কেঁদেই ওদের সুখ

২০১৩ সালের ৩ সেপ্টেম্বরের কথা। একটি সাধারন মহিলা। তার স্বামী মারা গেছে ১৯৭৭ সালের এই সেপ্টেম্বর মাসে ই। একটা ছেলে রেখে।মহিলাটি আর বিয়ে করেন নি আর। একটা মেয়ের শখ ছিল। ভেবেছেন ছেলেকে বড় করে বিয়ে দিয়ে একটা টুকটুকে বউ আনবে, যে হবে তার মেয়ে। ছেলে বড় হল, বিয়ে করল। বাড়ির সামনে খালার কাছ থেকে ভাড়া নিয়ে ছোট্ট একটি দোকানে লোহার পাত ঝালাই করে গ্রিল বানিয়ে বেচে ছেলে টা । এটা ই তার ব্যাবসা। বউ এর সাথে নিত্য ঝগড়া হওয়া সত্যেও বলা যায় হ্যাপি ফ্যামিলী। ছেলে আর ছেলে বউ নিয়ে বেশ আছেন তিনি। একটা নাতি ও একটা ফুটফুটে নাতনী ও এলো।
ছেলের বিজনেস ভালো চলে না। দিন দিন ঋণ বাড়ছে। বাড়ছে খালার কাছে দোকান ভাড়ার টাকার ঋণ ও। জমতে জমতে ১২ হাজার এ পৌঁছল। যত ই হোক খালা, আর পারেন নি। দোকার থেকে বের করে দিলেন। এবার ছেলে এক এক করে মেশিনারিজের এটা ওটা খুলে ভাঙ্গারির কাছে বেচতে লাগল। তিনি বললেন বাবা এভাবে না বেচে একসাথে বেচে কিছু একটা কর। ছেলে বলে, চুপ থাকো। একটা একটা কিছু বেচে আর বউয়ের হাতে টাকা দেয়।
এর পর একদিন বাড়ির বিছানা বালিশ কাথা সব এক করে ডাস্টবিনে ফেলে দিয়ে আস্লো। খাট টেবিল ভেঙ্গে ফেলল। কি থেকে কি হল কেউ বুঝে না তবে এটা বুঝতে কারো বাকি থাকল না যে জাহাঙ্গীর বাদশা পাগল হয়ে গেছে। বেঁধে রাখা হল। তখন ও কাছের সবাইকে চিনতে পারে। চিকিৎসা চলতে লাগলো সাধ্য মত। পরিবর্তন নাই। বছর না ঘুরতে ই বউ তার বাচ্চা কাচ্চা নিয়ে বাড়ি ছেঁড়ে বাবার বাড়ি গেলো এটা বলে ” আমি পাগলের বাড়ির ভাত খাবো না “।
শুরুতে বলা সাধারন মহিলাটি বললেন, মেয়েটারে আমার কাছে রেখে যা রে মা, আমি কারে নিয়ে থাকব। শুনল না তার কথা ।অসহায় হয়ে চেয়ে থাকলেন তিনি শুধু ।
এভাবে চলতে থাকল দিন। আত্মীয় বলতে কেউ নাই। এক ভাগ্নে কিছু সাহায্য করে যতোটা পারেন। ছেলে এখন আর কেউকে চিনে না। কাছে গেলে মারতে আসে। বালিশ ছিড়ে ফেলে, হাড়ি পাতিল ভেঙ্গে ফেলে। ৪/৫ দিন হয়ে গেলে ও ভাত খায় না, দিলে ছুড়ে ফেলে। বেঁধে রেখে দেন নিজের ছেলেকে।

এটা কোন মনগড়া কাহিনী বা সিনেমার কাহিনী না। ছেলের মাথায় বারি মারলে পাগলামি ভালো হয়ে যাবে না এই গল্পে। গল্প? হ্যাঁ গল্প ই তো। বারডেম জেনারেল হাসপাতালের ( সমাজ কল্যান বিভাগের কাছে সাহায্যের আবেদন প্রার্থী ) থেকে ডায়বেটিস রোগের চিকিৎসা সাহায্য আবেদন করা এক রোগী মোসাম্মাৎ জাবেদা বেগম এর জীবনের গল্প।

হোম ভিজিটের জন্য আজ যখন এই অসহায় মহিলার বাড়ি খুঁজছিলাম কেউ ই বলতে চাচ্ছিল না। হাসপাতাল থেকে এসেছি বললে ও কেউ বলতে চায় না। বুঝলাম না কারন টা। অনেক কষ্টে খুঁজে বের করে গেলাম। জাবেদা বেগম নিজে ই গেট খুলে দিলেন। ভিতরে গিয়ে ভাব্লাম এটা কি মানুষের বাড়ি না ভূতুড়ে বাড়ি? আমি শুধু জানতাম তার ছেলে মানসিক ভাবে অসুস্থ। পুরোপুরি না বুঝে প্রশ্ন করে বসলাম দায়িত্বের খাতিরে ” আপনার ছেলে কোথায়? “। এই প্রথম কারো চোখ থেকে বের হওয়া অশ্রুবিন্দুর প্রথম ফোঁটা টি দেখলাম। অপরাধ বোধে ভুগছিলাম। তবু দায়িত্ব পালন করতে তো হবে ই, এর পর আরো একটা হোম ভিজিট বাকি। ১০ মিনিট এ কাজ শেষ, জাস্টিফাই করার আসলে কিছু ই ছিলো না। কিছু ই নাই মহিলার, কিচ্ছু না। তবুও কিছুক্ষন বসে কথা বললাম তার সাথে। একা মহিলা, পাগলের বাড়ি বলে কেউ আসে না। কেউ ভাড়া ও থাকতে চায় না, কারন ওই পাগলের বাড়ি। কারো সাথে কথা বলতে পারে না সারা দিন। সন্ধ্যার পর নাকি ভূতুড়ে লাগে নিজের কাছে নিজের বাড়ি ই, কল্পনা করতে গিয়ে ব্যার্থ হলাম এটা শুনে। সাইকোলজিক্যাল ভাবে একটু সাপোর্ট দিতে তার সাথে একটু কথা বললাম, একটু হাল্কা করতে। এর থেকে আর কি ই বা করতে পারতাম আমি। তিনি কান্না একটু থামিয়ে পুরনো কথা বলতে লাগলেন।
ফেরার সময় উঠে দাঁড়ানোর সময় তার অবস্থা দেখে বুঝতে পারছিলাম তিনি চাচ্ছিলেন আরো কিছুক্ষন থাকি। কিন্তু সম্ভব ছিল না। এক পর্যায়ে তিনি আমাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলেন। আমি মাথায় হাত রেখে কিছুটা শান্তনা দিতে চেস্টা করলাম। তিনি বললেন, বাবা আমার ছেলে ভালো থাকলে আমাকে এভাবে ই জড়িয়ে ধরত। মহিলার জায়গায় আপন কেউকে কল্পনা করতে ও ভয় পাচ্ছিলাম আমি। কিছু বলতে পারি নি। চোখে পানি আসলে ও বের হতে দেই নি। দুর্বলদের ভিড়ে অপেক্ষাকৃত কম দুর্বলদের ও মাঝে মাঝে শক্তিশালী হতে হয়। প্রার্থনায় কিছু হয় বলে আমার খুব একটা বিশ্বাস নেই, তবুও বলে আসলাম, আল্লাহর উপর ভরসা রাখেন, নামাজ পরে ছেলের জন্য দোয়া করেন। তিনি সব দেখছেন।

গেট থেকে বের হওয়ার সময় তিনি বলছিলেন, ” ছেলেটা ভাল হলে আমি ওরে নিয়ে পথে পথে ঘুরতে রাজি আছি, আর কিচ্ছু চাই না। ”
আমি আর দাড়াই নি। নিষ্ঠুরের মত পিছে একটি বার তাকিয়ে আবার নিজের গন্তব্যে হাঁটতে শুরু করলাম। হয়ত মোসাম্মাৎ জাবেদা বেগম তখন কাঁদছিলেন, অনেক্ষন ধরে। কিন্তু আমার সামনে এগিয়ে চলা থেমে থাকে নি। আমাদের পথচলা থেমে থাকে না, কিন্তু জাবেদা বেগম রা কাঁদতে ই থাকেন। কেঁদেই ওদের সুখ।

৬ টি মন্তব্য : “কেঁদেই ওদের সুখ”

  1. রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)
    মহিলার জায়গায় আপন কেউকে কল্পনা করতে ও ভয় পাচ্ছিলাম আমি। কিছু বলতে পারি নি। চোখে পানি আসলে ও বের হতে দেই নি। দুর্বলদের ভিড়ে অপেক্ষাকৃত কম দুর্বলদের ও মাঝে মাঝে শক্তিশালী হতে হয়। প্রার্থনায় কিছু হয় বলে আমার খুব একটা বিশ্বাস নেই, তবুও বলে আসলাম, আল্লাহর উপর ভরসা রাখেন, নামাজ পরে ছেলের জন্য দোয়া করেন। তিনি সব দেখছেন।

    ::salute::


    এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : সুশান্ত (০৩-০৯)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।