উটের বিরিয়ানী এবং উট পালকের জন্মদিন…

বন্ধু সাকিব মাহফুজ। উট পালক সাকিব মাহফুজ। আমার এই বন্ধু উট পালন করে স্বনির্ভর বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখে। তার উট সংক্রান্ত গল্পটা একটু বলা দরকার।

কলেজে আমরা তখন ক্লাস টেনে। আমাদের ব্যাচের পক্ষ থেকে আমাদের ব্যাচ টি শার্ট বানানো হবে। আমরা তখন পাতি পোলা পান। ব্যবসা ভাল বুঝিনা। সাকিব মাহফুজ আমাদের দিকপাল হয়ে দেখা দিল। আমরা টি শার্টের যাবতীয় দায়িত্ব মাহফুজকে দিয়ে নির্ভার হলাম। মাহফুজ ঢাকায় থাকে,তার উপর লেভেলে যোগাযোগ ভাল। বাবার বন্ধু’র( মাহফুজের ভাষ্য মতে তার বন্ধু) নাকি গার্মেণ্টেসের বিশাল ব্যবসা। আমাদের চোখে তখন রংচঙ্গা টি শার্টের স্বপ্ন। আমরা স্বপ্ন চোখে নিয়ে ছুটিতে গেলাম।

ছুটি শেষে কলেজে আসি। উত্তেজনার তুঙ্গে আছি সবাই। নিজেদের বানানো টি শার্ট পরবো, ভাব নিয়ে হাউজ করিডোরে ঘুরাঘুরি করবো। জুনিয়র পোলাপান চোখ বড় বড় করে দেখবে!! কী আনন্দ!! সাকিব মাহফুজও আমাদের হতাশ করলো না। সে সময়মত জিনিষ ডেলিভারি দিলো। আমরা সবাই মহা আনন্দে সশব্দে প্যাকেট খুলে টি শার্ট গায়ে দিলাম।

তাৎক্ষণিকভাবে আমরা খুব অবাক হয়ে আবিস্কার করলাম, সাকিব মাহফুজের বানানো টি শার্ট আমাদের সবার নাভির উপরে উঠে আছে। ব্যাচের সবচেয়ে ছোট করে যে ছেলেটা সেও খুব বিরক্ত চোখে মাহফুজের দিকে তকালো,

এইটা কী বানাইছস? তোরে ব্লাউজ বানাইতে কইছে কে??

মাহফুজ হাসি দিল। রহস্যময় চিরায়ত সেই আদিম হাসি…!!

আমরা টি শার্ট খুলে হাতে নিলাম। উল্টে পাল্টে দেখবো বলে। সেখানেও ছিল বড়সর ধাক্কা!!

পিঠের দিকে সাদা চুন দিয়ে শুধু পিসিসি ২৪তম ব্যাচ লেখা। এ ছাড়া আর বিশেষ কিছু সেখানে নেই। চুনের মানও ছিল চূড়ান্ত খারাপ। হাত দিলে চুন হাতে লেগে উঠে আসে, এমন অবস্থা!!

সে আমলে ১৫০ টাকা ছিল টাকার অংকে মেলা টাকা। তখন ১৭টাকা কেজি দরে বাজারে চাল পাওয়া যায়। আমরা বুঝলাম, সাকিব মাহফুজ আমাদের ভাতে মেরেছে, পানিতেও মেরেছে। সর্ব সাকুল্যে ২০ টাকা দিয়ে কাজ সেরেছে। বঙ্গ থেকে ১০ টাকার কেজি দরে কেনা টি শার্ট আর ৫ টাকার চুন। বাকী সব টাকা তার পকেটে।

এতো টাকা মেরে মাহফুজ কী করেছিল, সেটা সে আমাদের বলেনি। আমরাও আর জানতে চাইনি। আমরা আমাদের নিজেদের মত করে ব্যাখ্যা সাজিয়ে নিয়েছি।

অনেকে অনেক রকম ব্যাখ্যা দিল। কেউ কেউ বললো, এই টাকা দিয়ে সাকিব মাহফুজ রিকশা কিনেছে।( এইচ এস সি পরবর্তী বেকারত্বকালীন সময়টাকে কাজে লাগানোর একটা আগাম ব্যবস্থা)

কেউ বললো বান্ধবীকে সঙ্গে নিয়ে সাকিব মাহফুজ থাইল্যান্ডে ঈদ শপিং করেছে। বালুকাময় সৈকতে রৌদ্র স্নান করেছে।

আরেক দল বললো, মাহফুজ বসুন্ধরায় কয়েক কাঠা জায়গার উপরে একটা ফ্ল্যাট কিনেছে, সেটা নাকি, আবার ডুপ্লেক্স। ভিতরে সুবিশাল সুইমিং পুল আর একটা হেলিপ্যাডও নাকি সেখানে দেখা গেছে।

যাই হোক, এতো শত অতিরঞ্জনে আমরা কান দেইনি। আমরা যেটা জানতাম, সেটা হলো কুরবানী ঈদের আগে সে ছুটিতে সাকিব মাহফুজ সৌদির মরু থেকে অর্ডার দিয়ে উট আনিয়েছে। তাও আবার একটা না, জোড়া উট। দিনে দিনে সাকিব মাহফুজের উট পরিবার বংশ বৃদ্ধি করবে। আমাদের এই বন্ধু একদিন হয়তো গাবতলির হাটে উট সাপ্লাই দিবে। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম একদিন উটের পিঠে করে হেলতে দুলতে স্কুলে যাবে।

সেই দিন আর বেশি দেরী নাই, যেদিন ঢাকার রাজপথ সাকিব মাহফুজের পোষা উটদের ব্যস্ত পদচারণায় মুখরিত হবে। চির জ্যামের এই শহরে উট হবে পরিবেশ বান্ধব নিরাপদ বাহন। আমরা সেইদিনের অপেক্ষায় আছি।

যাই হোক, বিশেষ কারণে আজকের এই আউল পোস্টটি খুব তারাহুড়া করে লিখতে হচ্ছে। আমাদের এই উটপালক বন্ধুটির আজ তেইশতম জন্মদিন। বন্ধুটির কাছে আমরা নানা ভাবে ঋণী। অবশ্য এই ঋণ শোধ করবার তেমন কোন ইচ্ছাও আমাদের নেই।

বন্ধু সাকিব মাহফুজ,ক্লাস টেনে সেই শিশু বয়সেই টাকা মেরে আমাদের কোমল মনে তুমি যে কঠিন দাগা দিয়েছ, তার জন্য তোমার ক্ষমা হয়তো নাই। কিন্তু এ কথাও ঠিক যে, তোমার মত এমন নিখাদ মনের বন্ধু পাওয়াটাও আমাদের জন্য বিরাট কপালের।

আমাদের ছুটে চলা দিনগুলোর নানা ব্যস্ততায় আমরা হয়তো অনেক কিছুই ভুলে যাই। তুমি ভুলে যাও না। এখানেই তোমার সাথে আমাদের পার্থক্য। তুমি ভাল থাকো। সব সময় আনন্দে থাকো, এই কামনা করি। শুভ জন্মদিন বন্ধু…

(আর একটা কথা না বললেই না, চারণ কবি কালিদাস নাম নিয়ে ফেসবুকে প্রতিনিয়ত যে কাব্য চর্চা কর,সেটা চালু রেখো।)

চারণ কবি তথা উটপালকের লেখা একটা অণুকাব্য দিয়ে শেষ করছি,


চারন কবি কালিদাসের বিশাল ছিল দাড়ি
মাতা তাহার হুকুম দিলেন ছোট কর তাড়াতাড়ি
হুকুম তামিল করিতে কবি গেলো বারবার সপে
বারবার ভাই ৮০টি টাকা খসাইলো এক কোপে।

************************************************

(জনস্বার্থে মাহফুজের কিছু ছবি দিয়ে দিলাম। সিসিবির যারা আসন্ন কুরবানী ঈদে উট কুরবানী দিতে চান, তারা সাকিব মাহফুজের সাথে যোগাযোগ করতে পারেন। তবে এক্সক্যাডেটদের জন্য বিশেষ কোন মূল্যছাড় আছে কি না, তা আমার জানা নাই।)

কবিগুরুর সাথে আবেগঘন মুহূর্তে...

কলেজের আজন্ম লালিত সাধ রি ইউনিয়নে মেটাবার প্রয়াসে উটপালক...

সর্বশেষে নায়িকা বাধনের সাথে জোড়া ছবি...

২,৭৯৮ বার দেখা হয়েছে

১৭ টি মন্তব্য : “উটের বিরিয়ানী এবং উট পালকের জন্মদিন…”

  1. নাফিজ (০৩-০৯)

    মাহফুজ ভাইয়ের কি ডিউটি মাস্টার হওয়ার স্বপ্ন ছিলো নাকি ?? সেকেন্ড ছবিটা তো তাই বলে। :khekz: :khekz: :khekz:


    আলোর দিকে তাকাও, ভোগ করো এর রূপ। চক্ষু বোজো এবং আবার দ্যাখো। প্রথমেই তুমি যা দেখেছিলে তা আর নেই,এর পর তুমি যা দেখবে, তা এখনও হয়ে ওঠেনি।

    জবাব দিন
  2. নাজমুল (০২-০৮)

    হা হা হা ভাই সেরকম কাহিনী :))
    আমরাও নিজেদের টিসার্ট,জার্সী সব বানাইসিলাম 🙂
    মাহফুজ ভাইয়ার আম্মু কি এক্স-ক্যাডেট???
    তিন নাম্বার ছবিতে মনে হচ্ছে ঘাপলা আছে ???
    😕

    জবাব দিন
  3. আজহার (০১-০৭)

    বন্ধু সাকিব এর শুধু ডিউটি মাস্টার ই না......মডেলকন্যা বাধনের হাতে হাত রাখার ও অনেক শখ ছিল......তাই বাধনের বিয়ের ছবিতে নিজের ছবি নিজ দায়িত্যে বসিয়ে নিয়েছে......... =))

    জবাব দিন
  4. আজহার (০১-০৭)

    "আমাদের ছুটে চলা দিনগুলোর নানা ব্যস্ততায় আমরা হয়তো অনেক কিছুই ভুলে যাই। তুমি ভুলে যাও না। এখানেই তোমার সাথে আমাদের পার্থক্য।"......কথাটা একদম সত্য...অনুভব করেছি আগে......কিন্তু কনফারম হলাম আজকে.........ওর আরেকটা গুণ হল......তীক্ষ অবসারভেশন পাওয়ার...... :khekz:

    জবাব দিন
  5. আহসান আকাশ (৯৬-০২)

    মজাদার পোস্ট :)) :)) :))

    মাহফুজকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা।


    আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
    আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷

    জবাব দিন
  6. আসাদুজ্জামান (১৯৯৬-২০০২)
    ক্লাস টেনে সেই শিশু বয়সেই টাকা মেরে আমাদের কোমল মনে তুমি যে কঠিন দাগা দিয়েছ, তার জন্য তোমার ক্ষমা হয়তো নাই। কিন্তু এ কথাও ঠিক যে, তোমার মত এমন নিখাদ মনের বন্ধু পাওয়াটাও আমাদের জন্য বিরাট কপালের।

    :khekz:

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : শিশির (১৯৯৬-২০০২)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।