অসংলগ্ন ভাবনাচিন্তা ……… বয়েস এবং পেশা পর্ব

অনেক প্রস্তুতি নেয়া সত্ত্বেও ম্যাচটা মিস করলাম। একেবারে ঠিক খেলা শুরু হবার ত্রিশ মিনিট আগে টেরও পেলাম না কখন ঘুমিয়ে পড়েছি। সাড়ে বারোটার পরে ঘুম থেকে উঠে দুরুদুরু বুকে লাইভস্কোরের ওয়েব সাইটটা খুলে দেখি ব্রাজিল জিতেছে। কলেজে থাকতে দেড়টা বিশ্বকাপ পেয়েছিলাম। ৯৪ সালেরটা গোটাটাই কলেজে দেখেছি, ৯৮ সালেরটাতে, সম্ভবত, কোয়ার্টার ফাইনালের সময় আমরা এইচ এস সি পরীক্ষা শেষ করে বাড়ি চলে যাই। ২০০২ এর সময় বুয়েট বন্ধ থাকার কারনে খেলাগুলো দেখেছিলাম আকিকের বাসায়। ওদের বাসার নীচতলার একটা রুমে সে থাকতো। আড্ডা দেবার আর হৈ হুল্লোড় করে খেলা দেখার সেরা জায়গা। ২০০৬ এরটা দেখা হলো কামরুলের বাসায়। অফিস শেষে চলে যেতাম ওর বাসায়। একসাথে মনে হয় ১০-১২ জন মিলে খেলা দেখা হতো। মাঝরাতের পরে খেলা শেষ হলে গনবিছানাতে ঘুম। বউ বিরক্ত হয়ে যেতো মাঝে মাঝে – কি এমন খেলা, এইটা এত আয়োজন করে আরেক বাসায় গিয়ে দেখারই বা কি আছে। দুশ্চিন্তায় আছি …… ২০১০ এরটা মনে হয় একা একাই দেখতে হবে।

অনেকতম বারের মতন ফ্রেন্ডস রিভিশন দিচ্ছিলাম। সিজন সাতের একটা পর্ব – হোয়েন দে অল টার্ন থার্টি, আমার বেশ ভালো লাগে সব সময়। ত্রিশ পার হবার সাথে সাথেই সবাই মনে হয় জীবনের হিসেব নিকেশগুলো পেছন ফিরে দেখতে থাকে – কি চেয়েছিলাম, কি পেলাম, কি পাইনি টাইপের। স্বাভাবিক, ত্রিশ পার করা মানেই তো প্রায় অর্ধেক আয়ু শেষ। গত মাসে আমারও ত্রিশতম জন্মদিন চলে গেলো। অনেকক্ষন বসে বসে চিন্তা করলাম, ফেলে আসা পঁচিশটা বর্ষাকালের কয়টার কথা মনে আছে। ১০-১২ টার বেশি মনে করতে পারলামনা দেখে মন খারাপ হয়ে গেলো। এখন থেকে ঠিক করেছি, প্রতি বর্ষাকালেই স্মরণযোগ্য কিছু একটা করে রাখবো যেনো, যদি ষাট বছর বাঁচতে পারি, তাহলে প্রতিটার কথা মনে থাকে। এখন বুঝতে পারছি না কি করে আগামি বর্ষাটা স্মরণীয় করে রাখা যায় ……

বয়েসের কথা এলেই অনেক আগে পড়া হুমায়ুন আহমেদের এলেবেলে লেখা একটা ছোট গল্পের কথা মনে পড়ে যায়। গোটা গল্পটাতে তিনি মেয়েদের বয়েস সংক্রান্ত বিভিন্ন উচ্চ মার্গীয় কথা বার্তার একটাতে লিখেছিলেন, মেয়েদের বয়েস নাকি খুব কনফিউজিং একটা জিনিস। ব্যাক্তিগত অভিজ্ঞতার রেফারেন্স দিয়ে উনি দেখিয়েছিলেন উনি নাকি অষ্টম শ্রেনীতে পড়া একটা মেয়েকে দেখে মায়ের (মেয়ের মায়ের) বোন আর আরেক জায়গায় এক ইউনিভার্সিটি শিক্ষিকাকে স্কুল পড়ুয়া মেয়ে মনে করে বেশ বিব্রতকর অবস্থাতে পড়েছিলেন। ওই বয়েসে ব্যাপারটাকে বেশ গাজাখুরি মনে হয়েছিলো। কিন্তু একটু বড় হবার পরে বুয়েটে ওরিয়েন্টেশন ক্লাসের সময় যখন দেখলাম, যে মেয়েটাকে আমাদের কোনো বান্ধবির ছোট বোন বলে ভেবে এসেছিলাম, সে মেয়েটি সগৌরবে আমাদের সাথেই ক্লাস করবে, তখন মনে হলো হুমায়ুন আহমেদের অভিজ্ঞতাটা সত্যি হলেও হয়তো হতে পারে। কি জানি, নারীজনিত অভিজ্ঞতা আমার তেমন একটা ছিলো না (এখনও অবশ্য অত বেশী নেই)। তারপরে সেই ক্লাসেই আমার ফৌজদারহাটের এক বন্ধুকে যখন ব্যাপারটা নিয়ে দৃষ্টি আকর্ষন করলাম এইভাবে যে – “এই পিচ্চি মেয়েটা আমাদের সাথে ক্লাস করবে ??!!!” , সে উত্তর দিলো, “তা তুই কি ভাবসিলি?? এখনো সন্দেহ থাকলে গিয়া জিগাইলেই তো পারস, যে আসলেই ক্লাস করবে নাকি এখনো বড় বোনের প্রক্সি দিতাসে ……”। আমি আবার খুবই লাজুক হবার কারনে তখন গিয়ে জিজ্ঞেস করে হুমায়ুন আহমেদের মতন ফার্স্ট পারসনে বিব্রত হওয়া থেকে বেঁচে গিয়েছি। পরে ক্লাস করতে করতে সন্দেহ দূর হয়ে গিয়েছে।

ইচ্ছে ছিলো, এইবার দেশে গিয়ে আমাদের নাফিজের সাথে ওর অফিসে (বিসিবি) গিয়ে দেখা করবো। আমাদের সবারই বিভিন্ন ব্যাপারে প্যাশন থাকে, কিন্তু আমরা নানা কারনে আমাদের সেই প্যাশনের ফিল্ডটাকে পেশা হিসেবে বা এমনকি শখ হিসেবেও রাখতে পারিনা। নাফিজকে আমার লাকি মনে হয়েছে, কারন সে ওর প্যাশনের (স্পোর্টস, ফুটবলটা বেশি তবে ক্রিকেটও খুব কাছাকাছি) ফিল্ডে চাকরী করছে। যদিও মার্কেটিং-কমার্শিয়াল বিভাগে, তারপরেও জাতীয় ক্রিকেটের এবং ক্রিকেটারদের কাছে থেকে নিয়মিত দেখার সুযোগ আসলেই ঈর্ষনীয়। মাঝে মাঝে চিন্তা করি, কোন পেশাটা আমি উপভোগ করতাম ………। ছোট থাকতে শখ ছিলো পাইলট হবো, আমার মনে হয় অনেকেরই ছোট বেলার শখ এইটাই থাকে। তবে মির্জাপুরের এক বন্ধুর শখ শুনেছিলাম, হাবিলদার হওয়া। তখন বলেছিলাম, “ভাগ্যিস ক্যাডেট কলেজে চান্স পাইসিলি, অন্তত ড্রেসের দিক দিয়া তোর স্বপ্ন পুরন হইছে”। যুদ্ধের ছবি আমার সব সময়েই ভালো লাগে, কিন্তু সেনা বাহিনীতে যোগ দেবার কখনই তেমন একটা শখ ছিলোনা কখনই। রোমান্টিক হিরোইজমের পাশাপাশি এদের অনেক সময় অনেক কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হয় যেটা আমার কখনই পোষাবেনা। ইন্টারে প্রথম সুযোগেই বায়োলজী বাদ দিয়ে দিয়েছিলাম, তাই ডাক্তারীর প্রশ্ন কখনই আসে না। একদিক দিয়ে ভালোই হয়েছে, আমার ছোটবোন যখন ক্লাস করে এসে আজকে কিভাবে লাশ কেটেছে আর কোন অংগ প্রত্যংগ কি কারনে কি চেহারা ধারন করে সেই বর্ণনা দেয়, তখন কেমন কেমন জানি লাগে। ইদানিং সি এস আই দেখছি, মনে হলো, কোনোরকমে লাশের দৃশ্যটা হজম করতে পারলে এই পেশাটা ইন্টেরেস্টিং হতে পারে। তবে সমস্যা হলো, আমার বায়োলজী বা কেমেষ্ট্রি নিয়ে কোনো ডিগ্রী নেই। আরোও বড় সমস্যা হলো, আমার বয়েস থাকতে থাকতে বাংলাদেশে অপরাধ দমনে ক্রিমিনোলজীর প্রচলন হবে কিনা সেই ব্যাপারে সন্দেহে আছি। আদৌ দেখে যেতে পারবো কিনা ……………। আমার এখনকার পেশাও তেমন খারাপ না, তবে এক্সাইটমেন্ট কম। কোন মোবাইল কোম্পানি কিভাবে তার কাস্টমারদের বিল করবে, সেটা চিন্তা করতে করতে আর যাই হোক এক্সাইটমেন্ট, পাওয়া যায় না। এখন মাঝে মাঝে চিন্তা করি, গেম প্রোগ্রামিং এর কাজে ঢুকতে পারলে জটিল হত। দেখা যাক, সামনে কি আছে।

এখন মাঝে মাঝে মনে জীবনটা মনে হয় রোলার কোস্টারের মতন হয়ে যাচ্ছে। উত্থান-পতন, টার্ন, ওলট-পালট সব কিছুই আছে —- কিন্তু সেই একটা নির্দিষ্ট ট্র্যাকের মধ্যেই। আরোও যাচাই বাছাই করে এই রাইডে ওঠা উচিৎ ছিলো কি ???

৩,৩২১ বার দেখা হয়েছে

৫৭ টি মন্তব্য : “অসংলগ্ন ভাবনাচিন্তা ……… বয়েস এবং পেশা পর্ব”

  1. সামীউর (৯৭-০৩)

    কোন এক বইতে হুমায়ূন আহমেদ বলেছিলেন যে জীবনে আইস্ক্রীম ওয়ালা, জাহাজের খালাসী থেকে পাইলট অনেক কিছুই হতে চেয়েছিলেন কিন্তু কখনো শিক্ষক হতে চাননি, তাই দিন কেটেছে শিক্ষকতায়।
    কি হবো কি হতে চাই জানিনা জানতে চাইও না! শুধু ভেসে যাওয়া , গড্ডলিকা প্রবাহে!

    জবাব দিন
  2. কাইয়ূম (১৯৯২-১৯৯৮)
    ২০০৬ এরটা দেখা হলো কামরুলের বাসায়।

    মানে কি ই ইন্দিরা রোডের ঢুকার মুখেরটায়, দায়েম সাজ্জাদ শফিকুল সহ যেইটায় থাকতো ঐটার কথা কইতাসোস?

    লেখা নিয়া পরে কমেন্ট দিতাসি, অনেক কিছু কওয়ার আছে মনে হইতাসে। 😀
    আগে বুখে আয় দোস্ত, কত্তদিন পর কিছু লিখলি :hug:


    সংসারে প্রবল বৈরাগ্য!

    জবাব দিন
  3. জিহাদ (৯৯-০৫)

    গুনে গুনে ছয় ছয়টা কাল থাকতে বর্ষা কালকেই কেন স্মরণীয় করে রাখতে হবে সেইটা বুঝলাম না :no:

    আপনার পেশা সংক্রান্ত চিন্তাভাবনার প্রথম অংশ পুরোপুরি আমার সাথে মিলে যায়। তবে সেকেন্ড ইনিংস এ মেলার চান্স কম।

    অনেকদিন পর লিখলেন 🙂


    সাতেও নাই, পাঁচেও নাই

    জবাব দিন
  4. তৌফিক (৯৬-০২)

    কপালে যা আছে তাই হবে ভাবলেও টেনশান কমানো যায় না ঠিক।

    যাহোক, অনেক দিন পর লেখা দিলেন মইনুল ভাই।

    আমার ঠিক করছি ছোট কনসালটেন্সি ফার্মে কাজ করুম, নিত্য নতুন প্রজেক্ট আসবে। বোর হওয়ার চান্স নাই। 😀

    জবাব দিন
  5. তানভীর (৯৪-০০)

    মইনুল ভাই কি ট্র্যাক বদলানোর চিন্তা করছেন নাকি? মানে, টেলিকম ছেড়ে সফটওয়ার লাইনে?

    অনেকদিন পর লেখা দিলেন। আপনার কাছ থেকে আরও গল্পের প্রত্যাশা জানায়ে রাখলাম।

    ব্রাজিল পাথরায়। :thumbup:

    জবাব দিন
  6. টিটো রহমান (৯৪-০০)
    ত্রিশ পার হবার সাথে সাথেই সবাই মনে হয় জীবনের হিসেব নিকেশগুলো পেছন ফিরে দেখতে থাকে – কি চেয়েছিলাম, কি পেলাম, কি পাইনি টাইপের। স্বাভাবিক, ত্রিশ পার করা মানেই তো প্রায় অর্ধেক আয়ু শেষ।

    গল্পের আইডিয়া কি দিতে হইব?? লিখা ফেলেন না একটা উপন্যাস........


    আপনারে আমি খুঁজিয়া বেড়াই

    জবাব দিন
  7. আশহাব (২০০২-০৮)

    তারপর আমি পাশ করলে আমারে একটা চাকরী দিয়েন। পেটে ভাতে চলে যাবে :khekz: :khekz: :khekz:
    মইনুল ভাই, জটিল লেখা...উপন্যাসের মনে হয় আর বেশী দেরী নাই 😛


    "Never think that you’re not supposed to be there. Cause you wouldn’t be there if you wasn’t supposed to be there."
    - A Concerto Is a Conversation

    জবাব দিন
  8. সামি হক (৯০-৯৬)

    মইনুল কি লেখা দিলা মিয়া, আমারওতো দেখি এখন হিসাব নিকাশ নিয়ে বসা উচিত। :(( এতোদিন যদিও জানতাম কিন্তু উট পাখির মতো বালিতে মাথা গুজে ছিলাম, ভাবছি যে যদি হিসাব না করি তাইলে বয়স মনে হয় আর বাড়বে না :((

    জবাব দিন
  9. যে মেয়েটাকে আমাদের কোনো বান্ধবির ছোট বোন বলে ভেবে এসেছিলাম, সে মেয়েটি সগৌরবে আমাদের সাথেই ক্লাস করবে, তখন মনে হলো ...

    তারপর কি হলো? :grr: :grr: :grr:

    অফটপিক: ভালা আছেন?

    জবাব দিন
  10. সাইফ (৯৪-০০)

    মইনুল ভাই ,ভালো লাগ ল।এই চিন্তাটা মনে হয় ক্যাডেটদের মধ্যে খু বেশি কাজ করে এবং সবার মধ্যে একই মত্রায়।সবার অনুভূতিগুলাকে আপনি নিজের মত করে সুন্দর ও সাবলীল ভাবে বর্ণ ণা করেছেন।

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : স্বপ্নচারী (১৯৯২-১৯৯৮)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।