আমি তোমার সঙ্গে বেঁধেছি আমার প্রাণ

১.

বাংলাদেশে মহিলা গুন্ডি দের তালিকা করা হইলে শামা কে অনায়াসে চোখ বন্ধ করে এক নম্বরে রাখা যাবে। তার যন্ত্রণায় নুহা (শামার বেস্টফ্রেন্ড) একশ একবার মনে মনে আর দুয়েকবার ভয়ে ভয়ে শামার সামনে আক্ষেপ করে , কোন দুঃখে শামা নামক অতিমানবীর ফ্রেন্ড যে হইছিল । ফ্রেন্ড হইছিল তাও মানা যায়,এক্কেবারে বেস্ট ফ্রেন্ড,আবার মরার উপর খাঁড়ার ঘা রুমমেট ও !! নাহ, বড্ড ঝামেলা করে মেয়েটা। বললেই ক্লাসের পিছন দরজা দিয়ে পালাতে হবে, ক্লাসনোট কপি করিয়ে রাখতে হবে, নিউমার্কেট গিয়ে কেনাকাটা বাদ দিয়ে ঝাল করে ফুচকা খেতে হবে, এরকম আরও ম্যালা আবদার হাসিমুখে মেনে নিতে হবে। একবার নিউমার্কেটের ভিড়ের মধ্যে ছুঁচো টাইপের একটা লোক শামার কোমরে চিমটি কাটার পর শামা থাবা মেরে হাত টেনে ধরে খামচি দিয়ে হারামজাদার হাতের চামড়া তুলে নেয় ।এরকম গাদাখানেক কাহিনী আছে শামার গুন্ডামির।নুহা কোন কিছু করতে আমতা আমতা করলেই শামা অমনি তার গুন্ডি বেটি আচরণ শুরু করবে। বইখাতা গুম করবে, ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করবে ,অবশেষে নুহা রাজি হলে বত্রিশ দাঁত বের করে বলবে, এইজন্যই তোকে এত ভালবাসি !!

এই গুন্ডি বেটি শামা নাকি প্রেমে পড়েছে! নুহা প্রথমে শুনে ভাবে ,কোন ছাগল যে এই কথা রটাইছে শামা জানলে তার কয়েকটা হাড্ডি ভেঙ্গে হাড্ডি সংখ্যা দুয়েকটা বাড়ায়ে দেবে নির্ঘাত।আর কোনমতে ভুলেও যদি এই কাহিনী সত্যি হয়, তাইলে যে বেচারার গলায় শামা ঝুলার জন্য তোড়জোড় লাগাইছে তার কপালে শনি তো বটেই,রবি সোম সব আছে ! শামা ওই বেচারা কে বুঝায়ে ছাড়বে কত ধানে কত চাল। তবে এই কাহিনী মোটামুটি অসম্ভব দেখে নুহা শামার প্রেমে পড়ার সম্ভাবনা উড়ায়ে দিল। কিন্তু আরও কয়েক ফ্রেন্ডের কাছ থেকে শুনে নুহা বিশ্বাস করবে নাকি বিশ্বাস করবেনা এটা নিয়ে ধন্দে পড়ে যায়।

অবশেষে একটা ঝাড়ি খাওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে নুহা শামাকে কথাটা একটু ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করল , ” শামা, কোন হাঁদারাম নাকি তোর প্রেমে পড়ছে ! ” শামা তখন ল্যাব রিপোর্ট লিখতে লিখতে নুহাকে ধমক দিয়ে বলে, দুনিয়ায় সবার মাথায় বুদ্ধিশুদ্ধি কিছুটা হইলেও আছে,তোর মাথা তো দেখি পুরাই বায়োগ্যাস চেম্বার। ঠিকমত হট নিউজ ও যোগাড় করতে পারিস না । আরে, কোনো হাঁদারাম আমার প্রেমে হাবুডুবু খাইতেছে কিনা জানিনা,আমি পুরাই ডুবন্ত। ও হ্যাঁ ,ভাল কথা ফয়সাল কে হাঁদারাম বলবি না, এই নামের উপর আমার কপিরাইট !!!

নুহা বাস্তবিক ই হা করে তাকায়ে ছিল শামার দিকে ফয়সালের কথা শুনে।পাক্কা দু মিনিট কোন কথা বলতে পারেনি।ফয়সাল ওদের ক্লাসে নিতান্ত অমায়িক ভদ্র পোলা । অবশ্য পোলাটা দেখতে চশমা পরা গোবেচারা শান্তশিষ্ট লেজের আগায় অবশিষ্ট টাইপ হইলেও জিনিয়াস আছে , খুব একটা আতেল ভাব দেখায় না । অবশেষে তাব্দা খাওয়া চেহারা নিয়ে শামা কে জিজ্ঞেস করল,তা কেমনে কি হইল ? আমি তোর রুমমেট আর আমি কিছুই জানিনা ! শামা বলল, গাধী ,আগে আমার কথা শুনবি তো ! তারপর যা বর্ণনা করল , তার সারমর্ম হল , কেমিস্ট্রি ল্যাবে সব মাইয়াগুলা জোড়ায় জোড়ায় আগেই গ্রুপমেট ঠিক করে ফেলায় বাকি ছিল খালি শামা আর ফয়সাল । অগত্যা ওরেই গ্রুপপার্টনার করতে হয় । এক্সপেরিমেন্ট করতে গিয়ে শামা যতই তাড়াহুড়া করত এক্সপেরিমেন্ট শেষ করে ল্যাব থেকে বের হবার জন্য , ইচ্ছা করেই ফয়সাল ধীরে সুস্থে পেন্টিয়াম ওয়ান প্রসেসরের মত কাজ করত । এই নিয়ে শামা চরম খেপা ছিল ফয়সালের উপর,সবসময় তক্কে থাকত কিভাবে ওরে স্যারের কাছে ঝাড়ি খাওয়ানো যায় , কিন্তু ওই ব্যাটা ফয়সাল দেখতে গোবেচারা হলেও অনেক চালাক। কিছুতেই শামা সুযোগ পাচ্ছিল না। বরং প্র্যাক্টিকাল এক্সামের দিন শামা কোনভাবেই রেজাল্ট বের করতে পারতেছিল না,ফয়সাল ওরে বাঁচায়ে দিছে । সেই থেকে শামা ফয়সালের কাজকর্মে আর ডিস্টার্ব দিত না। পরের টার্মে আবার ল্যাব গ্রুপিং করার সময় ফয়সাল যেচেই শামাকে বলছিল,তার গ্রুপমেট হবে কিনা। শামা চোখ কপালে তুলে জিগাইছিল,ক্লাসে এতগুলা ভাল স্টুডেন্ট, আর না হয় ভদ্র টাইপ মাইয়া থাকতে ফয়সাল কেন ওরই আবার গ্রুপমেট হইতে চায়। ফয়সাল একটা হাসি দিয়ে বলছিল ,”আমার ইচ্ছা” । অন্যসময় এরকম ভাব দেখে শামার হয়ত গা জ্বলে যেত,কিন্তু ওইদিন শামা ভেবে দেখল,ওরে গ্রুপমেট করলে মেলা লাভ । নিজের মাথা ঘামানো লাগবেনা ,এককথায় ফাঁকিবাজি করতে পারবে। এরপর আস্তে আস্তে লাইব্রেরীতে একসাথে পড়াশুনা, আর শামার হিটলারগিরি সহ্য করার কারণে ফয়সাল কে নির্দ্বিধায় শামা কাছের ফ্রেন্ডলিস্টে জায়গা দিয়ে দিল।

একবার হুট করে শামা খেয়াল করে ফয়সাল ক্লাসে আসছে না। এমনকি মোবাইল ও বন্ধ। সারাদিন ফয়সালের সাথে গুন্ডামি না করতে পেরে দিন শেষে শামা চরমভাবে মিস করতে থাকল ফয়সাল কে। এইভাবে দুইদিন,তিনদিন…শেষমেশ পাক্কা এক সপ্তাহ পর ফয়সাল ক্যাম্পাসে আসল। ওকে দেখে শামার ব্রহ্মতালু পর্যন্ত জ্বলে গেল। নবাবপুত্তুর কোন রাজকাজে ব্যস্ত ছিল যে একবার শামাকে জানাতেও পারেনি এই কয়দিন কোথায় ছিল । শামা সরাসরি ফয়সালের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, ওই পয়ছাল,নিজেকে খুব ইয়ে ভাবিস না? একবার আমাকে একটা মেসেজ না দিয়ে এইভাবে ডুব মারলি? অনেকক্ষণ ধরে ঝাল ঝেড়ে শামা ফয়সালের দিকে অবাক হয়ে তাকায়ে দেখে ফয়সাল মিটমিট করে শয়তানের মত হাসছে। শামা আরও রেগে বলে যা দূরে গিয়া মর,তোর লজ্জা শরম নাই ,আবার হাসিস? ফয়সাল দুম করে বলে ,নাই ই তো দস্যুরানী ফুলন দেবী। এই উপমা শুনে শামার মনে হইল,দেই ছাগলটাকে একটা ঘুষি ।কিছু না বলে গরগর করতে থাকল। পরে মেজাজ ঠান্ডা হইলে শামাকে ফয়সাল বলল, এই কয়দিন ভাইরাল ফিভার ছিল, সবসময় টেম্পারেচার ১০৩-১০৪। তাই ক্লাসে আসতে পারেনি। অসুস্থতার কথা শুনে শামা এবারের মত আর বেশি কিছু বলল না।

রাতে হলে ফিরে হঠাৎ চিন্তা করতে বসল, এই কয়দিন ফয়সাল ক্লাসে আসেনি বলে তার এত খারাপ লাগার কারণ কি? কত ফ্রেন্ড ই তো মাঝে মাঝে ক্লাস ফাঁকি মারে,তাদের কে তো শামা আধা ঘন্টা পরপর কল করেনা। হলের গেস্ট হাউসে একসাথে ঢলাঢলি করা যেসব কপোত কপোতীর পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় “ঢং” শব্দ টা ছাড়া অন্য কিছু মাথায় আসত না,তাদের মত শামা ও কি তাইলে শেষমেশ প্রেমে পড়ল !! আ মর জ্বালা ! শামাও কি তাইলে রাত বারটা বাজলেই করিডোরে আল্ট্রাসনিক সাউন্ডে মোবাইলে কথা বলতে বলতে পায়চারি করবে আর দুদিন পরপর ফ্যাচফ্যাচ করে কান্নাকাটি করবে !! সে দিব্য চক্ষে দেখতে পেল, ফয়সালের কথা শুনামাত্রই তার মা সিনেমাটিক স্টাইলে বলতেছে ,” হতভাগী, এই জন্যই কি তোরে আমি পেটে ধরেছিলাম, দূর হয়ে যা চোখের সামনে থেকে !” প্রেম পরবর্তী সমস্ত জটিলতা হুড়মুড় করে শামার মস্তিষ্কে হাতুড়ি ঠুকতে লাগল। এই ভয়েই পরদিন শামা আর ফয়সালের ত্রিসীমানায় ঘেঁষল না। লাইব্রেরীতে যাওয়ার জন্য ফয়সাল ডাকতে এলে বলল,তুই যা। এইভাবে তিনদিন যাওয়ার পর শামা নিশ্চিত হইল,আসলেই সে রবীন্দ্রনাথের নায়িকার মত জেনেশুনে বিষপান করে “মরিয়াছে”।

তিনদিন পর ফয়সাল ক্লাস শেষ হলে শামাকে অনেকটা জোর করেই ক্যাফে তে নিয়ে গেল। চশমা কপালে তুলে সিরিয়াস ভাবে জিজ্ঞেস করল,এই ডাকুরানী, তোর কি হইছে রে? আমাকে এভয়েড করছিস ক্যান? তোরে কে কি বলেছে? শামা সত্যি বলবে নাকি ভাব দেখাবে বুঝতে না পেরে ভ্যাবলার মত তাকায়ে থাকল। কিছুক্ষন পর পুরাই স্বরূপে ফিরে গিয়ে বলল, দ্যাখ পয়ছাল, এদ্দিন বলিনাই কিন্তু আজকে বলতেছি । তুই এই হ্যারি পটার চশমার ফ্রেম দুইদিনের মধ্যে চেঞ্জ করবি।আর খবরদার যদি চুলে বাটি ছাঁট দিছিস কখনও আর,তাইলে তোর খবর ই আছে ! আর ,ভুলেও মোবাইল অফ রাখবিনা। আরেকটা শর্ত আছে , তোকে আমি ছাড়া আর কেউ পয়ছাল বাবু আর হাঁদারাম বলে ডাকতে পারবে না” । আর আমার সাথে জীবনেও ন্যাকা ন্যাকা পেরেম বাণী কচলাবি না আর জানু, ডার্লিং এইসব বলে ডাকার বিন্দুমাত্র চেষ্টা করবি না। ভাল কথা, আমার আরো একটা শর্ত আছে ,এইটা তোকে এখন বলব না,সময় হলেই জানতে পারবি । আর …আর……… ফয়সাল অনেক কষ্টে হাসি চাপিয়ে বলে,বাকিটুকু আমি বলি? শামা বলে,খবরদার,আমার কথার মধ্যে কথা বললে তোর বত্রিশ টা দাঁত …..ফয়সাল কথাটা শেষ করতে না দিয়ে বলে, কি আর করা , হবু বউ যখন একটা সাক্ষাৎ গুন্ডি বেটি,তখন কিছু যন্ত্রণা সহ্য তো করাই লাগবে…… এই কথা শুনার পর শামা বিরাশি সিক্কা ওজনের কিল ফয়সালের পিঠে লাগিয়ে উদ্বোধন করল দাম্পত্য গুণ্ডামির প্র্যাক্টিস ।

 

 

২.

মাঝে বছর দুয়েক কেটে গেছে। শামা আর ফয়সালের জীবনটাও বদলে গেছে । ওরা অবশ্য দুজন ই জানত যে,এমনটাই হওয়ার কথা ! তবুও মাঝে মাঝে কষ্ট হয়না তা না। কিন্তু একজনের মুখে দুশ্চিন্তার ছায়া দেখলে আরেকজন যে অধীর উৎকণ্ঠা নিয়ে তার কারণ খুঁজে তা দূর করার জন্য লেগে যায়,এতেই বোধ হয় সব কষ্টগুলো সহজে শামা আর ফয়সালের সংসারে ঢুকার পথ খুঁজে পায়না । কোন কোন সময় শামার তীব্র ইচ্ছে হয় তার প্রিয় বাড়িটার দেয়ালের পিছে লুকিয়ে থেকে দেখে বাবা মা কেমন আছে, ছোট্ট তিথি মনিটা স্কুলে যাওয়ার আগে একের পর এক অজুহাত দেখিয়ে ফাঁকি মারতে চায় কি না । ধুর…শামা এগুলো মনে করতে চায় না একদম। বছর খানেক আগে ফয়সালের কথা বাড়িতে জানার পর ওখানে ফেরার পথ পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায় শামার। পড়াশুনা শেষ না হতেই বাধ্য হয়ে ফয়সাল শামাকে বিয়ের সিদ্ধান্ত নেয়।

হাজার চারেকের সাবলেটের বাসা ভাড়া, হাজার তিনেকের বাজার খরচ, নিজেদের পড়াশুনা,যাতায়াত , সংসারের অন্যান্য টুকিটাকি খরচ সব মিলিয়ে এই ঢাকা শহরে টিউশনি করে সংসার চালানো মোটামুটি যুদ্ধ জয়ের সমান। একটু আধটু টাকা বাঁচাতে মাঝে মাঝে ডায়েট কন্ট্রোলের নাম করে রাতে আর রাঁধত না শামা, সকালের বেঁচে যাওয়া ভাত তরকারি দিয়ে ফয়সালের চলে যেত কোনরকম। বন্ধুদের বার্থডে পার্টি, ক্লাস পার্টি নামক বিলাসিতা গুলা সুকৌশলে এড়িয়ে যেত ওরা। তবুও হেসে খেলে , স্বপ্ন বুনে আর শামার মধুর গুণ্ডামি সহ্য করে ফয়সালের দিনগুলো সোনার রথে চেপে হয়ে উঠেছিল রঙ্গিন । জানত ওরা, পড়াশুনাটা শেষ করে দুজনের চাকরি হয়ে গেলে এই দিনগুলোই দিনলিপির পাতায় স্মৃতি হয়ে থাকবে।

আজ শামাদের প্রথম বিবাহ বার্ষিকী, ঠিক আজ না,আজ রাত বারটা বাজলেই শুরু হবে,তার মানে কাল।এই দিনটার জন্য শামা অনেকদিন অপেক্ষা করেছে। টিউশনির টাকায় সংসারের জন্য টুকিটাকি খরচ করে আর নিজের পড়াশুনা চালিয়ে অল্প কটা টাকা বাঁচিয়েছে শামা । একটা কেক কিনবে নাকি ফয়সালের জন্য কোন গিফট কিনবে এটা নিয়ে দোনামনা করতে করতে অবশেষে কেক ই কিনে।একবার মনে হয়, গাধাটার আদৌ এই দিনটার কথা মনে আছে তো ! কিন্তু কেক এনে লুকাবে কোথায় ! এটা নিয়ে বিরাট ঝামেলায় পড়ে সে, একে তো ছোট্ট একটা ঘর, তার মধ্যে বেশি আসবাব ও নাই ,অবশেষে রান্নাঘরেই লুকিয়ে রাখে আর বারবার গিয়ে দেখে আসে ঠিকঠাক আছে কিনা… ও ঠিক করেছে আজই ফয়সাল কে ওর শর্তটার কথা বলবে। কে জানে গাধাটা কি বলবে শর্তটা শুনে।

ফয়সালের টিউশনিতে আজ বেতন দেয়ার কথা…হাত প্রায় খালি। আজ বেতনটা না পেলে চরম মেজাজ খারাপ লাগবে। কাল ওদের এনিভারসারি, অনেকদিন ধরে কিছু টাকা জমাইছিল শামাকে একটা শাড়ি কিনে দেবে। ওই গুন্ডি বেটি শাড়ি পরতে পারে কি না এটা নিয়ে অবশ্য চিন্তায় ছিল ফয়সাল! জীবনেও শামাকে ও শাড়ি পরতে দেখেনি , এমনকি শামার মত সালোয়ার কামিজ পরে আর কেউ বিয়ের রেজিস্ট্রি করেছে কিনা আল্লাহ মালুম। টিউশনি করাতে করাতে বারবার উসখুস করতে থাকে ফয়সাল, কখন ওর স্টুডেন্টের বাবা আসবে। পড়ানো শেষ হলে অনেকক্ষণ গল্প করে যাতে টাইম পাস হয়, এমনকি যেই ফয়সাল গরু আঁকলে ছাগল নাকি বানর বুঝার উপায় নাই ,সে স্টুডেন্টের ড্রয়িং হোমওয়ার্ক করাতে লেগে গেল। তাও বিচ্ছু পোলার বাপ আসেনা। অবশেষে বিচ্ছু স্টুডেন্ট বলেই ফেলে,স্যার যাবেন না? ফয়সাল বলে ,তোমার আম্মুকে ডাক । পিচ্চির আম্মু আসলে ফয়সাল আমতা আমতা করে লজ্জার মাথা খেয়ে বলেই ফেলে,আন্টি আজ স্যালারি টা না পেলে খুব সমস্যা হয়ে যাবে। পিচ্চির বাবা আসতে দেরি দেখে পিচ্চির মায়ের কাছে যা ছিল, অর্ধেক বেতন নিয়ে বের হয়। কিন্তু ততক্ষনে আটটা প্রায় বেজে গেছে, দোকান বন্ধ হয়ে যাবে বলে তড়িঘড়ি এক দোকানে ঢুকে বেশি দরদাম না করে একটা শাড়ি কিনে ফেলে।

অনেক কসরত করে শাড়ির প্যাকেটটা জামার নিচে লুকিয়ে আনে ফয়সাল, এবার বারটা বাজার অপেক্ষা। শামাকে সারপ্রাইজ দেবে এই উত্তেজনায় ফয়সাল সময় গুণতে গিয়ে খেয়াল ও করেনা যে শামা অনেকক্ষণ রুমে নেই । ঠিক বারটা যখন বাজে , ফয়সাল অবাক হয়ে দেখে তার আনা আজকের শাড়িটা পরে শামা ঘরে ঢুকছে ! শামা ঘরে ঢুকেই বলে ,হাঁদারাম শার্টের নিচে শাড়ির প্যাকেট ঠিকমত লুকাতেও পারিস না? ফয়সাল বত্রিশ দন্ত বিকশিত করার আগেই খেয়াল করে , শামার হাতে তার অতি প্রিয় কেক আর মোমবাতি । শামা তখন বলে, পয়ছাল, এখন আমি আমার বাকি শর্ত টা বলব। শামা বলা শুরু করে,দেখ , তোর নিশ্চয় মনে আছে আমাদের বিয়েটা কিরকম ভাবে হয়েছিল। কিন্তু জানিস ,ছোটবেলায় মাসী আর পিসীদের বিয়ে দেখে আমার ভীষণ সখ জাগত বিয়ে করার । দিদির বিয়ের সময় পুরুত মশাই যখন মন্ত্র পড়ছিল, মন্ত্রের প্রতিটা শ্লোক শুনে আমার মনে হয়েছিল , ইস ! কবে আমার রাজপুত্তুর আমার হাত ধরে সবার সামনে প্রতিজ্ঞা করবে- ” যতদিন হৃদয় তোমার, ততদিন হৃদয় আমার “।তখন থেকেই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতাম জন্ম জন্মান্তরের জীবনসঙ্গীর হাতে হাত রেখে এই প্রতিজ্ঞা করার । লুতুপুতু আবেগ আমার ধারেকাছে ঘেঁষতে পারেনা,তুই জানিস কিন্তু মেয়ে হয়ে জন্মাইছি বলেই বউ সাজার সখটা বোধ হয় রক্তে মিশে আছে। জন্মান্তরে আজ আর হয়ত বিশ্বাস করিনা বলেই এই জন্মে তোর হাতে হাত রেখে আমি বিয়ের শ্লোক টা একবার পড়তে চাই। বাবা আমায় সম্প্রদান করেনি তো কি হয়েছে! নাই বা হল লাল বেনারসী পরে বউ সাজা। তবু একবার হলেও মিছেমিছি ওরকমভাবে বিয়েটা করতে চাই…….

ঢাকের বাদ্যি হয়ত ছিল না, চোখ ধাঁধানো আলোয় কনে বেশে লগ্ন হবার অপেক্ষায় ছিল না বাড়ি ভর্তি মানুষ। মাঝরাতে জানালা দিয়ে আসা বাঁধভাঙ্গা জ্যোৎস্না আলোয় শুধু একটা মোমবাতি জ্বালিয়ে খুব সাধারন পোশাকে একজোড়া মানব মানবী সাত পাকে ঘুরতে ঘুরতে হাতে হাত রেখে অস্ফুটে একসাথে বলেছিল-

“যদেতৎ হৃদয়ং তব

তদস্তু হৃদয়ং মম।

যদিদং হৃদয়ং মম,

তদস্তু হৃদয়ং তব।।”………

৩,৮৭৯ বার দেখা হয়েছে

৩৮ টি মন্তব্য : “আমি তোমার সঙ্গে বেঁধেছি আমার প্রাণ”

  1. তন্ময় (২০০৬-২০১২)

    কিছু কিছু স্বপ্ন মানুষ দেখে নিজের ইচ্ছায় আর কিছু প্রকৃতি তাকে দেখায় । আপু,আপনার লেখাটা পড়ে দ্বিতীয় গোত্রের কথা মনে পড়ল । অসম্ভব সুন্দর একটা গল্প......কিন্তু গল্প বলেই হয়তবা........নয় কি?? :dreamy: :-/ :dreamy: :-B :-/


    চলো বহুদুর.........

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : আহসান আকাশ (৯৬-০২)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।