অবশেষে বাড়ি ফেরা

কয়েকমাস ধরে আমি এমপ্লয়েড বেকার।মাঝে মাঝে অফিসের কাজের চাপে বাসায় ফিরি রাত দশটায় আর মাঝে মাঝে কাজের অভাবে অফিসে বসে বসে জেগে দিবা স্বপ্ন দেখি …সরকারি অফিস হলে নিশ্চয় মাছি মারতাম, নেহায়েত সিসিটিভি নামক আপদ টা আছে দেখে টেবিলে মাথা রেখে ঘুমাইতে পারিনা,বড়ই দুঃখের ব্যাপার।

যাই হোক এরকম অকামের দিনগুলাতে যে পরিমান চিন্তা আমি করি,তা যদি শুধু ভাল চিন্তা করতাম তো কবেই দার্শনিক হয়ে যেতাম ।আজ হঠাত হাবিজাবি চিন্তার মাঝে একটা স্মৃতি মনে পড়ে গেল।বাকি আর সবগুলা ক্যাডেটের মতই ক্যাডেট শব্দটা শুনলেই আমি আপ্লুত হয়ে যাই।আবার সব কাজ বাদ দিয়ে মনে মনে চিন্তা করি আর হা হুতাশ,ইশ আবার যদি ক্লাস সেভেন হতাম।

যাইহোক, তখন আমরা ক্লাস সেভেন, ফাইনাল স্পোর্টস ডে… ক্যাডেট কলেজগুলার চীফ আসছেন চীফ গেস্ট হয়ে, সেইরকম সাজ সাজ রব চারদিকে। ফাইনাল স্পোর্টস এর কয়েকদিন আগে প্যারেন্টস দের কে চিঠি দিয়ে ইনভাইট করা হইসিল। আমার বাড়ি মেহেরপুর থেকে ময়মনসিংহ যাওয়া আসা মানে এ যুগের সাত সমুদ্দর পার… এই যাওয়া আসার ঝক্কির কথা ভেবে আর ফাইনাল স্পোর্টস এর এক সপ্তাহ পর এ ঈদ এর বিশাল ছুটি দেখে আমি ও আর আমার বাপ মা কে ওইদিন আসতে মানা করসিলাম। যথারীতি আমার কেও আসেনাই ওইদিন… তো চীফ গেস্ট যাওয়ার আগে বিশাল খুশির সংবাদ দিলেন যে ৭ দিন আগে ওইদিন ই কলেজ ছুটি । যাদের প্যারেন্টস আসছিল ,সবাই তো আহ্লাদে আটখানা, আর আমার মত যারা ওইদিন এতিম ছিল,সবার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ল।

ডিনার টাইম এ ডাইনিং হল এ দেখি, মোটামুটি চল্লিশ জন মত বাসায় যেতে পারিনি।আমার রুমমেট এর প্যারেন্টস আমাকে নিয়ে যেতে চাইছিলেন,কিন্তু পারমিশন দেয়নি কলেজ।সেই রাত টা আমাদের খুব ই আনন্দে কাটসিল ।সেদিন আর সিনিওর জুনিওর,রুলস এই ব্যাপার গুলা ছিলনা,এমন কি রাতে আমরা সবাই কমন রুম এ ঘুমাইছিলাম। কোন হাউসের কমনরুম ,ভুলে গেসি।যেসব সিনিওর দের যমের মত ভয় পাইতাম,তাদের কয়েকজনের সাথে অনেক রাত পর্যন্ত আমরা মোস্ট জুনিওর রা আড্ডা দিতে পেরে ধন্য হয়ে গেসিলাম।

রাত টা ভালই কাটল, পরদিন সকালে খবর পেয়ে অনেকে প্যারেন্টস এর সাথে বাড়ি চলে গেসিল।বাকি ছিলাম আমরা বার জন।আমরা কি আর করি,পুরা কলেজ চক্কর দিতে শুরু করলাম ইচ্ছামত। যেদিকে আগে গেলে দাবড়ানি খাওয়া লাগত,আমাদের টার্গেট অবশ্য ওইদিকেই বেশি ছিল।মিল্ক ব্রেকের পর সেলিমা আহমেদ ম্যাডাম আমাদের কে উনার বাসায় নিয়ে গেলেন । ( উনার বিরাশি সিক্কা ওজনের দ্রুম দ্রুম কিল যে না খাইসে,সে ছাড়া আর কেও বুঝবেনা সেই কিলের মাহাত্ম্য। উনি যেদিন এন ডি এম, তারপরদিন ক্লাস টুয়েলভ এর ডজন খানেক উনার কিল খেয়ে ঘুম থেকে উঠত) ।তো উনার বাসায় যাইতে পেরে আমরা তো আনন্দে আটখানা হয়ে গেসিলাম। আর যখন উনি সবাইকে চিকেন ফ্রাই আর পুডিং খাইতে দিসিলেন আমরা তো পুরাই উনার পাঙ্খা হয়ে গেলাম(সেটা শুধু সেইদিনের জন্য অবশ্য)

সেইদিন বিকাল হইতে হইতে আরও তিন চারজন চলে গেল। মানুষজন বাপ মার হাত ধরে চলে যায় আর আমরা যারা অভাগা, গ্রিল ধরে দাড়িয়ে করুণ চোখে তাকায়ে দেখি।এই করুণ দৃশ্য দেখেই মনে হয় নাসিমা ম্যাডাম সবাইকে চকলেট খাইতে দিসিলেন। ওইরাতেও আমরা সবাই এক কমনরুম এ ঘুমাইসিলাম।

পরদিন সকালে ব্রেকফাস্ট এর পরে দেখি বাকি আছি আর ৫ জন। আমার বাপ মার উপর যেই রাগ টা উঠতেসিল,মনে হইতেসিল, আমি মানা করসি তো কি হইসে,ওরা স্পোর্টস ডে তে আসতে পারলনা? ওইদিন ই সবাই চলে গেল,বাকি থাকলাম আমি আর পাপিয়া আপা। আমার বাসায় তখন মোবাইল ছিলনা আর সেইসময় বাসার ল্যান্ডফোন টাও ছিল নষ্ট,তাই কলেজ থেকে সরাসরি যোগাযোগ করা যাচ্ছিল না,পাপিয়া আপার ও একই অবস্থা,উনাদের বাসায় কেও ছিলনা সেইসময় ।শেষমেষ আমাদের বাসায় টেলিগ্রাম পাঠানো হল।

সন্ধ্যা থেকেই শুরু হল আমাদের পালাক্রমে কান্নাকাটি ।আমি থামলে উনি কাঁদে ,আবার উনি থামলে আমি শুরু করি।সবাই পড়ল মহা বিপদে। কিছুক্ষন পরপর স্যার ম্যাডাম রা আমাদের দেখতে আসেন। মুনীরা ম্যাডাম কলেজ এ পারমিশন চাইলেন যাতে আমাদের উনার বাসায় নিয়ে রাখতে পারে(উনি আমার ব্যাচমেট সিঁথি র মা) ,কিন্তু পারমিশন দিলনা কলেজ।

রাতে আর ঘুম আসেনা,মনে হচ্ছিল এর থেকে কলেজ এ তিনবেলা সিনিওরদের পাঙ্গানিও অনেক সুখের।রাত যাও বা কাটল,সকাল থেকে ডাইনিং এর সামনে কারও আওয়াজ পাইলেই মনে হয় আমাদের কে নিতে আসছে। দৌড় দিয়ে গিয়ে দেখি ধুর… আমরা দুইজন সারাদিন চক্কর মারি,আমলকী পাড়ি, ফুল ছিঁড়ি, পারলে রাগে দুঃখে নিজের মাথার চুল ছিঁড়ি টাইপ অবস্থা…আমাদের শুকনা মুখ দেখে স্যার ম্যাডাম রা বড়ই বিপর্যস্ত, ডাইনিং এ প্রতিবেলায় ভালো ভালো মেনু…আহা … সন্ধ্যার দিকে নার্গিস ম্যাডাম আমাদের জন্য চকলেট আর কোকোলা ওয়েফার দিয়ে যাইতেন, এখনও ওয়েফার দেখলেই আমার ওই কথা মনে পড়ে… আসলে ওই কয়দিন স্যার ম্যাডাম রা আমাদের যে কি পরিমাণ আদর করসিলেন,সারা জীবন ধরে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেও শেষ হবেনা।

আমরা দুইজন কেঁদেকেটে যখন ছেড়াবেড়া অবস্থা, ৬ দিন পর ব্রেকফাস্ট এর টাইম ডাইনিং এর জানালা দিয়ে দেখি আমার বাপ হেঁটে আসতেছে ……কিসের কি পারমিশন, টেবিল থেকে এক দৌড় দিয়ে বাপের কাছে,গিয়েই চিরাচরিত চোখের জলে নাকের জলে ভাসমান অবস্থা…সে এক সিনেমাটিক দৃশ্য……  হঠাত পাপিয়া আপার দিকে তাকায়ে দেখি উনার চোখ ছলছল করতেসে ,একবারের জন্য মনে হল,উনি একা থাকবে,আমি বরং উনার প্যারেন্টস না আসা পর্যন্ত থেকেই যাই…

কিন্তু এদ্দিন এত অপেক্ষার পর আবার সব ভুলে বাপের হাত ধরে বাড়ি ফেরা টা যে এত সুখের,তা আর উপেক্ষা করতে পারলাম কই………

২,৬৭৩ বার দেখা হয়েছে

৩৪ টি মন্তব্য : “অবশেষে বাড়ি ফেরা”

  1. শরিফ (০৩-০৯)
    নেহায়েত সিসিটিভি নামক আপদ টা আছে দেখে টেবিলে মাথা রেখে ঘুমাইতে পারিনা,বড়ই দুঃখের ব্যাপার।

    :khekz: :khekz:

    কিন্তু এদ্দিন এত অপেক্ষার পর আবার সব ভুলে বাপের হাত ধরে বাড়ি ফেরা টা যে এত সুখের,তা আর উপেক্ষা করতে পারলাম কই………

    আমি আবার বাড়িতে গেলে একটু বিপদে পড়তাম । বাড়িতে গেলেই জিজ্ঞেস করত রেজাল্ট কি,কেমন পড়াশুনা হচ্ছে ।আর রেজাল্ট খারাপ করলে কি বকাই না খেতাম । 😛

    জবাব দিন
  2. সাব্বির (৯৫-০১)

    কলেজের যে কোন স্মৃতিচারণ পড়তেই ভাল লাগে।
    যদিও পাপিয়া আপা এবং তোমার জন্য একটু খারাপ লাগছে, অনেক গুলা দিন ছুটি মিস্ করলা। কিন্তু পোষ্ট পড়ে খুব মজা পাইছি 😀

    জবাব দিন
  3. মোর্শেদ (৯৮-০৪প.ক.ক)

    ইসস আমগো সময় যদি ইলেভেন বা টুয়েল্ভ এ আইয়া এরকম কিছু হইত :(( :(( :((
    তাইলে কম কইরাও এমন ১০টা পোলা সাথে পাইতাম যারা বাসায় ফোন করে বলে দিতাম যে এবার আর ছুটিই দিবে না। অবশ্য লাভ হইত না। কলেজ জামাই আদর না কইরা ঠিক ই ধাক্কা মাইরা বাইইত পাঠাই দিত। 😕 😕 (সম্পাদিত)


    মোর্শেদ_(৯৮-০৪)পাবনা ক্যাডেট কলেজ

    জবাব দিন
  4. সামি হক (৯০-৯৬)

    ক্যাডেটদের সিসিটিভি ক্যামনে আটকায় রাখে? চারদিকে ফাইল টাইল দিয়ে ঘুমায়ে যাবা আর না হলে কোন একটা আঙ্গেল খুজে নাও যেখান থেকে সিসিটিভি তে দেখা যায় না।

    লেখা খুব ভালো লাগছে। নারগিস ম্যাডাম বাংলার না? আমাদের ক্লাস সেভেন এইটের ফর্ম মাস্টার ছিলেন ম্যাডাম। খুব ভালো ছিলেন, আমাদের ক্লাসের প্রেজেন্টসন নাইটগুলোর আগে বাসা থেকে কিছু না কিছু রান্না করে আনতেন।

    জবাব দিন
    • সুষমা (১৯৯৯-২০০৫)

      হেহে, ভাইয়া সিসিটিভি আমার ঘুম আটকাবে এমন সাধ্য নাই 😛 কলেজে টেস্টের আগে ঘুম কাটানোর জন্য দাঁড়ায়ে পড়তে গিয়ে দাঁড়ায়ে ঘুমাইছি আর এ তো কোন সিসিটিভি......ঘুম পাইলে নামাজের রুম এ গিয়ে ঘুম দেই( অবশ্যই আশপাশে তাকায়ে অবস্থা বুঝে) 😛
      নার্গিস ম্যাডাম বাংলার...মাঝে মাঝে গালি গুলা যা দিতেন ওই গুলা ইগনোর করলে উনি ১০০ ভাগ ভালো মানুষ 🙂 :))

      জবাব দিন
  5. মুসতাকীম (২০০২-২০০৮)

    ভালো ছিল 😀 😀 😀 😀
    সিরাম মজা পাইলাম :))


    "আমি খুব ভাল করে জানি, ব্যক্তিগত জীবনে আমার অহংকার করার মত কিছু নেই। কিন্তু আমার ভাষাটা নিয়ে তো আমি অহংকার করতেই পারি।"

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : সুষমা (১৯৯৯-২০০৫)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।