আমি একদিনও না দেখিলাম তারে।

ব্যাপারটা যদি এমন হয় যে, সে বেলার বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া সে ছেলেটা- যে নাকি বই থেকে মুখ তুলে তাকাতে কখনো সাহস করেনি, সেও পর্যন্ত একদিন হঠাৎ বৈকাল হ্রদের পাড়ে দাঁড়িয়ে গেল! কিংবা উরে-ঘুরে বেড়ানো বাদামী রং এর মাঝারি তরুণটিও একদিন সন্ধ্যায় দক্ষিণের বন্দর থেকে জাহাজে উঠে পড়লো- হুট করেই! কিন্তু জাহাজের ডেকে এসে তাঁর মনে হয়, সামনের নীল সাগরটি এতো নিশ্চল কেন হবে? তরুণ উত্তর খুঁজে পায় না। তাঁদের দিন চলে যায়। বছর যায়, এক বন্দর থেকে আরেক বন্দর চলে আসে। হ্রদ দেখে বাড়ি ফেরারা হয়তো নতুন করে অরণ্য দেখবে- বলে ঠিক করে। কিন্তু যে চক্রে তারা পড়ে থাকে, সেটা থেকে রেহাই মেলে না।

দূর থেকে হালকা রেখায় যেখানে চোখে অসীমের ছোঁয়া এসে লাগে- এমন এক সমুদ্রের পাড়ে গিয়ে একদিন আমার মনে হয়েছিল, এমন কেন হবে ? সমুদ্রের আবার কখনো শেষ দেখা যায় নাকি ? আমাদের প্রথম দেখা সমুদ্রটির পরে তো কোন পৃথিবী আছে বলে মনে হয়নি। আর রাত গভীর হলে যখন আমরা দল বেঁধে সেটার কাছে গিয়েছিলাম- মনে হয়েছিল নীচ থেকে সামনে সাদা দেয়াল তুলে রাখা। দেয়ালের ওপাড়ে কিছু নেই। সে দেয়াল সামনে চলে আসে, আবার পিছিয়েও যায়! ধবধবে সাদা ঢেউগুলো যখন সে রাতে এক একটা আলো হয়ে জ্বলে উঠছিল, পৃথিবীর তাবৎ বিস্ময় চোখে নিয়ে আমরা সেটা দেখেছি। প্রথম দেখার যে অনন্য মুগ্ধতা বালক আজীবন বয়ে নিয়ে বেড়ায়- পরে সেটার কাছে বোধহয় আমাদের আজকের মহাসাগরগুলো হেরে গিয়েছিল। পাথুরে মাটির উপর মাইলের পর মাইল যে অরণ্য দেখে, ফিনিশ উপদ্বীপের কবিরা পাতার পর পাতা কবিতা লিখে ফেলতে পারে- বালকের সেদিনের মুগ্ধতা এসব অরণ্যকেও হারিয়ে দেয়। অরণ্যরা এভাবে একবার নয়, প্রায়ই হারে।

আমাদের গত বছর। গত বছরটি এমন ছিল যে, হাতে অল্প কিছুর টাকা জমা হয়েছে কি হয়নি। হয়তো দুই অংক তখনও এসে ছোঁয়নি। এমনসব দিনেও আমরা ঘর থেকে বের হয়েছি, কারণ ঘরে আমাদের বড় বন্দী লাগে। পৃথিবীর তাবৎ সব ভাবনার চেয়ে তখন চোখের উপর কড়া রৌদ্রের ডাক’কে গুরুত্বপূর্ণ ঠেকেছে। এরপর অনেকটা দিন। শুরুর দিকে এটা দারুণ লাগলেও পরে মনে হয়েছে, ধুর অযথাই সব। যেখানেই যাই, সব শেষ দেখা হয়ে যায়। উত্তর সাগর পাড়েও তো শেষ আছে। আর দক্ষিণে ছবির মত সবুজ যে উপত্যকা সাঁঝের বেলায় আকাশের সাথে কমলা রঙে মেলে, সেখানেও আমরা শেষ দেখে এসেছি। আমরা জেনেছিলাম ওসবের পরে আর কিছু নেই।

হিসাব যখন এভাবে অমিল; তখন ঘোর অবরোধ আর অস্থির এক সময়ে দেশে গিয়ে জানা গেল- টাঙ্গাইলের এলেঙ্গা থেকে জামালপুরের সরিষাবাড়ি পর্যন্ত বাঁধের উপর একটা রাস্তা আছে। সে রাস্তায় এখনও নাকি কাঠের জানালা টানা বাস চলে। হলদে আলোর সেসব দিনে জানুয়ারির পনেরো তারিখ। হাতের ঠিক বামে যমুনা রেখে নাক বরাবর হেমন্তি আলোর এক দুপুরে। আমার বামে শীতকালের ক্ষীণ যমুনা ধীরে প্রবহমান। ওর সাহসী প্রবাহে রূপোর রংটুকু যেন দূর থেকেও ভীষণ স্পট। আর অবারিত দুকূল জুড়ে জীবনের প্রখর স্পন্দন। চরের মিষ্টি আলুর ক্ষেতে স্বাভাবিক হাসির মাঝবয়সী সে লোকটি, কিংবা বাঁধের দুপাশে সারি সারি ছনের ঘর। আর প্রতিটি ঘরের সামনে রোদে ফেলে রাখা একরঙা শাড়ি। ভাঙ্গা রাস্তার ঝাঁকুনি আর মোড়ের পরে বয়েসী বটের পাড়ে ঝিরঝিরে বাতাস। বাতাসে চরের ভীষণ ধুলো ওড়ে সেখানে একরাশ। কিন্তু ধুলো সরে গেলে আবার সেখানে উদোম গায়ের কৌতূহলী বালক-বালিকার দলও খলখলিয়ে হেসে ওঠে। সে হাসিতে বাতাসের ধুলোরা সব নীচে ঝরে পড়ে। শুধু হাসির রেশটুকু থেকে যায়। রেশ ভেসে বেড়ায় একূল থেকে সে কূলে। এই হল সেখানের জীবন। আবহমান কাল ধরে এখানে বোধহয় প্রান্তর বাস করে আসছে। পথের ধুলো আজ যেমন; ঠিক হাজার বছর আগে যখন বুদ্ধ এ পথ ধরে হেঁটে গিয়েছিলেন- ঠিক তখনও এখানে এমনটাই ছিল।

যমুনার পাড়ে সেদিন আমার প্রথম মনে হয়েছিল- প্রান্তর দূরের কোন পথ নয়। প্রান্তর থাকে আমাদের চোখের সামনে। অনেকটা পথ হেঁটে আসার পর যে সন্ধ্যায় বাড়ির পথ আর পথ থাকে না, দিগন্ত রেখায় গিয়ে মেলে; সেখানে প্রান্তর তৈরি হয়। কিংবা আঘন মাসের কোন এক সন্ধ্যায়; যখন চারপাশ থেকে বাতাসে হাহাকার ভেসে আসে- তখন অড়হর কলাইয়ের ক্ষেতেও প্রান্তরের দেখা মেলে।

সেদিন আমরা প্রথম বুঝেছিলাম, ঘরের চেয়ে বড় বাহির আর নাই।

২,৫২৪ বার দেখা হয়েছে

২২ টি মন্তব্য : “আমি একদিনও না দেখিলাম তারে।”

  1. নাফিস (২০০৪-১০)

    পুরো লেখাটা দুই বার মনোযোগ দিয়ে পড়লাম। সাধের ফ্রাইড রাইস ঠান্ডা হচ্ছে। হোক গে , ওয়ার্ড রুমে গিয়ে ওভেনে পরে গরম করে নিবো নে.. আগে কমেন্ট করে নেই..

    আমার কেন জানি মনে হয় এই অনুভূতি টা দেশ বিভূয়ে ঘুরে বেড়ানো প্রত্যেকটা মানুষের ই জীবনের কোন না কোন এক পর্যায়ে আসে .. ঘুরে বেড়ানোর মন মানুষিকতা সবার থাকেনা। যাদের মাঝে এই ইচ্ছে গুলো সুপ্ত থাকে দেশে থাকার সময় তাদের মাঝে অনেক টা হীনমন্যতা কাজ করে.. (সবার বেলায় হয়তো সত্য না ) "দেশে আর দেখার কি আছে " এ ধরণের একটা চিন্তা আমার মাথায় প্রায় ই খেলতো। এখন আর খেলেনা। গত ১ বছরে প্রচুর ঘোরাঘুরি করেছি সাধ্য মতন। আপনার মতন ই মানুষিকতা আমার। ঘরে মন টেকেনা। এই ঘোরাঘুরির মাধ্যমে সবচেয়ে বড় যে উপকার টা আমার হয়েছে সেটা হলো ওই হীনমন্যতা বা উদাসীনতা টা কেটে গেছে। একটা উপলব্ধি এসেছে। আপনার লেখার শেষ লাইন টাই হলো আমার সেই উপলব্ধি।

    "সেদিন আমরা প্রথম বুঝেছিলাম, ঘরের চেয়ে বড় বাহির আর নাই।"

    এক বাক্যে আমার গত ২ বছরের সবচেয়ে বড় শিক্ষাটা বলে দিলেন। লেখা মারাত্মক হয়েছে। ভালো লাগছে দেখে যে আমাদের চিন্তাধারায় কত মিল.. আমি নিশ্চিত আরো অনেক ঘরছাড়া মানুষ ও একমত হবেন এই ব্যাপারে।

    জবাব দিন
  2. সামিউল(২০০৪-১০)

    আমিতো সিদ্দিক ভাইয়ের ভক্ত অনেক আগে থেকেই। এইডাতে আর নতুন করে কী বলবো?

    খুব জোর বৃষ্টির পর হলের সামনের কৃষ্ণচূড়া নাকি রাধাচূড়া নাকি অন্যকোন নামের বিশাল গাছটির দিকে তাকাই, তার পুরো মাথা জুড়ে থাকা লাল লাল ফুলের দিয়ে চেয়ে থাকলে যে রকম অনুভূতি হয়; তার সাথে মনে হয়না বিদেশের কোন জায়গার তুলনা চলে।

    বস ঠিকই বলেছেন-

    ঘরের চেয়ে বড় বাহির আর নাই।


    ... কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালবাসে!

    জবাব দিন
    • রেজা শাওন (০১-০৭)
      খুব জোর বৃষ্টির পর হলের সামনের কৃষ্ণচূড়া নাকি রাধাচূড়া নাকি অন্যকোন নামের বিশাল গাছটির দিকে তাকাই, তার পুরো মাথা জুড়ে থাকা লাল লাল ফুলের দিয়ে চেয়ে থাকলে যে রকম অনুভূতি হয়; তার সাথে মনে হয়না বিদেশের কোন জায়গার তুলনা চলে।

      সঠিক। আমাদের ঢাবি ক্যাম্পাসের মত সুন্দর ক্যাম্পাস আর কোথাও নাই। ইতিহাস সেখানে রাস্তার মোড়ে মোড়ে।

      তোমার কি খবর, ভাল আছ?

      জবাব দিন
  3. নূপুর কান্তি দাশ (৮৪-৯০)

    একটা ক্ষুদ্রপরিসর কক্ষে প্রবেশ করেও কখনো কখনো মনে হয় একটা বিশাল হলঘরে দাঁড়িয় রয়েছি, মনে হয় আমার মতোই সবার হাতে সুরাপাত্র --- আমি চুমুক দিতেই সবাই একসঙ্গে চুমুক দিতেই বুঝতে পারা যায় ঘরটির দেয়াল জুড়ে আয়না -- সকলে আসলে আমারি বিম্ব।

    এ-লেখাটিও তাই। অল্পক'টা বাক্যের এ সমাহারে যখন প্রান্তর, হ্রদ কিংবা দিগন্তরেখার কথা ছড়ানো তখন লেখাটি তার আপাত ক্ষুদ্র কলেবর ছাড়িয়ে সীমানা পেরিয়ে অসীমের ভেতরে চলে গিয়েছে --- ঘরের মধ্যেই বাহিরকে ধারণ করেছে; লেখক-আমি আর পাঠক-আমি হরিহর আত্মায় 'ঘরে-বাইরে'র বিবেচনাবোধলুপ্ত হয়ে বিশ্বপরিব্রাজক হতে পারার পরিতৃপ্তিতে মগ্ন হতে পেরেছে।

    জবাব দিন
  4. শাহরিয়ার (০৬-১২)

    ব্লগের মাধ্যমে মাদকতা বিস্তার করার জন্যে রেজা শাওন ভাইকে বিচারের আওতায় আনা হোক। ব্লগ এডজুট্যান্টের দৃষ্টি আকর্ষন করছি।


    • জ্ঞান যেখানে সীমাবদ্ধ, বুদ্ধি সেখানে আড়ষ্ট, মুক্তি সেখানে অসম্ভব - শিখা (মুসলিম সাহিত্য সমাজ) •

    জবাব দিন
  5. মোকাব্বির (৯৮-০৪)

    সিদ্দিকের লেখা গরম গরম পড়তে না পেরে নিজেকে ব্যর্থ মনে হচ্ছে! তবে আমার এককালের বাউন্ডুলে শেষে প্রেম করে স্থিতিশীল বন্ধু রুশোর কথা মনে পড়ছে। "সমগ্র বাঙলাদেশ ৬৪ কাপ চা" নামক এক মজাদার প্রজেক্ট হাতে নিয়েছিল সে, তার বাউন্ডুলে দিনগুলোতে। ১২-১৪ নম্বরে যাবার পর স্থিতিশীলতা আসে জীবনে। যাকগে সে কথা। লেখাটা পড়ে নিজের মাঝের এককালের নিঃসঙ্গ-ভ্রমনবিলাসী সত্বাটি জেগে উঠার চেষ্টা করলো। এই সত্বাটি এখনো বেঁচে আছে। তবে কৃত্তিম শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে। সেই সত্বাটিকে আমি আমার মাঝে আবারো ফিরে পেতে চাই। ধন্যবাদ সিদ্দিক! 🙂


    \\\তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা
    অবুঝ শিশু হামাগুড়ি দিল পিতামাতার লাশের ওপর।\\\

    জবাব দিন
  6. আহসান আকাশ (৯৬-০২)

    যে রাস্তাটার কথা বলেছোসেখানে আমারো যাওয়া হয়েছে, অনুভূতিগুলো প্রায় কাছাকাছি। কিন্তু বাজি ধরে বলতে পারি, আমাকে বোমা মারলেও এভাবে প্রকাশ করতে পারতাম না।

    কিভাবে পারো? :boss: :hatsoff:


    আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
    আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷

    জবাব দিন
  7. মহিউদ্দিন (২০০২-২০০৮)

    আপনার লিখাগুলো সব আমার প্রিয়তে চলে যায় কেন জানি। মুগ্ধ হই। এবেলা একটা বই না লিখলেই নয় রেজা অথবা শাওন অথবা সিদ্দিক ভাই। :clap: :clap: :clap:


    Prisoner of Own Mind

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : রেজা শাওন (০১-০৭)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।