অসংলগ্ন ভাবনাচিন্তা ……… হা পিত্যেশ পর্ব

বহুদিন হয় কোনো কিছু লেখা হচ্ছে না। আসলে লেখা তো দূরে থাকুক, সিসিবির পোস্টগুলো পড়ে ঠিকঠাক মতন কমেন্টও করা হচ্ছে না। দুই সপ্তাহ আগে মনে হয়, ছোট্ট রকিব মেইল দিয়ে বলেছিলো একটা লেখা দিতে। আসলে লিখতে কিন্তু খুব ইচ্ছে করে। বহুদিন ধরে একটা গল্পের প্লট মাথায় ঘুরছে, শব্দে রুপ দেয়া হচ্ছে না সেটাকে। মাঝখানে শখ হয়ে ছিলো অনুবাদ লিখবো। কিন্তু যে বইগুলো পড়ছি, সেগুলো সুন্দর করে অনুবাদ করার সাধ্য এবং ধৈর্য- দুইটারই অভাব আছে আমার মধ্যে। আবার বেশ কয়েকদিন হিস্টোরি চ্যানেলে যুদ্ধের ওপরে কিছু ডকুমেন্টারি দেখে ইচ্ছে হয়েছিলো, প্রাচীন আমলের বিখ্যাত কিছু যুদ্ধ নিয়ে লিখবো। কিন্তু সময়ের অভাবে বা মতান্তরে, আমার আলসেমির জন্যে সেটাও করা হয়ে ওঠেনি। অবশ্য শুধু আমি না, গত মাসে দেখেছি গোটা সিসিবি বেশ আলসেমিতে ভুগেছে। যাহোক, ছোট্ট রকিবকে উৎসর্গ করে কিছু হা পিত্যেশ প্যাচাল পাড়া যাক।

এই বছর দুইটা ঈদই দেশের বাইরে করলাম। রোজার ঈদে তাও বন্ধু-বান্ধবদের সাথে করতে পেরেছি বলে তেমন খারাপ লাগেনি। কিন্তু এই কোরবানির ঈদে তারা অধিকাংশই দেশে চলে যাবার কারনে শুধু তিনজনের ঈদ করতে হয়েছে। তার ওপরে চায়নিজ অধ্যুষিত এলাকাতে থাকার জন্যে ঈদের আমেজটাও মিস করেছি। আমার পুরাতন এক কলিগ এই কোরবানির ঈদটা সবসময় গ্রামে গিয়ে করতো। কারন জিজ্ঞেস করলেই বলতো, আরে মাম্মা, এই ঈদ তো গ্রামেই জমে ভালো।

সেই ক্লাস টেনে থাকতে আমার দাদা মারা যাবার পর থেকে আর গ্রামে গিয়ে ঈদ করা হয় না। গত কয়েকদিন ধরে সেই ছোটবেলার ঈদের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। ঈদের প্রায় ১০-১২ দিন আগেই চাচাদের সাথে চলে যেতাম গ্রামের দিকে। তখনও ঢাকা-ফেনী জমজমাট বাস সার্ভিস চালু হয়নি বলে ট্রেনই ছিলো একমাত্র ভরসা। ট্রেন ভ্রমনের সবচাইতে ইন্টেরেস্টিং জিনিস ছিল বিভিন্ন স্টেশনের ঝাল মুড়ি এবং কাটলেট। সেই স্বাদের কাটলেট আর কোথাও পাইনি এখনো। ফেনী স্টেশনে নেমে আবার বিলোনিয়া এক্সপ্রেস নামের আরেকটা ট্রেন নিতে হতো। ফেনী-বিলোনিয়া লাইনে এই একটা ট্রেনই চলতো এবং এই ট্রেনটাকে এক্সপ্রেস ট্রেন বলার কারনটা এখনও আমার কাছে রহস্যজনক লাগে। কারন, যতদুর মনে পড়ে, এই ট্রেনটা সাইকেলের সমান গতিতে চলতো আর লেট করার বিশেষ রেকর্ড ছিলো এইটার। বড় চাচার কাছে শুনেছি, গোটা একদিনও নাকি লেট করতো। মাঝে মাঝে ফেনী স্টেশনে নেমে যখন দেখতাম এই বিলোনিয়া এক্সপ্রেস অনেক লেট করবে, শহরে ছোট ফুপুর বাসাতে গিয়ে উঠতাম। ফুপাতো ভাই-বোনদের সাথে ঘন্টা কয়েক হুটোপুটি-ছোটাছুটি করে আবার ফেনী স্টেশনে গ্রামের পথে যাত্রা। আমরা যাবার দুই-তিন সপ্তাহ আগে থেকেই দাদাকে চিঠিতে আমাদের আসার দিন তারিখ জানিয়ে দিতো আম্মু। দাদা আমাদের জন্যে চিথলীয়া স্টেশনে রিকশা পাঠিয়ে দিতেন। সেই রিকশাতে করে ধান ক্ষেতে ধারের কাঁচা রাস্তা, গ্রামের ভিটাবাড়িগুলোর পাশের ইট বিছানো রাস্তা আর নদীর পাড়ের উঁচু বাঁধের ওপর দিয়ে পৌছাতাম পশ্চিম অলকাতে। সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে নাস্তা করে বড়শিতে মাছ ধরা, দুপুরে সেই মাছ দিয়ে ভাত খাওয়া, বিকেলে ধান ক্ষেতে ছোটাছুটি আর রাতে দাদা সাথে রেডিও শোনার এক চমৎকার রুটিন শুরু হয়ে যেতো। তখন গরু কিনতে যাওয়া হতো পরশুরাম হাটে। একবার হাটে গিয়ে দেখি এক কৃষক দুই-তিনটা ছাগল বিক্রি করার জন্যে নিয়ে এসেছে। আরেক জন লোক, আমার চাচাদের বয়েসি, অনেক জোরাজুরি,
অনুরোধ, ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল ইত্যাদি করে ৮০০ কি ৯০০ টাকা করে সবগুলো ছাগল কিনে ফেললো। তারপরে সেই কৃষক চলে যাবার পরে লোকটা
ছাগলগুলো নিয়ে মোটামুটি অবস্থাপন্ন একলোকের কাছে গিয়ে বললো – কিনবেন্নি ভাইসা ……। সেই লোকের সাথে ছাগলের দামাদামি করার সময় সে গল্প
শোনালো সে কিভাবে এই ছাগলগুলাকে বড় করেছে, যত্ন আত্তি করেছে ইত্যাদি ইত্যাদি। শেষ পর্যন্ত সেই অবস্থাপন্ন লোকটা ১৫০০ টাকা করে ছাগলগুলো কিনে নিলেন। আমি আর আমার বড় চাচা এই গোটা দুই অংকের নাটকটা দেখলাম। আমার চাচা জানালেন, ভাতিজা, এইটারে বলে ব্যবসা। যাহোক, গরু কেনার পরের কয়েকদিন গরু চরানো বা গরুকে খাওয়ানোর পরে কোরবানির দিন মন খারাপ হয়ে যেতো খুব। তবে সমবয়েসি চাচাদের পাড়া বেড়াতে বেড়াতে কখন যে সেই মন খারাপ ভাব উধাও হয়ে যেতো টেরও পেতাম না।

গ্রামে আমার সমবয়েসি বা একটু বড় বা একটু একটু বড় যারা ছিলো,সবাই দেখা যেতো সম্পর্কে আমার চাচা বা ফুপু হচ্ছে। নইলে হয়তো ফয়েজ ভাইয়ের মতন অমুকদি বা তমুক আপুকে (মতান্তরে কবিতা) নিয়ে আমিও ব্লগ লিখতে পারতাম। (খেরোখাতা – কাঁচা হলুদ রোদ এবং আমার কবিতারা —— দীর্ঘশ্বাস দীর্ঘশ্বাস)। ঈদের দিন দুপুরে দাদা, বাবা এবং চাচারা সবাই একসাথে খেতে বসতেন। দাদার বড় নাতি হবার সুবাদে তাঁর পাশের সিট আমার জন্যে ছিলো রিজার্ভড। চালের গুড়া দিয়ে বানানো রুটি দিয়ে গরুর এবং ছাগলের গোশতের (দাদী স্পেশাল) স্বাদের কোনো তুলনা হয়না।

অবশ্য ছোটবেলায় পাওয়া আদরের কথা ভেবে এখন আর হা পিত্যেশ করে লাভ নেই। আমাদের দিন শেষ, যাঁরা আমাকে মনোযোগ দেবার কথা তাদের পুরো
মনোযোগ এখন নতুন প্রজন্ম পাচ্ছে। তাদের হিংসে না করে অন্য কিছু নিয়ে হা পিত্যেশ করি। খরার মাসে জুনায়েদ একটা চমৎকার ওয়েস্টার্ন সিরিজ লিখলো। তবে নায়কটাকে মেরে ফেলায় মন খারাপ। সানা ভাইয়ের স্মৃতির ঝাঁপিগুলো অসাধারন ছিলো, তবে তাড়াতাড়ি পাইনা। অবশ্য ওনার লেখাগুলো অনেক সময় নিয়ে লিখতে হয় দেখে তাড়াতাড়ি লেখা দাবিও করা যাচ্ছে না। শাহরিয়ার একটা সিরিজ শুরু করেছে। অতীতের গাছে উঠিয়ে দিয়েই মই সরিয়ে ফেলেছে। দেখা যাক, কিছু ডাল পালা তাড়াতাড়ি দেয় কিনা। অনেক দিন ধরে তানভীর এলোমেলো লেখে না। বন্ধু কাইয়ুমের কথা অবশ্য না বলাই ভালো। ছোট আদনানের খবর নেই। ওর একটা সিরিজ পেন্ডিং আছে। শার্লীর সাধারন মানুষ, রকিবের গোধুলী কথন বা রবিনের ভালোবাসার বন্ধুত্বের শেষ দেখে যেতে পারবো কিনা বুঝছিনা। এহসান ভাই অনেক দিন রিভিউ দেয় না। আকাশ তার সাপ্তাহিকগুলো ধরে রাখলেও বিগ ম্যাচগুলো নিয়ে লিখছে না। সিসিবি ম্যানেজারদের আমলনামার সুবাদে কামরুল তাও কিছু লিখতো, এখন সেটাও বাদ। জুলহাস ভাইইয়ের সিরিজটাতে হঠাৎ ব্রেক পড়লো কেনো কে জানে …..

একটা কবিতার একটা লাইন মাথায় ঘুরছে — “বহুদিন হয় পাখির মাংস খাইনি”। রইস স্যার বহুদিন আগে আবৃত্তি করেছিলেন। কবির বা কবিতার নাম মনে
নেই। কারো কাছে পাওয়া যাবে কি?

৩,৫২২ বার দেখা হয়েছে

৪৯ টি মন্তব্য : “অসংলগ্ন ভাবনাচিন্তা ……… হা পিত্যেশ পর্ব”

  1. তানভীর (৯৪-০০)

    ছোটবেলার ঈদগুলোর কথা মনে হলে এখন বেশ অবাক লাগে- এত মজা কেমন করে করতাম! সব কিছু কেমন জানি ঝাপসা ঝাপসা লাগে, মনে হয় যেন এইগুলা আমি মজা করি নাই, এগুলো শুধুই আমার কল্পনা। আর বড় হতে ইচ্ছা করে না। 🙁

    অনেকদিন পর একটা লেখা দিলেন, পড়ে মন খারাপ হয়ে গেল। আপনার মন খারাপ ভাবটা আপনি ভালই সংক্রমিত করতে পেরেছেন মইনুল ভাই।

    রইস স্যারের এই কবিতাটার দুইটা লাইন মনে আছে আমারঃ
    "আমি বহুদিন হয় পাখির মাংস খাইনাই,
    স্বপ্নভুক মানুষ খেয়েছে আবাল্যের প্রেম।"
    আমাদের বার্ষিকীতে ছাপা হয়েছিল এই কবিতাটা, আমিও খুঁজছি।

    আশা করি আপনি গল্পে, মন্তব্যে আবার নিয়মিত হবেন। 🙂

    জবাব দিন
  2. ফয়েজ (৮৭-৯৩)

    বিলোনিয়া, চিথলীয়া পশ্চিম অলকা, কি অসাধারন কাব্যিক নাম একেকটা।

    নাম গুলো এত সুন্দর, জায়গাটা না জানি কত সুন্দর।


    পালটে দেবার স্বপ্ন আমার এখনও গেল না

    জবাব দিন
  3. সানাউল্লাহ (৭৪ - ৮০)

    লেখাটা পড়ে আমিও তো অসংলগ্ন হয়ে গেলাম মইনুল। তুমি আর ফয়েজ তো এইবার আমাকে স্মৃতিকাতর করে দিলা! অনেকদিন গ্রামে যাইনা। কতোদিন? ৮/১০ বছর! হবে হয়তো। আমাদের ছেলেটা একবারও তার দাদাবাড়ি যায়নি। ওরও তো ১৪ বছর বয়স হয়ে গেল!

    গত কয়েকদিন ধরে আমারও এক ফুপুর কথা খুব মনে পড়ছে। বাবার চাচাতো বোন শেফালি ফুপু অসাধারণ সুন্দর ছিলেন। মানুষ তো এতো সুন্দর হয় না, হয় পরীরা! এ আকর্ষণেই তার ন্যাওটা হয়েছিলাম। সামনে পেলে পায়ে পায়ে ঘুরতাম। ভীষণ আদর পেতাম তার।

    ফুপুর যখন বিয়ে হলো তখন আমার বয়স কতো? ১২/১৪? হবে হয়তো। তারপর প্রথম সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে তিনি চলে গেলেন না ফেরার দেশে। স্মৃতিতে ধুলো জমেছে। কুয়াশার জালটা আলতোভাবে কেটে আমি দেখছি তাকে আবছা আবছা আবছা........


    "মানুষে বিশ্বাস হারানো পাপ"

    জবাব দিন
  4. জুনায়েদ কবীর (৯৫-০১)

    এবার বহুদিন পর গ্রামের বাড়ি ঈদ করতে এসেছি...ব্যাপক ঠান্ডা লাগা ছাড়া আর কোন ফিলিংস হইল না। তবে মন খারাপ না করে বাস্তবতা মেনে নিয়েছি...বাস্তবতা হল- ঈদের আনন্দ একটি নির্দিষ্ট বয়সীদের জন্য, বাকিদের কাছে নেহায়েত একটি ছুটির দিন।
    আমায় কাছে এটাই অনেক বড় পাওয়া মনে হয়...৩/৪ দিন সবার কমন ছুটি, ঈদ ছাড়া আর কেম্নে পাইতাম??


    ঐ দেখা যায় তালগাছ, তালগাছটি কিন্তু আমার...হুঁ

    জবাব দিন
  5. কামরুল হাসান (৯৪-০০)
    “আমি বহুদিন হয় পাখির মাংস খাইনাই,

    মইনুল ভাই
    চলেন সিলেটে আহসান ভাইয়ের ওইখানে বেড়াইতে যাই। কবুতরের মাংস দিয়া ভাত খাওয়াইবো কইছে।


    ---------------------------------------------------------------------------
    বালক জানে না তো কতোটা হেঁটে এলে
    ফেরার পথ নেই, থাকে না কোনো কালে।।

    জবাব দিন
  6. রকিব (০১-০৭)

    সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে এই পোষ্ট দেখতেছি। মইনুল ভাই তো আমারে লজ্জায় ফেলে দিলেন :shy: :shy: থ্যাঙ্কু থ্যাঙ্কু ভাইয়া।
    গ্রামের বাড়িতে ঈদ করা হয় না বহুদিন। তবে সত্যি বলতে আমার ঢাকার ঈদটা বেশি পছন্দ হতো। কারণ বন্ধুবান্ধব সব ঢাকাতেই ঈদ করতো। তাই গ্রামে ঈদ করতে গেলেই আসার জন্য আঁকুপাঁকু করতাম।
    দারুন লেখা হয়েছে স্বপ্নদা।


    আমি তবু বলি:
    এখনো যে কটা দিন বেঁচে আছি সূর্যে সূর্যে চলি ..

    জবাব দিন
    • মইনুল (১৯৯২-১৯৯৮)

      আসলে বছরের শেষ দিকে অফিসে যখন ব্যালান্সশীট মেলানোর ধুম পড়ে যায়, তখন মনে হয়, মনে মনে সবাই নিজের ব্যালান্সশীটটাও চেক করতে থাকে। আমাদের অধিকাংশেরই পাওয়ার চাইতে চাওয়ার পরিমানটা বেশী থাকে বলে বছর শেষে সবার মন খারাপ হয়ে যায়।

      জবাব দিন
  7. দিহান আহসান

    অনেকদিন পর লিখা দিলেন ভাইয়া 🙂

    আমি অবশ্য ছোট থেকে ঈদ চট্টগ্রামে করে আসছি, মামা-খালা-চাচা রা সবাই সেইখানেই।
    আব্বু'রা নামাজ পড়ে এসেই আমাকে নিয়ে যেত সবার বাসায়। সালাম তারপর সালামী'র জন্য অপেক্ষা। বড় হওয়ার সাথে সাথে অনেক কিছুই ফিকে হয়ে আসে, কিন্তু আমি এখনো সালামী পাই, ;))

    বই অনুবাদ বা বিখ্যাত কিছু যুদ্ধ ... যাই নিয়ে লিখেন না কেন, লিখেন কিছু একটা নিয়ে, অপেক্ষায় রইলাম আমরা। 🙂

    ভালো থাকবেন।

    জবাব দিন
  8. কাইয়ূম (১৯৯২-১৯৯৮)

    দোস্ত, তোরে নিয়াও আমি আর কিছু বলবোনা 😛
    শুধু একটা কথা বলি, তুই এতো কম লিখিস কেনো?

    লেখা নিয়ে কথা বলবো পরে। ৯২ ব্যাচটাই দেখি পুরাই ডজার ব্যাচ।


    সংসারে প্রবল বৈরাগ্য!

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : আহসান আকাশ (৯৬ - ০২)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।