আমার বুবু………বুবু আমার

 

লেখাটা যে কোথা থেকে শুরু করবো কোনভাবেই সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলাম না। দুচোখের সামনে এত স্মৃতির আনাগোনা; এত কথা ঝুপি খুলে বসেছে যেন মনে হয় সব একসাথে লিখে ফেলি। কিন্তু কলমটা যেন লিখতে ভুলে গেছে……………………। নিজের আজান্তেই দেখি চোখ বেয়ে পড়ে লোনা জল।

আমার বুবু। বয়সে আমার থেকে ৭ বছরের বড়। বুদ্ধি হবার পরথেকে দেখেছি শুধুই আমার উপর ওর খবরদারি। বুবুর সেই সময়ের খুনসুটি গুলো আমার গায়ে সর্বদা জ্বালা ধরিয়ে দিত। পান থেকে চুন খসলেই বসিয়ে দিত দুচারটা কিল ও ঘুষি। বাবা-মা কোন কথা ও গায়েই নিতনা। বেশি কিছু বললে সোজা চলে যেত নানু বাড়ি। নানু বাড়ি ছিল আমাদের বাড়ির কছেই। বুবুর দস্যিপনায় সবাই সবসময় ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি আবস্থায় থাকত। বয়স বাড়তে থাকলেও বুবুর কোন পরিবর্তন হয়না।

২০০১ সালের কথা। আমি ভর্তি হলাম ক্যাডেট কলেজ। বুবু তখন অনার্স পড়ে। আমাকে রেখে আসার সময় বুবুর সেকি কান্না। আম্মু  বুবু কে বলল, “ দেখছিস তোর ভাই তো তোর জন্য মোটেও কাঁদে না?” আমিও নির্লিপ্তের মত বলে দিলাম, “ আমি কাঁদবো কেন ওর জন্য, ও তো আমাকে সবসময় মারে।” এটা শুনে বুবুর কাঁদা আরও বেড়ে গেল কিন্তু আমার কোন ভাবান্তর হলনা।

বাবা ছোট সারকারি চাকুরী করতেন আর মা গৃহিণী। নুন আনতে পান্তা ফুরানো এই চিরায়িত চিত্রের বাহিরে ছিলনা আমাদের পরিবার। বাবা চাকুরী থেকে অব্যহতি নিলেন ওই বছরের শেষের দিকে। সমস্যার চাদর যেন বড় করে চেপে বসলো আমাদের এই নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারটির উপর। পরের বছর বুবুর বিয়ে দেবার  সিদ্ধান্ত নিল বাবা-মা। যে বুবু আগে সবসময় বলতো পড়াশুনা শেষ না করে বিয়ে করবেনা সেই কিনা বাবা বলার সাথে সাথে রাজী হয়েগেল!!! দস্যি বুবুর হটাৎ এই পরিবর্তন দেখে সবাই খুব অবাক হল। এখন বুঝি কেন এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছিল বুবু। বাবার চাকুরী ছিলনা, দুই ভাইবোনের পড়ালেখার খরচ তা ছাড়া পারিবারিক খরচ এই সব চিন্তা করেছিল বুবু। তার উপর দুলাভাই ভাল একটা চাকুরী করে, ফ্যামিলি ভাল,বাবা-মায়ের মত আছে।

যে বুবু আমার শখ করে ও মায়ের সাথে রান্না করতে যেত না,সে ঠিকই আর একজনকে রান্না করে খাওয়ানো শুরু করল। যদিও প্রথমদিকে একটু সমস্যা হত কিন্তু পরে ঠিকই মানিয়ে নিয়েছিল। বিয়ের পরে আবার পরাশুনাও শুরু করল। ওরা তখন থাকত খুলনা। বুবু বলল আমি গ্রামে থাকার চেয়ে খুলনা থাকলে আমার জন্য ভাল হবে তাই কলেজ থেকে ছুটিতে থাকতাম তার কাছে। বুবুর আমার অনেক পরিবর্তন, আমাকে আর মারে না, কোন স্যার দের কাছে পড়বো, পড়াশুনা, ঘুম, খাওয়া সবই দেখে সে। প্রতিবার ঈদ আসতে না আসতেই  বাবা-মা আর আমার জন্য ঠিকই নতুন জামাকাপড় কিনে ফেলত। টিউশনি করে যে টাকাগুলো জমে এইগুলো দিয়ে আমার চাহিদা  পূরণ করাই ছিল ওর কাজ।

বাবা-মা  প্যারেন্ট’স ডেতে কলেজ এ আসার সময় বুবুর বাসা হয়ে আসত। বুবু ঠিকই আমার পছন্দের হাঁসের মাংস আর চিংড়ি মাছ রান্না করে পাঠাত। আমার পড়ালেখার খরচ যখন যেভাবে পেরেছে বাবা-মাকে দিয়ে তাদের কাজটা সহজ করেছে সবসময়।

আমার পড়ালেখা তখন ও শেষ হয়নি। বাবা এরই মাঝে খুব আসুস্থ হয়ে পড়ল। আমার খরচ,বাবার চিকিৎসা খরচ এই চিন্তা করে আমার মা তখন কি করবে ভেবেই পায়না। এই যাত্রায়ও বুবু এগিয়ে এলো। ভাইয়ার সাহায্য নিল আর নিজের সাধের গহনা গুলো বেঁচে দিল। আমি যদি কিছু জানতে চাইলে  বলত এইতো ম্যানেজ করেছি।

আমার পড়ালেখা শেষে আমি চাকুরীতে যোগ দিলাম। আমার পেশাটা একটু অদ্ভুত। জলের মানুষ আমি; জলে জলে ভেসে বেড়ানোই আমার কাজ। প্রথম প্রথম খুব খারাপ লাগত। আগেও সবাইকে ছেড়ে থেকেছি কিন্তু সেটা কিছু দিনের জন্য। ছুটিতে আসলে সব ভুলে যেতাম। যখন যে দেশ থেকে সুযোগ পেতাম বাসাতে যোগাযোগ করতাম। যদি কোন বার শুধু বাবা-মাকে ফোন করি,পরের বার বুবুকে ফোন করলে আগে জাবাবদিহি করতে হত কেন বুবুকে ফোন করিনি। আবার নিজে নিজেই বলে সময় পাসনে,তাই না? আমি কিছুই বলতে পারিনা।

প্রথমবার চুক্তি শেষে যখন দেশে আসলাম বাসার সবার জন্য টুকিটাকি কিছু কেনাকাটা করেছিলাম।আমার বুবুর জন্য ইরান থেকে ব্লু সেফিয়ার এর এক সেট গহনা কিনেছিলাম। বুবুর সেকি আনন্দ! কিন্তু বুবুকে  কোনদিন পরতে দেখিনি। একদিন আগ্রহভরে জিজ্ঞাসা করলাম। সে বলল,আমি রেখে দিয়েছি তোর সাথে যার বিয়ে হবে তার জন্য। আমি ভাবি আমার বুবু যেন আর পাঁচটা মানুষের মত না; মনে হয় অন্য কোন ধাতুতে গড়া।

এইতো সেদিন বাসায় মামী-চাচী,মা আর বুবু বসে গল্প করছিল। মা একসময় বলল, তোমরা একটা ভাল মেয়ে দেখ। কিছু দিন পর আমার বিয়ে দিতে চায় আমার মা। বুবু বলল, ওর বিয়ের বয়স হইছে নাকি??? ওর বিয়ের এখনও অনেক বাকি। আর আমি দেখব ওর জন্য পাত্রী। সেই দিন রাতে বুবু আমাকে ডেকে বলল, সবকিছু এখন আমার হাতে ভাইয়া। আমি যা বলবো তাই হবে। আমি এটা কেন বলেছি জানিস? যাতে তোর কোন পছন্দ থাকলে আমাকে বলবি পরে আমি সবাইকে বলবো তুই এই মেয়েকে চিনিস না। আমিই তোর জন্য পছন্দ করেছি। আমি কোন কথা বলতেপারলাম না,শুধু একটু হাসলাম।

এখন আমার বুবুর দুটো বাচ্চা। সারাদিন তাদেরকে আগলে রাখতেই ব্যস্ত। কিন্তু এখনও আমি যখন যাই ও যেন সবকিছু ভুলে যায়। সেই আমার দস্যি বুবু কেমন দুই হাত দিয়ে আগলে রেখেছে দুই-তিন টা সংসার।

এখন আমি ভাবি আসলে মেয়ে জাতটাই যেন এমন। খোদার এক অপূর্ব সৃষ্টি। মায়া, মমত্ব,আদর, স্নেহ, ভালোবাসা যেন তাদের রক্তে-মাংসে মিশে আছে। আমার বুবুকে নিয়ে আমার বড্ডও গর্ব হয়। এমন বড় বোন কয়জনের ভাগ্যেই বা জোটে।

 

 

১৪০,৫৪৩ বার দেখা হয়েছে

৪৮ টি মন্তব্য : “আমার বুবু………বুবু আমার”

  1. নূপুর কান্তি দাশ (৮৪-৯০)

    এরকম স্নেহময়ী মা, দিদি পেলে জীবনটাকে আর বোঝা মনে হয় না। তোমার মতো পারিবারিক আবহ আমরা সবাই পেলে পৃথিবীটা আরো সুন্দর হতো।

    তোমার বুবুকে সালাম।

    জবাব দিন
  2. রকিব (০১-০৭)

    হিংসে দিলুম না।
    আমারও অনেকগুলা বোন আছে। যদিও একজন খালি ক্যাডবেরির লোভ দেখায়, জীবনেও দেয় না। আরেকজন আমার উপর রাগ করে কোন যোগাযোগ করে না 🙁


    আমি তবু বলি:
    এখনো যে কটা দিন বেঁচে আছি সূর্যে সূর্যে চলি ..

    জবাব দিন
    • তানভীর (২০০১-২০০৭)

      তোর আর হিংসে দিতে হবে না। কষ্ট করে পড়লি সেটাই অনেক।
      আর যেহেতু এটা একটা সৃজনশীল জায়গা লেখার সমালোচনা করলে আরও বেশি খুশি হবো। আমার মত নতুন ব্লগারদের জন্য সেইটা বেশি কাজ দিবে।
      আর ক্যাডবেরি না হয় আমি তোকে দিব.............................. 😛 😛 😛


      তানভীর আহমেদ

      জবাব দিন
  3. সন্ধি (১৯৯৯-২০০৫)

    তানভীর, লেখাটা আগে পড়া হয়নি। তোর অনুভূতিগুলো এত সুন্দর ভাবে ফুটে উঠেছে, অসাধারন। চালিয়ে যা। আমার নিজের বড় বোন নেই। সব সময় এই একটা না পাওয়া অনুভব করি। তাও তোর লেখা পড়ে তোর অনুভূতির কিছু অংশ ধার নিয়ে কল্পনার জাল বুনি। খুব ভাল লাগল। :clap:

    জবাব দিন
  4. খায়রুল আহসান (৬৭-৭৩)

    আমারও একটা বুবু ছিলো, তিনি আজ পরপারে। তোমার লেখাটা পড়তে পড়তে চোখ ঝাপসা হয়ে এলো। তাঁর কথা মনে হলো। ভেবেছিলাম, এখানে তাঁর কথাও কিছু লিখবো, কিন্তু পারছিনা।
    তোমার বুবুর প্রতি :hatsoff:

    জবাব দিন
  5. সাজেদ (২০০৪-২০১০)

    অনেক আবেগ দিয়ে লেখা। নিজের বড় কোন বোন না থাকলেও অনুভব করতে অসুবিধা হয়নি। ভাই, অসাধারণ লাগছে।
    🙂 🙂 🙂


    "মরনের বীথিকায় জীবনের উচ্ছ্বাস,

    জীবনের যাতনায় মৃত্যুর মাধুরী"

    জবাব দিন
  6. আসসালাআলাইকুম,ধন্যবাদ, এমন আদরের বোনের কথা পোষ্ট করার জন্য, আমি সবার বড় বোন,তবে আমার ফুফাতো বোনের কাছে আমি অনেক দিন বলতে প্রায় অনেক বছর ছিলাম,তার খুনসুটি ভালোবাসা আমায় ধন্য করেছে,মেয়ে হয়েও অনেক ভালোাসা পেয়েছি,আল্লাহর কাছে হাজার শুকরিয়া আদায় করি। আমার বোনটা একন শশুর বাড়িতে,তার দুটো মেয়ে আছে,সবাই আমার বোন- ভাগনীদের জন্য দোয়া করবেন যাতে তারা সবসময় সুখীও সুস্থ থাকে আল্লাহ তাদের নেক হায়াত দান করে।আমিও দোয়া করি,আল্লাহ তাদের সহীহ সালামত রাখে,নেক হায়াত দরাজ করে,আমিন। ::salute:: সবাই কে আমার পক্ষ থেকে সালাম জানাই,আসসালামুআলাইকুম...........সুস্থ থাকুন ভালো থাকুন, নামাজ পড়ুন,আল্লাহর ইবাদত করুন।

    জবাব দিন
  7. আমারও বড় বোন আছে,,ছোট বেলায় বোন আমায় কতই না শাসন করেছে,সহ্য হত না,কিন্তু এখন আমি যখন বাড়িতে যায় তখন আপু আমাকে তাদের বাড়িতে নেওয়ার জন্য পাগল হয়ে যা,অনেক মায়া করে,অনেক সম্মান ও করে,,,আসলেই বড় আপুরা এরকমই হয়,,,

    জবাব দিন
  8. ইউ আর লাকি ভাই আমার ও চারটে বোন আছে মা আছে বাবা ভাই কেউ নাই অথছ আমি বড় অসহায় আমার সব থেকেও যেন কেউ নেই। কখনো কারো কাছ থেকে একটু ভালোবাসা পাইনি সব সময় তারা আমার কাছে শুধু টাকা চেয়েই সিমাবদ্ধ টাকা দিলেই তারা খুশি টাকা না দিতে পারলে আমি সবার চোখে কেমন জানি পর পর হয়ে যাই

    জবাব দিন
  9. MOINUL

    এমন লেখা কবে পড়েছি মনে পড়ছেনা। যদি ও আমার কোন বোন নেই, তবে তোমার লেখাতে একটা অন্য রকম অনুভুতি মনকে ছেয়ে গেল। এখন মনে হচ্ছে একটা বোন থাকলে মন্দ হত না !

    মঈনুল ইসলাম
    ম্যানেজার
    দেশীচাই এগ্রো প্রোডাক্টস
    https://www.facebook.com/Deshichaibd/

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : Farjana Ahmed Mohima

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।