চাকা

মহাদেবপুর মহাকূমা থেকে অজগরের মত এঁকেবেঁকে বিশাল রাস্তাটা চলে এসেছে সূত্রাপুর। ইট বসানো পাকা রাস্তা। দু’ধারে কড়ই,নিম আর শাল গাছগুলো কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।প্রায় দুশো বছর আগে মহাদেবপুরের জমিদার বিনোদ রায় সিং যশোর থেকে মহাদেবপুর পর্যন্ত ২০০ ক্রোশ লম্বা এই রাস্তা নির্মাণ করেছিল। সূত্রাপুরে তখন কয়েক ঘর লোকের বসতি ছিল। গ্রামের দক্ষিণদিকটায়, খালের পাড়ে। কুমোরপাড়া।

আজ সূত্রাপুরে কয়েক হাজার লোকের বাস।  কুমোরপাড়া,জেলেপাড়া, তাঁতিপাড়া,শেখপাড়া ও কাজীপাড়া নিয়ে আজকের এ গ্রাম।গ্রামে এখন একটা স্কুল,একটা মসজিদ ও দুটো মন্দির আছে।খালের পাড়ে হাট বসে সপ্তাহে দু’বার। সময়ের সাথে গ্রামের রঙ বদলালেও কুমোরপাড়ার মানুষের ভাগ্যে কোন পরিবর্তন আসেনি। সেই সূত্রাপুরের জন্মলগ্ন থেকে কুমোরদের চাকা ঘুরলেও তাদের ভাগ্যের চাকা আজন্ম থমকে আছে। বছরের পর বছর।

নারান কারিগর তাদেরই একজন। জন্ম থেকে তার একটা হাত বাঁকা। বয়স ৩০ হবে। ছোট্ট সংসার তার। বৌ আর সে। মা তার গত হয়েছে বয়স যখন চার। আর বাবা দুবছর আগে, পৌষসংক্রান্তির ঠিক এক সপ্তাহ আগে।ছোটবেলায় বাবার কাছেই তার এ কাজে হাতেখড়ি। বয়সের সাথে এক হাতেই পটু হয়েছে সে এ কাজে। এখন ওর কাজ দেখে বোঝার উপায় নেই যে ওর একটা হাত অকেজো। তার রাত-দিনের খাটুনিতে কাদা হয় মাটির  হাঁড়িপাতিল, কলস, সরাইসহ আরও কত কি? হাটের দিন সে এইসব নিয়ে বিক্রি করে সূত্রাপুর বাজারে। এছাড়া বৈশাখে যখন মহাদেবপুরসহ অন্য গ্রামে মেলা বসে তখন সে মাটির তৈরি খেলনা,মাছ,পুতুল,পালকি,খেলনা হাঁড়িপাতিল ও অন্যান্য জিনিস নিয়ে যায় সেখানে।ওই মৌসুমে তার বিকিকিনি ভাল।

কিরনবালা। নারানের বউ। সামনে বৈশাখে ওদের বিয়ে তিন বছরে পড়বে। বিয়ের সময় কিরনের বয়স বড়জোর হবে বার বা তের। আসলে বয়সের হিসাবটা কিরনেরও ঠিক জানা নেই। বয়স কম হলেও ঠিকই ঘরের দিকটা গুছিয়ে নিয়েছিল ও। সবসময় ঘরবাড়ি ছিপছাপ রাখে। সময়ে নারানের হাতের কাজে ও সাহায্যও করে।

কিরন যখন এ বাড়িতে আসে ওর সমবয়সী ছিল কেবল শ্যামল। শ্যামল নারানের খুড়তুতো ভাই।নারানের ঘরের দু’ঘর বাদেই ওর ঘর। নারানের থেকে মোটে না হলেও ৬-৭ বছরের ছোট ও। কুমোরপাড়ার ছেলে হলেও পেশাটা ওর ভিন্ন।মুদি দোকানদার। সূত্রাপুর বাজারে ওর বড় দোকান। সংসারে শুধু বুড়ো বাপ। বড় বোনটার বিয়ে হয়েছে অনেক আগেই। দোকানে বেচাকেনা ওর ভালই। গতবছর পাকা ইটের গাঁথুনি দিয়ে ঘর উঠিয়েছে। টিনের ছাউনি।

নারানদের বাড়িতে ওর আসাযাওয়া ছিল বেশ। কিরন একজন কে পায়  যার সাথে বসে দুটো কথা বলা জায়। নারান সারাদিন কাজ নিয়ে থাকে। তাছাড়া যখন মেলা যায় সেই সময় কিরন কে তিন-চার দিন এমন কি এক সপ্তাহ ও একা থাকতে হয়। বাড়ির চৌহদ্দি থেকে বের হওয়ার সাধ থাকলেও যেতে পারেনা। তার ও সাধ হয় মেলায় ঘুরতে,লালফিতে-চুড়ি কিনতে। মন চায় আলতায় পা দুটো রাঙাতে।

কালী পূজায় কুমোরপাড়া একেবারে নতুনভাবে সাজে। পাড়ার ছেলেমেয়েরা কলা গাছ দিয়ে গেট সাজায় ও মন্দিরের চারিপাশটা সাজিয়ে ফেলে বাহারি নকশায় কাটা রঙিন কাগজে।মাইক ভাড়া করে সারাদিন হিন্দি ছবির গান বাজায়। পূজামণ্ডপের সামনের খালি জায়গাটায় ফেরিওয়ালাদের ছোট ছোট দোকানও বসে। পাড়ার ছেলেমেয়েদের রঙ মাখামাখির মধ্য দিয়ে শেষ হয় পূজা। এইতো সেবার পূজায় শ্যামল দাঁড়িয়েছিল মণ্ডপের পিছনে। কিরন দুটো হাত পিছনে বেঁধে শ্যামলের কাছে এসে চোখের পলকে দু’হাতের গুড়া রঙ মুখে মাখিয়েদিয়ে এক দৌড়ে যেয়ে ঘরের কপাট বন্ধ করে দেয়। শ্যামল ওর পিছু নেয়। নারানের বাড়ি যেয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বলে, “ বৌদি,সাহস থাকলে একবার দরজা খুইলা দেহ?” শ্যামলের কথা শুনে মনের কপাট খুললেও কোন এক অদৃশ্য ভয়ে ঘরের কপাট খুলতে পারেনা কিরন।

কুমোরপাড়ার যেকোনো অনুষ্ঠানে পাড়ার সবাই মিলেমিশে কাজ করে। সবসময় বাড়ির মহিলারা রান্না বাড়ার কাজটা সারে আর পুরুষেরা করে মেহমানদারি। গেল মাসে বিয়ে হল হরিপদর মেয়ে রাধার। বিয়ের দিন কেউ হলুদ বাটে ,কেউ বাটে মেহেদী আবার কেউ কলসভরে জল এনে রাখে রাধার গোসলের জন্য। নেচেগেয়ে সবাই অনুষ্ঠানটা নিজেদের করে নেয়। কিরন পান,দূর্বা ঘাস, ধান, দুধ, হলুদ বাটা আর মেহেদী বাটা সাজিয়ে কুলা নিয়ে রাখে পানি ভরা কলস গুলোর পাশে। হরিপদর রান্না ঘরের দাওয়ায় বসেছিল শ্যামল। হঠাৎ এক কলস পানি তুলে ঢেলে দেয় কিরনের গায়ে। কিরন সহ সব মেয়েরা তাড়া করে শ্যামলরে। সে এক দৌড়ে যেয়ে ঝাপ দেয় হরিপদর পুকুরে। মেয়েরা দু’একটা ঢিল ছুড়ে এসে রাধার গোসলে হাতদেয়।

বৈশাখ আসে।নারানের ব্যস্ততা বাড়ে। এরই মাঝে কয়েকটা মেলায় গেছে সে। কাল যাবে মহাদেবপুর।পাশের গ্রামে মেলা থাকলেও ও যাবে মহাদেবপুর। ওখানে রথের মেলা;বিকিকিনি ভাল। খুব ভোরে মালামাল সাজিয়ে চলে যায় নারান।

দিন গড়িয়ে রাত আসে। শ্যামল এসে বসে নারানের দাওয়ায়।

-আমায় ম্যালায় নিবা? কিরন বলে শ্যামল কে।

-কি কও বৌদি? এই রাতে?

-তুমি নিবা কিনা কও?

দুজনে চুপিচুপি চলে যায় পাশের গ্রামের মেলায়। কিরন চুড়ি, ফিতা আর টিপ কিনে।তারপর ফিরে বাড়ি।

বাড়ি ফেরার পথে শ্যামল বলে, “একডা কথা আছিল?”

-কিডা ? কও ?

-বাবা,জেলেপাড়ার কাত্তিকের মাইয়া সুরলার লগে বিয়ার কথা কইতাছে। তুমি কি কও?

কিরন কোন কথা বলেনা। শ্যামল উত্তর না পেয়ে আবার বলে, “ কিছু কও না ক্যান?”

এবারও কোন জবাব না পেয়ে পা মিলেয়ে হাঁটতে থাকে সে।

আকাশে দুচারটা তারা দেখা যায়। চাঁদ উঠেছে কিছুক্ষণ আগে। চাঁদটার উপর দিয়ে মাঝে মাঝে খণ্ড খণ্ড মেঘ ভেসে যায়। চাঁদটা একবার মেঘের আড়ালে লুকায় আবার উঁকি দেয়, যেন লুকোচুরি খেলছে।

নারান মাহাদেবপুর থেকে ফিরবে কাল। আরও একরাত বাকি। বাড়ি ফেরার জন্য ওর মনটা কাঁদে। এবার বিকিকিনি বেশ ভাল। এর মাঝে কিছু সওদাও করেছে। কিরনের জন্য একটা মোটা পাড়ের লাল শাড়ি, চুড়ি, ফিতে এর স্নো-পাউডার কিনে। ঘরের জন্য একটা মোড়া আর শীতল পাটি কিনে আর ভাবে অ্যাইগুলান পাইলে কিরন খুব খুশি হইব।

রাতে ঘরের ছোটখাটো কাজ করছিল কিরন। এমন সময় বৌদি বলে ডাকে শ্যামল।

-কাল তোমার দাদা আইব। ঘরডা গোছায় ফেলি।

-তুমি আইবা না যামু।

-আইতাছি। বলে কাজ করতে থাকে কিরন।

শ্যামল এবার দাওয়া থেকে উঠে ঘরে ঢুকে। কিরনের দুই হাত ধরে এক নিঃশ্বাসে বলে, “ চল আজ রাতে পালাইয়া যাই। কেও জানবো না। দাদা কাল আইয়া পড়বো ।আমি সব ঠিক কইরা রাখছি।”

কিরন চুপ করে থাকে। কোন কথা বলেনা। শ্যামল কিরনের হাত ধরে গড় গড় করে হাঁটতে থাকে। ওরা সোজা চলে যায় নদীর ঘাটে। কাদের মাঝি আছে নৌকা নিয়ে। কাদের মাঝি শ্যামলের কাছের লোক । সবসময় দোকানের মালামাল নিয়ে এসে ওর নৌকায়। মাঝি ওদের কে নিয়ে যাবে মোতালেবপুর।ওখান থেকে সোজা শ্যামলের বোনের বাড়ি। বোন জামাই সব ব্যবস্থা করে দিবে।

ভাটির টানে নৌকা চলে। উজান আসতে এখনও ঘণ্টা খানেক বাকি। নৌকার দাঁড়ের শব্দ শোনা যায় ছপাত ছপাত। কাদের মাঝি সর্বশক্তি দিয়ে দাঁড় টানে কিন্তু নৌকা যেন চলতে চায় না।

কিরনবালার চোখে ভেসে উঠে নারানের মুখখানি। নারান কারিগরের চাকার মত ঘুরতে থাকে যেন পৃথিবীটা। বারবার এর থেকে বের হতে চায় কিন্তু পারেনা। চাকার ঘূর্ণনের মত বার বার ফিরে আসে নারানের মুখটা। কিরনের দু’চোখ গড়িয়ে পড়ে লোনাজল।।

 

 

 

 

 

১,০৬৪ বার দেখা হয়েছে

৪ টি মন্তব্য : “চাকা”

  1. তাওসীফ হামীম (০২-০৬)

    একটু সমালোচনা না করে পারছি না। আমি খুব বেশি রকমের পদ্মা নদীর মাঝির ছাপ পেলাম,সোজা করে বললে মানিকের। গল্পের প্রথম অংশটা খুবই সুন্দর হয়েছিল,বুনন আরও অনেক বেশি শক্ত হতে পারতো।
    লেখার একটা প্রধান গুন হোল দ্বন্দ্ব। চরিত্রের চারিত্রিক দ্বন্দ্ব না তুলে ধরতে পারলে লেখা নুন ছাড়া সুপের মতো লাগে।
    লিখতে থাকুন। ভালো লেখার আশায় থাকলাম।


    চাঁদ ও আকাশের মতো আমরাও মিশে গিয়েছিলাম সবুজ গহীন অরণ্যে।

    জবাব দিন
  2. তানভীর (২০০১-২০০৭)

    ধন্যবাদ হামীম। তোমার মূল্যবান কথাগুলো মনে থাকবে। এবং সমালোচনা না করলে ভুলগুলো জানবো কোথা থেকে। আমিতো আর রবীন্দ্র - নজরুল নই ভাই। যা হোক তোমার এমন মূল্যবান দিকনির্দেশনার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ।


    তানভীর আহমেদ

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : তানভীর (২০০১-২০০৭)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।