AIM IN LIFE

উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত ইংরেজি দ্বিতীয় পত্রে প্যারাগ্রাফ নামের একটা জিনিস ছিল । তো সেই প্যারাগ্রাফের নানা রঙ ,নানা ঢং। একবারের বিষয় আমার মেনি বিড়াল তো আরেকবারের বিষয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি । তবে সুবিধাও ছিল । ক্যাডেট কলেজের বদৌলতে আর পাঁচটা ক্যাডেটের মত এই বস্তু পড়ার হ্যাপা কখনও পোহাতাম না । -ধুর মামা, প্যারাগ্রাফ পড়া লাগে নাকি? ওইটা তো এমনি লেখা যায় । সিভিল বন্ধুদের সামনে পার্টটা ছিল দেখার মত।

দিন তারিখের মারপ্যাঁচে দেখতে দেখতে বয়সটা কম হয়নি । কলেজও ছেড়েছি বেশ আগেই । জীবনের প্রাপ্তি অপ্রাপ্তির খেরোখাতা নিয়ে মাঝে মধ্যেই বসে যাই । ভাবটা এমন, আর যাই হোক মানুষ (!!) তো হতে হবে । কিছুদিন আগের কথা । এক ছোটভাইয়ের প্যারাগ্রাফ সংক্রান্ত দুশ্চিন্তা দেখে নিজের কথাই মনে পড়ল । আচ্ছা, আমার কাছে কোন প্যারাগ্রাফটা কঠিন লাগত? হাস্যকর হলেও সত্যি টপিকটার নাম হচ্ছে AIM IN LIFE. আমার জীবনের লক্ষ্য । কারণটা খুব বেশি জটিল না । লেখার জন্য বরাদ্ধ গুটিকয় মিনিটের বেশিরভাগই কাটত কোন প্রফেশনের কথা লিখব তা ভেবে ।

খুব ছোটবেলার কথা । মনের ইচ্ছা ছিল পাইলট হব । কারন খুব সোজা । যান জটের কোন ঝামেলা নেই । ইচ্ছা করলেই শোঁ করে উড়ে যাব যেখানে খুশি । উপরি পাওনা হিসেবে মেঘের দৃশ্যটা মন্দ হবে না । একদিন একতলা বাসার ছাদ থেকে লাফ দিয়ে পানিতে পড়ার আগে বুঝলাম উচ্চতা জিনিসটা বড় বেরসিক। নাহ । প্লেন চালানো সম্ভব না । তারচেয়ে বরং নতুন সাইকেলটা চালাই ।

“বাবুদের তাল পুকুরে, হাবুদের ডাল কুকুরে” নজরুলের কবিতা পড়তে পড়তে মনে হল- নাহ, বাংলা সাহিত্যে আরেকটা নজরুল না হলেই নয় । এই গুরু দায়িত্ব নিজের কাধে নিয়ে লিখে ফেললাম ক্লাসের সবচেয়ে সুন্দরী মেয়েটাকে নিয়ে দুই লাইন । লিচু চোরের মত সেই কবিতা গিয়ে পড়ল মালির ঘাড়ে । মানে আমার আম্মাজানের কাছে । রাম ধোলাই খাওয়ার পরে পশ্চাদ্দেশ মালিশ করতে করতে ভাবলাম দেশ একজন কালজয়ী কবি হারাল । এই দোষ পুরাই আম্মার । ইতিহাস তাকে কখনও ক্ষমা করবে না ।

নাইন-টেনে পড়ার সময় সুপারহিরোদের সাথে প্রথম পরিচয় । ফ্যান্টাসির দুনিয়া বলতে সুপারম্যান, ব্যাটম্যান আর স্পাইডারম্যান । এমন সময় মাথায় ঢুকল আরেক ভূত । ব্যাটম্যান হওয়াই লাগবে। নইলে জীবনটাই বৃথা । মিনিট দশেক পরে মনে পড়ল আমার আব্বাজানের চেয়ে ব্রুস ওয়েনের ভাড়া করা কামলারও বেতন বেশি। ধুর, এইটা কিছু হইল? ব্যাটম্যানও হতে পারলাম না। আব্বার উপর রাগ ছিল অনেকদিন।

টিনেজে বয়স তখন । মনটা উড়ুউড়ু। প্রতিদিন প্রেমে পড়ি গড়ে বার পাঁচেক। ভিন্ন ভিন্ন ললনার প্রতি ভালবাসায় আমার তখন ভাংচুর অবস্থা । সমস্যা একটাই । আমার অজাতশ্মশ্রু চেহারা দেখে কেউই প্রেমের ব্যাপারটা সিরিয়াসলি নেয় না । এমন সময় সিদ্ধান্ত নিলাম দার্শনিক তো এবার হতেই হবে। ঝাঁকড়া চুল, বাবরি দাড়ি আর শান্তিনিকেতনি ব্যাগ কাঁধে না ঝোলালে হচ্ছেনা। তখন নিশ্চয়ই সবাই সিরিয়াসলি নিবে।
ফিলসফির সাথে মনস্তত্ব নিয়েও পড়াশোনাটা চালিয়ে যেতে হবে। এক ঢিলে দুই পাখি । দুটো স্বপ্নই ভেঙ্গে গেল জীবনের প্রথম ছ্যাকা খেয়ে। ধুর, এক নারীর মনই পড়তে পারিনা। আমি আবার হব মনস্তাত্বিক? আর দর্শন? সেটার দৌড় তো ‘হায় সেলুকাস’ পর্যন্ত গিয়েই আটকে আছে।

কষ্টে সৃষ্টে মাধ্যমিক পাস করার পর মনের মধ্যে সিরিয়াস ভয় ঢুকল । নাহ এবার তো সিদ্ধান্ত নিতেই হয় । ডাক্তারি পেশাটার কথা মনের মাঝে গোটা দুয়েকবার উঁকি দিলেও বেশি পাত্তা দিলাম না । আরে ভাই, এস এস সিই তো পাশ করলাম আরেকজনের খাতা আর তাবিজের কল্যাণে । ডাক্তার হব কেমনে? উপায়ন্তর না দেখে ভাবলাম সেনাবাহিনীই ভাল। গা গতর খাটাব, মাসে মাসে টাকা তুলব, বয়সকালে বেসম্ভব সুন্দরী কোন ললনাকে বিয়ে করে থিতু হব । সব দিক দিয়েই ফুল প্রুফ প্ল্যান । গেলামও একাডেমী পর্যন্ত । মাইল টেস্টের জ্বালা সহ্য না করতে পেরে ভাবলাম, খ্যাতা পুড়ি সুন্দরী বউয়ের । পিটির জ্বালায় নিজেরই ত্রাহি মধুসূদন অবস্থা । প্লাটুন কমান্ডারের মুখে ঝামটা মেরে চলেও আসলাম বছরখানেক পর । শেষ মেশ ভাবলাম গিটারিস্ট হতেই হবে । ডুড । চিকস ডিগ অন দেম। ডাইম ব্যাগ ড্যারেল না হোক আমাদের
দেশি শাফিন আহমেদ তো হতেই পারি । গিটার বাজাতে গিয়ে হাতে গিট্টু লাগার মত অবস্থা হলে মনে হয় গিটারের তার ছয়টার যায়গায় তিনটা হলে কোন সমস্যা ছিল? জীবনটা এত প্যাড়ার ক্যারে?

সাত ঘাটের জল খেয়ে এখন কোন এক বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রকৌশলে পড়ছি। ক্লাস, অ্যাসাইনমেন্ট, কুইজের চাপে চ্যাপ্টা হয়ে চুল ছেঁড়ার সময় ভাবি সন্ন্যাসী হলে মন্দ কি। সমস্যা হল ধ্যান করার জন্যে বড়-সড় একটা নীরব জঙ্গল পাওয়া। সুন্দরবনেতো আমার চেয়ে বড় সন্ন্যাসীরা বিদ্যুতের খুঁটি লাগানো নিয়ে ব্যস্ত। আর হিমালয়েও ঝামেলা। ভিসা পাসপোর্টের ঝামেলায় আর যেতে ইচ্ছা করে নারে ভাই। তার উপরে হালকা টনসিলের ঝামেলা আছে কিনা?

শেষ মেশ কোন কিছুই বুঝতে না পেরে বুক ভরে সিগারেটের ধোঁয়া নিয়ে আকাশটার দিকে তাকাই। সবচেয়ে কাছের বন্ধুটি কাঁধে হাত দিয়ে বলে, “গায়ে হাওয়া লাগিয়ে চললে হবে দোস্ত? পড়াশোনা করে বড় মানুষ হতে হবে না?” উত্তর দিতে পারিনা। এ প্রশ্নের উত্তর আমার জানা নেই।

কিছু হওয়া আর হয়ে উঠছে না। ছোট বেলায় পড়া আল-মাহমুদের ছড়াটাই মাঝে-মাঝেই মনে পড়ে।

“তোমরা যখন পড়ছ পড়া মানুষ হবার জন্য,
আমি নাহয় পাখি হব, পাখির মতো বন্য…”

কি হবে মানুষ হয়ে ? ? ? ?

২৩ টি মন্তব্য : “AIM IN LIFE”

  1. দিবস (২০০২-২০০৮)

    কয়েক হাজার এইম নিয়ে শুরু করা জীবনে কেটে ছিটে এখনো ৫-১০ টার মত সাথে নিয়ে চলতেছি। আহা টিন-এইজ, সেই গোল্ডলিফ এইজ!

    লেখা চমৎকার হইছে। জ্যাম জট শব্দটা যান জট হবে সম্ভবত। চেক করে নিও।

    ব্লগে স্বাগতম এখন কুইক ১০ টা লাগায় ফালাও। :grr:


    হেরে যাব বলে তো স্বপ্ন দেখি নি

    জবাব দিন
    • সোহান (২০০৪-১০)

      দোস্ত কি হতে পারতাম আর কি হতে পারলাম না এটা নিয়ে কখনো আফসোস করিনি। কোনমতে পোডিয়াম হয়ত পার হতে পারতাম। কিন্তু থাকতে পারতাম না। আর বললামই তো পাখি হতেই চাইছি। বন্য পাখি, খাঁচার পাখি না। 🙂


      আমি সিগারেটের ছাই, জানালার ধুলো। চাইলেই ফু দিতে পার। ঊড়ে যাব।

      জবাব দিন
  2. তাহমিনা শবনম (৮৪-৯০)

    লেখাটা ভাল হইসে।
    বন্য পাখি হবার আইডিয়াও ভাল্লাগলো!
    বনে যাবার আগে খালি উড়ানটা শিখ্যা যাও।


    আমি চোখ মেললুম আকাশে
    জ্বলে উঠলো আলো পূবে পশ্চিমে

    জবাব দিন
  3. শাহীন (৯৬-০২)

    জীবনে কি করতে চাই এইটা বের করাই সব থেকে জটিল বিষয়।
    ৩ ইডিয়েটস মুভির উদাহরন দেই, ওইটাই করো যা তোমার করতে ভাল লাগে।
    সবশেষে তো লক্ষ্য একটাই। খুশি থাকা।


    The Bond Cadet

    জবাব দিন
  4. শাফি (০৬-১২)
    কোনমতে পোডিয়াম পার হতে পারতাম।কিন্তু থাকতে পারতাম না।আর বললামই তো পাখি হতেই চাইছি। বন্য পাখি, খাঁচার পাখি না।"

    আমার মত মানুষ আছে তাহলে। 🙂 🙂


    তোমাকে সালাম ^:)^

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : সোহান (২০০৪-১০)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।