সিক্স ডেজ সেভেন নাইটস – শেষ পর্ব

সিক্স ডেজ সেভেন নাইটস০১০২

খাওয়ার পরে সিগারেট ধরিয়ে সবাই একসঙ্গে বের হলাম সমুদ্রের পারে হাঁটতে । খোলা গলায় এবং হেড়ে গলায় গান চললো কিছুক্ষণ। অনেক্ষণ পর ফিরে এসে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিলাম, কিন্তু রুমে গিয়ে বিছানায় শুয়ে দেখি এই গরমে রুমে ঘুমানো সম্ভব না। বালিশ তোশক নিয়ে একজন বারান্দায় এসে শুয়ে পড়লো, তার দেখাদেখি বাকি সবাই। কিন্তু কিছুক্ষণ সেখানে শুয়ে থাকার পর দেখি আমার গরম লাগা যাচ্ছেই না। তাই হাসনাত আর শোয়েবকে নিয়ে ছাঁদে চলে এলাম। ব্যস, সেখানে বিছানা পেতে সমুদ্রের বাতাস গায়ে লাগিয়ে এবার আরামসে ঘুম দিলাম।

ভোররাতের দিকে একটা মারাত্মক স্বপ্ন দেখালাম। আমি জঙ্গলের ভিতর শুয়ে আছি একা আর অসঙ্খ্য সাপ শোঁ শোঁ করতে করতে আমার পায়ে কামড় বসাচ্ছে। হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে গেলো। জেগে দেখলাম বৃষ্টি হচ্ছে, আর আমি সেই বৃষ্টিতে ছাঁদে একা শুয়ে আছি। পরে জিজ্ঞেস করে জেনেছিলাম, বৃষ্টি শুরু হবার পর হাসনাত আর শোয়েব নাকি আমাকে ডেকেছিলো, কিন্তু আমি না উঠায় আমাকে ফেলে ওরা নিচে চলে এসেছে।

নৌকায় করে সেন্টমার্টিন থেকে ছেঁড়াদ্বীপ

নৌকায় করে সেন্টমার্টিন থেকে ছেঁড়াদ্বীপ

সকালে সূর্য উঠতেই মনটা ভাল হয়ে গেল। উঠে রুমের সামনে জেতেই দেখি দরজার কাছে এক ঝাকি ডাব। মাসুদ দেখি ডাবের পানি দিয়ে মুখ ধুচ্ছে। সেন্টমার্টিনে ডাব বিশাল সস্তা। ভোর বেলা উঠেই কামরুল প্রায় গোটা চল্লিশেক ডাব আনিয়েছে। সেই ডাবের পানি দিয়ে এখন ঘুম থেকে উঠে মুখ ধুয়াও চলছে। আমি একটা ডাব খাওয়ার পর হোটেলের মামা বললো ‘স্যার, আরেকটা খান।’ ডাবের ঝাকির কাছে চেয়ারে বসে বারান্দার রেলিংয়ে পা তুলে দিলাম আর মনে মনে বললাম, সারাজীবনের সব ডাব আজ খেয়ে শেষ করবো। খুব ডাব খেয়েসিলাম সেবার। তারপর সবি মিলে বের হলাম সেন্টমার্টিনের পাশে ‘ছেঁড়াদ্বীপ’ দেখতে।

ছেঁড়াদ্বীপে

ছেঁড়াদ্বীপে

একটা ছোট্ট নৌকা নিয়ে খুব সহজেই পৌছে গেলাম ‘ছেঁড়াদ্বীপ’। যেতে যেতে সমুদ্রের নীলাভ সবুজ পানিতে দেখলাম কোরাল মাছের লাফ, তারা মাছের ঝাক আর উড়ে যাওয়া সামুদ্রিক পাখি। মনে হলো একটা বড় ট্রলারে করে যদি এখন যেতে পারতাম আন্দামান বা শ্রীলঙ্কা তাহলে বেশ মজা হতো। এই সব ভাবতে ভাবতে ছেঁড়াদ্বীপ এসে পড়লাম। অসম্ভব রোদ উঠেছিলো সেদিন। সবার গায়ের চামড়া পুড়ে প্রায় লাল হয়ে গেছে। যাদের আগে থেকেই লাল ছিলো তাদের চামড়াও ছাইবর্ন হয়ে গেছে। ছেঁড়াদ্বীপের সবচেয়ে যে জিনিসটা ভালো লেগেছে তা হলো সারি সারি কেয়া ঝোপ। গরমে বালিতে পা ফেলা যাচ্ছে না। যারা পোজ মেরে খালি পায়ে এসেছিল তারা ধরা খেলো। বেছে বেছে সমদ্রের পাড় দিয়ে পানিতে পা ডুবিয়ে হাঁটতে হলো। ছেঁড়াদ্বীপের প্রবাল আর পাথরগুলি মারাত্মক সুন্দর। পানিতে দল বেঁধে ডুবাডুবি চললো অনেক্ষণ। তারপর সেই নৌকাতে করেই আবার ফিরে চল্লাম সেন্টমার্টিনের দিকে।

এটাই সম্ভবত বাংলাদেশের শেষ স্থলভাগ

এটাই সম্ভবত বাংলাদেশের শেষ স্থলভাগ

হোটেলে ফিরে আবার ডাবের পানি খেলাম প্রাণভরে। আর তারপরই হঠাৎ শুরু হলো প্রচন্ড ঝড়। দমকা হাওয়ায় সব যেন উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে। আমাদের সেদিন ফিরে আসার কথা ছিলো, কিন্তু ঝড় একটু থামার পর কামরুল খোজ নিতে গিয়ে জানতে পারলো ঝড়ের কারনে সেদিনের ট্রলার চলাচল বন্ধ করা হয়েছে। শুনে আত্মা শুকিয়ে এলো। এখন উপায়? আমি একটু সাহস আনার জন্যে খুব বিজ্ঞের মতো এক বৃদ্ধ লোককে জিজ্ঞেস করলাম, ‘ভাই আপনাদের এখানে ঝড়ের সিজন কখন থেকে শুরু হয়?’ উনি বললেন, ‘ঝড়ের সিজনতো দু’মাস আগেই শুরু হয়েছে, কিন্তু ডরের কিছু নাই। অনেক আগে এই দ্বীপে একজন দরবেশ এসেছিলেন উনি সেন্টমার্টিনে একটা পাথর স্থাপন করে গেছেন আর বলে গেছেন-এই পাথন যেদিন ডুবতে শুরু করবে সেদিন সেন্টমার্টিনও ডুবে যাবে।’ উনার কাছ থেকে সেই জায়গার খোজ নিয়ে আমরা গেলাম সেই পাথর দেখতে। গিয়ে দেখি পাথরের প ও নাই। সবার ভয় আরো বেড়ে গেলো। সেন্টমার্টিন বুঝি আজই ডুবলো।

এতো গরমেও ফাজলামি কম করিনাই আমরা

এতো গরমেও ফাজলামি কম করিনাই আমরা

সেদিন রাতের বেলা আমি আর হাসনাত গেলাম নেভাল ক্যাম্পে’র খোঁজ করতে যদি ওরা কোন সাহায্য করতে পারে। রাতের অন্ধকারে সেন্টমার্টিনে একা একা বের হতে ভয় লাগে। আমরা দু’জনে তাও হাঁটতে হাঁটতে বাজার ছাড়িয়ে, কুপি জ্বালিয়ে মাঝিদের জাল বোনা দেখতে দেখতে কখন যে কেয়া জঙ্গলে ঢুকে পড়েছি খেয়াল করিনাই। এদিকটায় কোন আলোর নাম গন্ধ নাই। শুধু আমরা দু’জন আর মহাশুন্যের মতো অন্ধকার। টুকটাক কথা বলে একজন অন্যজনকে নিজের উপস্থিতি জানান দিচ্ছি, কিন্তু একজন অন্যজনকে বুঝতে দিচ্ছি না যে ভয় পাচ্ছি। একসময় হাসনাত বলেই ফেলল, ‘মামা আমার কিন্তু ভয় লাগতেছে।’ আমি খুব স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করে বললাম ,’ধুর ব্যাটা ভয়ের কি আছে।’ বলতে না বলতেই কি যেন একটা আমাদের দু’জনের মাঝখানে এসে দাড়ালো। একবার পা স্পর্শ করলো। তারপর দেখি হাসনাতও বলছে, ‘মামা আমার পায়ে এটা কি লাগছে, নড়তেছে মনে হয়।’ অনেক্ষণ পর বুঝতে পারলাম এটা কারো হারিয়ে যাওয়া ছাগল। পথ হারিয়ে বেওয়ারিশ হয়ে এখানে ঘুরাঘুরি করছে। সেটা ফেলে রেখে আরেকটু এগিয়ে যেতেই একটা আলো চোখে পড়লো। কাছাকাছি গিয়ে দেখলাম একটা ছোট্ট কুঁড়ে ঘরের মতো বা তার চেয়েও ছোট একটা ঘর। বাইরে দাঁড়িয়ে সাহস করে জিজ্ঞেস করলাম ‘কেউ আছেন?’ একটা লোক বেরিয়ে এলো। তার সঙ্গে কথা বলে জানতে পারলাম সে সেন্টমার্টিনের ইলেক্ট্রিক মিস্ত্রি। এই দ্বীপে এসেছে ছয় মাস আগে। এখন এখানেই থাকে। আসল বাসা ছিলো ঢাকার মিরপুর। শুনে একটু অবাক হলাম। মানুষের জীবন বড়ই বিচিত্র। কেউ জানে না কখন প্রকৃতি তাকে কোথায় নিয়ে যাবে।

ফিরে আসার সময়

ফিরে আসার সময়

ফেরার পথে দেখি সেই ছাগলটা তখনো সেখানে আছে। সেটাকে কোলে নিয়ে হোটেলে ফিরলাম। সেদিন রাতে অনেক হইচই হলো। চট্রগ্রাম থেকে আনা বাংলা মদ খেয়ে মাতাল হয়ে গেলাম কয়েকজন। তারপর সমুদ্রের পাড়ে গিয়ে বালিতে পাটি বিছিয়ে বসলাম সিগারেট নিয়ে। হঠাৎ হাসনাতকে দেখি দৌড়ে সমুদ্রের কাছে চলে গেলো তারপর জামাকাপড় সব খুলে আদিম হয়ে দিলো পানিতে ঝাপ। আমি পাশে বসা কামরুলকে বলতে গেলাম, ‘দেখ শালার কান্ড।’ কিন্তু পাশে তাকিয়ে দেখি কামরুল নেই। সামনে ফিরে দেখি কামরুল নিজেও আদিম হয়ে পানিতে ঝাপ দিচ্ছে। তারপর কি মনে করে দুইজন সেই অবস্থায় আমার দিকে এগোতে লাগলো। আমি পাটি ফেলে দে ছুট।

শেষবারের মতো দেখে নেয়া প্রিয় সেন্টমার্টিন

শেষবারের মতো দেখে নেয়া প্রিয় সেন্টমার্টিন

পরের দিন সকালে আরেক দফা ইছেমতো ডাব খাওয়া হলো। তারপর সেন্টমার্টিনের মায়া কাটিয়ে রওনা দিলাম টেকনাফের উদ্দেশ্যে। আবহাওয়া ভালো ছিলো সেদিন তাই আর কোন ঝামেলা ছাড়াই টেকনাফ এসে পৌছলাম। সেখানে লাঞ্চ সেরে মাইক্রোতে করে কক্সবাজার। আর কক্সবাজারে একদিন রেস্ট নিয়ে পরদিন রাতের বাসে সরাসরি ঢাকা।

পেছনে ফেলে এলাম ছয় দিন সাত রাতের দারুণ এক স্মৃতি।

১,৬৮৩ বার দেখা হয়েছে

২০ টি মন্তব্য : “সিক্স ডেজ সেভেন নাইটস – শেষ পর্ব”

  1. রকিব (০১-০৭)
    সামনে ফিরে দেখি কামরুল নিজেও আদিম হয়ে পানিতে ঝাপ দিচ্ছে।

    :khekz: :khekz:

    বর্ণনাভঙ্গি দারুণ লেগেছে।
    :boss: :boss:


    আমি তবু বলি:
    এখনো যে কটা দিন বেঁচে আছি সূর্যে সূর্যে চলি ..

    জবাব দিন
  2. কামরুল হাসান (৯৪-০০)

    ভরা মজলিসে আমাকে বেইজ্জতি করায় সুব্রত'র দুই বছরের ফাঁসি চাই :bash:


    ---------------------------------------------------------------------------
    বালক জানে না তো কতোটা হেঁটে এলে
    ফেরার পথ নেই, থাকে না কোনো কালে।।

    জবাব দিন
  3. মাহমুদ (১৯৯০-৯৬)

    বর্ণনা বড়ই সৌন্দর্য। ইচ্ছে করছে এখনই ছুটে যাই সেন্টমার্টিনসে। :clap: :clap:

    ছুডোরা তোমরা কেউ গেলে আগে থেকে কইও, তাইলে পরে যামু। বলা তো যায়না, কামরুলদের মতো গোসলের ইচ্ছে হয় যদি... 😛 😛


    There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx

    জবাব দিন
  4. তানভীর (৯৪-০০)

    এই ভরা মজলিসে কামরুলের ইজ্জত নিয়ে ছিনিমিনি খেলায় সুব্রত'র ব্যান চাই। :grr: :grr:
    দোস্ত, ফাটাফাটি লিখছিস্‌! তোর লেখা পড়েই তোদের মজাটুকু অনুভব করতে পারলাম। :boss: :boss:
    আমার আবার সেন্টমার্টিন যাইতে মন চায়। 🙁 🙁

    জবাব দিন
  5. ফয়েজ (৮৭-৯৩)
    সামনে ফিরে দেখি কামরুল নিজেও আদিম হয়ে পানিতে ঝাপ দিচ্ছে।

    কোন ছবি নাই এইটার। থাকলে পাঠাও আমারে.........

    ইহা একটি আদেশ............


    পালটে দেবার স্বপ্ন আমার এখনও গেল না

    জবাব দিন
  6. সুব্রত (৯৪-০০)

    এই প্রসঙ্গে আমি কামরুল কে একটা ধন্যবাদ দিতে চাই। যারা শীতের সিজনে সেন্টমার্টিন্স যায় তারা আসলে সামুদ্রিক কুয়াশার কারনে সেন্টমার্টিন্স এর আসল সৌন্দর্য দেখতে পারে না। কিছু দেখা যায় না,তাই যাবার পর অনেকে bored হয়ে যায়। আমরা লাকি যে কামরুলের গো ধরার কারনেই ঝড়ের দিনের পরিস্কার সেন্টমার্টিন্স দেখে এসেছি। ওটাই ছিল সেন্টমার্টিন্স দ্বীপের আসল সৌন্দর্য। থ্যঙ্কু দোস্ত।

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : রবিন (৯৪/ককক)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।