খোয়াই পাড়ের গল্প।

হাতেম আলী নামে আব্বার একজন বন্ধু ছিলেন- তাঁর দেশের বাড়ি কোথায় এ মুহূর্তে আমার স্মরণে নাই। এটা মনে আছে যে, প্রায়ই তিনি রাজশাহীতে আমাদের শালবাগানের বাসায় আসতেন। তিনি এসব গল্প করতেন যে, বাড়িতে তাঁর আমার বয়সী দুই ছেলে আছে- যারা চূড়ান্ত ত্যাঁদড়। তাঁরা দিনভর গ্রামের রাস্তায় হাতেপায়ে ধুলো মেখে মার্বেল খেলে বেড়ায়। ছেলেদুটির বিদ্যার রেখা খুব বেশীদূর এগুবেনা- সেটা নিয়ে হাতেম আলীর চিন্তার শেষ ছিল না। বাসায় এসে উনি আমাকে ইংরেজীর এটা-সেটা জিজ্ঞেস করেন। আমি কিছুই পারি না, যেটা পারি- সেটাও বলি না। হাতেম আলী খুব হতাশ হন। তাঁর ছেলেদের সাথে আমার বেহাল দশার সাদৃশ্য খুঁজে পান। সাথে সাথে পণ করে ফেলেন- এবার ছুটিতে গিয়ে তাঁর ছেলেদের গ্রাম থেকে শহরে আনবেন। নাহলে দিনভর মার্বেল খেলে বড় হয়ে এরা জুয়াড়ি হবে। আমি জুয়াড়ি হব- কিনা সে ব্যাপারে তাঁর কোন ভবিষ্যৎবাণী না থাকলেও; আম্মাকে বার বার আমাকে ভাল স্কুলে ভর্তির ব্যাপারে সতর্ক করতেন।

আমার কপাল ভাল ছিল। ভাল স্কুলে ভর্তি হতে হয়নি। ভাল স্কুলে ভর্তির আগেই আমাদের রাজশাহী ছাড়ার সময় চলে আসে। শেষ যেবার উনি আমাদের বাসায় আসলেন, সাথে করে নিয়ে আসলেন- সেমাই বানানোর এক অদ্ভুত কাঁসার হাতমেশিন। আমার চোখে সেটা মসৃণভাবে পালিশ করা চোঙ্গার মত এক অদ্ভুত ধাতব খেলনা। খেলনা যে সেটা ছিলনা- সেটা হাতেম আলীও জানতেন, জানতাম আমিও। কিন্তু সে বয়সে খেলার জন্য ‘খেলনা’ না হলেও চলে। যাবতীয় অ- খেলনাসমূহ এবং নাটবল্টু সে বয়সের প্রধান খেলনা। অ-খেলনা দিয়ে কীভাবে খেলা যায়- সে ব্যাপারে নিরন্তর চেষ্টা একসময় উদ্ভাবনের দিকে চলে যায়। একদিন আবিষ্কার করলাম, হাতেম আলীর দেওয়া সেমাই মেশিনের সামনে চালুনির মত ছিদ্র ওয়ালা ডাইস আছে। কায়দা করে সেটায় সূর্যের আলো ঢুকাতে পারলে সেখানে চমৎকার এক খেলা তৈরি হয়। আলো ঢুকানোর কাজটা ছিল সবচেয়ে দুরূহ অংশ। কারণ আলো সরল রেখায় চলে- বক্রপথে যেতে তাঁর চূড়ান্ত অনীহা। তাই সামনে আয়না রেখে সেটায় প্রতিফলিত সূর্যের আলো কৌশলে চোঙ্গায় ঢুকাতে হয়। এরপর সামনে ডাইসের চালুনি ঘুরে সেটা যখন উপরে ছাদের দিকে চলে যায়; তখন দেখলাম- সেখানে ছায়া ঝিরঝিরে এক অভাবনীয় আলোর ফোয়ারা তৈরি হয়। অজস্র আলোর সন্তানেরা সবে মিলে ঘরের ছাদে কী এক অপূর্ব সূর্যনকশা করে! আমার কেন যেন মনে হত, ছায়ার নীচে বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে কম্পমান এসব আলোক শিশুদের বয়স তিনমাস। বড় কোমল তাঁদের চলন-বলন। আয়নার বিন্দু মাত্র এদিকে সেদিকে তাঁদের মন খারাপ হয়।

পরের গল্পটা এমন যে, সেই সেমাই মেশিনে কোনদিন আমাদের বাড়িতে সেমাই বানানো হয়নি। আমি সেটাকে খেলনা হিসেবে আমার দখলেই রাখলাম ৯৭ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত। সে বছর নতুন পেপার পড়া শিখেছি। বানান করে পড়তে হয় না। মোড়ের দোকানে গিয়ে পেপার পড়ে আসি। অক্টোবর ৩০ তারিখ। সেদিন খবরের শিরোনামটা ঠিক- শিরোনাম ছিল না। এটা হয়তো অন্য কিছু ছিল। খবরটা অন্যরকম- সিলেটের তামাবিলে বি এস এফের গুলিতে একজন বিডিআর সদস্য নিহত। নিহত সদস্যের লাশ এখনও ভারতের ভেতরে। তামাবিলের পাথর শ্রমিকদের একজন’কে বিএসএফ নদী থেকে জোর করে তুলে নিয়ে যাচ্ছিল। তাঁকে ফিরিয়ে আনার তাৎক্ষণিক প্রচেষ্টায় বাঁধা দেন বিডিআরের সেই সদস্য লোকটি। টহল বিএসএফের দল তাঁকেও ধরে নিয়ে যায়। এরপর খুব কাছ থেকে তাঁর মাথায় গুলি করা হয়। নিহত বিডিআর সদস্যের নাম হাতেম আলী পাটোয়ারী, ২১ রাইফেলস ব্যাটালিয়ন।

বিডিআর বিশাল বাহিনী। এতো লোক। আর একই নামের কত লোক! খবরের নিহত লোকটির জন্য আমরা কষ্ট হয়তো পেলাম। আমি আর মা। তবে সেটার আবহ বদল হয় আব্বার চিঠি পাবার পর। সেদিন প্রথম নিশ্চিত হই, খবরের হাতেম আলীকে আমরা চিনি। তাঁর দুই ছেলে। যে ছেলেদুটো গ্রামের পথে পথে সারাদিন হাতে ধুলো মেখে মার্বেল খেলে বেড়ায়। আর যারা বড় হয়ে জুয়াড়ি হবে- এমনটা তাঁদের বাবা’র আশংকা ছিল। তবে তাঁদের বাবা শেষ পর্যন্ত তাঁদের ভালো স্কুলে ভর্তি করেছিল কিনা- সে খবর আমাদের অজ্ঞাতেই থেকে যায়।

এরপর একদিন রাজশাহীতে উপহার পাওয়া কাঁসার সেমাই মেশিনটি হুট করেই আমার কাছ থেকে বেদখল হয়। আমার মা’কে দেখি খুব যত্ন করে সেমাই মেশিনটি’কে তারের জালি টানা কাঠের আলমারিতে তুলে রাখলেন। একদম অনেক উপরে, ধরাছোঁয়ার বাইরে। যেখানে সেমাই মেশিনটি রাখলেন- সেখানে জানালা গলে সকালের প্রথম সূর্যটুকু এসে পড়ে। আমি দেখি, সেটার উপর আলো পড়লে আলোদের বয়স কমে যায়। তিন মাস বয়সী অজস্র আলোর সন্তানেরা ধাতব সে খেলনার শরীর জুড়ে ঘুরে বেড়ায়। বড় নিরন্তর ছুটাছুটি তাঁদের! কী এক অলঙ্ঘনীয় হাহাকার তাঁরা ছড়িয়ে দিয়ে যায় প্রতিদিন- এঘর- ওঘর।

আমরা বৃদ্ধ হই, জরা’র আগমনী খবরে আমাদের চোখে বিহ্বলতা চলে আসে। শুধু আমাদের সেই সেমাই মেশিনটা এখনও আগের মত চকচকে। প্রতিদিন সকালে জানালা গলে ঘরে ঢুকে পড়া সূর্যের সাহসী যে কিরণ- সে হয়তো একজন বাবা; আর কাঠের আলমারি জুড়ে ঠিকরে পড়া তাঁর অজস্র আলোক সন্তান।

খোয়াই পাড়ের গল্পটিঃ

হাতেম আলীর স্মরণে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের অদূরে শ্রীপুর পাথর কোয়ারীতে একটি স্মৃতিস্তম্ভ বানিয়েছিল সেখানের পাথর শ্রমিকে’রা। পাশে প্রবাহমান অগভীর নদীটির বুক থেকে পাথর তুলে এনে সেটা তৈরি। এবার ছুটিতে দেশে বিচ্ছিন্ন ঘুরে-বেড়ানো দিনগুলোর কোন একদিনে, হুট করেই খোয়াই নদীর পাড়ে স্মৃতিস্তম্ভটি আমার চোখে পড়ে যায়। আমি দেখি, কারা যেন বহুকাল আগে একটা হিজল গাছ লাগিয়েছিল সেটার উপরে। সে হিজল গাছ ঘন সবুজ পাতা ছড়িয়ে এখন শিশু থেকে যুবক। খোয়াই নদীর পাড়ে স্মৃতিস্তম্ভটি সব সময় তাঁর ছায়ায় ঢাকা থাকে।

১,২৮২ বার দেখা হয়েছে

৮ টি মন্তব্য : “খোয়াই পাড়ের গল্প।”

  1. নূপুর কান্তি দাশ (৮৪-৯০)

    সূর্যের সাহসী কিরণকে একজন বাবা মনে হওয়া! আর সেই বাবার তিনমাস বয়েসী আলোক সন্তানেরা, যারা মানবসন্তান হলে মার্বেল খেলে ধুলোময় হয়ে থাকতে চাইতো -- যারা হয়তো তামাবিল সীমান্ত পেরিয়ে সূর্যপিতার গুলিবিদ্ধ খুলির রক্তক্ষরণ রোধ করতে চাইতো তাদের আলমারীর ওই উঁচু শেলফে কেমন অসহায় বোধ হয় বুঝতে পারি।
    সূর্যের সাহসী কিরণ বুকে পিঠে ধুলোর মতন মেখে সারা ঘরময় তারা নেচে বেড়াক, তারা মুক্তিলাভ করুক। হাতেম আলীর গুলিবিদ্ধ কবরে ঘাসফুল ফুটুক, আলোর ফুলঝুরি ঝরুক।

    জবাব দিন
  2. পারভেজ (৭৮-৮৪)

    বিডিআর এক অদ্ভুত বাহিনী ছিল। দ্বৈততায় ভরপুর। কত যে না জানা বিরত্ব গাঁথা আছে তাঁদের!
    আবার অন্য একটা অন্ধকার অধ্যায়ও আছে।
    খুবই ব্যক্তিগত কারনে এসব নিয়ে কোন দিন কিছু লিখা হবে না আমার।

    চমৎকার লিখা। মুগ্ধ হয়ে পড়ে গেলাম...
    :boss: :boss: :boss: (সম্পাদিত) (সম্পাদিত)


    Do not argue with an idiot they drag you down to their level and beat you with experience.

    জবাব দিন
  3. টিটো মোস্তাফিজ
    প্রতিদিন সকালে জানালা গলে ঘরে ঢুকে পড়া সূর্যের সাহসী যে কিরণ- সে হয়তো একজন বাবা; আর কাঠের আলমারি জুড়ে ঠিকরে পড়া তাঁর অজস্র আলোক সন্তান।

    :dreamy:


    পুরাদস্তুর বাঙ্গাল

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : মোকাব্বির (১৯৯৮-২০০৪)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।