উৎসর্গঃপ্যালেস্টাইন বন্ধুদের

ছেলেগুলোর সাথে প্রথম দেখা একটা প্রাচীর ঘেড়া জায়গায়। ছয় ফিট উঁচু প্রাচীরের এক পাশে ট্রেন লাইন এগিয়ে গেছে বহু দূর।আরেক পাশে সবুজ রংগা পাহাড় আকাশের কোল ঘেঁষে দাড়িয়ে আছে। জায়গাটা বাংলাদেশ মিলিটারী একাডেমী। জানুয়ারী মাসের এক রাতে ওদের একজনের সাথে প্রথম পরিচয়।ওরা ফিলিস্তিনি। খবরের কাগজ বা টিভী পর্দার বাইরে এই প্রথম ওদের দেখলাম। দেশ ছেড়ে,পরিবার ছেড়ে আমাদের দেশে এসেছে সামরিক প্রশিক্ষণ নিতে।। বয়স আঠার পেরোইনি কারো।তবে এ বয়সেই বেশ সুপুরুষ। অনেকটা রোমান যোদ্ধাদের মতন। প্রথম প্রথম ওদের একগুঁয়ে স্বভাবটা ভাল্লাগতো না তেমন। নিজেদের গন্ডির মাঝেই পরে থাকত ওরা। যেচে কারও সাথে কথা বলতে যেত না। আচার ব্যাবহারও খুব একটা সুবিধার না। আমাদের দেশে এসে আমাদের সাথেই এমন করে? এদের জন্যই কি এতদিন শুভকামনা করেছি মন থেকে? অভিশাপ দিয়েছি ইজরায়েলকে? এদের জন্যই কি অজানা ভালবাসায় মনটা সিক্ত হত এতদিন? নাহ। প্রথম অনুভূতি সবসময় স্থায়ী হয় না। সঙ্গত কারনেই এই ভুল ধারণা গুলো মনের মাঝে বাসা বাঁধতে পারেনি।   

সময়ের সাথে সাথে বরফ গলল। বন্ধুত্ব হল ওদের সাথে। আড্ডা, হাসি-তামাশা, অক্লান্ত পরিশ্রমের ট্রেনিং করেছি একসাথে। প্রচন্ড শীতের রাতে ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে পাড় করেছি পুরো রাত, জ্বলন্ত সিগারেটটা হাত বদল হয়েছে নিমিষেই, ভাঙ্গা ভাঙ্গা উচ্চারনে বাংলা গালি খেয়ে গড়াগড়ি খেয়েছি হাসতে হাসতে ।
ঘড়ির কাটার সাথে বন্ধুত্বটাও গাঢ় হল ওদের। ধীরে ধীরে বুঝতে শুরু করলাম ছেলেগুলোকে। অবাক হয়ে দেখতাম কি আশ্চর্য মনোবল ওদের। এতটুকু ছেলের মাঝে কি প্রবল আত্ববিশ্বাস। দেশের জন্য কি অগাধ মমতা।

একবার ঈদের সময় ছুটি পেলাম না। প্রায় সবাই চলে গেছে ছুটিতে। চুপচাপ রুমে বসে আছি মন খারাপ করে। এমন সময় মোহাম্মদ ভাই এসে ওর ফোনটা এগিয়ে দিয়ে বলল, “বাসায় কথা বল। ভাল্লাগবে। আর মন খারাপ কর না। আমরা তো আছিই। এইবার নাহয় আমাদের সাথে ঈদ করলে।“ মনে পরল আমি তো মাকে দেখি না মাত্র তিন মাস ধরে। আর ছেলেটা তার মাকে দেখবে দুই বছর পর। এক মায়ের জন্য আরেক মার কাছ থেকে দূরে থাকছে এতটা সময়।

 সেকেন্ড টার্ম। একরাতের কথা। বক্সিং প্র্যাকটিস শেষে রুমে এসেছি সবাই। দেখলাম হায়েলের নাক দিয়ে ক্রমাগত রক্ত পড়ছে। সেদিকে বিকার নেই কোন। নিজের মনে রুমাল চাপা দিয়ে বসে আছে। বাজে ভাবে ব্যাথা পেয়েছে কিনা জিজ্ঞেস করলাম। বলতে চাইল না। পাশে মোহাম্মদ ভাইকে জিজ্ঞেস করলাম। জানলাম, দেশে থাকতে একবার ইজরায়েলি সৈন্যরা ওকে ধরেছিল। প্রচন্ড মারে সেদিন। তারপর থেকে নাকে সমস্যা। হালকা আঘাতেই রক্তপাত হয়। শুনলাম আরেক বন্ধু আলির গল্প। ওর ভাইকে রাস্তায় গুলি করে রেখে যায় কোন একদিন। দোষ? রাস্তায় মিছিল করতে গিয়েছিল ছেলেটা। হাসতে হাসতে সাব্বাহ বলল, Don’t worry we will fight them. কেন যেন এসব বলতে চাইত না  ওরা। মনের ক্ষোভ থেকেই হয়ত। রাগটা মনের মাঝেই পুষে রাখত।

আর দশটা সাধারণ ছেলের মত রাজনৈতিক ব্যাপার গুলো সযতনে এড়িয়ে যেতাম একটা সময়ে। নিজের রুমে জাতীয় পতাকা রাখার কোন ইচ্ছে অনূভব করতাম না। ঠিক একই সময়ে আমাদের সমবয়সী আরেকটা ছেলে রুমে পতাকা টাঙ্গিয়ে রাখত। এক কোণে ছিল ইয়াসির আরাফাতের ছবি। ও জানত আজ হোক কাল হোক। যুদ্ধে যাচ্ছে সে। তাই হয়ত আগাম যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে মনে মনে।

যে সময়টায় আমরা আয়েশ করে ইফতার সেড়ে অনলাইনে সমালোচনার ঝড় তুলছি অথবা বন্ধুদের নিয়ে সেলফি তুলছি, ঠিক সেই সময়টায় হাজার মাইল দূরের ছেলেগুলো হয়ত অটোমেটিক রাইফেল হাতে দাড়িয়ে আছে কোথাও। রাতের খাবারটা বাসায় খেতে পারবে তো? নাকি তার আগেই ভিনদেশী কোন বুলেট তার বুক ছুয়ে যাবে। অথবা নিদ্রাদেবীর কোলে মাথা দেয়ার আগে কোন জংগীবিমানের ছোড়া গোলায় হারিয়ে যাবে সপরিবারে। কিছুই জানে না এসবের। শুধু জানে রক্ষা করতে হবে সবাইকে। যে করেই হোক। নিজের জীবন দিয়ে হলেও।

অনেকে বলে একপেশে মানবতার মত ভন্ডামী আর হতে পারে না। কিছু বোঝার আগে, বলার আগে দু পক্ষের কথাই ভালভাবে শোনা উচিত। কিন্তু জীবন সবসময় সরল হিসেব নিকাশ মেনে চলেনা। কখনো কখনো পক্ষপাতটাই ঠিকই নিরপেক্ষতার মুখোশ না। প্রশ্ন একটাই। কোন পক্ষ নিতে চান আপনি?
মাত্র নয় মাসে স্বাধীনতা পেয়েছি বলে স্বাধীনতার মর্মটা হয়ত ঠিক বুঝিনা আমরা। কিন্তু ফিলিস্তিনিরা বোঝে। আর তাই তারা পারবে। আজ হোক, কাল হোক। পারবেই।এত অন্ধকারের মাঝেও তাই আলো দেখতে পাই। The night is the darkest just before the dawn. সূর্যোদয় আসছে।

শেষ দেখায় কথা দিয়েছিলাম আবার দেখা হবে। হয়ত হবে। স্বাধীন এক রাষ্ট্রে। সেদিনের প্রতিক্ষায় রইলাম।

    

১২ টি মন্তব্য : “উৎসর্গঃপ্যালেস্টাইন বন্ধুদের”

  1. সামিউল(২০০৪-১০)

    কী কমু বুঝতেছিনা, লেখাটা একদম বুকের ভিতরে বসে গেল।
    ফিলিস্তিনি ভাই-বোনদের জন্য সমবেদনা আর আল্লাহর কাছে দোয়া করা ছাড়া আর কোন অপশন নাই। এত অসহায় কেন আমরা?? 🙁


    ... কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালবাসে!

    জবাব দিন
  2. সোহান (২০০৪-১০)

    বাবার কাছে শুনেছিলাম ৮০র দশকের শেষ দিকে বাংলাদেশের অনেক তরুন গেরিলা প্রশিক্ষণ নিত প্যালেস্টাইন এর স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্য। অনেকে গিয়েছিলও। তারপর হটাত ক্লাস্টার বোম্বিং শুরু হওয়ার পর রিক্রুটমেন্ট বন্ধ হয়ে যায়। এর বেশি কিছু জানি। আর একই বয়সে আমরা ফেবুতে বসে মানবতা উদ্ধার করি। হাহ। কতই না বিচিত্র আমরা।


    আমি সিগারেটের ছাই, জানালার ধুলো। চাইলেই ফু দিতে পার। ঊড়ে যাব।

    জবাব দিন
  3. মোকাব্বির (৯৮-০৪)

    চমৎকার একটা লেখা দেয়ার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ। ফেইসবুকের নিউজ ফীডে চোখ রাখা যাচ্ছেনা দুটো কারণে। প্রথমটি আক্রমনে আহত মানুষের রক্তাক্ত বিভৎস ছবি শেয়ার করা দেখে এবং দ্বিতীয়টা, হিটলারের একটি ভিত্তিহীন উক্তিঃ তিনি নাকি জিউইসদের কিছু বাঁচিয়ে রেখেছিলেন সাড়া পৃথিবীকে দেখানোর জন্য তারা কত খারাপ। এছাড়াও, হিটলারের সব জিউইসদের মেরে ফেলা উচিৎ ছিল ইত্যাদি নানান রঙের কথা দেখে যেই পরিমাণ সহমর্মিতা প্যালেস্টাইনের জন্য হচ্ছে তারচেয়ে বেশী করুণা হচ্ছে এইসব মূর্খ বাঙালীদের কাজকর্ম দেখে।

    এক হত্যাকান্ড দিয়ে আরেক হত্যাকান্ডের সাফাই দেয়ার মত ছাগলামি আর কত দেখতে হবে? প্যালেস্টাইনের এই মুক্তির সংগ্রামতো আর ১০-১৫ বছরের না। এখানে হাজার বছরের ইতিহাস জড়িত। একদিকে নিজেদের মাঝে ঝগড়ারত প্রতিবেশী সাথে মার্কিন-পাদুকা-লেহনকারী আরব দেশগুলোও ইসরায়েলের মতই সমান অপরাধী। যত মুসলীম ভাতৃত্ববোধ সব এই উপমহাদেশেই, আমাদের মুসলমান আরব ভাইয়েরা এইসব নিয়ে বিন্দুমাত্র বিচলিত নন। ইতিহাস পড়ে দেখলে পরিস্কার হয়ে যায়, এই প্যালেস্টাইনকে দেশ হিসেবে কেউ দেখতে চায় নি। গরিমসি চলেছে বছরের পর বছর। ইসরায়েলের মত ধান্দাবাজ, মার্কিন সহায়তায় শক্তিশালী একটি দেশ এই বিবাদের সুযোগ নিয়ে একটু একটু করে শেষ করছে প্যালেস্টাইন নামক এই দেশহীন দেশটিকে।


    \\\তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা
    অবুঝ শিশু হামাগুড়ি দিল পিতামাতার লাশের ওপর।\\\

    জবাব দিন
    • সোহান (২০০৪-১০)

      জ্বী ভাই। এক গণহত্যা দিয়ে আরেক গণহত্যা জাস্টিফাই করার কোন লজিক থাকতে পারে না। অন্তত গণহত্যার মর্ম আমাদের বোঝা উচিত ছিল। আফসোস। বাংগাল বুঝল না।
      অল্পবিস্তর পড়ায় যা মনে হয়েছে, হিটলারের যুদ্ধ শুরু করার পিছে লজিক থাকতে পারে। কিন্তু গণহত্যার পিছে ব্যাক্তিগত ক্রোধঈ মুখ্য। সেটা নিয়ে এখন না বলি।
      আসলে আমার মনে হয় এসব অনলাইন এক্টিভিটি দিয়ে কিচ্ছু হবে না। আরে জাতিসংঘই কিছু করতে পারে না। আমরা কোথাকার কে? কূটনৈতিক কথা বার্তা তো কম হয় নাই এতদিনে। শুনতে খারাপ শোনালেও, এই পরিস্থিতির একমাত্র সমাধান হয়ত সামরিক। ফিলিস্তিন কে নিজের স্বাধীনতা অর্জন করে নিতে হবে।


      আমি সিগারেটের ছাই, জানালার ধুলো। চাইলেই ফু দিতে পার। ঊড়ে যাব।

      জবাব দিন
      • মোকাব্বির (৯৮-০৪)

        অনেকগুলা ঝামেলা আছে এখানেঃ কনফ্লিক্ট রেজুল্যুশানে জাতিসংঘের সাফল্য কিন্তু খুব সীমিত। ব্যুরোক্রেসির ভারে আক্রান্ত এই সংগঠনের অর্থের জোগান, লজিস্টিক আরো অন্যান্য ঝামেলায় তো ভুগছেই। সরাসরি যুদ্ধে যাওয়া ছাড়া আসলেই উপায় নাই এবং সেটা একই সাথে ডেডলি। ইসরায়েল গত দুই তিন দশক ধরে দখল করতে করতে প্যালেস্টাইনের কিছু বাকি রাখে নাই। আর নিয়মতি বোমা মেরে মানুষ তো মেরেই আসছে। যুদ্ধে আর কি যাবে। জর্ডানতো আমেরিকা বলতে স্যালুট ঠুকে, মিশর, লেবানন, সিরিয়া নিজেরাই অস্থিতিশীল, আর ওদিকে Saudis with Audis ও বাকি আরব নেতৃবৃন্দ বসে বসে মজা দেখছেন। আমি তো করুণ পরিণতি ছাড়া কিছু দেখি না।

        হিটলারের জিউইশদের প্রতি হিংসা ও নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার ইচ্ছা বহু পুরাতন। শেষ পর্যন্ত চেষ্টাও করেছে। ব্যক্তিগত কিনা জানি না তবে অর্থডক্স চার্চে বিশ্বাসী এই লোকের কথা ছিল জার্মানি জিউইশ মুক্ত হবে। হাস্যকর হলেও সত্য ব্যাপারটাকে এভাবে কেউ দেখছে নাঃ এই হিটলার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হলোকাস্টে না মেতে উঠলে আজকে এই ইসরায়েল দেশের জন্ম হয় না। হয়তো তখন ইতিহাস নতুন মোড় নিতে পারতো, অন্তত এত রক্তপাত ও অবিচার দেখা লাগতো না।


        \\\তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা
        অবুঝ শিশু হামাগুড়ি দিল পিতামাতার লাশের ওপর।\\\

        জবাব দিন
        • সোহান (২০০৪-১০)

          দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে সশস্ত্র সংগ্রাম ছাড়া কোন গতি নেই। কিন্তু কথা হচ্ছে দেয়াল আর কত দূর। প্রতিবেশী দেশ বা আন্তর্জাতিক সংস্থা থেকে সাহায্য পাওয়ার চিন্তা নিতান্তই বাতুলতা। আর সম্মুখ সমরেও খুব একটা লাভ হবে না হয়ত। সামরিক রষদেরই তো যোগান নেই। গেরিলা হামলায় আরকি হবে? দু একটা রকেট এর বদলে ফিরে আসে কয়েকশ মিসাইল। আর এই বিষয়টা এতই স্পর্শকাতর যে সুপার পাওয়ারদের হস্তক্ষেপ আরেকটা বিশ্বযুদ্ধ ডেকে আনতে পারে। আমি বলছি না যুদ্ধই একমাত্র সমাধান। কিন্তু হতভাগ্যদের এছাড়া কোন উপায়ও আছে বলে মনে হয় না।


          আমি সিগারেটের ছাই, জানালার ধুলো। চাইলেই ফু দিতে পার। ঊড়ে যাব।

          জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : সোহান (২০০৪-১০)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।