বিশ্বকে আমাদের দেশে যে গণহত্যা চলছিল সেটা সম্পর্কে অবগত করেছিলেন তাদের কথা বলতে)

 

 

২,১০৩ বার দেখা হয়েছে

৫ টি মন্তব্য : “স্বাধীনতাযুদ্ধে ভিনদেশী বন্ধুরা”

  1. তাওসীফ হামীম (০২-০৬)

    হু,মাহমুদ জেনেভার চুম্বক অংশগুলো দেখলাম ফেশবুকে ( ব্রাউনমিলারের)।
    তানভির ভাই একটা ধন্যবাদ নেন আমার পক্ষ থেকে। লেখটা খুব সুন্দর হইছে।
    আন্তর্জাতিক ভাবে আমাদের প্রচার আর সমর্থন না থাকলে হয় ৭১ শেষ হত একটা রক্তাক্ত গৃহযুদ্ধ কিম্বা প্রাদেশিক ম্যাসাকারে।


    চাঁদ ও আকাশের মতো আমরাও মিশে গিয়েছিলাম সবুজ গহীন অরণ্যে।

    জবাব দিন
    • তানভীর (২০০১-২০০৭)

      হামীম, ধন্যবাদ নিলাম। তুমি পড়লে এটাই অনেক।
      আর হ্যাঁ, আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে আন্তর্জাতিক প্রচার আর সমর্থন যতটুকুন পেয়েছি তার মধ্যে প্রচার মাধ্যমের ভূমিকাটা সবচেয়ে বেশী। আর অন্য জাতির কাছ থেকে যতটুকুন সমর্থন সেটাতে কিন্তু আছে বৈকি।


      তানভীর আহমেদ

      জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : সন্ধি (১৯৯৯-২০০৫)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।