ধূসর নস্টালজিয়া

২০০৬ এর কোন একটা সময়। কাঁধের ওপর ততদিনে উঠে গেছে তিন স্ট্রাইপ। গেমস টাইমে খেলা,ব্লক ক্রিকেট, আম-কাঁঠাল চুরি, স্যারদের টিজ করা আর ক্লাস বাঙ্ক মারা। জীবন যাপন মোটামুটি এ কয়টা জিনিসের মাঝেই আটকে আছে। পিঠের কাছে সদ্য গজানো পাঙ্খা নিয়ে ইকারাসের দূর সম্পর্কের চাচাত ভাই ভাবা শুরু করেছি নিজেদের।

সামনে একমাত্র বড় ইভেন্ট বলতে ফুটবল বিশ্বকাপ। হিসেব কষে দেখলাম ক্যাডেট লাইফে আর কোন বিশ্বকাপ পাওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই।  বিদেশী লীগের সাথে পরিচয়টা সবে হচ্ছে। এন ডি এমের চোখ এড়িয়ে চ্যাম্পিয়ন্স লীগের খেলা সেবারই দেখা শুরু করেছি। তারপরেও জাতীয় দলের প্লেয়ার চিনিনা বললেই চলে। তাতে কি? তাই বলে কি ক্যাডেট বসে থাকবে নাকি? কাজ বাকি অনেক। তাছাড়া জুনিওর গ্রুপের লিডার হিসেবে মর্যাদার একটা ব্যাপারও আছে। এসব মাথায় রেখে বিশ্বকাপের মাস খানেক আগে থেকেই শুরু করে দিলাম ফুটবল লীগ। আফটারনুন প্রেপে টীম ক্যাপ্টেনরা ট্যাক্টিকাল মারপ্যাঁচ খোঁজে। বিকেলটা যায় একরাশ আনন্দ মিছিলের মত। তারপর সেভেন আপের বোতলে এক পশলা শান্তি। ইভেনিং প্রেপে ঘাড় ফুলিয়ে ইউরোপিয়ান লিগের তর্ক আর নাইট প্রেপের সম্বল কাঠের ডেস্কটাই।

সম্ভবত হাউজ কালারের জন্যই তিতুমীর হাউজে ব্রাজিলিয়ান সমর্থক ছিল বেশি আর ভাসানী হাউজে আর্জেন্টাইন। ফলাফল যা হওয়ার তাই। আর্জেন্টিনা-ব্রাজিল যুদ্ধটাকে আমরা ক্লাসিক্যাল ভাসানী-তিতুমীর হাউজ রাইভালরী বানিয়ে ফেললাম। আর যুদ্ধের শুরু পতাকা থেকে।

ব্রাজিলের পতাকা বানানোটা বেশ ঝামেলার। সবুজ টেবিল ক্লথের মাঝে হলুদ কাপর। তার মাঝে নীল রঙের গোল্লা। অনেক জটিল ব্যাপারস্যাপার। সেদিক দিয়ে আর্জেন্টিনার পতাকা বানানো অনেক সহজ। নীল টেবিল ক্লথের মাঝ বরাবর একটা সাদা আর্ট পেপার। ব্যাস । কেল্লা ফতে। তিতুমির আর ভাসানী হাউজের বেশিরভাগ টেবিল ক্লথের বুকে জায়গা নিল ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা। এ পর্যন্ত সব ঠিকই ছিল। একদিন রেস্ট টাইমে আবিষ্কার করলাম তিতুমীর হাউজে জাম্বু সাইজের এক ব্রাজিলের পতাকা ঝোলানো। না না না। এই ঘোর অন্যায় কোন ভাবেই মেনে নেয়া যায় না। কোনভাবেই না। কোমর বেধে নামলাম এর একটা বিহিত করার জন্য। কিন্তু এত বড় আকাশী নীল কাপড় কই পাব? এমন সময় আমাদের বিশিষ্ট সুবোধ বালক সালেহিন এগিয়ে এল এই সমস্যা সমাধানের। “আরে মামা, নীল কাপড় নাই তো কি হইছে? কাপড়ে দেওয়ার নীল তো আছে। যা একটা বেডশীট আর বালতি নিয়া আয়। বাকিটা আমি দেখতেসি।’’  পরবর্তী আধা ঘন্টার প্রচেষ্টার ফসলকে আর যাই হোক আর্জেন্টিনার পতাকা বলা যায় না। ভাগ্যিস। আর্জেন্টাইন দূতাবাস বাংলাদেশে নেই। নির্ঘাত জাতীয় পতাকা অবমাননার দায়ে সব কয়টা ফেসে যেতাম।

কলেজের সেন্ট্রাল পানির ট্যাঙ্কটা ছিল আমাদের হাউজের ঠিক পেছনে। হলুদ রঙা বিশাল সাইজের এই পানির ট্যাঙ্কটার অন্যরকম একটা মাহাত্ম্য ছিল। ক্লাস সেভেনের জুনিওর পোলাপানগুলাকে ভয় দেখানোর যাবতীয় ভৌতিক গল্পগুলোর জন্মস্থান ছিল এই ট্যাঙ্কিকে ঘিরে। এছাড়াও আরেকটা বিশেষত্ব ছিল ট্যাঙ্কিটার। কলেজের সবচেয়ে উঁচু জায়গা হিসেবে প্রতি ব্যাচের মকড়া ক্যাডেটদের শুভ দৃষ্টি ছিল এর ওপর। তাই ট্যাঙ্কির উপর ওঠাটা ছিল একটা শিল্পের ব্যাপার। আসল ঘটনায় ফেরা যাক। খেলা শুরু হওয়ার আর কদিন বাকি। পিটিতে যাওয়ার সেকেন্ড বেল দিবে কিছুক্ষনের মাঝে। মুখে ব্রাশ পুরে দৌড়াচ্ছি বাথরুমের দিকে। জুনিওর ব্লকের সামনে দেখি কয়েকটা ক্লাস এইট হা করে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে।সাথে দুইটা ক্লাস সেভেনও ইতি উতি তাকাচ্ছে। ভাবলাম খুশির খবর নাকি। বৃষ্টি বাদলা হলে তো ভাল কথা। আরেক রাউন্ড ঘুম দেয়া যাবে। উপরের দিকে তাকিয়ে দেখি বিশাল সাইজের একটা ব্রাজিলের পতাকা ট্যাঙ্কির গা বেয়ে ঝুলছে। ২৪ ব্যাচ তখন লিডিং এ। কলেজের যাবতীয় অপকর্ম (!!) কে তারা মোটামুটি শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেছে। এই জিনিস নির্ঘাত ভাইদের কাজ। পরের ঘটনা আর বলার মত না। পিটি টাইমে ব্রাজিলিয়ান সাপোর্টারগুলোকে আর পায় কে? ভাবখানা এমন এই কাজ তাদের প্রত্যেকের একার করা। পরের দিন আবার লেট থেকে বাঁচার জন্য দৌড়াদৌড়ি করে বাথরুমের দিকে যাচ্ছি। আবার দেখি কয়েকটা ক্লাস এইট হা করে আকাশ দেখে। গ্রো আপ গাইজ। সাপোর্ট কর একটা দল ভাল কথা। তাই বলে সারাদিন হা করে তাদের পতাকা গিলতে হবে নাকি? অনিচ্ছা সত্যেও উপরের দিকে তাকালাম। ওমা। কই ব্রাজিলিয়ান সাম্বা? এ দেখি আর্জেন্টাইন ট্যাংগো নাচে। ব্রাজিলের পতাকার কোন নাম নিশানা নেই। সে জায়গায় নীল সাদা পতাকা ঝুলে আছে। ভাইয়াদের রাইভালরীতে পুরো কলেজে একটা টানটান উত্তেজনার আবহ তৈরি হয়ে গেল। ক্যাডেট, স্টাফ , স্যার-ম্যাডাম সবার কথার টপিক ট্যাঙ্কির উপরের পতাকা। এ সব দেখে এডজুটেন্ট মুস্তাইন স্যারের মাথা খারাপ হওয়ার জোগাড়। পিটি শুরুর আগে দেখলাম স্যার সি এস এমের সাথে গুজুর গুজুর করছে। স্টাফদের মধ্যে সবচেয়ে মাল টাইপ স্টাফ ছিল ওমর ফারুক স্টাফ। দুর্ভাগ্যজনক ভাবে সে আবার আমাদের হাউজ স্টাফ। পিটিতে আমরা প্রাণপণে সাইড জাম্প দিচ্ছি আর স্টাফ বলছে,

–হেহ হে। খুব মজা পাইছেন না?? দিনে একবার করে পতাকা পাল্টানোর উছিলায় টাঙ্কির উপরে উঠতেছেন? দাড়ান। এডজুটেন্ট স্যার চেতসে। কে করছেন ঠিক খুইজা বের করবে। আমার অবশ্য ধারণা এই কাজ মাক্ষি রেজার। (ব্যাক্তিগত নিরাপত্তার খাতিরে পুরো নাম দেয়া হল না। তবে হিন্টস দেয়া যায়। ভাই সি সি বি র একজন ডাকসাইটে লেখক।)

অবশ্য এডজুটেন্ট স্যারের কপাল খারপই বলতে হবে। পরের দিন মনে হয় স্যারকে ভেংচি কাটার জন্যই দুইটা পতাকাই একসাথে ট্যাঙ্কি থেকে ঝুলতে দেখা গেল।

বিশ্বকাপ জ্বরে পুরো কলেজ তখন হি হি করে কাপছি। ফর্ম মাস্টারকে বলে কয়ে কাগজ কেনা হল ফুটবল থিমের ডিসপ্লে বোর্ড বানানোর জন্য। নতুন করে আর বলতে হবে না যে ক্লাস বাঙ্ক মারার সবচেয়ে কার্যকরী উপায় হচ্ছে ডিসপ্লে বোর্ডের কাজ করা। যাকে বলে হাইডিং ইন প্লেইন সাইট। কে কাজ করবে এ ব্যাপারে এক মত না হয়ে একরকম একাডেমী অচল হয়ে গেল। স্যার ক্লাসে আসেন। কিছুক্ষন গাই গুই করেন। অতঃপর ক্ষান্ত দিয়ে ক্লাস টাইম পার করেন। আর ডিসপ্লে বোর্ডে একে একে জীবন্ত হয়ে ওঠে মেসি-ভিয়া-পাভেল-দ্রগবা-জেরার্ডরা।

তখন কলেজ সি এস এম ছিল রফিক স্টাফ। পিটি গ্রাউন্ডে ক্লাস নাইন ফলিন করে দাড়িয়ে আছি। মন মেজাজ খুব একটা ভাল না। একে রাতে খেলা দেখার জন্য ঘুম হয়নি, তার উপর ম্যাচ হেরে গেছি। এমন সময় স্টাফ এসে বলল,

-ক্লাস নাইন সাআআবধান,আপনাদের মধ্যে আর্জেন্টিনা পার্টি কে কে? এক কদম সামনে গুনে চল। আপনাদের জন্যে একটা খারাপ খবর আছে।
-জ্বী স্টাফ জানি। কালকে আর্জেন্টিনা হারসে।

-আরে হারসে তো সেটা জানেনই। কালকে ওদের গোলকিপার আহত হইসে না? ও তো মইরা গেছে।

এই খবরে আর্জেন্টাইন সমর্থক পোলাপানের মাথায় বিনা মেঘে এক্কেরে ঠাডা। কিছুক্ষন এর ওর মুখ চাওয়াচাওয়ি করে জিনিসটা ঠাহর করার চেষ্টা করলাম। স্টাফ কি মজা নিল? আমাদের মাঝে সবচেয়ে বড় আর্জেন্টাইন সমর্থক ছিল আরমান। কাঁদো কাঁদো গলায় বলল “স্টাফ এইসব কি কন?”

রফিক স্টাফ ভারিক্কি একটা চাহনী দিয়ে বলল, “মন খারাপ কইরো না, হায়াত মউত সব আল্লাহর হাতে। ওকে প্যারেড দৌড়েএএএ ছল।’’ এদিকে আরমানের চেহারার দিকে তাকানো যায় না। পাংশু মুখে ছেলেটা ঘুরে বেরায়। ক্লাসে আনমনা হয়ে সিলিং ফ্যান দেখে। ফুটবল মাঠে ড্রিবল করতে ভুলে যায়। আরমানের দুঃখে আকাশ কাঁদে, বাতাস কাঁদে। ডাইনিং হলের কুত্তাও কাঁদে। ছেলেটা স্টাফের কথা যাচাইয়ের জন্য হন্যে হয়ে পেপার খোঁজে। আমরা সবাই একবার করে আরমানের মন ভাল করার চেষ্টা করতে গিয়ে ব্যর্থ। অবশেষে তার মন ভাল করতে পারল থিয়েরী অরি। ব্রাজিলের বিপক্ষে একমাত্র গোল। ফলাফল পরের দিন বন্ধুবরের মুখে আকর্ণ বিস্তৃত হাসি।

বিশ্বকাপ শেষ হয়। তর্ক শেষ হয় আরও কিছু দিন পর। মাথায় ঢুকিয়ে যায় ফুটবলের পোকা। পরের তিন বছর যে পোকার অত্যাচারে রেড বুকের হাজার খানেক আইন ভেঙ্গে পার করেছি অজস্র বিনিদ্র রাত । মাঝখানে পেরিয়ে গেছে আট বছর। বিশ্বকাপের মঞ্চটা ঠিক আগের মতই আছে। শুধু পরিবর্তন হয়েছে নায়কের। ক্রেসপো-রোনালদো-বালাক-জিদানের জায়গাটা এখন মেসি-ক্রিশ্চিয়ানো-সুয়ারেজ-রুনিদের দখলে। উৎসবের রং এখনো নীল সাদা কিংবা সবুজ হলুদ। আর মাঝ রাতে একা একা খেলা দেখা কিছু যুবকের কাছে সেটা বিবর্ণ ধূসর।নস্টালজিক। যুবকদের একটা নাম আছে। নামটা এক্স ক্যাডেট।

৩০ টি মন্তব্য : “ধূসর নস্টালজিয়া”

      • মোকাব্বির (৯৮-০৪)

        বিশেষ কোন কারণ না থাকলে সিসিবি থেকে লগ অফ করা হয় না! ইদানিং ল্যাপটপের সামনেই বেশী থাকা হয়। তাই নতুন কিছু চোখে পড়লেই :gulli2: :))

        ফুটবল নিয়ে আগ্রহ কম কিন্তু এবারের প্রত্যেকটা লেখ মন দিয়ে পড়ছি। স্মৃতিচারণের মত এরচেয়ে ভাল কিছু হতে পারে না। আর এর জন্য ফুটবলপ্রেমী হওয়া লাগে না! চমৎকার লাগলো! :thumbup: :thumbup:


        \\\তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা
        অবুঝ শিশু হামাগুড়ি দিল পিতামাতার লাশের ওপর।\\\

        জবাব দিন
  1. পারভেজ (৭৮-৮৪)

    ভালো লাগলো।
    বিশ্বকাপের মত ক্যাডেট কলেজগুলিতেও মানুষ বদলায় চরিত্রগুলো বদলায় না।
    সব ব্যাচেই দুচারটা কবি, গায়ক, আকিয়ে, সবজান্তা যেমন থাকে, দুচারটা বদের হাড্ডীও থাকে।
    একব্যাচে তাঁদের নাম রহিম হলে অন্যব্যাচে করিম কিন্তু কাজ তার ঐ কোন একটাই করে এবং তা খুব ভাল করেই।


    Do not argue with an idiot they drag you down to their level and beat you with experience.

    জবাব দিন
  2. সোহান (২০০৪-১০)

    বন্ধু তুমিও আয়া পরলা?? ভালাই। তা লেখ একটা। ভাইদের ডাক দেই। কিছু ফ্রন্টরোল লাগাবা নে। :p


    আমি সিগারেটের ছাই, জানালার ধুলো। চাইলেই ফু দিতে পার। ঊড়ে যাব।

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : মোকাব্বির (১৯৯৮-২০০৪)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।