ফিরে দেখা (পর্ব-২)

(৪)
ইলেভেনে আমার রুমমেট ছিলো রকিব । এস এস সির ছুটিতে নতুন গার্লফ্রেন্ড জুটিয়েছে সে । মেয়েটার সাথে কথা বলতে হবে তাই মোবাইল নিয়ে এসেছে কলেজে । প্রতিদিন রাতেই মেয়েটির সাথে কথা বলে ও । বিষয়টি কারো কাছে অজানা রইলনা । একদিন আমরা জিজ্ঞাসা করলাম , দোস্ত তোর গার্লফ্রেন্ডের কন্ঠ কেমন । উত্তরে সে বলল মেয়েদের মতো ।
(৫)
সব কলেজেই কিছু প্রচলিত ভুতের গল্প আছে হয়ত , যা নতুন ব্যাচের ছেলেদের শোনানো হয় । এর ফলে তারা কয়েকদিন ভয়ে তটস্থ থাকে । আবার যখন তারা সিনিওর হয় তখন তারা এই গল্প শোনায় তাদের জুনিওরদের । অর্থাৎ একসময় ভয় পাওয়া ক্যাডেটগুলো আবার ভয় দেখাতে চায় তাদের জুনিওরদের ।
তেমনি আমাদের কলেজের প্রচলিত গল্পটি ছিল পুষ্পা পরীর গল্প । সেভেনে থাকতে কোন এক বৃহষ্পতিবারে আমদের এই গল্প শুনিয়েছিলেন আমাদের ক্লাশ নাইনের ভাইয়েরা । মাঝে মাঝেই মধ্যরাতে নাকি হাউসের পাশের পানির ট্যাংকির উপর তাকে দেখা যায় । সেই পুষ্পা পরী নাকি সাদা শাড়ি পরে খিলখিল করে হাসে । কোন এক এক্স ক্যাডেট উপর ভর করেছিল এই পুষ্পা পরী । সেই ভাইয়া নাকি পাগল হয়ে গিয়েছিল এবং মাঝে মাঝেই নাকি পানির ট্যাংকির উপর গিয়ে বসে থাকত আর পুষ্পা পুষ্পা বলে চিৎকার করত । আরো বললেন রাত বারোটার পরে তিন নাম্বার টয়লেটে ফ্লাশ করলে নাকি রক্ত পরে । এই কলেজে নাকি ৭১ এর সময় বধ্যভুমি ছিল । ভয়ে শিউরে ওঠার মত আরো অনেক কিছুই বললেন তারা । গল্প শুনে ভয় লাগলো ঠিকই কিন্তু মনকে শান্তনা দিলাম এই বলে যে , ভাইয়ারা ভয় দেখানোর জন্যই এসব বলেছে । তবে আসল ভয়টা শুরু হল লাইটস অফের বেল দেয়ার পর । সেই যে ডিনারের পর গল্প শোনার জন্য এক রুমে বসেছিলাম , তারপর কেউ আর উঠতে চায় না । কেউই স্কীকার করে না ভয় পেয়েছে কিন্তু কেউ নিজের রুমে যাওয়ার সাহস করে না । এমন সময় জ়েপি এসে ধরে ফেললেন আমাদের । ক্লাশ সেভেনের সবাই এক রুমে , তাও আবার
লাইটস অফের পর তা তো বরদাশত করাই যায় না । সুতরাং পানিশমেন্ট খেতেই হল । এরপর রুমে গেলাম । ভয় কাটলো না তবু । রুমমেটরা গল্প করে ঘুমানোর চেষ্টা করলাম । সহজে কি আর ঘুম আসে ? কয়েক সপ্তাহ সেই ভয়
থেকেই গেলো । লাইটস অফের পর আমরা বাইরে বের হতাম না । একজনের টয়লেট চাপলে আরো দুজনকে ডেকে নিয়ে যেতাম । আমাদের একজনতো একদিন বাইরে যাবার ভয়ে মগের ভেতর কাজ সেরে ঘুমিয়ে পড়েছিল । পরের দিন
ঘুম ভেঙ্গে আমার বন্ধুরা আবিষ্কার করল রুমের ভেতর উৎকট ঝাঝালো গন্ধ । পরে খুজে দেখে শরীফের (ছদ্মনাম) খাটের নিচে মগভর্তি হলুদ তরল ।
আমার রুমমেটদের মধ্যে সাঈদ ছিল সবচেয়ে ভীতু । ওর বেড ছিল জানালার পাশে । সবসময় বলত পাশে মসজিদ আছে না ভয় কিসের । কিন্তু রাত হলেই ওর দৌড় বোঝা যেত । প্রতিদিনই বলত আয় দোস্ত বেড জোড়া লাগায়া ঘুমাই ।
আর একদিনের ঘটনা । আরামের ঘুমটা ভাঙিয়ে দিল আমার রুমমেট আকাশ (ছদ্মনাম) । আমাকে ঘুম থেকে তোলার কারণ ওর লং টয়লেটে যেতে হবে , একা যেতে ভয় পাচ্ছে । উঠে দেখি অন্য দুই রুমমেটো ঘুমজড়ানো চোখে দাড়িয়ে
আছে । অগত্যা যেতে হল সাথে । ও ভেতরে কাজ সারছে আর আমরা তিনজন বাইরে পাহাড়া দিচ্ছি । আমাদেরো যে ভয় করছে না তা নয় । পুরো হাউস নিস্তব্ধ , পোকামাকড়ের একটানা শব্দ শোনা যাচ্ছে শুধু । চোখের সামনে কলেজের
পানির ট্যাংকি । পুষ্পার কথা মনে পড়ে বুকের ভেতর ঢিপঢিপ করতে থাকে । হঠাৎ একটা জিনিস দেখে আমি ভয়ে আৎকে উঠি এবং ওমা বলে চিৎকার দিয়ে দৌড়ে রুমে চলে যাই । আমার অন্য দুই রুমমেটো কিছু না বুঝেই আমার পিছে
পিছে দৌড়ে চলে আসে । কিন্তু পরক্ষনেই দেখতে পেলাম আমার ঐ রুমমেটো চলে এসেছে এবং হাপাচ্ছে । অথচ যতদুর জানি ও একবার টয়লেটে ঢুকলে সহজে বের হয় না । যাই হোক সেদিন রাতে কারো ভালো ঘুম হলো না । পরদিন যেয়ে
দেখতে পেলাম যা দেখে ভয় পেয়েছিলাম তা ছিলো একটা পুরনো সাদা পায়জামা । আমাদের উপরের হাউসের কার্ণিশ থেকে সেটা ঝুলছিল যেটা দেখে মনে করেছিলাম কারো ঝুলন্ত পা ।
এই আমরাই আবার যখন সিনিওর হলাম তখন মাথায় এলো এবার জুনিওরদের ভয় দেখাতে হবে । তাই কোন এক বৃহষ্পতিবারে ক্লাশ নাইনের কয়েকজন মিলে ক্লাশ সেভেনের সবাইকে এক রুমে ডাকলাম । সেই পুরনো গল্পগুলোকেই ঘষেমেজে
নতুন করে বলা হলো । ওদের মনজুর কি ভয়টাই না পেয়েছিল সেদিন । আমরা যে ভয় দেখানোর জন্য এসব বলেছি তা তাকে বিশবাস করানোই যাচ্ছিল না । শেষে অথরিটি জেনে যায় এই ভয় কতভাবে যে বোঝানোর চেষ্টা করলাম তা
আর বলার অপেক্ষা রাখে না । আর এও পণ করলাম আর কোনদিন কাউকে এসব গল্প বলবো না ।
(৬)
এই গল্পটা আমাদের এক ফ্রেন্ড আর এক জুনিওরকে নিয়ে । এস এস সির ছূটি শেষ করে কলেজে ফিরেছি । স্বাভাবিকভাবেই আমরা তখন কলেজের ত্রাস । পথেঘাটে দেখা হলেই জুনিওরেরা সালাম দেয় । সালাম পেতে ভালোই লাগে । একদিন আমাদের ইমরান (ছদ্মনাম) প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেওয়ার জন্য জুনিওর টয়লেটে গেছে । তাড়াহুড়ো করে দরজায় টান দিয়ে দেখে ক্লাশ সেভেনের এক জুনিওর তার বড় কাজ সারছে । ছেলেটা ভুলে দরজা লাগায়নি । সে এক বিব্রতকর পরিস্থিতি । জুনিওরটাও কি করবে ভেবে না পেয়ে উঠে দাড়িয়ে বলে উঠলো ইমরান (ছদ্মনাম) ভাই স্লামালাইকুম । সেই থেকে ইমরানকে দেখলেই আমরা ওকে সালাম দিতাম ।

৩,৩৭৮ বার দেখা হয়েছে

৩৮ টি মন্তব্য : “ফিরে দেখা (পর্ব-২)”

  1. মাসরুফ (১৯৯৭-২০০৩)

    এইটা তো ভাল,২০০২ ব্যাচের শোয়েব ভাইয়ের কাছে আরো ভয়াবহ এক কাহিনী শুনছিলাম।কুমিল্লার উনাদের ব্যাচের এক ভাই টয়লেটে বড় কাজ সারার সময় হঠাৎ এক ক্লাস সেভেন সেই টয়লেটের দরজা খুইলা ঢুইকা সিনিয়র ভাইরে "কর্মরত" অবস্থায় দেইখা অধিক শোকে পাথর হয়া দাঁড়ায় ছিল।সেই বড়ভাই আবার দুর্দান্ত নার্ভের অধিকারী-যাকে বলে "কুল আন্ডার ফায়ার"।তা তিনি একটুও ঘাবড়ায় না গিয়া জুনিয়রকে বললেন-"কি চাও?কিছু লাগবে?আমি এখন ব্যস্ত যাও পরে আসো।"

    এই কাহিনী শুইনা আমার মুখ থিকা অজান্তেই বের হয়া আসল-সাব্বাস ক্যাডেট!!

    জবাব দিন
  2. আব্দুল্লাহ্‌ আল ইমরান (৯৩-৯৯)
    “কুল আন্ডার ফায়ার”।তা তিনি একটুও ঘাবড়ায় না গিয়া জুনিয়রকে বললেন-”কি চাও?কিছু লাগবে?আমি এখন ব্যস্ত যাও পরে আসো।”

    সাবাস ! আমাদের সময় মোবাইল কেউ কল্পনাও করত না।বড়জোর এডু'র ফোনের লাইন চুরি করার আপচেষ্টা করেছিল কেউ কেউ।

    জবাব দিন
  3. নাজমুল (০২-০৮)

    দোস্ত দারুণ লিখছিস
    আমরাও সেভেনে ভাইয়ারা ভয় দেখানো পর বেড জোরা দিয়ে ঘুমাইতাম 😀 কিন্তু আমরা তো বিসিসি
    পিসিসি কি আসলেই ভয় পাইতি নাকি ;;) নাহ এটা আমার অনের ভুল তোরা আসলেই ভয় পাইতি ঠিক বলসিনা?? 😀

    জবাব দিন
  4. ১. পুষ্পাপরীর কাহিনী নাইনথ ব্যাচের শাহআলম ভাইয়ের বানানো। উনি এই পুষ্পা ভূতের গল্পের জনক ছিলেন যতটুকু জানি। এই পুষ্পার বাড়ি ছিল টাঙ্গাইল। সম্ভবত ওনার ব্যর্থ প্রেম, কলেজে ভুত বানিয়ে গিয়েছিলেন। তারপর এটা ব্যাট টু ব্যাচ টুইষ্ট হয়ে এগিয়েছে।
    ২. ৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় পিসিসি'তে একটা পাকিস্থানী আর্মি ক্যাম্প ছিল। হাউসগুলোতে গ্রাম থেকে গরু-ছাগল রাজাকারদের মাধ্যমে এনে রাখতো আর ওদের রেশন ও অন্যান্য জিনিস স্টোর করতো। হাউসে যুদ্ধের সময় অত্যাচার করা হতো এটা শুনিনি, তবে হওয়াটা অস্বাভাবিক না, যেহেতু ক্যাম্প ছিল তখন। তথ্যদাতা: বয়স্ক হাউস ও ডাইনিং হল বেয়ারারা যাদের বাড়ি কলেজের আশেপাশের গ্রামে।
    ৩. মহা শয়তান এবং খাইস্টা ক্যাডেট ছিলাম। পানির ট্যাংকের উপর এ্যাডভেন্চার করতে কয়েকবার রাতে উঠেছিলাম, তখন হাউসগুলোতে গ্রীল ও কলাপসিবল গেইট ছিলো না। ইচ্ছামতো কলেজের বাইরে যাওয়া যেত রাতে। এখন ভাবলে শিউরে উঠি! সে নুহুনবীর আমলের কথা, তোমরা পাওনি।
    ৪. শোভন তোমার লেখার হাত ভাল। চলতে থাকুক।

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : রানা (৯৬-০২)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।