চুরি কাহিনী (১)

ছেলেদের কলেজের বন্ধুদের কাছে শুনেছি তারা নাকি ডাব চুরি করে, কলেজ পালায় ইত্যাদি ইত্যাদি। আমরা যেহেতু মেয়ে তাই আমাদের পক্ষে কলেজ পালানোটা সম্ভবপর ছিল না। উপরন্তু নিজেদের সিকিউরিটির একটা ব্যাপার ছিল। তাই ডাব চুরি মাথায় ঘুরতে থাকল। কিন্তু ফলিনের পাশে (broad way) তে দাড়িয়ে থাকা নারিকেল গাছ গুলির দিকে তাকিয়ে আমরা বেশ কজন মনে বেশ দুঃখ নিয়ে ভাবতে লাগলাম – এত লম্বা গাছে ছেলেরা ক্যামনে উঠে? আর আমাদের নিজেদের উচ্চতা ও খুব একটা সুবিধার ছিল না! তাই ডাব চুরির প্লান-ও বাদ দিয়ে এবার আম চুরির প্লান করা হল। যেহেতু আম গাছের উচ্চতা কম, কিন্তু লোকেশন সুবিধার না। একেবারে প্রিন্সিপাল স্যারের বাড়ির গেটের জাস্ট বিপরীতে। এবার গেমস টাইমে দশ/পনের জন মিলে আমগাছের নিচে ভিড় করেছে আম পাড়তে। আমগাছের উচ্চতা দেখেও ভয় লাগছে। আসলে গাছে তো আমরা কখনো উঠিনি; মেয়েরা কি গাছে চড়ে নাকি? আমাদের বরাবরই একটা প্রবনতা ছিল বয়েজ ক্যাডেটরা এটা করে ওটা করে, আমরাও করব। আমরা কখনোই এটা মেনে নিতে রাজি ছিলাম না যে আমাদের কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। একই শিডিউল আর নিয়মকানুন হবার কারণে আমরাও খুব বেশি অসাম্প্রদায়িক মনমানসিকতার ছিলাম। কিন্তু গাছ তো আর অসাম্প্রদায়িকতা বুঝে না; গাছে চড়তে হলে সাহস লাগে! তো যাই হোক, এ বলে তুই ওঠ আমি আম কুড়াই – ও বলে না আমি কুড়াই তুই উঠ! এরকম চলল কিছুক্ষণ। অবস্থা বুঝে এক বিজ্ঞ ক্লাসমেট বলে উঠলঃ “গাছে উঠার দরকার নাই, শেষে পা ভেঙে ফেলবি।“ পাশে ছিল টেনিস গ্রাউন্ড (উল্লেখ্য, আমাদের কলেজে নিয়ম ছিল শুধু 11 আর 12 টেনিস খেলতে পারবে।) সিদ্ধান্ত হল টেনিস ব্যাট দিয়ে ঢিলিয়ে আম পাড়া হবে। কারণ এতে কারো কোন ইঞ্জুরির চান্স নাই। নিয়ে আসা হল টেনিস ব্যাট। ঢিলাঢিলি শুরু হল…

ঝুর ঝুর করে আম পড়ছে, সবাই খুউব আনন্দিত ক্যাডেট লাইফে এই প্রথম গেমস টাইমে আম পেড়ে নিয়ম ভাংতে পেরেছি বলে। আনন্দের আতিশয্যে কেউ খেয়ালই করল না যে ওপাশে ব্যাডমিন্টন গ্রাউন্ডে খেলছে আমাদেরই ক্লাসমেটরা। এবার সিফের ছোড়া (আমি সবার নিক নেম ব্যবহার করছি) ব্যাটটা গাছের পাতা ভেদ করে এপাশ থেকে ওপাশে গিয়ে পড়ার সময় সাঁই করে গিয়ে পড়ল জ্যাক’এর নাকে। ব্লিডিং শুরু হয়ে গেল। লোকাল একটা ইঞ্জুরি ছিল নাকের উপরে কিন্তু রক্ত দেখে আমরা ভয় পেয়ে তাকে ধরাধরি করে হাসপাতালে নিয়ে গেলাম। এদিকে গেমস টাইম-ও শেষ। এডজুটেন্ট বাসা থেকে বেরিয়েই দেখেন একদল ক্যাডেট হাসপাতালে যাচ্ছে আর বাকি ক’জন ছড়িয়ে থাকা আমগুলি একত্র করতে গিয়ে পড়ল সোজা এডজুটেন্ট এর সামনে। স্যার এর ইন্সট্যান্ট অর্ডারঃ “স্টাফ, নাম নোট করেন”। ২ জন ধরা পড়ল। বাকি যারা হাসপাতালে গিয়েছে ডাক্তার জিজ্ঞেস করলেন “ইঞ্জুরি কিভাবে হল?” আহত ক্যাডেটের উত্তর – “ম্যাডাম টেনিস খেলতে গিয়ে ব্যাট দিয়ে”।
– টেনিস খেলতে গেলে কি ব্যাট উপরে ছুড়তে হয় নাকি? যে বল না এসে ব্যাট এসে তোমার নাকে লাগল??
তার নিজের উত্তরে নিজেই ধরা খেয়ে গেছে এই ভদ্র ক্যাডেটটি!! ততক্ষণে এডজুটেন্ট হসপিটালে চলে এসেছেন, আহত ক্যাডেটের নাম নোট করতে, যে কিছুই জানত না, অবলা ভঙ্গিতে ব্যাডমিন্টন খেলছিল।

এডজুটেন্টের আচরণে আমরা কিছুটা মনক্ষুন্ন হয়ে হসপিটাল থেকে বেরিয়ে আমগাছের দিকে যাচ্ছি, উদ্দেশ্য আমগুলি নিয়ে ডাইনিং-এ টি করে হাউসে ফিরে যাব। কিন্তু গাছের নীচে গিয়ে দেখি আম একটাও নাই; খোঁজ নিয়ে জানা গেল এডজুটেন্টের নির্দেশে আম সব স্টাফ নিয়ে গেছেন। আমরা চরম হতাশ হলাম! যে আম পাড়তে গিয়ে আমাদের এক বন্ধু আহত হল সেই আম স্টাফকে দিয়ে দেওয়া হল? কি অপমান!!! হাউসে এসে এডজুটেন্টের গাদাখানেক নিক দেওয়া হল। উনি আবার EX-MCC ছিলেন, তাই তাদের ও গোষ্ঠোদ্ধার হল। যদিও স্যার তিনটা নাম নোট করে নিয়েছিলেন, তবু একজন ক্যাডেট আহত হয়েছে আর আমগুলি ক্যাডেটরা নিতে পারেনি বলেই হয়ত সে যাত্রা আমাদের ক’জনকে ‘সাধারণ ক্ষমা’ ঘোষনা করে একটু খুতবা দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হল।

(চলবে)

২,৬৯৯ বার দেখা হয়েছে

৩৩ টি মন্তব্য : “চুরি কাহিনী (১)”

  1. ফয়েজ (৮৭-৯৩)

    আমাদের হলের সামনে জাহাংগীর হাউসের গার্ডেনে একটা ডাব গাছ ছিল, চার তলার সমান উঁচু। ক্যাডেট ডাব চুরি করতে গিয়ে গাছ থেকে পড়ে মরে যেতে পারে এই ভয়ে এমদাদ স্যারের সময় সেই গাছ অনেক আয়োজন করে কেটে ফেলা হল।

    ভয়ের যৌক্তিক কারন ছিল, স্টাফের বাশির শব্দে এক ক্যাডেট সেই গাছ থেকে ওমর ফারুক হাউসের বালকনিতে লাফ দিয়ে পালিয়েছিল। টাইমং ভাল ছিল, না হলে যে কি হত।


    পালটে দেবার স্বপ্ন আমার এখনও গেল না

    জবাব দিন
  2. রকিব (০১-০৭)

    চুরি! চুরি!! চুরি!!!
    জীবনে অনেক আম-কাঠাল খেয়েছি, কিন্তু চুরি করে কলেজ থেকে খাওয়াতে যে স্বাদ পেতাম 🙂 ওটা অন্য কিছুতে ছিল না B-) ।


    আমি তবু বলি:
    এখনো যে কটা দিন বেঁচে আছি সূর্যে সূর্যে চলি ..

    জবাব দিন
  3. সাজিদ (২০০২-২০০৮)

    আমাদের কলেজে হুজুগ উঠসিল কাঠাল খাওয়ার, hsc এর টাইমে চুরি করে কাঠাল খাইতেসি লান্চ্ঞের পরে একরুমে বসে, পোলাপাইন বেশি ছিল আর জোশে আওয়াজ একটু বেশি হয়ে গেসিল, এদিকে ডিউটি মাসটার ছিল এক ম্যাডাম, নরমালি ম্যাডামরা হাউসে রাউন্ড মারে না কিন্তু এই ম্যাডাম দেখি ঠিকি চলে আসতেসে, তাই তারাতারি খাটের নিচে কাঠাল লুকায় আমরা বাইর হইতেসি হটাৎ দেখি ম্যাডাম রুমের সামনে, জিগেস করে কিসের গন্ধ, একরুমে এতজন কি করতিসি, একজন বলে দিল মোজার গন্ধ, ম্যাডাম বলে ও এজন্য তোমরা ওকে চার্জ করতেস মোজা ধোয়নাই কেন? আমরা সাথে সাথে জি জি করে উঠলাম.... হটাৎ অন্য হাউসেরও ক্যাডেট দেখে ম্যাডামের সন্দেহ হইতেসে দেখে একজন বলেদিল যে মোজার গন্ধ এতই বাজে যে অন্য হাউসেও ছরায় পরসে তাই তারাও আসছে সাইজ করতে, ম্যাডাম গুড গুড নিজেরাই নিজেদের কারেক্ট করতেস দেখে খুশি হইলাম, বলে চলে গেল..... এরকম আরো অনেক ঘটনা আসে যা মনে করলেই মজা লাগে..... হায় সেই মজার দিন গুলি :dreamy:

    জবাব দিন
  4. সাজিদ (২০০২-২০০৮)
    তবু একজন ক্যাডেট আহত হয়েছে আর আমগুলি ক্যাডেটরা নিতে পারেনি বলেই হয়ত সে যাত্রা আমাদের ক’জনকে ‘সাধারণ ক্ষমা’ ঘোষনা করে একটু খুতবা দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হল।

    মহা অন্যায় আমরা একবার কাঠাল চুরি কোরতে গিএ ধরা খাইসিলাম তাও নিজে চুরি করিনাই সিনিওর করতেসিল আমারে গার্ড দিতে বলসিল, তবুও (সিনিওর রিকোয়েস্ট করসিল আমার কোন দোষ নাই, আমারে জাতে ছাইরা দে) এডজুট্যানট ছারে নাই উলটা ইডিএর টাইমে উনিই আরো ওনেককে আহত করে দিসিলেন 🙁 🙁 । এই বইসম্যের জন্য দুই এডজুট্যনটেরি ব্যান চাই।

    জবাব দিন
  5. কামরুলতপু (৯৬-০২)

    আম চুরির কাহিনী সবচেয়ে ভাল কইতে পারব মনে হয় কামরুল ভাই। ভাইয়া কি কইয়া ফালাইছেন অলরেডী? আমির ভাইর সেই কাহিনী?
    আমরা কলেজের ডাইনিং হলে ক্যাডেটের চুরি করে পাড়া আম খেয়েছিলাম যেগুলা কলেজ অথরিটি ধরে কি করবে খুঁজে পায়নি।

    জবাব দিন
  6. মাহফুজ (৯২-৯৮)

    ক্লাস সেভেন থেকেই ফল-ফলাদি চুরি করতাম। আম, বাতাবি লেবু, কাঁঠাল, পেয়ারা, খেজুরের রস, এমনকি লেবু পর্যন্ত বাদ পড়ে নাই; ক্লাস ইলেভেন এ উঠে ডাইনিং হল থেকে মুরগী চুরি করে রোস্ট বানায়ে খাইতাম। ক্লাস সেভেন এর থার্ড টার্মে লেবু চুরি করতে গিয়ে ক্লাস ইলেভেন এর সিনিয়রদের কাছে ধরা পড়ে গেছিলাম (উনারাও একই কাজে গেছিলেন কি না) - ফলাফল লাগাতার সতেরটা থাপ্পড় ( ধরেই নিছিলাম এই থাপ্পড় আমার মরণের আগে শেষ হবে না, ক্লাস ইলেভেন বলে কথা - তাই মরার আগে শেষ কাজ হিসেবে থাপ্পড় গুণতেছিলাম)। এখানেই ঘটনা শেষ হয় নাই, ওই টার্মের শেষ দিন পর্যন্ত সব কয়টা ফল ইন এ হ্যান্ডস ডাউন পজিশন এ থাকতে হয়েছিল।

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : আদনান (১৯৯৭-২০০৩)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।