সোনালি ডানায়

ক্যাডেট কলেজে থাকতে বয়স আর কতইবা ছিল! ক্লাস টেন-ইলেভেন এ থাকতে পরিচয় শুরু হয়- সুনীল, সমরেশ, সঞ্জীব, বুদ্ধদেব, হুমায়ুন, মানিক বন্দোপাধ্যায়- বাংলা সাহিত্যের এসব প্রথিতযশা সাহিত্যিকদের লেখার সাথে। বয়স কম ছিল বলেই বোধ হয় সে সময় হুমায়ুনের হিমু বেশ নাড়া দিয়ে যেত। হুমায়ুনের একটা বই বেরিয়েছিল ‘চাঁদের আলোয় কয়েকজন যুবক’- আমরা ক’জন নিজেদের অমন জ্যোৎস্না ভরা চাঁদের আলোয় কল্পনা করে শিহরিত হতাম। আমাদের ক্যাডেট কলেজকালীন সময় তো কেবল্‌ টিভি ছিলনা, সিডি-ডিভিডি ছিলনা। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় কমনরুমে টিভিতে সাপ্তাহিক নাটক, স্টেরিও-প্লেয়ারে গান আর টিচারদের চোখ ফাঁকি দিয়ে নিয়ে যাওয়া ওয়াকম্যানই ছিল ভরসা। ছুটিতে বাড়ী ফিরলেই ছুটে যেতাম এলিফ্যান্ট রোডে রেইনবো তে, গিতালীতে এল.পি. থেকে ক্যাসেটে পছন্দের ইংলিশ/বাংলা/হিন্দি গান রেকর্ড করাবার জন্যে। এখনকার মত বাড়িতে বসে মাউসের ক্লিক্‌ এ সিডি/ডিভিডি বার্ন করার সৌভাগ্য তখনও আমাদের হয়নি। নতুন প্রজন্মের ক্যাডেটদের বা এক্স-ক্যাডেটদের পছন্দ আমার জানা নেই; কিন্তু আমাদের সে সময়কার মানে নব্বই এর দশকের বাংলা ব্যান্ড আর ইংলিশ পপ, আর এন্ড বি, কান্ট্রি বা লাভ song গুলা হল কালোত্তীর্ন। হতে পারে আমি ঐ প্রজন্মের বলেই আমার প্রজন্মের সাফাই গেয়ে মুখে ফেনা তুলে ফেলছি। কেউ কিছু মনে করনা যেন 🙂 বাংলা ব্যান্ড এর মধ্যে ছিল রেঁনেসা, অব্‌সকিউর, ফিড্‌ব্যাক, নোভা, চাইম, আর্ক, সোল্‌স, মাইল্‌স ইত্যাদি। তপন চৌধুরী, কুমার বিশ্বজিৎ তো ছিলই। ইংলিশ গানে আমার পছন্দ ছিল সবার প্রথমে Chris de burgh। ইদানিং ক্রিস্‌ ডি বার্গ এর কোনও এলবাম বেরিয়েছে বলে আমার জানা নেই। ক্রিস্‌ ডি বার্গের Lady in Red, Carry me..like a fire in your heart…এই গানগুলা আমাদের মুখে মুখে ফিরতো। এই প্রসঙ্গে একটা ঘটনা মনে পড়ে গেল। ক্লাস টুয়েলভে তখন আমরা, আর ক’দিন বাদেই কলেজ ছেড়ে চলে আসবো। তখন বিছানার সাদা ‘বেড শীটে’ ফেভারিট গান গুলার লিরিক্‌স পারমানেন্ট মার্কার দিয়ে লিখে রাখা এবং সেই বেড শীটই ইউজ করা একটা ফ্যাশান হয়ে গেল আমাদের। যার বেড কভার তুললেই গানের লিরিক্‌স লেখা পাওয়া যাবে সেই ততো শিল্প মনস্ক, এমন একটা ভাব আরকি। বাকিরা ব্যাক-ডেটেড। আরও শুনতাম ফিল কলিন্স্‌, পল ইয়াং, জন ডেন্‌ভার, মাইকেল জ্যাক্‌সন, ম্যাডোনা, সামান্থা ফক্স, রিচার্ড মার্কস ইত্যাদি। ব্যান্ড এর মধ্যে ছিল- এয়ার সাপ্লাই, হোয়াম, ইউরোপ, স্করপিয়ন্‌স, পেট শপ বয়জ, U-2, UB-40, মর্ডান টকিংস, A-ha এইসব। Baltimore এর টারজান বয়ও বেশ জমতো। এই রকম টুক্‌টাক আরও অনেক গান ছিল, এখন আর সব মনে নাই। সবে মাত্র ক্লাস ইলেভেন উঠেছি, হঠাৎ করে আযম খান আমাদের মধ্যে খুব হিট হয়ে গেল। করিডোরে গসিপ্‌ করার সময়, রুমে বা ক্লাস রুমে টিচার না থাকলে, ডাইনিং হল থেকে ফেরার পথে হেরে গলায় অনেকে মিলে আযম খানের কোনও একটা গান গেয়ে উঠতাম। দেখতে দেখতে ক্লাস ইলেভেন এ এক্সকারসান্‌ চলে আসলো। মাথায় নতুন পোকা ঢুকলো- এক্সকারসান্ সামনে রেখে এমন কিছু একটা করতে হবে যা আগে কোনও ব্যাচ করেনি। ঠিক হলো সাদা টি-শার্ট কেনা হবে যাতে থাকবে আমাদের পছন্দের লোগো আর ব্যাচের নাম। সবাই কন্ট্রিবিউট করে টি-শার্টের ব্যবস্থা করা হলো। আমাদের ক্লাস এর আঁকিয়েরা বসে গেল রঙ আর তুলি নিয়ে। আখলাক, মোবারক, আতিক আর খায়রুল এর তুলির আঁচরে জীবন্ত হয়ে উঠলো ছেচল্লিশটা টি-শার্ট। আমাদের আর পায় কে, গ্রুপ ফটো-সেশান শুরু হয়ে গেল। এক্সকারসানের কাহিনী অন্য কোনও সময় বলার জন্যে তুলে রাখছি। সেই টি-শার্টটা কলেজ থেকে চলে আসার পরও আমি সযত্নে রেখে দিয়েছিলাম বহুদিন। কিন্তু সময়ের ধুলো পড়ে মলিন হয়ে যাচ্ছিল দিন দিন। তবুও স্মৃতিটাকে আঁকড়ে ধরে রেখেছিলাম। একদিন ভার্সিটি থেকে বাড়ি ফিরে দেখি আমার মা পুরোনো ব্যবহারের অযোগ্য ভেবে ঐ টি-শার্টটাকে তাঁর টেবিল মোছার ন্যাকরা বানিয়ে ফেলেছেন। এভাবে আমার ক
্যাডেট লাইফের অমুল্য একটা এন্‌টিকস আমি বিসর্জন দিলাম। দেখতে দেখতে ক্লাস টুয়েলভে উঠে গেলাম। সবাই একটু নড়েচড়ে বসলো। এবার পড়াশুনা নিয়ে সিরিয়াস হবার সময়। ক’দিন বাদেই উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা। পড়াশুনা চলে তার পাশাপাশি চলে আড্ডা। আড্ডার বিষয়বস্তু ফেলে আসা দিন, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা। আমরা যারা একসাথে বেশী উঠা-বসা করতাম ঠিক করলাম কলেজ ছেড়ে গেলেও আমরা কখনই হারিয়ে যাবনা। চাঁদের আলোয় সবসময় একসাথেই হাঁটবো। যেই ভাবা সেই প্ল্যান। ঠিক হলো আমরা যারা টুকটাক কাল্‌চারাল একটিভিটিজ এর সাথে সংশ্লিষ্ট কলেজ থেকে বেরিয়ে আমরা একটা ব্যান্ড ফরম করবো। ঐ বয়সে যেইরকম প্যাশান থাকে আর কি! ব্যান্ডের লাইনআপও ঠিক করা হয়ে গেল। ভোকাল-হাসান, খায়রুল, লীড্‌ গীটার- হাসান, বেজ্‌ গীটার- আখলাক, ড্রামস্‌-জিয়া আর কী-বোর্ডে- এই অধম। লাইন-আপের কিছু হেরফের হতে পারে, এতদিনে সবকিছু মনে নাই। ব্যান্ডের নাম কি হবে? খুব বেগ পেতে হলোনা, কে যেন প্রস্তাব করলো নাম হবে Ba-ha, সে সময়কার ব্যান্ড A-ha ‘র সাথে সাদৃশ্য রেখে। আমরা তাতেই খুশি, ব্যান্ড হবে এইটাই বড় কথা, চোথা মারা নাম তাতে কি বা আসে যায়। আসল লক্ষ্য হচ্ছে আমরা সারাজীবন হাতে হাত ধরে হাঁটবো, চাঁদের আলোয় হাঁটবো, বৃষ্টিতে ভিজবো। ক্যাডেট জীবনকে বিসর্জন দিয়ে ঢাকায় এলাম। প্রথম ৩/৪ মাস মোটামুটি যোগাযোগ ভালোই রইলো একজনার সাথে আরেকজনের। অনেকেই ভর্তি হ্লাম কোচিং সেন্টারে, কেউবা ISSB র জন্যে প্রিপারেশান নিতে শুরু করলো। কেউবা TOEFL দেয়া নিয়ে ব্যাস্ত-দেশের বাইরে চলে যাবে বলে। কয়েকমাস পরের ঘটনা- আমি ভর্তি হ্লাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। আখলাক, জিয়া, খায়রুল ISSB তে কোয়ালিফাই করে BMA তে চলে গেল, হাসান গেল BUET এ, আতিক ভর্তি হলো চারুকলায়। একটা ছোট্ট বাচ্চার হাতের মুঠো থেকে অনেকগুলো মার্বেল খসে পড়লে যেভাবে ছিট্‌কে চারদিকে ছড়িয়ে যায়, সময়-বাস্তবতা আমাদেরও ছড়িয়ে দিলো একেক দিকে। কোথায় যেন কিছুদিন আগে পড়েছিলাম- যেই মান্না দে তাঁর ‘কফি হাউজ’ গানটার জন্যে খ্যাত, উনি নাকি কখনও বাস্তবের কফি হাউজে যাননি। আমরা তো আমাদের কফি হাউজ নিজের হাতেই সাজিয়েছিলাম; কিন্ত আমাদের আড্ডাটা আমাদের অজান্তেই একদিন ভেঙ্গে গেল। যাই হউক নিজ নিজ প্রফেশনে একটু স্থির হবার পরে আবার আমাদের কয়েকজনের মধ্যে যোগাযোগ হ্ল। তথ্য প্রযুক্তির কল্যানে আমরা এখন ঘরে বসেই একে অপরের সাথে যোগাযোগ করি। আখলাক আর আমি দুইজন ঢাকায় থাকার সুবাদে নিয়মিতই আমাদের যোগাযোগ হয়, অনলাইনে/অফলাইনে। ঢাকায় আরও আছে ইসলাম, মোবারক, রিয়াজুল, রাসেল, আলম, হেমায়েত, রাশেদ, জাহিদ, সোয়েব, শফি কামাল, মাসুদ, মোর্শেদ, শাহীন, আজাদ, মইনুল- এদের সাথে কালে-ভদ্রে দেখা হয় বা সেলুলারে কথা হয়, কিংবা গ্রুপ মেইলে একে অন্যের খবর পাই। জিয়ার পোস্টিং এখন রাজেন্দ্রপুর ক্যান্টনমেন্ট এ, ওর সাথেও প্রায়ই কথা হয়, এক রাতে আমরা রাজেন্দ্রপুর যেয়ে ঘুরেও এসেছি। এই তো কয়েকদিন আগে জিয়া এসে আমার অফিসেও ঘুরে গেল। আতিক এখন অস্ট্রেলিয়ায়, হারিয়ে গেছে, যোগাযোগ নেই কারো সাথে। BUET শেষ করে হাসানও চলে গেল অস্ট্রেলিয়া, ও এখন ওখানে PR (Permanent Residentship) পেয়ে স্বস্ত্রীক বসবাস করছে। অনলাইনে হাসান এর সাথে ভাব বিনিময় হয়। খুব প্রয়োজনে সেলুলারেও কথা হয়। হাসান মাঝে মাঝেই বলে, ‘তোদের খুব মিস্‌ করি’। আমাকে প্রায়ই IELTS দিয়ে PR এর জন্যে এপ্লাই করতে বলে। বলে ‘তুই চইলা আয়, আবারও আড্ডা বসামু’। আমি হাসি, বলি দেখি। এই বয়সে প্রবাসে স্ত্রী-কন্যা নিয়ে আবার নতুন করে শুন্য থেকে শুরু করতে একটা শংকা কাজ করে, তাই সাহস করিনা। একা হলে হয়তো এতো ভাবতামনা, দিতাম ছুট। তো সেদিন হাসানের সাথে অনলাইনে কথা হচ্ছিল। আমি বললাম, ‘হাসান তোর মনে আছে আমাদের একটা ব্যান্ড করার স্বপ্ন ছিল?’ বলে আমি হাসলাম। হাসান ওপাশ থেকে কিন্তু সিরিয়াস। বলে ‘ আমি তো এখনও সেই স্বপ্ন দেখি। Someday, somewhere in a moonlit night we walk together hand in hand again’. আমি অবাক হই মন
ের গহিনে ওর সযত্নে পুষে রাখা স্বপ্নের কথা শুনে। আমি আর্দ্র হই। মনে মনে আমি ফিরে যাই ১৬ বছর পেছনে, হয়ে যাই ১৮ বছরের এক যুবক যার দু’চোখে স্বপ্ন, ‘আমরা কয়েকজন হাতে হাত রেখে হাঁটছি ভরা চাঁদের আলোয়।’

১,৫২০ বার দেখা হয়েছে

১৪ টি মন্তব্য : “সোনালি ডানায়”

  1. ভাইয়া, অসাধারণ লেগেছে। পড়তে পড়তে বেশ কয়েকবার গায়ের লোমগুলা দাঁড়ানোর অনুভূতি পেলাম। এই লেখাটাই আমি কিছু পরিবর্তন করে নিজের বলে চালিয়ে দিতে পারব। সব কিছু বড় বেশি একইরকম।

    জবাব দিন
  2. "হাতের মুঠো থেকে অনেকগুলো মার্বেল খসে পড়লে যেভাবে ছিট্‌কে চারদিকে ছড়িয়ে যায়, সময়-বাস্তবতা আমাদেরও ছড়িয়ে দিলো একেক দিকে"---
    অসাধারণ বর্ননা। খুব ভাল লাগলো। শফি ভাই,
    "আপনিই boooosssssss"

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : Mahmudul Alam

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।