ব্যক্তিগত অপেক্ষাঃ শুভ বিবাহবার্ষিকী

আমার কচ ও দেবযানী

“যেদিন গেলেন পিতা, দেখলাম মা’কে–
জননী আমার নির্দ্বিধায় শান্ত তাঁকে
নিলেন প্রবল টেনে বুকে, রাখলেন
মুখে মুখ ; যেন প্রিয় ব’লে ডাকবেন
বাসরের স্বরে । এখনো আমার কাছে
সেই দৃশ্য সবচেয়ে গাঢ় হ’য়ে আছে !”

(কোন দৃশ্য সবচেয়ে গাঢ় হ’য়ে আছে ?-শামসুর রাহমান)

নাহ, আমি সেই দৃশ্যপটে ছিলাম না।

আব্বা যেদিন গেলেন, আম্মা নাকি তাকে বিদায় দেন নাই।
হয়তো অবুঝ অভিমানে; অথবা, মাত্র কয়েক ঘন্টা পরেই আবার দেখা হবে- মনে মনে জানতেন সে কথা…

একসাথে পথ চলি আমরা অনেকেই। কিন্তু পথের শেষ একইসাথে দেখতে পারি কয়জনা?

আজ সেই পথচলা শুরুর ৪৬ বছর। যেদিন সকালে “বিদায় অভিশাপ” শুনে ঘুম ভাঙতো, আমি জানতাম আজ আমাদের কচ আর দেবযানীর সেই বিশেষ দিন। অথবা কোন বর্ষার বছরে, ঘুম ভাঙাতো চাপা অথচ গাঢ় দ্বৈত কন্ঠের “এমনি দিনে তারে বলা যায়…”। আমি তখন হাফপ্যান্ট পরি, আমাদের ঢাকাও তখন অনেক বেশি সবুজ আর মানবিক শহর। আমরা এই দিনে রিকশায় করে সেই সবুজ শহরের নিতান্ত সাধারণ সব জায়গায় ঘুরে বেড়াতাম।কখনো লালবাগ কেল্লা, কখনো শিশুপার্ক, কখনো বা মধুমিতা’র ম্যাটিনী শো। তারপরে রাতের খাবার; সবচেয়ে বেশিবার গেছি স্টেডিয়াম মার্কেটের দোতলার ‘প্রভিন্সিয়াল রেস্তোরা’য়। আরো ছিল বিজয়নগরের ‘সকাল-সন্ধ্যা’, তোপখানা রোডের ‘ক্যাফে ঝিল’; একবার গুলিস্তান থেকে হাঁটতে হাঁটতে ঠাটারীবাজারের ‘স্টার হোটেল’ এ যাবার কথাও মনে পড়ে।

উপহারের ব্যাপারে আম্মা ছিলেন অনেক সৌখিন। আমাকে সাথে নিয়েই মৌচাক মার্কেট থেকে আব্বার জন্য একবার কিনেছিলেন “ওয়ান ম্যান শো”। কয়েক বছর পর্যন্ত যেকোন বিয়ের দাওয়াতে যাওয়ার সময় আমরা ভাই-বোন, আব্বা-আম্মা সবাই মিলে সেই একই সুগন্ধী মাখতাম;লেডিস পারফিউম আর জেন্টস পারফিউমের পার্থক্য তো শিখেছি অনেক পরে। কখনো এলিফেন্ট রোডের ‘গীতাঞ্জলি’ থেকে রেকর্ড করায়ে দিতেন পছন্দের গান নিয়ে একটা ক্যাসেট; সতীনাথ, মানবেন্দ্র,জগন্ময় মিত্র। আরেকবার, একটা রেড লেবেলের বোতলে ভরা কনকচাঁপা ফুলের পাপড়ি- এখনো আমাদের বাসায় আছে; শুকায় নাই। সেই তুলনায় আব্বাকে কখনো আড়ম্বর করে কোন উপহার দিতে দেখি নাই। শুধু পরের দিন আম্মা যখন আমাকে স্কুল থেকে আনতে যেতেন, দেখতাম পরনে একটা নতুন সুতির শাড়ি।

এভাবেই বিশে সেপ্টেম্বর আমাদের মত আটপৌরে মধ্যবিত্তের নিস্তরঙ্গ জীবনে একটা বিশেষ অপেক্ষার দিন ছিল। একটা ঢেউয়ের অপেক্ষা।

আজ আবার সেই দিন। অনেকদিন আগের সেই ছোট্ট আমার মত প্রবল উত্তেজনায় ঘুম ভেঙ্গে যায়। আমি রূদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করতে থাকি…

আজ কি আমি আবার কচ আর দেবযানীর মান-অভিমান শুনতে পাবো?
আজ কি আমি আবার আম্মার কোলে চড়ে রিকশায় ঘুরে বেড়াবো আমাদের সেই সবুজ শহর?

২,১৭৭ বার দেখা হয়েছে

১৭ টি মন্তব্য : “ব্যক্তিগত অপেক্ষাঃ শুভ বিবাহবার্ষিকী”

  1. তাইফুর (৯২-৯৮)

    সাকেব, লেখার স্টাইল্টা ভাল লেগেছে খুব।
    আংকেল-আন্টি'কে ৪৬ তম বিবাহবার্ষিকী'র অভিনন্দন।

    লেখার কিছু কিছু জায়গা কনফিউসন তৈরি করেছে ...

    আব্বা যেদিন গেলেন, আম্মা নাকি তাকে বিদায় দেন নাই।
    হয়তো অবুঝ অভিমানে; অথবা, মাত্র কয়েক ঘন্টা পরেই আবার দেখা হবে- মনে মনে জানতেন সে কথা…

    কচ ও দেবযানী উপাখ্যান বলতে আমি যা জানি ...

    কচ ও দেবযানী উপাখ্যানঃ কচ হলেন অঙ্গিরার পৌত্র এবং দেবতাদের গুরু বৃহস্পতির পুত্র। মহাভারতে উল্লেখ আছে, কচ দেবতাদের অনুরোধে অসুরদের গুরু শুক্রের কাছ থেকে মৃতসঞ্জীবনী বিদ্যা আয়ত্ত করতে তার শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। সেখানে কচের সঙ্গে শুক্রের সুন্দরী কন্যা দেবযানীর পরিচয় হয়। কচের অভিসন্ধি বুঝতে পেরে অসুরা কচকে দু'বার হত্যা করলেও দেবযানী শুক্রকে দিয়ে সঞ্জীবনী বিদ্যা প্রয়োগ করে তাকে বাঁচিয়ে তোলে। শেষে অসুররা কচকে পুড়িয়ে তার দেহ-ভষ্ম শুক্রের পানীয়ের মধ্যে মিশিয়ে দেন। শুক্র তখন কচ-ভষ্মকে সঞ্জীবনী মন্ত্র শিখিয়ে দিয়ে বলেন যে, কচ শুক্রের শরীর থেকে বেরিয়ে আসার পর শুক্রকে বাঁচিয়ে দিতে। এভাবে সঞ্জীবনী মন্ত্র শিখে শুক্রের উদর ভেদ করে কচ বেরিয়ে এসে শুক্রকে পুনর্জীবিত করেন। এর কিছুদিন পর কচ গুরুগৃহ থেকে বিদায় নিতে চাইলে, দেবযানী তাকে বিয়ে করার প্রস্তাব দেন। কিন্তু কচ তাকে একবার বোন, আরেকবার গুরুকন্যা হিসেবে মা তুল্য বলে বিয়ে করতে অসম্মত হন। প্রত্যাখ্যাত দেবযানী তখন ক্ষুব্ধ হয়ে কচকে অভিশাপ দিয়ে বলেন, কচ তার অর্জিত বিদ্যা কখনও প্রয়োগ করতে পারবেন না। কচ তার কথা মেনে নিলেন এবং অর্জিত বিদ্যা অন্যদের শিখিয়ে দিলেন। তার এই সঞ্জীবনী বিদ্যা শেখার ফলে দেবতাদের আর অসুরদের হাতে মৃত্যুর ভয় থাকল না।


    পথ ভাবে 'আমি দেব', রথ ভাবে 'আমি',
    মূর্তি ভাবে 'আমি দেব', হাসে অন্তর্যামী॥

    জবাব দিন
  2. নূপুর কান্তি দাশ (৮৪-৯০)

    কি লিখি সাকেব!
    সবে ঘুম থেকে উঠলাম। বাইরে মেঘলা দিন আর মন হু হু করা হাওয়া।
    হঠাৎ ভীষণ কান্না পেয়ে গেলো। এমন রোমান্টিক বাবা-মা, এমন স্মৃতি কাতরতা ।
    যেন বেহালায় ভিমপলশ্রী।
    কি দারুণ একটা শৈশব দিয়ে গেছেন তোমাকে।
    বিদায় অভিশাপের কথা মনে করিয়ে দেবার জন্য ধন্যবাদ।

    রমণীর মন সখা সহস্র বর্ষেরই সাধনার ধন
    জবাব দিন
  3. কাইয়ূম (১৯৯২-১৯৯৮)

    এমন চমৎকার একটি দম্পতির সন্তান হওয়া নিঃসন্দেহে সৌভাগ্যের! নিশ্চয়ই উনারা খুব খুব ভালো আছেন অপরজীবনে।

    লেখাটায় যে আবেগ জড়িয়ে আছে এক সন্তানের, সেটি পরিমাপ করার দুঃসাহহ নেই। তবে আনন্দের স্মৃতির টুকরো টুকরো বিষাদময় বর্ণনায় হাত বাড়ালেই ছুঁতে না পারার কষ্টটা পাঠক যে কাউকেই স্পর্শ করবে 🙁
    সাকেব, আন্টির সাথে তোর চেহারার খুব মিল, নিশ্চয়ই সবসময়েই শুনে আসছিস। ভালো থাকিস।


    সংসারে প্রবল বৈরাগ্য!

    জবাব দিন
  4. সাকেব (মকক) (৯৩-৯৯)

    সবাইকে ধন্যবাদ...কোন কমেন্টের উত্তর না দেওয়ার দোষ নিজ গুণে ক্ষমা করবেন।
    এইটা লেখার পরে আমার নিজেরই অনেক মন খারাপ ছিল...তাই অনেকদিন ঢোকা হয় নাই...


    "আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
    আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস"

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : সামিয়া (৯৯-০৫)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।